তসলিমা নাসরিন
আজকাল মোল্লারাও বিজ্ঞানের জ্ঞান শেখাচ্ছে। কারণ তারা বুঝে গিয়েছে জগৎ যখন ক্রমশ বিজ্ঞাননির্ভর হয়ে উঠছে তখন বিজ্ঞানের সঙ্গে তাল না মেলাতে পারলে তাদের ধর্মও আর টিকে থাকে না। তাই চতুর ধর্মব্যবসায়ীরা বিজ্ঞানকে তাদের দলে নেবার জন্য দেশে দেশে লোক নিয়োগ করেছে। এই লোকেরা সমাজে প্রতিষ্ঠিত, দার্শনিক, কেউ আবার বিজ্ঞানীও। এরা যখন ধর্মপ্রচারে নিবেদিত হয় তখন সাধারণ মানুষ ভাবে যে, অত বড় মনীষী যখন বলছে তখন নিশ্চয় সে জেনেই বলছে। নিশ্চয় বেহেশত-দোজখ বলে কিছু আছে পরকালে। মরিস বুকাইলি নামের এক লোক কোরানকে বিজ্ঞান গবেষণাগারের টেস্টটিউবে রেখে লিটমাস পেপার ডুবিয়ে পরীক্ষা করে দেখিয়েছে বিজ্ঞানের সৌরজগৎ এবং কোরানের সৌরজগৎ একই, কোনও হেরফের নেই। আমাদের অশিক্ষিত লোকেরা ভাবছে, মরিস বুকাইলি যখন বলছে, ঠিকই নিশ্চয় বলেছে। ওল্ড টেস্টামেন্টের ছয় দিনে পৃথিবী বানাবার ঘটনাটি কোরানেও যখন হুবহু উচ্চারিত হয়, তখন মরিস সাহেব আরবি শব্দ উলটে দিয়ে নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে কোরান রচনার ধৃষ্টতা দেখান। কোরানে লেখা ছয় দিন, মরিস বুকাইলি লিখে দেন ‘ছয় সময়কাল’। বুকাইলি বিংশ শতাব্দীর লোক, কিন্তু মুহম্মদ তো বিংশ শতাব্দীর লোক ছিলেন না। বুকাইলি বিজ্ঞানের সকল ব্যবহারকে কোরানসম্মত করে মূর্খ মানুষের বাহবা পেতে চেয়েছেন, পেয়েছেন। কেবল বুকাইলি নয়, এই উপমহাদেশে প্রফেসর সালাম, শমশের আলিও সস্তা বাহবার জন্য ইসলামের খাঁচায় বিজ্ঞানকে ঢুকিয়েছেন।
মিশরের চিন্তাবিদ আল্লামা ফরিদ আজদি লিখেছেন—
‘পুরুষের মগজ সাধারণত গড়ে ৪৯%, আউন্স। আর স্ত্রীলোকের মগজের ওজন মাত্র ৪৪ আউন্স। দুশো আটাত্তর জন পুরুষের মগজ ওজন করে দেখা গেছে, সবচেয়ে বড় মগজের ওজন হচ্ছে ৬৫ আউন্স। আর সবচেয়ে ছোট মগজের ওজন ৩৪ আউন্স। পক্ষান্তরে, ২৯১ জন স্ত্রীলোকের মগজ ওজন করলে পর প্রমাণিত হল যে, সবচেয়ে ভারী মগজের ওজন হচ্ছে ৫৪ আউন্স, আর সবচেয়ে হালকা মগজের ওজন হচ্ছে ৩১ আউন্স। এ থেকে কি একথা প্রমাণিত হয় না যে, স্ত্রীলোকের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও স্নায়ু পুরুষের তুলনায় অনেক অনেক গুণ দুর্বল।’ (ফরিদ আজদি)
ফরিদ আজদি বোঝাতে চেয়েছেন পুরুষেরা বুদ্ধি ও জ্ঞানে নারীর তুলনায় পরিপক্ব। প্রাণীজগতে মানুষের মগজের তুলনায় ভারী মগজ ধারণ করে এমন প্রাণীকে দেখা গেছে বোকা অথবা গবেট গোছের কিছু হতে এবং কম মগজ ধারণকারীকে দেখা যায় অধিক ধীসম্পন্ন হতে। মগজের আকার-আকৃতি, ওজন কখনও বুদ্ধি, ধীশক্তি, মেধা ও প্রতিভার ধারক নয়। তবে তো চড়ুই পাখির চেয়ে গন্ডার বুদ্ধিমান হত।
আরব মনীষী আব্বাসে মাহমুদ আকাস আল আক্কাদ লিখেছেন— ‘স্ত্রীর উপর স্বামীর নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব স্বাভাবিক মর্যাদা আধিক্যের কারণে এবং এ কারণে যে, স্ত্রীর যাবতীয় আর্থিক প্রয়োজন পূরণ করবার দায়িত্ব স্বামীর। আর এ কর্তব্য হচ্ছে কম মর্যাদাশালীর প্রতি অধিক মর্যাদাবান ব্যক্তির কর্তব্য। কেবল আর্থিক প্রয়োজন পূরণই এর একমাত্র ভিত্তি নয়। অন্যথায় যে স্ত্রী ধনশালী কিংবা যে স্বামী স্ত্রীর প্রয়োজন পূরণ, করে না বরং স্ত্রীর মেহমান হয়ে তার সম্পদ ভোগ করে, সেখানে স্ত্রীরই উত্তম কর্ত্রী হওয়া উচিত স্বামীর, কিন্তু ইসলামে তা কোনওদিন হতে পারে না।’
কোরানে অবশ্য এ-কথা স্পষ্ট লেখা— নারীর ওপর পুরুষের মাতব্বরি করবার প্রধান কারণ পুরুষেরা টাকাপয়সা উপার্জন করে তাই। নারী যদি টাকাপয়সা উপার্জন করে তখন কী উপায় হবে এ-কথা মুহম্মদের মাথায় আসেনি। কারণ তিনি আব্বাস মাহমুদের মতো চতুর ছিলেন না। তাই বর্তমানের আব্বাসেরা দায়িত্ব নিয়েছেন কোরানের সূত্র ধরে নারীর কর্ত্রী হবার ব্যাপারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির।
বাংলাদেশের পারিবারিক আইনে নতুন এক ধরনের উদারতা শুরু হয়েছে। কোরানে স্পষ্ট লেখা আছে, ‘অতঃপর যদি সে তাহাকে তালাক দেয় তবে সে তাহার জন্য বৈধ হইবে না, যে পর্যন্ত সে অন্য স্বামীর সহিত সংগত না হইবে।’ (সূরা বাকারা, আয়াত ২৩০)
কোরানে যা লেখা, সবই আল্লাহ্ বিধান। অথচ পারিবারিক আইনে তালাক হয়ে যাবার পর অন্য স্বামীর সঙ্গে সংগত হওয়া দূরের কথা, অন্য বিবাহ না করেই তালাকদাতা স্বামীকে বৈধ করবার বিধান চালু হয়েছে। আল্লাহ্ বিধান অমান্য করে নতুন বিধান যারা সৃষ্টি করল, তাদের নিশ্চয় কাফের বলা যায়। যারা কোরান মানে না, তারা কাফের। তবে পারিবারিক আইনে যা ধর্মসম্মত বলে প্রচার করা হয়ে থাকে তা আসলে ধর্মসম্মত নয়, বরং উলটো। আল্লাহতায়ালা কখনও এই অনুমতি দেননি যে, বান্দারা তোমরা তোমাদের সুযোগ-সুবিধেমতো কোরান রচনা করো অথবা বিধান সৃষ্টি করে নিয়ো।
যদি মানতে হয় আল্লাহ্র আদেশ, তবে পুরোটাই মানতে হবে। আর তা না হলে অগ্রসর বিজ্ঞানকে, সভ্যতাকে, নারীর অধিকারকে অল্প অল্প করে ধর্মের ফোকরে ঢোকাতে গেলে ধর্মের বারোটা বাজবে, সভ্যতাও অসভ্য হবে আরও।
পুরুষের চার বিয়ে করতে অনুমতি নিতে হয় স্ত্রীদের কাছ থেকে— এ হচ্ছে পারিবারিক আইন। ‘কোরানের চার বিয়ের’ সঙ্গে ‘সভ্যতার অনুমতি’ মিশিয়ে এখানে এমন একটি খিচুড়ি তৈরি করা হয়েছে যে, এর ফলে আল্লাকেও অমান্য করা হয় এবং সভ্যতাকেও অর্থাৎ নারীর অধিকারকেও ব্যঙ্গ করা হয়। কারণ কোরানে আল্লাহ্ বলেছেন— ‘বিবাহ করিবে নারীদের মধ্যে যাহাদের তোমাদের ভাল লাগে, দুই, তিন অথবা চার। (সুরা নিসা, আয়াত ৩) কোথাও উল্লেখ নেই, স্ত্রীদের অনুমতি নিতে হবে দ্বিতীয়, তৃতীয় অথবা চতুর্থ বিবাহে। যারা অনুমতির বিধান চালু করেছে তারা নিঃসন্দেহে কাফের, কারণ তারা আল্লাহ্ আইন অমান্য করেছে। বর্তমান পারিবারিক আইনকে নিশ্চয় তবে ইসলামবিরোধী আইন বলা যায়।
আর বিরোধিতা করতে হলে এমন মিনমিনে বিরোধিতা কেন, জোর গলায় নয় কেন! বিরোধিতার অর্থ বিরোধিতাই। কণ্ঠ নিচু হোক, কণ্ঠ উঁচু হোক, ঘটনা একই।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন