‘উই শ্যাল ওভারকাম’

তসলিমা নাসরিন

কুসুম নামের এক মেয়ে আমার বাড়িতে কাজ করে, এটিকে সামান্য শোভন করে অবশ্য বলা যায়, কুসুম আমার সংসারের কাজে আমাকে সাহায্য করে। কুসুমের বয়স তেরো বা চোদ্দো। সে, আমি জানি না কোত্থেকে, কিছু আচার-ব্যবহার শিখে এসে প্রায়শ প্রয়োগ করে এখানে। সে, বেশ ক’মাস থেকে লক্ষ করছি, আমার বাড়ির চারদিক থেকে মাইকে যখন আজান শুরু হয়, তখন হাতের সব কাজ ফেলে দৌড়ে চলে যায় কলতলায়, অজু করে এবং বড় নিবিষ্টমনে রান্নাঘরের এক কোণে বসে নামাজ পড়ে। কারও তখন সাধ্য নেই, কুসুমকে দিয়ে অন্য কোনও কাজ করায়। চুলোয় যদি কিছু পুড়ে তখন ছাই হয়ে যায়, কুসুম শব্দ, গন্ধ, ধোঁয়া— সব পেছনে ফেলে আল্লাহ্‌র দরবারে হাত ওঠায়।

একদিন আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই যে তুই পাঁচবেলা নামাজ পড়ছিস, নামাজের সুরাটুরা জানিস তো?

কুসুম মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, দুইটা জানি।

কী কী?

আলহামদুলিল্লাহ আর কুলহুআল্লা

এই সুরাগুলোর অর্থ জানিস? মানে কী বলা হয়েছে এগুলোয়?

কুসুম শুনে আশ্চর্য হল, সুরার যে আবার কোনও অর্থ হয়, সে যেন প্রথম শুনল। সে হঠাৎ তার ভ্রূ কুঞ্চিত করে, আশঙ্কা করে একটি অশোভন কথা তার ওপর ছোড়া হচ্ছে, তাই সে কিছুটা রুষ্ট হয়েই বলে— কী যে বলেন, সুরার আবার অর্থ কী? সুরা তো সুরাই।

তা বটে, সুরা তো সুরাই। সুরার আবার অর্থ কী।

জিজ্ঞেস করলাম, এই যে তুই নামাজ পড়ছিস, কেন পড়ছিস?

কুসুম সরল এবং অকপট উত্তর করল, বেহেশতের জন্য।

কেন? বেহেশতে কী আছে?

কুসুম পা ছড়িয়ে মেঝেয় বসল, অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে বলল– বেহেশতে মাছের কলিজা দিব খাইতে।

মাছের কলিজা খাওয়ার এত শখ তোর? ঠিক আছে, কালই আমি মাছের কলিজা এনে দেব বাজার থেকে।

কুসুম উঠে দাঁড়াল। বেশ প্রত্যয়ের সঙ্গে বলল, দুনিয়ার মাছের কলিজা তো তিতা, বেহেশতের মাছের কলিজা হইল মিষ্টি।

এর পর অবাক হয়ে ওর অনমনীয় গ্রীবার দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আমার আর করবার কিছু থাকে না। কুসুম তার বিশ্বাসের ব্যাপারে অটল, সে মাছের কলিজা খাওয়ার লোভে দিনে পাঁচবেলা নামাজ পড়বেই, তাকে বাধা দেবার সাধ্য কারও নেই।

আজকাল একটি দৃশ্য আমাকে আরও অবাক করে দেয়, তা হল ঝাঁকে ঝাঁকে মসজিদের দিকে ধাবমান তরুণ ও যুবক। আমার শৈশব-কৈশোরে মসজিদের দিকে এত লোক যেতে দেখিনি। যেত বেকার বৃদ্ধরাই, ঠকঠক করে খড়মে শব্দ তুলে অথবা লাঠিতে ভর রেখে রেখে, ধীরে। এখন শুক্রবার জুম্মার নামাজ পড়তে মার্সিডিজ হেঁকে বিত্তবান যান তারকাখচিত মসজিদে, এই বিত্তবানদের অধিকাংশই স্মাগলার, অসৎ ব্যবসায়ী, মিথ্যুক, অত্যাচারী। তাঁরা পাটভাঙা ফরসা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে মসজিদে যান। কেউ যায় চোর, ছিঁচকে চোর— বেরোবার পথে অন্যের জুতো চুরি করে ঘরে ফেরে। আর যান মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সভ্য কিশোর, যুবক, বৃদ্ধ। তাঁদের সকলের প্রার্থনায় বেহেশতে যাবার আকুলতা কিছু থাকেই।

অধিকাংশ বৃদ্ধ তাঁদের জীর্ণ শরীর নিয়ে কবরের আজাবের ভয়ে নীল হয়ে থাকেন, তাঁদের পায়ের আঙুল কুঁকড়ে পুলসেরাত পার হতে কী হয়, কী হয়, কী জানি কী হয় আশঙ্কায়। তাঁরা আখেরাতের ময়দানে নিজের দিকে পাল্লা ভারী করবার সাধনায় রাত্রিদিন বুঁদ হয়ে থাকেন। তাঁদের বিরুদ্ধে আমার কোনও অভিযোগ নেই, জগতে তাঁদের প্রয়োজন ফুরিয়েছে বোধহয়। কিন্তু টগবগে মেধাবী প্রাণবান তরুণেরা? কর্মক্ষম যুবকেরা? ওদের চোখে কেন চিকচিক করবে লোভ, … অলৌকিকের দুর্মর মোহ? এর একটি কারণই আমি আবিষ্কার করেছি— ফ্রাসট্রেশন ফ্রাসট্রেশন, ফ্রাসট্রেশন এবং ফ্রাসট্রেশন। যার বাংলা নাম নৈরাশ্য। চারদিকে নৈরাশ্য এখন। রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে। সমাজের সর্বত্র দুর্নীতি, সমাজের সর্বত্র অব্যবস্থা, বেকারত্বের জাল পাতা— এই জালে আটকা পড়ছে অসংখ্য নির্দোষ তরুণ, দেশের প্রজন্ম সম্পদ। তারা কেউ ছিনতাই করছে, কেউ মাদকদ্রব্য সেবন করছে, কেউ মসজিদে যাচ্ছে। এর মূল কারণ ওই নৈরাশ্য। তারা সততা, সৌন্দর্য, মুক্তবুদ্ধি ও সুস্থ চিন্তাচেতনা অর্জন করেছে কিন্তু কোথাও এর প্রয়োগ নেই। যেখানেই অসততা, অসুস্থতা; ক্ষমতা বা বিত্তের জোর। তরুণেরা তাই নৈরাশ্যে ভুগতে ভুগতে যে- কোনও ধ্বংসের দিকে বাড়াচ্ছে দ্বিধাগ্রস্ত পা। কেউ মাছের মিট্টি কলিজা খাবার আশায়, কেউ পাখির মাংস, ফলমূল, কেউ মদ; আবার কেউ যেতে চায় হুরের আশায়, কেউ দোজখের জাক্কুম গাছের ফল, সাপ বিচ্ছু আর গরম পানির অত্যাচার থেকে বাঁচবার আশায়। এই জগৎ তরুণদের আর কোনও আশা দিতে পারছে না বলে তারা অগত্যা মদ-মাংস খাবার আশার দিকে ধাবিত হচ্ছে। এই দোষ তাদের নয়, এই দোষ আমাদের অসৎ, লোভী ও মূর্খ রাজনীতিবিদদের, এই দোষ অথব রাষ্ট্রকাঠামোর, সমাজব্যবস্থার।

দেশে মাদকদ্রব্য-সেবনকারী বাড়ছে। বাড়ছে নৈরাশ্য থেকে মুক্তি পেতে আপাতত একটি আশার কাছে সমর্পিত হওয়া— আসলে যেটির ফলাফল আরও চরম নৈরাশ্য।

আমার মনে হয় মাছের কলিজা, মদ-মাংস-হুরের মোহ এবং মাদকদ্রব্যের ছোবল থেকে মানুষ তখনই মুক্ত হবে, যখন এই সমাজ বা দেশ তাদের জন্য বাসযোগ্য হবে। আর এই সমাজ এবং দেশকে বাসযোগ্য করবার দায়িত্ব আমাদের— আমরা যারা মাদক এবং কুসংস্কার দ্বারা এখনও আক্রান্ত হইনি।

সকল অধ্যায়

১. ‘আর রেখ না আঁধারে আমায় দেখতে দাও’
২. আশায় আশায় থাকি
৩. আমাদের বুদ্ধিজীবীরা
৪. আগ্রাসন
৫. নগর-যাপন
৬. ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’
৭. ‘কার নিন্দা কর তুমি। মাথা কর নত। এ আমার এ তোমার পাপ।’
৮. ‘দুঃখরাতের গান’
৯. বৃত্ত
১০. নাগরিক খাঁচা
১১. ‘নিজ বাসভূমে পরবাসী’
১২. সকল সন্তানই বৈধ
১৩. ‘জারজ’ শব্দের বিলুপ্তি চাই
১৪. নারীভোজ
১৫. ‘তৃষ্ণার শান্তি সুন্দর কান্তি’
১৬. ‘মুক্ত করো ভয়’
১৭. ‘সখী, আঁধারে একেলা ঘরে মন মানে না’
১৮. ‘নিশিদিন ভরসা রাখিস’
১৯. ‘আমাদের যাত্রা হল শুরু’
২০. ‘খসিল কি আপন পুরনো পরিচয়?’
২১. ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি’
২২. ঝরে পড়া শিক্ষার্থী
২৩. ‘বজ্রানলে বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে’
২৪. নাস্তিক্যবাদ
২৫. নিজের পায়ে নিজের কুড়োল
২৬. গোটা দুই ‘পতিত’, ছ’সাতটি ‘রক্ষিত’ হলে জমত বেশ
২৭. খারাপ মেয়ের গল্প
২৮. শব্দবাণবিদ্ধ নারী
২৯. থ্রি চিয়ার্স ফর হাসিবা
৩০. ‘বড় বিস্ময় লাগে’
৩১. ‘রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোকে পলাশে’
৩২. ‘মন কেমন করে’
৩৩. বিজ্ঞাপনের নারী
৩৪. ‘কে বলেছে তোমায় বঁধু এত দুঃখ সইতে…’
৩৫. ইসলামি থাবা
৩৬. নিজের গোলা শূন্য
৩৭. ‘নপুংসক’ বিষয়ক
৩৮. ‘MEGALOMANIA, THY NAME IS MAN’
৩৯. ধর্মের কাজ ধর্ম করেছে
৪০. কন্যাজন্মের প্রায়শ্চিত্ত
৪১. অবদমন
৪২. গিনিপিগ
৪৩. হিন্দুর উত্তরাধিকার
৪৪. বাঙালি মুসলমানের দুর্মতি ও দুর্গতি
৪৫. রাজনীতির ফাঁকফোকর
৪৬. নারীর নামপরিচয়
৪৭. কাজ
৪৮. পাকিস্তান-প্রীতি, অলৌকিকতা এবং অভিজ্ঞতা
৪৯. কবরের খবর
৫০. যদি সত্য কথা বলি
৫১. সংসার-চিতা
৫২. অনভ্যাস
৫৩. যে-কোনও নারীই আজ নুরজাহান
৫৪. ঘটনা-দুর্ঘটনা
৫৫. ‘উই শ্যাল ওভারকাম’
৫৬. ‘ভাবনার ভাস্কর্য’
৫৭. ‘একলা চলো রে…’
৫৮. অতঃপর নারী হবে মসজিদের ইমাম
৫৯. ‘ভালবেসে যদি সুখ নাহি…’
৬০. আইন বদল
৬১. প্ৰথা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন