তসলিমা নাসরিন
ভারতের হিন্দু সাকসেশন এক্ট (১৯৫৬) উত্তরাধিকার ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষে কোনও বৈষম্য রাখেনি। হিন্দু পরিবারে জন্ম নেওয়া যে-কোনও সন্তানই, সে পুত্র হোক বা কন্যা হোক, পাবে পিতা বা মাতার সম্পদ ও সম্পত্তির সমান উত্তরাধিকার। ও-দেশে হিন্দুদের বহুবিবাহও আইনত নিষিদ্ধ। এ-দেশের হিন্দুদের জন্য এমন কোনও পারিবারিক ও উত্তরাধিকার আইন নেই যা পুত্র ও কন্যাকে সমান অধিকার দেয় বা বহুবিবাহ বন্ধ করে। দেখা যায়, এ-দেশের কুলীন ব্রাহ্মণরাও এক সময় আশি-নব্বইটি করে বিবাহ করত, এখনও শখ ও সুবিধা হলে তারা ত্রিশ-চল্লিশটি বিবাহের সুখ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করতে চান না। আইন তো আর মাথার ওপর খড়্গা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে নেই যে, তারা সংকোচ করবে। একই রকম বাংলাদেশের মুসলিম বিবাহ আইন পুরুষের একাধিক বিবাহের ক্ষেত্রে প্রথম স্ত্রীর কাছ থেকে দ্বিতীয় বিবাহের অনুমতি নেবার কথা বলে, এ-রকম আইন কিন্তু ভারতের মুসলমানদের ওপর এখনও বর্ষিত হয়নি।
এ-দেশের হিন্দু মেয়েরা পিতার উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত। পুত্ররাই ভাগবাটোয়ারা করে নেয় পিতার সকল সম্পত্তি। হিন্দুশাস্ত্র পুত্রকে পিতার ধনসম্পত্তির একমাত্র অধিপতি বলে রায় দিয়েছে। জীমূতবাহনের দায়ভাগই এ-ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করে। জীমূতবাহন ছিলেন বাঙালি, একাদশ শতাব্দীর লোক। তাঁর দায়ভাগ কেবল এই বাংলাদেশেই প্রযোজ্য হচ্ছে এখন, ভারত তুলনায় সভ্য হয়েছে, তাই ‘দায়ভাগ’-এর রীতিও পালটে ফেলেছে।
যদি শাস্ত্রের কথাই ধরতে হয়, তবে মিতাক্ষরার শাস্ত্র কিন্তু দায়ভাগের মতো অত অনুদার নয়। মাদ্রাজ, বোম্বে, কাশি, মিথিলাতে এক সময় মিতাক্ষরার সমাদর ছিল, জীমূতবাহনের দায়ভাগের নয়। মিতাক্ষরার মতে অধ্যাগ্নি, অধ্যাবাহনিক, অন্বাধেয়, যৌতুক প্রভৃতি বিশেষ বিশেষ ধন হচ্ছে স্ত্রীধন। শ্বশুর-শাশুড়ির কাছ থেকে পাওয়া ধনও স্ত্রীধন। স্ত্রীধনে নারীরই অধিকার। স্বামী তা থেকে কিছু নিলেও পরিশোধ করতে বাধ্য থাকবে।
যাজ্ঞবন্ধ্যের মতে, ‘স্বামী বা শ্বশুর যদি নারীকে স্ত্রীধন না দিয়া থাকেন তবে পুত্রদের সমান অংশ পত্নীকে দেওয়া উচিত’ এবং ‘যদি পিতা সব পুত্রের ভাগ সমান করিয়া দেন তবে সজাতীয় পত্নীদেরও সমান ভাগ দেওয়া উচিত। যদি স্বামী-শ্বশুরের দেওয়া কিছু স্ত্রীধন নারীরা পাইয়া থাকেন তবে যতটা দিলে পুত্রদের সঙ্গে তাহাদের ভাগ সমান হয়, ততটা দেওয়া কর্তব্য।’
মিতাক্ষরাও যাজ্ঞবল্ক্যের মত সমর্থন করেন।
পিতার জীবৎকালে বিভাগ হলে মাতাদের ভাগ সমান হবে। এই কথা বলে যাজ্ঞবল্ক্য বলেন, ‘পিতামৃতেও মাতারা সমাংশভাগিনী হইবে।’
যাজ্ঞবল্ক্য আরও বলেন, “পিতার মৃত্যুর পর সম্পত্তির ভাগকালে মাতাও সমান অংশ পাইবেন।’ নারদও বলেন, ‘স্বামীর মৃত্যুর পর মাতা সমাংশভাগিনী।’ বৃহস্পতি এই কথা মানেন, ব্যাসও সমর্থন করেন।
ব্যাস পিতামহীকেও মায়ের মতো ভাগাধিকার দেবার কথা বলেন। বিষ্ণু বলেন, ‘মাতা এবং অবিবাহিতা কন্যা পুত্রভাগানুসারীভাগহারী।’
বৃহস্পতির মতে, ‘মায়ের ভাগ সমান, কন্যার ভাগ এক-চতুর্থাংশ।’ কাত্যায়নও অবিবাহিতা কন্যার এক-চতুর্থাধিকার সমর্থন করেন। তিনি বলেন, ‘সামান্য সম্পত্তি হইলে কন্যা ও পুত্রদের ভাগ সমানই হইবে।’ অনুদার যে মনু, সেই মনুও বলেন, ‘ভাইরা আপন ভাগ হইতে কন্যাকে ভাগ দিবেন। না দিতে চাইলে ভ্রাতারা পতিত হইবেন।’ মনু এও বলেন, ‘অপুত্রা সাধ্বী পত্নী স্বামীর পিণ্ডদানের ও সম্পূর্ণ অংশের অধিকারিণী।’ বরদরাজ বলেন, ‘ভার্যা অর্ধাঙ্গিনী, পুণ্যাপুণ্য ফলভাগিনী, তিনি বাঁচিয়া থাকিতে স্বামীর ধন কেন অন্যে পাবে।’ শ্রুতির মতে, ‘স্বামী ও স্ত্রী উভয়ে এক পূর্ণ স্বরূপেরই দুই অংশ। ‘
স্ত্রী যদি স্বামীর অর্ধাঙ্গিনী হন, তবে স্বামীর মৃত্যুতে স্ত্রীর মধ্যেই তিনি থেকে যান। থেকে যাবারই তো কথা, তা না হলে আবার অর্ধাঙ্গিনী কীসেরা আর তাই যদি হয় তবে ধনসম্পদ যা আছে, মৃত্যু হলে তার অর্ধাঙ্গেরই তো প্রাপ্য সব
মনু-নারদ উভয়ে বলেছেন, ‘পুত্র যেমন আত্মসম, দুহিতাও তেমনি পুত্ৰসমা, কাজেই আপনার ও পুত্রকন্যার মধ্যে কোনও প্রভেদ নাই। সেই আপনি বাঁচিয়া থাকিতে, অর্থাৎ পুত্রকন্যা থাকিতে, কেন অন্যে ধন হরণ করিবে? পুত্রকন্যা উভয়ে সমান। কাজেই পুত্রাভাবে দুহিতাই পুত্র। পুত্রকন্যা উভয়ে পিতার বংশরক্ষা করে।’
সুতরাং এ-কথা সত্য যে, শাস্ত্র একেবারেই বিরূপ নয় নারীর প্রতি, জগতের মানুষ যত বিরূপ। ‘দায়ভাগ’ তৈরি করেছে একাদশ শতাব্দীর মানুষ। আর এই একবিংশ শতাব্দীর দুয়োরে দাঁড়িয়ে আমরা সকল পুরাতন ঝেড়ে ফেলে কত নতুনকে স্বাগত জানাচ্ছি, পুরনো সমাজ-সংস্কার-স্বভাব ত্যাগ করে নতুন করে গড়ছি, নতুন চেতনায়। জীবনে কত কিছুই তো ছুড়ে ফেলেছি, কেবল শাস্ত্রকেই পারিনি। শাস্ত্র আঁকড়ে ধরে এখন বেঁচে আছে আমাদের অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত এমনকী তথাকথিত শিক্ষিত মানুষ
এ-দেশের হিন্দু সম্প্রদায় এখনও শাস্ত্রের নিয়মে চলছে। কোনও সভ্য আইন তৈরি হয়নি তাদের জন্য। তাদের বহুবিবাহ বন্ধের উত্তরাধিকারের সভ্য আইনটি তৈরি করে হিন্দু নারীদের অন্তত মানুষের মর্যাদা দেবার দাবি জানাচ্ছি সরকারের কাছে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন