তসলিমা নাসরিন
১. সন্তানপ্রসবকালে প্রসবের সুবিধের জন্য নারীর যোনিমুখকে সামান্য কেটে প্রশস্ত করতে হয়, তা না হলে যোনির দেওয়াল প্রসবের সময় এমন বিচ্ছিরিভাবে ছিঁড়ে যায় যে, যোনি ও মলনালির পথ এক হয়ে যাবার আশঙ্কা থাকে। এই ক্ষতি এড়াতে চিকিৎসকরা প্রসূতির যোনিপথ প্রশস্ত করবার ব্যাপারে সচেতন হন। তাঁরা যোনির দেওয়াল কেটে প্রসবকষ্ট দূর করেন এবং কাটা অংশটুকু সেলাই করে দেন, যে সেলাই সাতদিনের মধ্যে শুকিয়ে মিলিয়ে যায়। এতে কারও আপত্তি থাকবার কথা নয়। অথচ আপত্তি করেন রোগীর স্বামী। কেন আপত্তি? ‘বউয়ের গোপন জায়গায় সেলাই পড়েছে, এই বউকে ঘরে তোলা ঠিক নয়।
২. উন্নত দেশগুলোয় সিজারিয়ান অপারেশনের জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। যে নারীর আট-দশটি সন্তান গ্রহণ করবার প্রয়োজন নেই, তার সিজারিয়ান অপারেশনই অধিক যৌক্তিক এবং নিরাপদ। এতে নারী মুক্ত হয় নানা রকম বিপদের আশঙ্কা থেকে এবং তার সুস্থতাও যথাসম্ভব রক্ষা হয়। কিন্তু নারীর এই উপকারে অধিকাংশ পুরুষের বড় আপত্তি। নারীর শরীর হবে মসৃণ, কোমল। এতে দাগ পড়লেই তাঁদের বিরক্তি ধরে। তাঁরা ঠোঁট উলটে বলেন, ‘পেটকাটা বউ নিয়ে ঘর করা যাবে না।’
৩. ধরা যাক, জরায়ুর টিউমার বা অস্বাভাবিক রক্তপাতের কারণে জরায়ু কেটে বাদ দেওয়া হল। জরায়ুর চেয়ে জীবন বড়। জীবন বাঁচাতে জরায়ু নিঃসংকোচে ফেলে দিতে রাজি হবেন যে-কোনও সুস্থ ও বিবেকবান মানুষ। কিন্তু সকলে রাজি হলেও স্বামী রাজি হতে চান না। হয়তো জরায়ু আর কোনও প্রয়োজনে আসছে না কারও। বংশরক্ষার জন্য যে পুত্রের জন্ম হওয়া জরুরি, তাও সারা হয়েছে। তবুও কেমন- কেমন জানি লাগে। জরায়ু নেই, এ আবার কেমন বউ। পঙ্গু-পঙ্গু মনে হয়। জরায়ু ছাড়া মেয়েলোক আবার মেয়েলোক নাকি?’ আর যদি এমন কোনও জরায়ু ফেলে দিতে হয় যেটি কোনও সন্তানধারণ করেনি তবে আরোগ্য হবার আগেই স্ত্রীকে ত্যাগ করেন স্ত্রীর ‘স্বামীদেবতা’।
৪. স্তনে টিউমার হলে স্তন কেটে ফেলাই সংগত। এই অবস্থায় স্তনের মায়ায় নারীর চেয়ে কাতর হন পুরুষ বেশি। অসুস্থ স্তনকেও দলিত-মথিত করে আনন্দ নেবার জন্য পুরুষের হাত নিশপিশ করে। তাঁরা স্ত্রীর স্তনহীনতার শোকে এত মুহ্যমান হন যে, স্তনকাটা মেয়ের জন্য প্রেম-ভালবাসা কিছু আর অবশিষ্ট থাকে না। তাঁরা নির্দ্বিধায় বলে ফেলেন, ‘আমারও তো সাধ-আহ্লাদ বলে কিছু’ আছে। বিকলাঙ্গ বউ নিয়ে কি বাঁচা যায়!”
৫. গর্ভবতী নারীদের কারও কারও দেখা যায় যে, পা ফুলে উঠেছে, রক্তচাপ বেশি। এদের যদি চিকিৎসা না করা হয় তবে এরা ভয়াবহ খিঁচুনি রোগে আক্রান্ত হয়। একে বলে এক্লাম্পসিয়া। এই রোগে সন্তান তো মরেই, মা’ও মরে। এক্লাম্পসিয়া হয় একমাত্র অবহেলার কারণে, বউয়ের প্রতি স্বামী ও শ্বশুরকুলের অবহেলা। তাঁরা ঘরের বউকে চিকিৎসকের কাছে নেবেন না।
এক্লাম্পসিয়া হলে লোকে বলে জিনের আছড় লেগেছে। মাথায় কাপড় না দিয়ে বাঁশঝাড়ের তলায় গিয়েছিল, সেটিরই প্রায়শ্চিত্ত। তাবিজ, কবচ, মাদুলি বেঁধে, পানিপড়া খাইয়ে এক্লাম্পসিয়া-রোগীকে আরও মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। এর পর যদি চিকিৎসকের শরণে নেওয়া হয়, তাঁরা নারীর গর্ভের সন্তান দ্রুত প্রসব করিয়ে খিঁচুনি থেকে রোগীকে বাঁচান এবং ধীরে ধীরে বেঁচে ওঠে মৃত্যুর প্রায় দরজা ছুঁয়ে আসা নারী। কোনও কোনও নারীর অতি খিঁচুনির ফলে মস্তিষ্কবিকৃতিও ঘটতে পারে। তা ঘটুক এবং না ঘটুক, এই অসুস্থতাকে স্বামী-পুরুষটি ভাবেন, আর কোনও গর্ভবতী নারীর তো এমন হয় না, তার কেন হয়? নিশ্চয় কোনও পাপ সে করেছে; যার শাস্তি আল্লাহ্তায়ালা তাকে দিয়েছেন। একে ঘর থেকে তাড়াতেই হবে।’
৬. সন্তান হবার সময় হয়েছে। ধাই ডাকা হয়। সে এসে শরীরের শক্তি খাটিয়ে টানাটানি করে সন্তান বের করে। জরায়ুর স্বাভাবিক সংকোচন-প্রসারণের ফলে সন্তানপ্রসব হবে— এইটুকু অপেক্ষা তারা করে না। সন্তান হয় ঠিকই, এর পর দেখা যায় টানাটানির ফলে জরায়ু ধীরে ধীরে যোনিপথে বেরিয়ে এসেছে। হাঁটলে, কাশলে, জরায়ু নীচের দিকে বেরিয়ে যায়। এই অসুস্থতা নারীকে ভোগায় খুব। আর ওদিকে নারীর এই অসুস্থতায় সবচেয়ে বেশি রুষ্ট হন নারীর স্বামী। যোনিপথে জরায়ু বেরিয়ে আসায় যোনিপথ ব্যবহার করে শরীরের আনন্দ অর্জন করতে স্বামীর অসুবিধে হয়। তাঁরই নির্দেশে ধাই এসেছিল বাড়িতে আর ধাইয়ের চিকিৎসায় জরায়ু নেমেছে নীচে। এই দায়িত্ব শেষাবধি কোনও স্বামীই নেন না। তাঁরা তাঁদের সংগম সুস্বাদু না হওয়ায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন— ‘এই বিচ্ছিরি মেয়েলোককে আজই তালাক দেব।’
.
যে ছয়টি দৃশ্যের প্রসঙ্গ এল, এগুলো ঘটে, প্রায়ই। আমাদের গ্রামগঞ্জ এমনকী শহরেরও মূর্খ, অশিক্ষিত এমনকী তথাকথিত শিক্ষিত পরিবারেও ঘটে এই ঘটনাগুলো। শরীরের সুস্থতার জন্য আধুনিক বিজ্ঞান যদি শরীরে প্রয়োগ করা হয়— এখনও তা গ্রহণ করবার মানসিকতা স্বামী-পুরুষদের হয়নি। তাঁদের এই হীন মানসিকতার কুফল একা নারীকেই ভোগ করতে হয়। শুধু তাই নয়, স্বামীর ভুল সিদ্ধান্তের কারণে স্ত্রীর মৃত্যু হয় অহরহই (এখানে স্বামীর সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দেবার কারণ, যেহেতু কোনও সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার স্ত্রীর নেই, স্বামীই সিদ্ধান্তগ্রহণের একমাত্র অধিকর্তা) আর যদি নারী বেঁচে ওঠে হঠাৎ, তবে তার অসুস্থতা এবং অঙ্গহীনতার দোষে স্বামী তাকে ত্যাগ করেন। দরিদ্র হলে তালাকপ্রাপ্তা নারী আত্মীয়দের আশ্রয়ের আশায় ঘোরে অথবা পতিতালয়ে যায় অথবা ভিক্ষে করে। নারীর জন্য কাজের সংস্থান যেহেতু কম, তাই দ্রুত তার অবস্থা অবনতির দিকে ধাবিত হয়।
এর জন্য দায়ী কে আসলে? শুধু কি স্বামীই অথবা পুরুষই? ঠিক তা নয়। দায়ী আমাদের এই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুরবস্থা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সচেতনতা সমাজের সর্বস্তরে পৌঁছে দেবার ক্ষমতা এই দেশ এখনও অর্জন করেনি। এই দেশে বিজ্ঞানের চেয়ে ধর্মে গতি বেশি। ভালর চেয়ে মন্দ ছড়ায় আগে। দেশ ছেয়ে গেছে মন্দে, এত মন্দের মধ্যে ভালর আশা করাটাই হয়তো বোকামো।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন