তসলিমা নাসরিন
বাংলাভাষায় ‘রক্ষিতা’ শব্দটি সংস্কৃত ‘রক্ষিত’ শব্দ থেকে এসেছে। এটি সাধারণত বিশেষ্য হিসেবেই বেশি ব্যবহৃত হয়। শব্দটির অর্থ, পালিতা উপপত্নী। এই শব্দটির কোনও পুংলিঙ্গ প্রতিশব্দ নেই। ‘রক্ষিত’–এর পুংলিঙ্গ শব্দ নয়। কারণ ‘রক্ষিত’ শব্দটি বিশেষণ, এর অর্থ রক্ষা করা—রাখা হয়েছে এমন অথবা পরিত্রাত, পালিত, গচ্ছিত। ‘রক্ষিত’ শব্দ ‘পালিত উপপতি’ বোঝায় না। যেমন বোঝায় ‘রক্ষিতা’ দ্বারা ‘পালিত উপপত্নী’।
‘রক্ষিত’ শব্দটির অর্থ পালিত উপপতি নয়, কারণ সমাজে উপপতি রাখবার নিয়ম চালু করা হয়নি অথবা চালু করতে দেওয়া হয়নি। সমাজে যা চালু হয়নি তা শব্দার্থে চালু হবে কেন! রক্ষিতা চালু আছে সব দেশেই। আরবের আমিররা নাকি সত্তর-আশিটি করে রক্ষিতা রাখেন। এ-দেশের বিত্তবান মুসলমানরাও রক্ষিতা পছন্দ করেন, কেউ গোপনে, কেউ প্রকাশ্যে এই ব্যবস্থার চর্চা করছেন। রক্ষিতা তো আছেই। চারদিকে রক্ষিতা। কিন্তু ‘রক্ষিত’ কেন নেই? ‘রক্ষিত’ শব্দটি আমি বিশেষ্য হিসেবে এবং রক্ষিতার পুংলিঙ্গ প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করছি। আশা করছি এই শব্দটি অভিধানে এবং উচ্চারণে রক্ষিতার পুং প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হবে, যার অর্থ হবে উপপতি। পালিত উপপতি। খুঁজলে কি ‘রক্ষিত’ পাওয়া যাবে না এই দেশে? অথবা অন্য দেশে? আমি জানি পাওয়া যাবে। বিত্তবান নারীরা সত্তর-আশিটা না হোক একজন-দু’জন ‘রক্ষিত’ রাখবেন না, এ কেমন কথা! কেবল একতরফাভাবে বিত্তবান পুরুষেরাই এ কৃতিত্বের অধিকারী হবেন—এ কি মানা যায়? মানুষ তো মানুষকে দেখেই শেখে? নারী না হয় পুরুষের ‘রক্ষিতা’ রাখবার কায়দাকানুন শিখে নিজেই ‘রক্ষিত’ রাখলেন। নারীরও তো কৃতিত্ব দরকার। নারীরও তো বীরত্ব দরকার। পুরুষই কেবল একা ‘বীর’ হবে, একাই শৌর্য, তেজ, পরাক্রমের অধিকারী হবে? একাই ‘বীর্যবান’ হবে? ‘বিত্তবান নারী’ জগতে অনেক আছেন। তাঁরা ‘রক্ষিত’ রেখে অভিধানে ‘রক্ষিত’ শব্দটি যথার্থ অর্থে প্রচলন করবেন—এ আশা আমি করি। এ বিশ্বাস আমার আছে, একদিন ঘরে ঘরে ‘রক্ষিত’ জন্মাবে।
আমাকে যাঁরা পছন্দ করেন এবং না করেন, তাঁদের অনেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করেন অথবা আমার ব্যাপারে একটি অভিযোগই করেন তা হল— আমি কেন একের বেশি বিবাহ করেছি। এটি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে আমি উত্তর এড়িয়ে যাই। আমার এক সময় খুব ইচ্ছে ছিল, পুরুষ যেমন চার বিয়ে করে এক বাড়িতে চার বউ নিয়ে জীবনযাপন করবার অধিকার রাখে, তেমন আমিও চার বিয়ে করে চার স্বামী নিয়ে জীবন কাটাব। অনেক মেয়েই এ ঘটনা দেখে উৎসাহী হবে। আর মানুষের তখন টনক নড়বে যে, যে বিধানটি এ সমাজে প্রচলিত, তার উলটো চর্চা শুরু হলে কেমন দেখায়। কোথাকার জল কোথায় গড়ায়। মেঘে মেঘে বিদ্যুৎ কেমন খেলে। ‘বিধান’ যখন ভাল কথায় সরানো যায় না, বিধানের অপকারিতা বোঝাতে হয় বিপরীত বিধানের আশ্রয় নিয়ে।
দুঃখ এই, চার বিয়ে করা শেষ অবধি আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তবু যেটুকু সম্ভব হয়েছে তা-ই অনেককে যন্ত্রণা কম দেয় না। অসৎ পুরুষদের যন্ত্রণা দেখলে আমার অদ্ভুত আনন্দ হয়। বিত্ত থাকলে আমিও ‘রক্ষিত’ পুষতাম। বিত্তবানেরা শখ করে কুকুর পোষেন, অ্যালসেশিয়ান, শেফার্ড, শখ করে রক্ষিতা পোষেন, সুন্দরী, শিক্ষিতা। আমারও বড় সুদর্শন, শিক্ষিত, গুণবান ‘রক্ষিত’-এর শখ। বিত্ত থাকলে সত্তর-আশিটি না হোক, ছ’সাতটি ‘রক্ষিত’ পোষা গেলে মন্দ হত না।
‘পতিতা’র পুংলিঙ্গ প্রতিশব্দ হিসেবে ‘পতিত’ এবং রক্ষিতার পুং প্রতিশব্দ হিসেবে ‘রক্ষিত’ এখন সমাজ-সংসারে উচ্চারিত হোক। অভিধানে শব্দ দুটো নতুন অর্থসহ সংযোজিত হোক। অনাচার কেবল এক ক্ষেত্রে কেন, দু’ক্ষেত্রেই হোক। সংবিধানে যখন নারী ও পুরুষের অধিকার সমান, তখন নারী ও পুরুষের দু’জনেরই নিশ্চয় সমান অধিকার যে-কোনও কাজে, কর্মে, ভাবনায়, বিশ্বাসে।
দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গেলে, যে-কোনও বৈষম্য দূর করতে গেলে নারীর প্রথম কর্তব্য স্বনির্ভর হওয়া। স্বনির্ভর না হলে সবার যেমন বাকরুদ্ধ থাকে, পা অচল থাকে, হাত স্থবির থাকে, চেতনাও তেমন ভোঁতা থাকে, এই ভোঁতা চেতনার নারীদের, এই জড়বস্তুদের কাছ থেকে কোনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আশা করা আর খচ্চরের মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখা একই কথা
নারী শিক্ষিত হোক, স্বনির্ভর হোক। তবেই সে তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হবে। সে তার প্রাপ্য অর্জনের জন্য উদ্যোগী হবে। তা না হলে কী তার প্রাপ্য এবং কী নয় তা সে নিজেই জানবে না। যা অধিকাংশ নারীই এখন জানে না।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন