‘নিশিদিন ভরসা রাখিস’

তসলিমা নাসরিন

কোন খেলা ছেলেদের এবং কোন খেলা মেয়েদের তা ভাগ করেছে কে—আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে। মাঝেমধ্যে আমার মস্তিষ্ককে একটি রবারের গোলাকার পিণ্ড মনে হয়, ইচ্ছে করলেই এটিকে গলিয়ে চ্যাপটা করা যাবে অথবা চৌকো। মাঝেমধ্যে ভেতরটা বড় ফাঁপা লাগে। আমি তখন বুঝতে পারি না, মানুষের জন্য দু’রকম নিয়ম কারা বানায় এবং কেন বানায়।

ছেলেরা ফুটবল খেলবে, ক্রিকেট খেলবে, ছেলেরা লন টেনিস খেলবে, স্কোয়াশ খেলবে, বিলিয়ার্ড খেলবে। আর মেয়েরা খেলবে উঠোনের মাটিতে দাগ কেটে এক্কাদোক্কা, আর পাথর বা ইটের টুকরো তুলে ষোলোগুটি। মেয়েরা লুডো খেলবে ঘরে বসে। ছেলেরা হাডুডু খেলবে বাইরের মাঠে, মেয়েরা পুতুল খেলবে, পুতুলের বিয়ে দেবে, পুতুলকে খাইয়ে-দাইয়ে ঘুম পাড়াবে, সকাল-বিকাল পুতুলের জামা-জুতো পালটাবে, মেয়েরা রান্নাবান্না খেলবে। ইট পিষে লাল মশলা বানাবে, নানা রকম ফুল-পাতা ছিঁড়ে ইটের মশলা দিয়ে মিছিমিছি মাছমাংস রান্না চড়াবে। এই মিছিমিছি খেলায় মেয়েদের উৎসাহ দেয় পরিবারের সবাই। ছেলেরা শীতের সন্ধ্যায় মাঠে আলো জ্বেলে ব্যাডমিন্টন খেলে, ছেলেরা তাস খেলে। মেয়েরা দল বেঁধে গোল্লাছুট খেলে, বউচি খেলে, গোলাপ-পদ্ম খেলে। এই খেলাগুলোর বাইরে মেয়েরা হয়তো অন্য খেলাও খেলে কিন্তু তা ছেলেদের খেলা মেয়েরা খেলছে বলেই বিবেচিত হয়।

আমার প্রশ্ন, যে খেলাকে ছেলেদের খেলা বলে নির্দিষ্ট করা হয়, তা কেন ছেলেদের খেলা? মেয়েরা কি ফুটবল খেলতে, ক্রিকেট খেলতে জানে না? ছোটবেলায় আমি ক্রিকেট খেলতাম, ব্যাট বা বল করবার দক্ষতা আমার চেয়ে বেশি ছিল না বাকি ছেলে খেলোয়াড়দের। ছোটবেলায় আমি মার্বেল, ডাংগুলি, লাটিম খেলতাম, আমার খেলার সঙ্গী মেয়ের চেয়ে ছেলেই বেশি ছিল। আমার জন্ম নানাবাড়িতে, শৈশব-কৈশোর কেটেছে ওখানে, আমার সমবয়সি মামারা ও তাদের বন্ধুরাই ছিল আমার খেলার সঙ্গী। মার্বেলে তাদের হাতের টিপ আমার চেয়ে ভাল ছিল না। লাটিমের ঘূর্ণন আমার হাতের চেয়ে বেশি কারও হাতেই উঠত না।

আমি পুতুল খেলেছি, এক্কাদোক্কা খেলেছি, গোল্লাছুট খেলেছি। আমি ছেলেদের-মেয়েদের খেলাগুলো আলাদা করে বুঝতে পারিনি—কেন এটি ছেলেদের, কেন এটি মেয়েদের নয়। আমি লক্ষ করেছি আমার সেই কিশোর বয়সে আমার হাতে হকিস্টিক, ক্রিকেটের ব্যাট, আমার পায়ে বল দেখলে আমার পড়শিরা হাসত, যেন একটি উদ্ভট কাণ্ড করছি আমি। যেন আমার হাতে পুতুলই মানায়, কড়ি মানায়, ষোলোগুটির গুটি মানায়, এক্কাদোক্কা বা কুতকুত খেলার চ্যারা মানায়। মেয়েরা আসলে সবই খেলতে পারে, মেয়েরা নাভ্রাতিলোভা, পি টি উষা, স্টেফি গ্রাফ, ক্যাপ্রিয়েতি হতে পারে। মেয়েরা রুদ গুলিত, জিকো, রজার মিল্লা, মারাদোনাও হতে পারে। মেয়েরা বাস্কেটবল, সাঁতার, টেনিস, কিংবা দৌড়ে ছাড়িয়ে যেতে পারে প্রতিযোগী ছেলেদের।

অপেক্ষাকৃত হালকা চালের খেলা, যেখানে শারীরিক শ্রম নেই, উত্তেজনা নেই, আনন্দ নেই—সেই খেলাগুলোই মেয়েদের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। আর ছেলেদের জন্য আকর্ষণীয়, উত্তেজক, শারীরিক গতি ও শক্তির খেলাই নির্ধারণ করা হয়। এর কারণ মেয়েদের দুর্বল বলে ভাবা হয়, মেয়েদের ভাবা হয় শরীরে ও মনে নিতান্তই অক্ষম কিছু, পঙ্গু বা বিকলাঙ্গ কিছু—তাই মেধা বা শক্তির প্রয়োজন নেই, এমন খেলাই মেয়েদের জন্য নির্দিষ্ট হয়। তারা ঘরে খেলবে, বড়জোর উঠোনে খেলবে, মাঠ তাদের জন্য নয়, আকাশের নীচ তাদের জন্য নয়, রোদ-বৃষ্টি তাদের জন্য নয়। পুতুলখেলা আর রান্নাবান্নার খেলা খেলতে খেলতে তারা যোগ্য হয়ে উঠবে, তারা অভিজ্ঞ হয়ে উঠবে গৃহস্থালির কাজে। মূলত সংসার জীবনের মহড়া দেবার জন্যই মেয়ে-শিশুকে পুতুল এবং খেলনা-বাসন কিনে দেয় অভিজ্ঞ(!) অভিভাবকেরা। আর ছেলে-শিশুর জন্য কিনে আনে চাবি দিলে সাঁ করে ছুটে যায় এমন গাড়ি, অথবা রিমোট কন্ট্রোল, সনিক কন্ট্রোল ইত্যাদি নানা আকারের, নানা জাতের নতুন প্রযুক্তির গতিসম্পন্ন যন্ত্র। বাল্যবেলা থেকেই মেয়ে-শিশুর মেধাকে দুর্বল, অকেজো ও ঘর-সংসারের তুচ্ছাতিতুচ্ছ কাজে আচ্ছন্ন করে রাখবার জন্য বাসনপত্র ও পুতুল দেওয়া হয়। ছোট পুতুল, বড় পুতুল। কিশোর ছেলেকে দেওয়া হয় বিশাল মাঠ, কিশোর মেয়েকে দেওয়া হয় একচিলতে উঠোন। মেয়ের অঙ্গ ও মেধাকে বন্দি করবার কৌশল হিসেবে খেলাধুলার সীমাবদ্ধতা তৈরি করেছে সমাজ। সমাজের কতিপয় মানুষ।

এ-কথা যে-কোনও বুদ্ধিমানই স্বীকার করতে বাধ্য যে, যে-কোনও খেলাই মেয়েরা খেলতে পারে, মেয়েরা যদি ভলিবল খেলতে পারে, ফুটবল পারবে না কেন? আজকাল মেয়েদের জন্য ফুটবল খেলবার ব্যবস্থা হচ্ছে, অর্থাৎ খেলাটি মেয়েরাই কেবল খেলছে। কেবল মেয়েরাই কেন? মেয়েরা কেন কেবল মেয়েদেরই প্রতিদ্বন্দ্বী করছে খেলতে গিয়ে? কেন ফুটবলের এগারোজনের দলে পাঁচজন মেয়ে, ছ’জন ছেলে নয়? অথবা ছ’জন মেয়ে, পাঁচজন ছেলে? একইভাবে ক্রিকেটেও, একইভাবে হকি এবং বেসবলে? একইভাবে লন টেনিসে? যেখানে নাভ্রাতিলোভা জন ম্যাকেনরোর সঙ্গে, মনিকা সেলেসের সঙ্গে বরিস বেকার, সাবাতিনির সঙ্গে আগাসি প্রতিদ্বন্দ্বিতার খেলা খেলতে নামবে? সেই দিন কত দূরে, যেদিন কেবল মেয়েরা মেয়েদের কিছু নির্দিষ্ট খেলা খেলবে না, ছেলেরাও তাদের নির্ধারিত খেলা খেলবে না?

ছেলেরা-মেয়েরা প্রতিদ্বন্দ্বী হবে সাঁতারে, দৌড়ে, দাবায়, হাইজাম্পে, লংজাম্পে, ওয়েট লিফটিং-এ। ছেলেরা-মেয়েরা একই দলে খেলবে ফুটবল, ক্রিকেট, বিলিয়ার্ড, স্কোয়াশ, ম্যারাথন দৌড়, আইসস্কেটিং, টেবিল টেনিস, ব্যাডমিন্টন

ইন্ডোর গেম ছেড়ে মেয়েরা আউটডোরে যাবে। মানুষের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা যেমন হয়, ছেলেদের সঙ্গে মেয়েদের তেমনই হবে। মেয়েরা নিশ্চয় সাফল্য অর্জন করবে, মেয়েরা নিশ্চয়ই ছেলেদের পেছনে ফেলে দিয়ে এগিয়ে যাবে সমানে। এগিয়ে গিয়ে বিশ্বকাপের কাপ হাতে নিয়ে উল্লাসে নৃত্য করবে।

যারা প্লেয়ার, তারা প্লেয়ারই। লিঙ্গভিত্তিক খেলার অবসান না হলে মেয়েদের দক্ষতাকে কখনও সম্মান করা হবে না। তাই আলাদা-আলাদা দলে ভাগ না করে ছেলে এবং মেয়েকে মানুষ হিসেবে বা প্লেয়ার হিসেবে জার্সি নাম্বার দেওয়া হোক। অঙ্গ বা প্রত্যঙ্গের পার্থক্য জার্সির নীচে হারিয়ে যাক। দক্ষতাই হোক প্লেয়ারের প্রধান পরিচয়।

নারীকে যদি মানুষ হিসেবে সত্যিকার মূল্য দিতে হয়, তবে এই বৈষম্য দূর হোক। সমাজের অলিতে-গলিতে বৈষম্য। ঘরের উঠোনে, মাঠে বৈষম্য। বৈষম্য কোথায় নেই! নারী তার ঘর এবং ঘরের আঙিনা ছেড়ে খেলবার জন্য বিশাল মাঠ খুঁজে নেবে, দেশের মাঠ ছেড়ে বিদেশের মাঠ। গণ্ডিবদ্ধ জীবন ছেড়ে ক্রমশ বিশালতার দিকে তাকে যেতেই হবে যদি সে শক্তিমান মানুষ হিসেবে দাঁড়াতে চায়।

কেউ তাকে সুযোগ দেবে না। সুযোগ নিজেকেই খুঁজে নিতে হবে। নিজের জন্য জায়গা নিজেকেই দখল করতে হবে।

সকল অধ্যায়

১. ‘আর রেখ না আঁধারে আমায় দেখতে দাও’
২. আশায় আশায় থাকি
৩. আমাদের বুদ্ধিজীবীরা
৪. আগ্রাসন
৫. নগর-যাপন
৬. ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’
৭. ‘কার নিন্দা কর তুমি। মাথা কর নত। এ আমার এ তোমার পাপ।’
৮. ‘দুঃখরাতের গান’
৯. বৃত্ত
১০. নাগরিক খাঁচা
১১. ‘নিজ বাসভূমে পরবাসী’
১২. সকল সন্তানই বৈধ
১৩. ‘জারজ’ শব্দের বিলুপ্তি চাই
১৪. নারীভোজ
১৫. ‘তৃষ্ণার শান্তি সুন্দর কান্তি’
১৬. ‘মুক্ত করো ভয়’
১৭. ‘সখী, আঁধারে একেলা ঘরে মন মানে না’
১৮. ‘নিশিদিন ভরসা রাখিস’
১৯. ‘আমাদের যাত্রা হল শুরু’
২০. ‘খসিল কি আপন পুরনো পরিচয়?’
২১. ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি’
২২. ঝরে পড়া শিক্ষার্থী
২৩. ‘বজ্রানলে বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে’
২৪. নাস্তিক্যবাদ
২৫. নিজের পায়ে নিজের কুড়োল
২৬. গোটা দুই ‘পতিত’, ছ’সাতটি ‘রক্ষিত’ হলে জমত বেশ
২৭. খারাপ মেয়ের গল্প
২৮. শব্দবাণবিদ্ধ নারী
২৯. থ্রি চিয়ার্স ফর হাসিবা
৩০. ‘বড় বিস্ময় লাগে’
৩১. ‘রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোকে পলাশে’
৩২. ‘মন কেমন করে’
৩৩. বিজ্ঞাপনের নারী
৩৪. ‘কে বলেছে তোমায় বঁধু এত দুঃখ সইতে…’
৩৫. ইসলামি থাবা
৩৬. নিজের গোলা শূন্য
৩৭. ‘নপুংসক’ বিষয়ক
৩৮. ‘MEGALOMANIA, THY NAME IS MAN’
৩৯. ধর্মের কাজ ধর্ম করেছে
৪০. কন্যাজন্মের প্রায়শ্চিত্ত
৪১. অবদমন
৪২. গিনিপিগ
৪৩. হিন্দুর উত্তরাধিকার
৪৪. বাঙালি মুসলমানের দুর্মতি ও দুর্গতি
৪৫. রাজনীতির ফাঁকফোকর
৪৬. নারীর নামপরিচয়
৪৭. কাজ
৪৮. পাকিস্তান-প্রীতি, অলৌকিকতা এবং অভিজ্ঞতা
৪৯. কবরের খবর
৫০. যদি সত্য কথা বলি
৫১. সংসার-চিতা
৫২. অনভ্যাস
৫৩. যে-কোনও নারীই আজ নুরজাহান
৫৪. ঘটনা-দুর্ঘটনা
৫৫. ‘উই শ্যাল ওভারকাম’
৫৬. ‘ভাবনার ভাস্কর্য’
৫৭. ‘একলা চলো রে…’
৫৮. অতঃপর নারী হবে মসজিদের ইমাম
৫৯. ‘ভালবেসে যদি সুখ নাহি…’
৬০. আইন বদল
৬১. প্ৰথা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন