অনভ্যাস

তসলিমা নাসরিন

তিনি একজন শল্যচিকিৎসক। নিখুঁত সেলাই করেন মানুষের শরীরের ভেতর এবং বাহির। সিল্ক, নাইলন, ক্যাটগাট ইত্যাদি সুতো সোজা, বাঁকা, বড়, ছোট সুঁইয়ে ভরে তিনি যখন মানুষের পাকস্থলী, অস্ত্র, পিত্তথলি, মাংস, চামড়া সেলাই করেন, তাঁর দক্ষ হাতের কাজ দেখে আমি মুগ্ধ না হয়ে পারি না। কিন্তু এই মানুষটিই, আমি অবাক হয়েছি দেখে তাঁর শার্টের দুটো বোতাম ছিঁড়ে যাওয়ায় স্ত্রীকে ডেকে সেলাই করতে দিলেন, নিজে এক ঘণ্টা বসে রইলেন, কিন্তু বোতাম সেলাইয়ের কাজটি নিজের হাতে করলেন না।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনার সেলাইয়ের হাত এত ভাল, আপনি নিজেই কেন এ কাজটি করলেন না?

শুনে শল্যচিকিৎসক অপমানে লাল হয়ে উঠলেন। বললেন, আপনি আমাকে শার্টের বোতাম লাগাতে বলছেন!

অর্থাৎ এত তুচ্ছ কাজ আপনি আমাকে করতে বলছেন, আপনার স্পর্ধা দেখি কম নয়। তবু আবার বললাম— বোতাম লাগানো, শার্টের ছেঁড়াফেড়া বা কোনও কাপড়চোপড় সেলাইয়ে তো আপনি বেশ ভাল করবেন বলেই আমার বিশ্বাস।

শল্যচিকিৎসক উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, তবে আর ঘরে স্ত্রী আছে কেন? তিনি উচ্চশিক্ষিত মানুষ। কিন্তু মানুষের চামড়া সেলাইয়ের ঘটনাটিকে তিনি ‘স্টিচ’ বলেন, আর ঘরের কাপড়চোপড় সেলাইয়ের ঘটনাকে তুচ্ছার্থে বলেন ‘সেলাই’। ‘স্টিচ’ হচ্ছে পুরুষের কাজ আর ‘সেলাই’ মেয়েদের— এই সংস্কার তাঁর উচ্চশিক্ষার পাশাপাশি তিনি রক্ষা করে চলেছেন, দূর করেননি।

সুঁইয়ের ফোড় কোথাও কোথাও তাঁকে গর্বিত করে, আর কোথাও কোথাও অপমানিত করে। অপমানিত করে কারণ তাঁরা ধরেই নিয়েছেন এটি মেয়েমানুষের কাজ। মেয়েমানুষের জন্য যে কাজগুলো নির্ধারিত তা করতে গেলে অপমানিত হতে হয়। মেয়েরা কি আর মানুষের জাত?

ব্যাংকে চাকরি করেন স্বামী-স্ত্রী। একই বেতন পান, দু’জন একই সঙ্গে অফিসে যান, একই সঙ্গে বাড়ি ফেরেন। কিন্তু বাড়ি ফিরেই স্বামীটি গা এলিয়ে দেন বিছানায়, নয়তো বেড়াতে বেরোন, ক্লাবে যান, তাস পেটান, বন্ধুবান্ধব নিয়ে আড্ডায় মাতেন কিন্তু স্ত্রীটি রান্নাঘরে বাসন মাজেন, ভাত রান্না করেন, তরকারি কোটেন, মশলা তৈরি করেন, রান্না করেন এবং পরিবেশন করেন। তারপর এই রান্না করা জিনিসপত্র খান কিন্তু একজন নয়, দু’জন। স্বামীর থালায় ওঠে মাছ বা মাংসের বড় টুকরোটি। এর কারণ কী?

অর্থনৈতিক জোর? তা তো নয়। টাকা তো কামাচ্ছে দু’জনেই সমান, পদ তো দু’জনের একই, তবে?

এগুলো হচ্ছে সংস্কার। নারী বা পুরুষ যে কাজই করুক, স্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার হলে এবং স্বামী মেথর হলেও রান্নাবান্নার কঠিন কর্মটি স্ত্রীকেই করতে হয় এবং স্বামীকে যত্ন করে ভাল ভাল খাবারগুলো খাওয়াতে হয়। একবার এক সংসারে আমি স্বামী-স্ত্রী দু’জনের উদ্দেশে বলেছিলাম, আপনাদের এই রান্নার কাজটি ভাগাভাগি করে করা যায় না? স্বামী ভ্রূ কুঁচকে বললেন, কীরকম?

বললাম, ধরুন আপনি মশলা বাটলেন, স্ত্রী আনাজ কুটলেন, আপনি মাংসটা কষালেন, স্ত্রী ভাত চড়ালেন— এরকম।

শুনে লোকটি অপমানে লাল হয়ে উঠলেন, যার যেটা কাজ তাকেই সেটা করতে দিন।

স্বামী লোকটি বলতে চাচ্ছেন, রান্নার কাজ আসলে স্ত্রীর কাজ। পুরুষ লোকেরা রান্না জানলেও করা উচিত নয়।

কেন নয়?

আমার এই প্রশ্নের জবাব তিনি দেননি। দেননি কারণ, এর পক্ষে কোনও যুক্তি তাঁর নেই। আছে একটি কেবল সংস্কার— রান্নাবান্না স্ত্রীর কাজ। যদিও বাইরে রান্নার কাজটি বাবুর্চি-পুরুষেরাই করেন, বাইরে সেলাইয়ের কাজটিও পুরুষ-দর্জিই করেন। কিন্তু ঘরের রান্না-সেলাই মেয়েদেরই করতে হয়। বাইরের সাফসুতরো করবার কাজের জন্য পুরুষ-ক্লিনার আছে কিন্তু ঘরের কুক, ক্লিনার, টেইলর হিসেবে নারীই বিনা পারিশ্রমিকে পরিশ্রম করে যান। যেখানে পারিশ্রমিকের প্রশ্ন, সেখানেই পুরুষের নিয়োগ, আর বিনা পারিশ্রমিকের কাজগুলো তোলা থাকে নারীর জন্য। নারীর আর টাকাপয়সার প্রয়োজন কী? তাকে তো খাওয়ায় পরায় পুরুষেরাই। পোষা ময়নাকে যেমন খাওয়ায়-পরায় মনিবেরা— এও ঠিক তেমনই। পাখির জন্য খাঁচা বানানো হয় আর নারীর জন্য বানানো হয় ঘর। পুরুষের পোষ্য এই নারী-প্রাণীটি যেন কোনওরকম স্বাধীনতা অর্জন না করে— তার জন্য সজাগ থাকে সমাজের অতন্দ্ৰ পুরুষ প্রহরী।

ড. গোলাম মুরশিদ লন্ডন থেকে ‘যায় যায় দিন’-এ (১৭ নভেম্বর) চিঠি লিখেছেন। অবদমনের উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, পঙ্গু স্ত্রী নিয়ে দীর্ঘ আঠারো বছর একজন সাংবাদিক সংসার করছেন কিন্তু তিনি আর কোনও নারীকে ঘরে আনেননি। আমার ‘অবদমন’ নামক রচনাটিতে ‘ঘরে আনা’ বা ‘না আনা’র সঙ্গে ‘অবদমন’কে মোটেও মেলানো হয়নি। সেই সাংবাদিক অন্য নারীকে ঘরে না আনলেও, অন্য নারীর ঘরে গিয়েছেন কি না সে-কথা ড. মুরশিদ স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। পঙ্গু স্বামী নিয়ে জীবন কাটানো নারীটিকে কিন্তু কোনও পুরুষকে ঘরে আনবার পরামর্শ আমি দিইনি। ঘরে না আনবার অর্থ অবদমন নয়।

পিতা বা স্বামীর নাম নারীর নামে ধারণ না করলেই লোকে বলে, নারীর মূল সমস্যার সমাধান হবে? মূল সমস্যার কথা লিখুন। ধর্ম নারীকে কত রকম অমর্যাদা করেছে, তা জানালে লোকে বলে অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া নারীমুক্তি সম্ভব নয় সেটিই আগে বলুন। আর অর্থনৈতিক স্বাধীনতার কথা লিখলে বলে যৌনমুক্তি ছাড়া নারীর সত্যিকার মুক্তি নেই, অযথা অন্য কথা লিখে কী লাভ। আর পুরুষতন্ত্রের প্রতিবাদ করতে গেলে লোকে পরামর্শ দেয়, আসলে ধর্ম থেকে নিস্তার না পেলে নারীর স্বাধীনতার জন্য চেঁচিয়ে কোনও লাভ নেই। সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী লোকেরা বলে, ছো এইসব ফালতু কথা লিখে কেবল সময়খরচা, আসল কথা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা নির্মূল না হলে নারী কখনও মানুষ হিসেবে দাঁড়াতে পারবে না।

সকলেই ভাবছে আগে একটি হতে হবে, পরে আপনা-আপনি বাকিগুলো হবে। কিন্তু মাঝখানে আমারও একটি কথা আছে, সেটি হল, যে-কোনও অন্যায় এবং বৈষম্যের প্রতিবাদ করতে হবে, সমস্যা কোনওটি ছোট, কোনওটি বড়, কিন্তু কোনওটি তুচ্ছ নয়। যেহেতু তুচ্ছ নয়, প্রতিবাদ করতেই হবে সমাধান না হওয়া পর্যন্ত। ছোটবড় সকল বৈষম্যের প্রতিবাদ।

আর এই প্রতিবাদ করবার দায়িত্ব আমার একার নয়— সকলের, গার্মেন্টসের শ্রমিক থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত।

চিনদেশে মেয়েদের পায়ে লোহার জুতো পরিয়ে রাখা হত। এর ফলে চিনা মেয়েদের পা আকারে ছোট হয়ে গেছে। সেরকম বহু বছরের শৃঙ্খল তো এখানকার নারীর মনে ও শরীরে, তাদের মনও তাই হয়ে গেছে মরচেপড়া। মরচেপড়া মনে নতুন ভাবনাই আসে না, প্রতিবাদ তো দূরের কথা। অনেকটা খাঁচার পাখির মতো, না উড়তে উড়তে পাখি যেমন উড়বার অভ্যেস হারিয়ে ফেলে, এ-দেশের নারীরাও তাদের চারপাশের খাঁচা ভেঙে বাইরে বেরিয়ে আসবার অভ্যেস হারিয়ে ফেলেছে। অনভ্যাসে তারা প্রতিবাদের ভাষা ভুলে গেছে। আমাদের, যাদের এখনও কণ্ঠরোধ হয়নি, তাদের উচিত চিৎকার করা, ঘুমন্ত নারীর কানে যেন সেই চিৎকার পৌঁছে।

সকল অধ্যায়

১. ‘আর রেখ না আঁধারে আমায় দেখতে দাও’
২. আশায় আশায় থাকি
৩. আমাদের বুদ্ধিজীবীরা
৪. আগ্রাসন
৫. নগর-যাপন
৬. ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’
৭. ‘কার নিন্দা কর তুমি। মাথা কর নত। এ আমার এ তোমার পাপ।’
৮. ‘দুঃখরাতের গান’
৯. বৃত্ত
১০. নাগরিক খাঁচা
১১. ‘নিজ বাসভূমে পরবাসী’
১২. সকল সন্তানই বৈধ
১৩. ‘জারজ’ শব্দের বিলুপ্তি চাই
১৪. নারীভোজ
১৫. ‘তৃষ্ণার শান্তি সুন্দর কান্তি’
১৬. ‘মুক্ত করো ভয়’
১৭. ‘সখী, আঁধারে একেলা ঘরে মন মানে না’
১৮. ‘নিশিদিন ভরসা রাখিস’
১৯. ‘আমাদের যাত্রা হল শুরু’
২০. ‘খসিল কি আপন পুরনো পরিচয়?’
২১. ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি’
২২. ঝরে পড়া শিক্ষার্থী
২৩. ‘বজ্রানলে বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে’
২৪. নাস্তিক্যবাদ
২৫. নিজের পায়ে নিজের কুড়োল
২৬. গোটা দুই ‘পতিত’, ছ’সাতটি ‘রক্ষিত’ হলে জমত বেশ
২৭. খারাপ মেয়ের গল্প
২৮. শব্দবাণবিদ্ধ নারী
২৯. থ্রি চিয়ার্স ফর হাসিবা
৩০. ‘বড় বিস্ময় লাগে’
৩১. ‘রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোকে পলাশে’
৩২. ‘মন কেমন করে’
৩৩. বিজ্ঞাপনের নারী
৩৪. ‘কে বলেছে তোমায় বঁধু এত দুঃখ সইতে…’
৩৫. ইসলামি থাবা
৩৬. নিজের গোলা শূন্য
৩৭. ‘নপুংসক’ বিষয়ক
৩৮. ‘MEGALOMANIA, THY NAME IS MAN’
৩৯. ধর্মের কাজ ধর্ম করেছে
৪০. কন্যাজন্মের প্রায়শ্চিত্ত
৪১. অবদমন
৪২. গিনিপিগ
৪৩. হিন্দুর উত্তরাধিকার
৪৪. বাঙালি মুসলমানের দুর্মতি ও দুর্গতি
৪৫. রাজনীতির ফাঁকফোকর
৪৬. নারীর নামপরিচয়
৪৭. কাজ
৪৮. পাকিস্তান-প্রীতি, অলৌকিকতা এবং অভিজ্ঞতা
৪৯. কবরের খবর
৫০. যদি সত্য কথা বলি
৫১. সংসার-চিতা
৫২. অনভ্যাস
৫৩. যে-কোনও নারীই আজ নুরজাহান
৫৪. ঘটনা-দুর্ঘটনা
৫৫. ‘উই শ্যাল ওভারকাম’
৫৬. ‘ভাবনার ভাস্কর্য’
৫৭. ‘একলা চলো রে…’
৫৮. অতঃপর নারী হবে মসজিদের ইমাম
৫৯. ‘ভালবেসে যদি সুখ নাহি…’
৬০. আইন বদল
৬১. প্ৰথা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন