কাজ

তসলিমা নাসরিন

আমার ছোটবোন মাস্টার ডিগ্রি পাস করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য দরখাস্ত করছিল। দু’একটি সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকও ছিল তালিকায়। জিজ্ঞেস করলাম, ‘সিটি ব্যাংক বা আল বারাকা ব্যাংক থেকে অফিসার চেয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়নি?”

‘দিয়েছে, কিন্তু ও-সবে তো আমার দরখাস্ত দেওয়া চলবে না।’ আমার বোন বলল।

‘কেন?’

“ওরা মেয়ে নেয় না।’

‘শিক্ষা-যোগ্যতা থাকলেও নেয় না?’

‘না। ওরা ‘পুরুষ হবার যোগ্যতা’ চায়।’

‘এর কারণ কী?’

‘যতদূর শুনেছি মেয়েদের মেটারনিটি লিভ দিতে হয়, মেয়েদের দিয়ে ওভারটাইম করানো যায় না—এ-সব কারণে ওরা মেয়ে নেয় না।’

মানুষের অধিকার আছে যে-কোনও কাজ করবার, সে পুরুষ হোক বা নারী হোক। এ-দেশে শুধু ব্যাংক নয়, আরও অনেক প্রতিষ্ঠান মেয়েদের কাজে নেয় না। তার শিক্ষাগত যোগ্যতা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা সবই তুচ্ছ হয়ে যায়, সে মেয়ে হয়ে জন্মেছে বলে।

একবিংশ শতাব্দী শুরু হবে আর মেয়েরা চাকরি পাবে না মেটারনিটি লিভ নিতে হয় বলে—এ কি কোনও সভ্য দেশের প্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চারিত ঘোষণা বলে আমাকে বিশ্বাস করতে হবে?

গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলোয় নিম্নবিত্ত মেয়েরা কাজ করছে, একটি দেশি ওষুধ প্রতিষ্ঠান চলছে সম্পূর্ণ মেয়েদের দিয়ে, এন জি ও-গুলো প্রচুর মেয়েকে কর্মী হিসেবে নিচ্ছে—এ-সব অত্যন্ত শুভ লক্ষণ, যদিও অভিযোগ থেকে যায়, মেয়েদের খুব কম পারিশ্রমিক দেওয়া হয়। আর কম পারিশ্রমিকই মেয়েরা মেনে নেয় বলে ‘সস্তার শ্রমিক’ হিসেবে তারা নিয়োগপ্রাপ্ত হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মেয়েরা ‘সস্তা’ বলে কাজ পায় বেশি। খোদ আমেরিকাতেই যে কাজ করে একটি মেয়ে ৫৯ সেন্টস পাচ্ছে, একই কাজ করে একটি ছেলে পাচ্ছে এক ডলার।

অসভ্য দেশগুলোর অসভ্য সমাজ এক ধরনের ‘ফতোয়া’ প্রচার করে যে, মেয়েরা ঘরে বসে থাকবার ‘জিনিস’, তাদের ঘরের বাইরে কাজ করা উচিত নয়, স্বনির্ভর হওয়া উচিত নয়। যে দেশের প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক স্বনির্ভর নয়, সে দেশ কখনও সভ্য হবার নয়। এ আমার বিশ্বাস।

এ-দেশের সংবিধানে নারী ও পুরুষের সমান অধিকারের কথা লেখা আছে। অথচ এ-দেশেই বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সংবিধানের বিধান লঙ্ঘন করেও বাণিজ্য করবার ছাড়পত্র পাচ্ছে। এ-ক্ষেত্রে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করবার কথা বলে কোনও লাভ নেই, সে আমি জানি। কারণ সরকারই জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদ সম্পূর্ণ অনুমোদন করেননি, সমান অধিকারের জন্য কিছু কাজের আদেশ-নির্দেশ ওতে আছে কিনা, তাই।

লেখাপড়া শিখে যত মেয়ে চাকরি করে, তার চেয়ে অধিকসংখ্যক মেয়ে বেকার বসে থাকে। অথচ কাজের অভাব থাকবার কথা নয়। অনেকে বলে মেয়েরা শক্ত কাজ করতে পারে না, তাই হালকা ধরনের কাজগুলো ওদের জন্য রাখা হয়— এটি একটি চূড়ান্ত মিথ্যেকথা। গ্রামের কৃষক পরিবারের মেয়েরা কাক ডাকা ভোর থেকে শুরু করে মধ্যরাত অবধি একটানা যে কাজগুলো করে, কোনও পাষণ্ডও বলবে না এ-সব হালকা কাজ। মেয়েরা মাটি কাটছে, মাটি বহন করছে, ইট ভাঙছে, যে-কোনও কাজেই তারা পুরুষের সমান পারদর্শী। অথচ কাজের সুযোগ তাদের দেওয়া হয় না। সেদিন একটি রেস্তোরাঁয় কিছু মেয়ে কাজ করছে দেখে আমার চেনা দু’জন পুরুষ ঠোঁট চেপে হাসল। হাসবার কারণ একটিই, এই মেয়েদের ওরা ভাবছে ‘খারাপ মেয়ে’। এখনও এই সমাজ অভ্যস্ত হয়নি খুব নিচু এবং উঁচু স্তরে ছাড়া মেয়েরা কাজ করছে, দেখতে। হয় মেয়েরা ইন্ডাস্ট্রির মালিক হবে, নয় ঘুঁটেকুড়োনি, পতিতা, চাকরানি, মেথরানি ইত্যাদি হবে। মাঝামাঝি কোনও পদে মেয়েদের গ্রহণ করায় এখনও সমাজের জড়তা কাটছে না। সেনাবাহিনীতে মেয়েদের নেওয়া হয় না। এই না নেওয়ার পেছনে কারণ কী? মেয়েরা কি লাফাতে, দৌড়োতে, গুলি ছুড়তে পারে না? নিশ্চয় পারে।

অন্য দেশের মেয়েরা প্রমাণ দিয়েছে যে তারা পারে। তারা বিমান চালাতে ও জানে, জাহাজ চালাতেও জানে, গুলি ছুড়তেও জানে। মেয়েদের মনকে, শরীরকে অদ্ভুত এক রহস্যের জালে জড়িয়ে রেখে পুরুষ নামের প্রাণীরা বহু দর্শন, মনোবিজ্ঞান, কাব্য, মহাকাব্য রচনা করেছেন এবং মেয়েদের সরিয়ে রেখেছেন কঠোর বাস্তবতা থেকে, একইসঙ্গে মানুষের প্রাপ্য অধিকার থেকে। সেলস গার্ল হিসেবে, ট্রাক-বাস-টেম্পো-লঞ্চ-ট্রেনের ড্রাইভার হিসেবে, ব্যাংকে, ইনসিওরেন্স কোম্পানিতে, রেস্তোরাঁয়, হোটেলে, হাসপাতালে, লন্ড্রিতে, গ্যারেজে মেয়েরা সবধরনের দক্ষতা দেখাতে পারে। কাপড়, কাগজ, সাবান, শ্যাম্পু, স্নো-পাউডার, ওষুধ, জুতো, জুট, ইট, কলম, পেনসিল, মশলা, সিরামিক তৈরির কলকারখানায় অন্তত পঞ্চাশ ভাগ বাধ্যতামূলক নারী-শ্রমিক নিয়োগের ব্যবস্থা করলে, দেশের মেধাবী বেকারের সমস্যা যেমন ঘোচে, পরনির্ভর হওয়ার গ্লানি থেকে নারী যেমন রক্ষা পায়, তেমনি ইন্ডাস্ট্রিগুলোও অধিক সৎ, নিষ্ঠ ও কর্মঠ শ্রমিক পেয়ে লাভবান হয়। রাজমিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রি হিসেবেও আমার বিশ্বাস— নারী পুরুষের তুলনায় অধিক দক্ষ।

বৈজ্ঞানিক, বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ফিল্মমেকার, জজ, ব্যারিস্টার, উকিল, মন্ত্রী, রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মেয়েরা পারদর্শিতা দেখিয়েছে। শুধু বড় কাজে নয়— ছোট-মাঝারি যে কোনও কাজেই মেয়েদের বাধ্যতামূলক নিয়োগের ব্যবস্থা থাকা উচিত সরকারি এবং বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানে। সেই সঙ্গে কর্মজীবী মেয়ে-হোস্টেল নির্মাণও বাড়াতে হবে।

‘অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা’ এ-কথা সকলে জানেন। মেয়েদের কাজকর্মহীন অলস জীবন উপহার দিয়ে আমাদের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির সমাজপতিরা মেয়েদের বানাতে চাচ্ছে এক-একটি আস্ত ‘শয়তান’। তারা সাজবে, নাচবে, হাসবে, খেলবে দুলবে— ব্যাস। তারা কানে আট-দশটি ফুটো করবে, ওতে সোনার রিং ঝুলোবে। তারা নাক ফুটো করেও গয়না লটকাবে, তারা জামায়, জুতোয়, শাড়িতে জরি লাগাবে, চুমকি বসাবে। তারা অনর্থক সব কাজ করবার জন্য অনুৎপাদক শয়তানে রূপান্তরিত হচ্ছে। সাজগোজ, ফ্যাশন, চমক ইত্যাদির প্রতি মোহ সৃষ্টির একমাত্র কারণ নারীর কর্মহীন অলস মস্তিষ্ক। বাচ্চাদের স্কুল থেকে আনা-নেওয়াও মেয়েদের জন্য নতুন একটি ফ্যাশনে দাঁড়িয়েছে। তারা নাকি ভোর ছটায় উঠে মেকআপ করতে বসে আটটায় বাচ্চাকে স্কুলে পৌঁছোতে হবে বলে। কিন্ডারগার্টেনগুলো ছাত্রছাত্রীদের থেকে পয়সা তো কম নিচ্ছে না, স্কুলবাসের ব্যবস্থার জন্য কেন তবে কোনও উদ্যোগ নেই? অভিভাবকগণ কি এই যৌক্তিক দাবিটি কখনও উত্থাপন করেছেন?

মেয়েরা ‘মেটারনিটি লিভ নেয়’, মেয়েদের কাজ করবার বিপক্ষে এটি কোনও যুক্তি নয়। সেনাবাহিনী, পুলিশবাহিনীতে এমনকী রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে কাজ করেও যদি মেয়েরা মেটারনিটি লিভ নিতে পারে তবে এ-দেশের সিটি ব্যাংক এবং অল বারাকা ব্যাংকের স্পর্ধা কেন এত যে, তারা এই কারণ দেখিয়ে মেয়েদের চাকরি থেকে বঞ্চিত করে? নাকি আরও কোনও কারণ আছে লুকিয়ে, যা আমরা জানি না? মেয়েদের অবরোধ রাখবার গূঢ় কোনও ষড়যন্ত্র? হতে পারে। কিছুই এখন আর অবিশ্বাস্য নয়।

সেদিন আমার এক আত্মীয় তাঁর শিক্ষিত কন্যা সম্পর্কে বললেন,

‘ও কোনও স্কুল বা কলেজে ঢুকতে পারলে ভাল হত।’

জিজ্ঞেস করলাম, ‘স্কুল-কলেজে কেন?’

আত্মীয়টি বললেন, “শিক্ষকতার চাকরিই মেয়েদের জন্য ভাল। নিরাপদ। ‘

ইতিমধ্যে সমাজ-সংসারে আবিষ্কৃত হয়ে গেছে কোন চাকরিটি মেয়েদের জন্য ভাল, কোন চাকরিটি খারাপ। যে মেয়ে যে কাজে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে বা দক্ষতা দেখাবে, সে কাজই বা সে চাকরিই সেই মেয়ের জন্য ভাল হওয়ার কথা। অথচ মেয়েদের জন্য এই চাকরি ভাল, ওই চাকরি খারাপ— এই যে একটি ভাগাভাগি চলছে, এর ফলাফল এক ধরনের নৈরাশ্য সৃষ্টি করবে ভবিষ্যতে। ‘মেয়েলি’ এবং ‘পুরুষালি’ বলে আলাদা কিছু দোষগুণ যেমন নির্ধারণ করা হয়েছে কিছু দুষ্ট পুরুষ দ্বারা। তেমনি ‘মেয়েদের কাজ : এবং ‘ছেলেদের কাজ’ বলেও বিশাল এই বিজ্ঞাননির্ভর উর্বর পৃথিবীতে এক ধরনের ভাগাভাগির খেলা চলছে।

নারী যদি মানুষ হয়, তবে যে কাজ করতে পুরুষের কোনও বাধা নেই, সে কাজে নারীরও বাধা থাকবার কথা নয়। মেয়েরা হাত-পা, মস্তিষ্কসহ সম্পূর্ণ মানুষ। তাদের অকেজো করে রাখবার অধিকার কোনও মানুষের নেই, প্রতিষ্ঠানের নেই, রাষ্ট্রের নেই।

সকল অধ্যায়

১. ‘আর রেখ না আঁধারে আমায় দেখতে দাও’
২. আশায় আশায় থাকি
৩. আমাদের বুদ্ধিজীবীরা
৪. আগ্রাসন
৫. নগর-যাপন
৬. ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’
৭. ‘কার নিন্দা কর তুমি। মাথা কর নত। এ আমার এ তোমার পাপ।’
৮. ‘দুঃখরাতের গান’
৯. বৃত্ত
১০. নাগরিক খাঁচা
১১. ‘নিজ বাসভূমে পরবাসী’
১২. সকল সন্তানই বৈধ
১৩. ‘জারজ’ শব্দের বিলুপ্তি চাই
১৪. নারীভোজ
১৫. ‘তৃষ্ণার শান্তি সুন্দর কান্তি’
১৬. ‘মুক্ত করো ভয়’
১৭. ‘সখী, আঁধারে একেলা ঘরে মন মানে না’
১৮. ‘নিশিদিন ভরসা রাখিস’
১৯. ‘আমাদের যাত্রা হল শুরু’
২০. ‘খসিল কি আপন পুরনো পরিচয়?’
২১. ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি’
২২. ঝরে পড়া শিক্ষার্থী
২৩. ‘বজ্রানলে বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে’
২৪. নাস্তিক্যবাদ
২৫. নিজের পায়ে নিজের কুড়োল
২৬. গোটা দুই ‘পতিত’, ছ’সাতটি ‘রক্ষিত’ হলে জমত বেশ
২৭. খারাপ মেয়ের গল্প
২৮. শব্দবাণবিদ্ধ নারী
২৯. থ্রি চিয়ার্স ফর হাসিবা
৩০. ‘বড় বিস্ময় লাগে’
৩১. ‘রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোকে পলাশে’
৩২. ‘মন কেমন করে’
৩৩. বিজ্ঞাপনের নারী
৩৪. ‘কে বলেছে তোমায় বঁধু এত দুঃখ সইতে…’
৩৫. ইসলামি থাবা
৩৬. নিজের গোলা শূন্য
৩৭. ‘নপুংসক’ বিষয়ক
৩৮. ‘MEGALOMANIA, THY NAME IS MAN’
৩৯. ধর্মের কাজ ধর্ম করেছে
৪০. কন্যাজন্মের প্রায়শ্চিত্ত
৪১. অবদমন
৪২. গিনিপিগ
৪৩. হিন্দুর উত্তরাধিকার
৪৪. বাঙালি মুসলমানের দুর্মতি ও দুর্গতি
৪৫. রাজনীতির ফাঁকফোকর
৪৬. নারীর নামপরিচয়
৪৭. কাজ
৪৮. পাকিস্তান-প্রীতি, অলৌকিকতা এবং অভিজ্ঞতা
৪৯. কবরের খবর
৫০. যদি সত্য কথা বলি
৫১. সংসার-চিতা
৫২. অনভ্যাস
৫৩. যে-কোনও নারীই আজ নুরজাহান
৫৪. ঘটনা-দুর্ঘটনা
৫৫. ‘উই শ্যাল ওভারকাম’
৫৬. ‘ভাবনার ভাস্কর্য’
৫৭. ‘একলা চলো রে…’
৫৮. অতঃপর নারী হবে মসজিদের ইমাম
৫৯. ‘ভালবেসে যদি সুখ নাহি…’
৬০. আইন বদল
৬১. প্ৰথা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন