তসলিমা নাসরিন
আমার ছোটবোনের একটি চমৎকার মেয়ে হয়েছে। বাড়ির সবাই আমাকে বলেছে সুন্দর একটি নাম দাও মেয়েটির। আমি নাম দিয়েছি ‘স্রোতস্বিনী ভালবাসা”। ডাকনাম ভালবাসা। নাম শুনে আমার আত্মীয়রা এ ওর মুখের দিকে তাকিয়েছে। কেউ মুখ টিপে হেসেছে, কেউ ভ্রূ কুঁচকেছে, কেউ বলেছে, এ আবার কী ধরনের নাম!
কেন?
ভালবাসা কোনও নাম হল? এই নাম মুরুব্বিরা ডাকবে কী করে?
ডাকলে অসুবিধে কী?
ছি, কী লজ্জা!
‘ভালবাসা’ নাম রেখে আমি সম্ভবত আমার ছোটবোনের স্বামীকে যথেষ্ট অস্বস্তিতে ফেলেছি। সে তার আত্মীয়-বন্ধুদের সামনে নামটি উচ্চারণ করতে পারছে না। একটি ‘ভালবাসা’ নাম বাড়িসুদ্ধ কী ভীষণ অসন্তোষের সৃষ্টি করতে পারে তা আমি এ ক’দিনে বেশ উপলব্ধি করেছি।
তারা আরও আপত্তি করছিল, মেয়ে বড় হলে রাস্তার ছেলেরা এই নাম নিয়ে রীতিমতো টিজ করবে। এই নাম থেকে মেয়েকে মুক্ত করতে পারলে মেয়ের ‘শুভাকাঙ্ক্ষীরা এখন বাঁচে বই কী। ভালবাসা’ নামটি শেষ পর্যন্ত আমাদের সমাজ-সংসারে বড় দুঃসহ হয়ে উঠল। এই শব্দটিকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় না করলে তাদের শান্তি নেই। আমি ভেবেছি এই শব্দ নিয়ে লোকের এত আপত্তি কেন? আমি এ-কথা খুব বেশি বিশ্বাস করি যে, ভালবাসার চেয়ে সুন্দর কিছু, বড় কিছু, মহান কিছু পৃথিবীতে নেই। তবে এই শব্দ নিয়ে পরিবারে এবং সমাজে এত লজ্জা কেন? নাকি আমাকে এ-কথা বিশ্বাস করতে হবে যে, যেহেতু সন্ত্রাসের এই দেশে ঘৃণা এবং ভয়ই প্রধান দুই উপলব্ধি তাই এর বাইরে অন্য কোনও সুখকর অনুভবের তেমন মূল্য নেই।
ভালবাসা এই দেশ থেকে, সমাজ থেকে, পরিবার থেকে নির্বাসিত প্রায়। তাই নির্বাসিত কোনও শব্দ বা অনুভব নিয়ে সকলের কুণ্ঠা, জড়তা ও আতঙ্ক কাজ করে। তারা ভাবে ‘ভালবাসা’ শব্দটি লজ্জার, টিজ করবার।
ভালবাসা আমাকে এ জীবনে ভুগিয়েছে খুব। ক্লাস টেনে যখন পড়ি, স্কুলে যাবার পথে সুদর্শন এক তরুণ একটি চিঠি গুঁজে দিয়েছিল আমার হাতে। ব্যাপারটি জানাজানি হয়ে যায় আমার বাঙ্গিতে। আমি সেই চিঠিটি বইয়ের ভেতর লুকিয়ে রেখেছিলাম, অভিভাবকদের চোখ এড়িয়ে ফাঁক পেলেই আমি সেই চিঠিটি পড়তাম। চিঠিটি একসময় ওরা আবিষ্কার করে ফেলে এবং আমাকে বেদম মারধর করে। আমার সঙ্গে সেদিন থেকে একটি লোক দেওয়া হয়, স্কুলে যাওয়া-আসায় পাহারাদার হিসেবে। যে তরুণ আমাকে চিঠি দিয়েছিল, তার সঙ্গে আর কোনও যোগাযোগ ও পরে সম্ভব হয়নি। ভালবাসা আমার মনে হয়, কখনও স্থির থাকবার জিনিস নয়। কাউকে ভালবাসলাম তো সারা জীবন ভালবাসলাম, আর কারও দিকে তাকালাম না— ভালবাসার ব্যাপারে আমি এতটা সন্ন্যাসী হতে রাজি নই। আমি আমার জীবনেই দেখেছি, যাকে ভালবাসি, খুব গভীর করেই আমি তাকে ভালবাসি। আমার ভালবাসায় কোনও খাদ থাকে না। কিন্তু যখন ভালবাসার মানুষ থেকে আমার মন ওঠে, চিরতরেই ওঠে। মন উঠবার মতো কারণও ঘটে অবশ্য, বিস্তর কারণ। আমি যে পরিবারে বড় হয়েছি, সে হচ্ছে একটি রক্ষণশীল পরিবার— ‘ভালবাসা’ এই পরিবারে অত্যন্ত অন্যায়, গর্হিত একটি কাজ। আমার যখন আঠারো-উনিশ বছর বয়স, তখন এক যুবকের প্রেমে পড়ি আমি। প্রেম সম্পর্কে আমার ধারণা তখন কেবলই বই-পুস্তক নির্ভর। আমার ইচ্ছে হত, দেবদাস যেমন পার্বতীকে ভালবাসে, রোমিও যেমন জুলিয়েটকে, সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান যেমন বায়োনিক ওম্যানকে, তেমন করে প্রেমিক যুবকটি আমাকে ভালবাসুক। আমি কেবল মনের মধ্যে একশো একটা ইচ্ছেই পুষে বেড়াতাম। স্বপ্নই ছিল কেবল শীত-গ্রীষ্ম জুড়ে। স্বপ্নই ছিল কেবল হৃদয়-শরীর জুড়ে। কিন্তু প্রেমিকের ঘনঘন স্টার সিগারেট ফোঁকা, হিশি করবার তাগাদা, দুপুর হলেই ভাতের সঙ্গে গোরুর মাংসের হলুদ ঝোল মেখে খাওয়া, সব কেমন যেন অদ্ভুত লাগত, স্বপ্নের সঙ্গে মেলাতে পারতাম না কিছুই। আর আমিও ছিলাম লজ্জাবতী লতা। ভাববাচ্যে কথা বলতাম, ভালবাসার মানুষকে ‘তুমি’ সম্বোধন করতে আমার লেগেছিল পাক্কা পাঁচ বছর।
দেখলাম স্বপ্নে এবং বাস্তবে অনেক ফারাক। স্বপ্নে টাকাপয়সা হিসেব করতে হয় না, স্বপ্নে ঝগড়ঝাটি হয় না, মনখারাপ করা সময় আসে না, সারাদিন হয় বৃষ্টিতে, নয় উজ্জ্বল বিকেলে, নয় পূর্ণিমায় অবাধ সাঁতরে সাঁতরে জীবন পার হয়। আর বাস্তবে এদিক চেয়ো না, ওদিক ফিরো না, এটা কোরো না, ওটা করো ইত্যাদি নিয়মের জ্বালায় আমাকে স্থবির হয়ে থাকতে হয়। বাস্তব ব্যাপারটি ‘মেয়েদের’ জন্যই স্থবিরতাই দেয় বই কী
পুরুষ নামক প্রাণীকে ভাল কিন্তু আমিও কম বাসিনি। এর বিনিময়ে আমাকে বসিয়ে রেখে একজন টানবাজার’ সেরে এসেছিল মনে আছে। আমি দু’শো গোলাপ নিয়ে তার অপেক্ষা করেছিলাম, সে এসেই আমাকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে নেচে উঠবে, আশা ছিল। আমার কেবল আশায় বসতি। কেউ একজন আমাকে ভালবাসে, আমাকে ছাড়া বাঁচবে না ইত্যাদি বলে-টলে আমার ব্যাগ থেকে সাতশো ডলার আর গলার একটি সোনার চেইন হাতিয়ে নিয়েছিল। একজন আমাকে ভালবাসে মুখে খুব বলত, আড়ালে আমার কুৎসা রটাত। আর একজন তো বোতল-বোতল মদ খেয়ে সারা রাত ধরে প্যান্টের বেল্ট খুলে আমাকে পেটাত। তারপরও এই পুরুষদের জন্যই দেখি আমার ভালবাসার কমতি হয় না। ভালবাসা এমনই এক আশ্চর্য জিনিস, দিন দিন এর কেবল স্ফুরণ হয়, এর কোনও বিনাশ-বিলুপ্তি নেই। তবে ভালবাসা যে দিনে দিনে পরিণত হয়, এ আমি খুবই মানি। এখন যাকে ভালবাসি, লক্ষ করেছি, আমার আবেগ যথেষ্ট সংযত, এখন আমার ষোলো আনাই ভালবাসার জন্য আগের মতো তুলে রাখি না। এখন নিজের জন্য রাখি আমি বারো আনা, ভালবাসার জন্য চার আনা। এতে যদি পড়তা পড়ে, থাকো, না পড়লে পথ মাপো। সোজা হিসেব। ভালবাসায় আগে খুব বেহিসেবি ছিলাম, দু’আনা নিয়ে ষোলো আনা দিতাম, এখন দু’আনা নিলে দু’আনা দিই। তবে যেটুকু দিই, তা ষোলো আনাই নিখাদ।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন