তসলিমা নাসরিন
এই শহরে, শুধু এই শহরেই বা বলি কেন, বাংলাদেশের প্রতিটি শহরে মেয়েরা নানা রকম কাজ করছে, স্কুল-কলেজে যাচ্ছে, চাকরি করতে, বেড়াতে, বাজার করতে তারা এখন স্বচ্ছন্দ চলাফেরা করছে। মধ্যবিত্ত মেয়েরা তাদের প্রধান বাহন হিসেবে ব্যবহার করছে বাস, টেম্পো, রিকশা ইত্যাদি। আমার প্রশ্ন, মেয়েরা কেন এই দেশে সাইকেল ব্যবহার করে না? সাইকেল চালালে দুটো কাজ একসঙ্গে হয়, যাতায়াতের কাজটি দ্রুত হয় এবং শরীরের বাড়তি মেদের কিছুটা স্খলন হয়।
তবু, এ-দেশের মেয়েরা সাইকেলকে বাহন হিসেবে মেনে নিচ্ছে না। আসলে ‘মেয়েরা মেনে নিচ্ছে না’ কথাটি ঠিক নয়। মেনে নিচ্ছে না আসলে ছেলেরা। ছেলে মানলে তবে তো মেয়ের মানা! সমাজের বড় মাথাগুলো যদি সায় না দেয় তবে কি কোনও মেয়ের সাধ্য আছে যে, সে নিয়ম তৈরি করে! ঢাকা শহরে হাতেগোনা মাত্ৰ দু’একজন মেয়ে সাইকেল এবং মোটর সাইকেল চালায়। তারা কি নির্বিঘ্নে চালায়? না। তাদের সামনে প্রতিবন্ধকতার বিশাল পাহাড়। দু’একটি এন জি ও মেয়েদের মোটর সাইকেল চালাতে বাধ্য করছে। প্রথমে অবশ্য কথা ছিল মেয়েরা সাইকেলে চড়ে আশেপাশের গ্রামগুলোয় কাজ করতে যাবে। গ্রামের মাতব্বররা এতে বাধা দিল। বলল——অসম্ভব, মেয়েরা সাইকেল চালাবে আমাদের চোখের সামনে। আর আমরা তা বসে বসে দেখব?’ গ্রামের ছেলেছোকরারা মেয়েদের গায়ে ঢিল ছুড়ল, মেয়েদের গাল দিল। এন জি ও-র লোক গিয়ে গ্রামের লোকদের বোঝাল, শেষ পর্যন্ত গ্রামের লোকরা রাজি হল—ঠিক আছে, মোটর সাইকেল চলবে, কিন্তু সাইকেল চলবে না। মেয়েদের মোটর সাইকেল চালাবার অনুমতি দেওয়া হল, কিন্তু সাইকেল চালাবার নয়। দুটোই কিন্তু সাইকেল, দুটোই দু’চাকার, দুটোতেই বসতে হয়, দুটোই গতিসঞ্চার করে। তবে কেন একটি অনুমতি পায় এবং অন্যটি পায় না? আসলে এর ব্যাখ্যা একটিই—সাইকেলে দু’পা আন্দোলিত হয়, যা মোটর সাইকেলে হয় না। মেয়েদের দু’পায়ের আন্দোলন নিশ্চয়ই পুরুষের জন্য স্বস্তিকর নয়, তারা নিশ্চয় ভেতরে এক ধরনের অস্থিরতা অনুভব করেন এবং তৃষ্ণার্ত হন।
মেয়েদের শরীরের আন্দোলন গ্রহণ করার যোগ্য হয়ে ওঠেনি এখনও এই দেশ, শুধু এই দেশই বা বলি কেন—ইসলামের গন্ধযুক্ত যে-কোনও দেশই। ‘হাসিবা বুলমেরকাহ’ আলজিরিয়ার মেয়ে। নব্বই সালের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ইসলামি মৌলবাদীরা পার্লামেন্টে বসেছে, সামরিক বাহিনীর কারণে এখনও তারা দেশ শাসন করতে পারছে না, কিন্তু শোষণ করছে দেশ—ইসলামের শোষণ। হাসিবা বুলমেরকাহ এবারের অলিম্পির্কে সোনা জিতেছেন। আলজিরিয়ার ইতিহাসে এটিই অলিম্পিকের প্রথম ট্র্যাক ও ফিল্ড পদক। অথচ এই অলিম্পিকে আসতে হাসিবাকে বাধা দিয়েছিল আলজিরিয়ার মৌলবাদী দল। হাসিবা পৃথিবীর সকল সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আলজিয়ার্সের রাস্তায় যখন আমি ট্রেনিং করি, তখন অনেকেই আমাকে থুতু দেয়, পাথর ছোড়ে। অপরাধ, মুসলমান মেয়ের নগ্ন পায়ে দৌড়োনো। কনস্টানটাইনে পাহাড়ের নীচে জঙ্গলের মধ্যে গিয়ে এক সময় দৌড়োতাম। ভয় হত, মৌলবাদী নেতারা না আমার কোনও ক্ষতি করে দেন। মেয়ে হয়ে আমি কোনও অপরাধ করিনি। দৌড়োবই বা না কেন? ওদের বিরুদ্ধে আমার এটাই প্রতিবাদ। আমার সঙ্গে ট্রেনিং করত ইয়াসিয়া হাজিজি, হেপ্ট্যাথলিট। একজন পথচারী ওকে পতিতা বলায় ট্রেনিং-ই ছেড়ে দিল।’
হাত-পা উন্মুক্ত রেখে দৌড়েছিল বলে ইয়াসিয়া হাজিজিকে লোকে পতিতা বলেছে। এই দেশেও একই অবস্থা, যদিও এখানে মৌলবাদী দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। যদিও এই দেশ ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ নাম এখনও ধারণ করেনি। তবু হাত-পা উন্মুক্ত রেখে এখানে চলা বারণ, এখানে জার্সি পরা মেয়েরা বড়জোর দেওয়ালঘেরা মাঠে দৌড়োতে পারে। খোলা রাস্তায় নয় বা খোলা মাঠেও নয়। এখানে নগ্ন পা নিয়ে খেলাধুলা করতে গেলে সমস্যা সৃষ্টি হয়। যে মেয়েরা খোলা পুকুরে সাঁতার কাটে, খোলা মাঠে দৌড়োয়, এখানেও লোকে তাদের দিকে থুতু ছোঁড়ে।
আলজিরিয়ার মেয়ে হাসিবা বুলমেরকাহ তাঁর জিতে নেওয়া সোনাটি উৎসর্গ করেছেন প্রয়াত প্রেসিডেন্ট বুডেফের উদ্দেশে। প্রেসিডেন্ট বুডেফের উদারতাই হাসিবাকে অলিম্পিকের দিকে যাত্রা করবার পথ মসৃণ করেছে। পার্লামেন্টে মৌলবাদী দল চেয়েছিল বিল এনে মেয়েদের খেলা বন্ধ করবে। এখনও পারেনি। এখনও সেই বিল পাস হয়নি। হাসিবা শুধু খেলেই প্রতিবাদ করেনি। সেই উদ্ভট বিলের বিরুদ্ধে, অসভ্য মৌলবাদী নেতাদের বিরুদ্ধে হাসিবা প্রতিবাদ করেই যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘আলজিরিয়ার অসংখ্য মেয়ে আমার মতোই পরদার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। আমার লড়াই ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে। আমি হেরে গেলে ওদের আকাঙ্ক্ষারও মৃত্যু হবে।’
হাসিবা হেরে যাননি। জিতেছেন। আলজিরিয়ার নাম মানুষ মনে রাখবে হাসিবার নাম দিয়ে। মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে হাসিবার সবচেয়ে বড় বিজয় এটিই। যারা মেয়েদের পরদার আড়াল থেকে বাইরে বেরোতে দেয় না, যারা বলে কোরানে কোথাও নেই মেয়েদের খেলাধুলা করবার কথা, যারা বলে মেয়েরা কেবল ঘর-সংসার, স্বামী-সন্তানের যত্ন করবে, যারা বলে মেয়েদের প্রধান কাজ পুরুষের মনোরঞ্জন এবং সন্তান উৎপাদন, এ ছাড়া তার আর কোনও প্রতিভা গ্রহণযোগ্য নয়, তাদের মুখেই এবার থুতু ছুঁড়লেন হাসিবা বুলমেরকাহ। এই মৌলবাদী অপশক্তির গায়েই হাসিবার দ্রুত পায়ের লাথি পড়ল এবার।
হাসিবা বলেছেন, ‘এই পদকটা আমার পাওয়া খুব দরকার ছিল। ধর্ম আর রাজনীতিকে যাঁরা মিশিয়ে ফেলেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠবার জন্য। আমি মুসলিম, মনেপ্রাণে মুসলিম। কিন্তু ধর্মান্ধ নই। এখানে আমার টার্গেট ছিল পদক। এবার লক্ষ্য বিশ্বরেকর্ড। আমি পারবই।’
অন্ধকার-বন্দি আলজিরিয়ার মেয়েদের শেকল খুলে বেরিয়ে আসতে বলেছেন সোনার মেয়ে হাসিবা। তিনি তাঁর দৃঢ়তা, তাঁর অটল, অনড়, অবিচল মনের সাহস ও শক্তি নিয়ে মৌলবাদের খাঁচায় আটকে পড়া মেয়েদের উদ্ধার করবেন। আমরা, মৌলবাদে আক্রান্ত বাংলাদেশের মেয়েরা, হাসিবা বুলমেরকাহর জন্য আমাদের সর্বোত্তম ভালবাসা নিবেদন করছি।
এই বাংলাদেশেও জন্ম হোক অসংখ্য সোনার মেয়ে হাসিবার। তারা পাঁকে পড়া অন্ধকার-জীবন থেকে বেরিয়ে আসুক আলোর অরণ্যে। তারা তাদের শরীর ও মনের সকল শৃঙ্খল ভেঙে, তারা পান থেকে সংস্কারের চুন খসিয়ে হাসিবার মতো জয়ধ্বনি করুক। ধর্ম, সমাজ ও রাজনীতির নিষ্পেষণ থেকে নিজেদের মুক্ত করে এবার তারা সত্যিকার বাঁচুক।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন