বাঙালি মুসলমানের দুর্মতি ও দুর্গতি

তসলিমা নাসরিন

মুসলমানের নানা রকম বাতিক আছে। বাঙালি মুসলমান একবার ঘোষণা দিয়েছিল—‘আমরা ইংরেজি পড়ব না।’ ম্লেচ্ছদের পড়ালেখা না করবার কুফল তারা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে এখন। শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতিতে বাঙালি হিন্দুদের চেয়ে অন্তত দু’শো বছর পিছিয়ে থাকা বাঙালি মুসলমান এখন মাঝেমধ্যেই এগিয়ে থাকা বাঙালি হিন্দুর দিকে শিং বাগিয়ে তেড়ে আসতে চায়, কিন্তু মুশকিল হল, এই বাঙালি কিন্তু ওই বাঙালির নাগাল পায় না, গ্যাপ বেশি তো, তাই!

মুসলমানের আরও বাতিক ছিল। সেটি হল—নারীশিক্ষা চলবে না। বেগম রোকেয়া ১৩৩০ (বঙ্গাব্দে) সালে বলেছিলেন, ‘নারীর প্রতি মুসলমান ভ্রাতৃবৃন্দের অবহেলা, ঔদাস্য এবং অনুদার ব্যবহারের প্রতি কটাক্ষপাত অনিবার্য হয়। প্রবাদ আছে, বলিতে আপন দুঃখ পরনিন্দা হয়। নারী ও পুরুষ বিরাট সমাজদেহের দুইটি বিভিন্ন অংশ। বহুকাল হইতে পুরুষ নারীকে প্রতারণা করিয়া আসিতেছে আর নারী কেবল নীরবে সহ্য করিয়া আসিতেছে। পুরুষের পক্ষে নারায়ণী সেনা আছেন বলিয়া তাঁহারা এ-যাবৎ নারীর উপর জয়লাভ করিয়া আসিতেছেন। সুখের বিষয়, এতকাল পরে শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং আমাদের হিন্দু ভগিনীদের প্রতি কৃপাকটাক্ষপাত করিয়াছেন। তাই চারিদিকে হিন্দু সমাজের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অবরোধবন্দিনি মহিলাদের মধ্যে জাগরণের সাড়া পড়িয়া গিয়াছে। তাঁহারা, বিশেষত মাদ্রাজের মহিলাবৃন্দ সর্ববিষয়ে উন্নতির পথে অগ্রসর হইয়াছেন। এবার মাদ্রাজের লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে ডেপুটি প্রেসিডেন্টের পদে একজন মহিলা নির্বাচিত হইয়াছেন। সম্প্রতি রেঙ্গুনে একজন ব্যারিস্টার হইয়াছেন। লেডি ব্যারিস্টার মিস সোরাবজির নামও সুপরিচিত; কিন্তু মুসলিম নারীর কথা আর কী বলিব? তাহারা যে তিমিরে ছিল সে তিমিরেই আছে।’

‘মাতা যদি বিষ দেন আপন সন্তানে
বিক্ৰয়েন পিতা যদি অর্থ প্রতিদানে
তাহাকে আর কে রক্ষা করিবে?’

বেগম রোকেয়া আরও বলেছেন, ‘যদিও ইসলাম ধর্ম কন্যাদের শারীরিক হত্যা নিবারণ করিয়াছেন, তথাপি মুসলিমগণ অম্লানবদনে কন্যাদের মন, মস্তিষ্ক এবং বুদ্ধিবৃত্তি অদ্যাপি অবাধে বধ করিতেছেন। কন্যাকে মূর্খ রাখা এবং চতুষ্প্রাচীরের অভ্যন্তরে আবদ্ধ রাখিয়া জ্ঞান ও বিবেক হইতে বঞ্চিত রাখা অনেকে কৌলীন্যের লক্ষণ মনে করেন।’

বেগম রোকেয়ার শাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলে ছাত্রীদের অভিভাবক এই বলে চিঠি লিখতেন যে, তাঁদের মেয়েদের যেন সামান্য উর্দু ও কোরান শরিফ পাঠ ছাড়া আর কিছু, বিশেষত ইংরেজি শিক্ষা দেওয়া না হয়। একবার শিক্ষাবিভাগ থেকে বেগম রোকেয়াকে অনুরোধ করে চিঠি পাঠানো হয়েছিল যে, বঙ্গদেশে যতগুলো মুসলিম মহিলা গ্র্যাজুয়েট আছেন, তাঁদের নাম ও ঠিকানা যেন তিনি লিখে পাঠান। তিন কোটি মুসলমানের মধ্যে মাত্র একজন মহিলা গ্র্যাজুয়েট পাওয়া গিয়েছিল।

আলিগড়ের বালিকা বিদ্যালয়ের সেক্রেটারি শেখ আবদুল্লাহ সেই তখন বলেছিলেন—‘স্ত্রীশিক্ষার বিরোধীগণ বলে যে, শিক্ষা পাইলে স্ত্রীলোকেরা অশিষ্ট ও অনম্যা হয়। ধিক! ইহারা নিজেদের মুসলমান বলেন, অথচ ইসলামের মূল সূত্রের এমন বিরুদ্ধাচরণ করেন। যদি শিক্ষা পাইয়া পুরুষগণ বিপথগামী না হয়, তবে স্ত্রীরা কেন বিপথগামিনী হইবে? এমন জাতি, যাহারা নিজেদের অর্ধেক লোককে মূর্খতা ও পরদারূপে কারাগারে আবদ্ধ রাখে, তাহারা অন্যান্য জাতির, যাহারা সমানে সমানে

স্ত্রীশিক্ষার প্রচলন করিয়াছেন; তাহাদের সহিত জীবনসংগ্রামে কীরূপে প্রতিযোগিতা করিবে? ভারতবর্ষে এক কোটি লোক ভিক্ষাজীবী, তন্মধ্যে মুসলমান-সংখ্যাই অধিক। সুতরাং তাহারা কোন মুখে অন্য জাতির সহিত সমকক্ষতা করিবে? আমরা আবার কৌলীন্যের বড়াই করি। ভিক্ষাবৃত্তি সর্বাপেক্ষা নীচ কাজ আর মুসলমানের সংখ্যাই ইহাতে অগ্রণী। ইহার কারণ এই যে, তাহারা স্ত্রীলোকদিগকে শারীরিক ও মানসিক বিকাশসাধনে বঞ্চিত রাখিয়া সর্ববিষয়ে পঙ্গু করিয়া রাখিয়াছে। ফলে তাহাদের গর্ভজাত সন্তান অলস ও শ্রমকাতর হয়; সুতরাং বাপ-দাদার নাম লইয়া ভিক্ষা ছাড়া তাহারা আর কী করিবে?’

বেগম রোকেয়ার জন্ম ১৮৮০ সালে। মৃত্যু ১৯৩২ সালে। আজ থেকে প্রায় সত্তর বছর আগে তিনি বলেছিলেন——মুসলমানদের যাবতীয় দৈন্যদুর্দশার একমাত্র কারণ স্ত্রীশিক্ষার ঔদাস্য। ভ্রাতৃগণ মনে করেন, তাঁহারা গোটাকতক আলিগড় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলিকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর করিয়াই পুলসিরাত পার হইবেন আর পার হইবার সময় স্ত্রী ও কন্যাকে হ্যান্ডব্যাগে পুরিয়া লইয়া যাইবেন। কিন্তু বিশ্বনিয়ন্তা বিধাতার বিধান যে অন্যরূপ—যে বিধি অনুসারে প্রত্যেককেই স্ব-স্ব কর্মফল ভোগ করিতে হইবে। সুতরাং স্ত্রীলোকদের উচিত যে, তাঁহারা বাক্সবন্দি হইয়া মালগাড়িতে বসিয়া সশরীরে স্বর্গলাভের আশায় না থাকিয়া স্বীয় কন্যাদের সুশিক্ষায় মনোযোগী হন। কন্যার বিবাহের সময় যে টাকা অলংকার ও যৌতুক ক্রয়ে ব্যয় করেন, তাহারই কিয়দংশ তাহাদের সুশিক্ষায় ও স্বাস্থ্যরক্ষায় ব্যয় করুন।’

স্কুলে ছাত্রীদের স্বাস্থ্যপরীক্ষা করতে গেলে ছাত্রীদের অভিভাবক চেঁচিয়ে উঠতেন, বলতেন, ‘স্কুল মে লড়কি পড়নে কো দিয়া হ্যায়, না যা বিচার করনে কো, কি আঁখ কমজোর, দাঁত কমজোর, হলক মে ঘাও হ্যায়, ফেফড়া খরাব হ্যায়। ইয়ে সব বোলনে সে হামারি লড়কি কি শাদি ক্যায়সে হোগি?”

বেগম রোকেয়া ছিলেন একটি স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা, শিক্ষক। তিনি অবাক হতেন বালিকাদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার চেয়ে শাদি’র গুরুত্ব অধিক বলে।

সেই সময় থেকে এই সমরের ব্যবধান দীর্ঘ, কিন্তু এখনও মেয়েদের ‘শাদি’র গুরুত্ব কমেনি। এখনও একজন মেয়ে কতদূর লেখাপড়া করেছে, এই সংবাদের চেয়ে মেয়েটির বিয়ে হল কার সঙ্গে, এই সংবাদটি সমাজের সর্বস্তরের লোকের জন্য জরুরি। এ-দেশে নারীর শক্তি প্রমাণিত হয় তাঁর মেধা বা শিক্ষায় নয়, তাঁর স্বামীর যোগ্যতায়। বছরের পর বছর পার হচ্ছে, কিন্তু সেই অন্ধকার এখনও কাটছে না। বাঙালি মুসলমানের চেতনার ভেতর জমে থাকা ঝুলকালি, মাকড়সার জাল কারও বোধহয় সাধ্য নেই সরায়।

নারীর জন্য স্কুল-কলেজ খোলা হচ্ছে। এতে খাতাকলম নিয়ে যারা পড়তে আসছে, ‘শিক্ষাগত যোগ্যতার’ চেয়ে ‘স্বামীগত যোগ্যতায়’ দীপ্তমান হবার আকাঙ্ক্ষা—আমি নিশ্চিত—শতকরা অন্তত নিরানব্বইজনের মনে কাজ করে। এই দোষ আমি মেয়েদের দিচ্ছি না, এই দোষ তাদের—যারা নানা রকম অন্যায় সংস্কার বা বিশ্বাস সংক্রামিত করে এক মানুষ থেকে আরেক মানুষের মধ্যে। যারা শক্ত শিকল পরিয়ে দেয় মানুষের এক পা থেকে আরেক পায়ে।

মুসলমান মেয়েরা শিকল-পরা পায়ে ঘর এবং আঙিনার বাইরে বেশিদূর যেতে পারে না, ভোঁতা মস্তিষ্কের কল্পনাশক্তিও বেশিদূর অগ্রসর হয় না। বিয়ে হয়ে যাবার পর মেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ করে দেবার প্রবণতা আমাদের শিক্ষিত সমাজ থেকে এখনও দূর হয়নি। সরকারের লাখ টাকা খরচ করে শিক্ষাদীক্ষা অর্জন করে ঘরে বসে কেবল স্বামী ও সন্তানের সেবায় নিয়োজিত হওয়া মেয়েদের সংখ্যাও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে, কমছে না।

বাঙালি মুসলমানের জগৎ থেকে এত কিছু দূর হল, হিন্দু দূর হল, উর্দুভাষী দূর হল, কেবল অন্ধকার দূর হয় না।

সকল অধ্যায়

১. ‘আর রেখ না আঁধারে আমায় দেখতে দাও’
২. আশায় আশায় থাকি
৩. আমাদের বুদ্ধিজীবীরা
৪. আগ্রাসন
৫. নগর-যাপন
৬. ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’
৭. ‘কার নিন্দা কর তুমি। মাথা কর নত। এ আমার এ তোমার পাপ।’
৮. ‘দুঃখরাতের গান’
৯. বৃত্ত
১০. নাগরিক খাঁচা
১১. ‘নিজ বাসভূমে পরবাসী’
১২. সকল সন্তানই বৈধ
১৩. ‘জারজ’ শব্দের বিলুপ্তি চাই
১৪. নারীভোজ
১৫. ‘তৃষ্ণার শান্তি সুন্দর কান্তি’
১৬. ‘মুক্ত করো ভয়’
১৭. ‘সখী, আঁধারে একেলা ঘরে মন মানে না’
১৮. ‘নিশিদিন ভরসা রাখিস’
১৯. ‘আমাদের যাত্রা হল শুরু’
২০. ‘খসিল কি আপন পুরনো পরিচয়?’
২১. ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি’
২২. ঝরে পড়া শিক্ষার্থী
২৩. ‘বজ্রানলে বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে’
২৪. নাস্তিক্যবাদ
২৫. নিজের পায়ে নিজের কুড়োল
২৬. গোটা দুই ‘পতিত’, ছ’সাতটি ‘রক্ষিত’ হলে জমত বেশ
২৭. খারাপ মেয়ের গল্প
২৮. শব্দবাণবিদ্ধ নারী
২৯. থ্রি চিয়ার্স ফর হাসিবা
৩০. ‘বড় বিস্ময় লাগে’
৩১. ‘রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোকে পলাশে’
৩২. ‘মন কেমন করে’
৩৩. বিজ্ঞাপনের নারী
৩৪. ‘কে বলেছে তোমায় বঁধু এত দুঃখ সইতে…’
৩৫. ইসলামি থাবা
৩৬. নিজের গোলা শূন্য
৩৭. ‘নপুংসক’ বিষয়ক
৩৮. ‘MEGALOMANIA, THY NAME IS MAN’
৩৯. ধর্মের কাজ ধর্ম করেছে
৪০. কন্যাজন্মের প্রায়শ্চিত্ত
৪১. অবদমন
৪২. গিনিপিগ
৪৩. হিন্দুর উত্তরাধিকার
৪৪. বাঙালি মুসলমানের দুর্মতি ও দুর্গতি
৪৫. রাজনীতির ফাঁকফোকর
৪৬. নারীর নামপরিচয়
৪৭. কাজ
৪৮. পাকিস্তান-প্রীতি, অলৌকিকতা এবং অভিজ্ঞতা
৪৯. কবরের খবর
৫০. যদি সত্য কথা বলি
৫১. সংসার-চিতা
৫২. অনভ্যাস
৫৩. যে-কোনও নারীই আজ নুরজাহান
৫৪. ঘটনা-দুর্ঘটনা
৫৫. ‘উই শ্যাল ওভারকাম’
৫৬. ‘ভাবনার ভাস্কর্য’
৫৭. ‘একলা চলো রে…’
৫৮. অতঃপর নারী হবে মসজিদের ইমাম
৫৯. ‘ভালবেসে যদি সুখ নাহি…’
৬০. আইন বদল
৬১. প্ৰথা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন