অতঃপর নারী হবে মসজিদের ইমাম

তসলিমা নাসরিন

চার্চ অফ ইংল্যান্ড নারীকে যাজক হবার অনুমতি দিয়েছে। চার্চের যাজক হবার কোনও অধিকার নারীর ছিল না, চার্চে যাদের কথা বলবারই অধিকার নেই, তারা আবার যাজক হবার অধিকার পায় কী করে! নারী এখন যাজক হবে শুনে একযোগে দেড় হাজার যাজক হুমকি দিচ্ছেন তাঁরা চার্চ অফ ইংল্যান্ড ছেড়ে দেবেন। ভ্যাটিকান থেকেও অনুশাসনবিরোধী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করা হয়েছে।

১৫৩৪ সালে সম্রাট অষ্টম হেনরির উদ্যোগে চার্চ অফ ইংল্যান্ড রোমান ক্যাথলিক চার্চ থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিল। অ্যাংলিক্যানের এমন ঐতিহাসিক রায় শুনে পোপ দ্বিতীয় জন পল জানিয়েছেন, ধর্মীয় অনুশাসন অনুসারে রোমান ক্যাথলিক চার্চ নারীদের প্রিস্ট (যাজক) সম্প্রদায়ভুক্ত করাকে অনুমোদন করতে পারে না। পৃথিবীর সাত কোটি অ্যাংলিক্যান সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের ধর্মীয় নেতা ক্যান্টারবেরি আর্চ বিশপ জর্জ কেরি নারীকে যাজক করবার সিদ্ধান্তকে খুব জোর সমর্থন দিচ্ছেন। ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের নেতা কার্ডিনাল ব্যাসিল হিউম অবশ্য অ্যাংলিক্যান চার্চের এই নতুন বিপত্তির’ পরও মিলিতভাবে প্রার্থনার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

নারীকে যাজক করবার প্রস্তাবটির পক্ষে হাউস অফ বিশপের ভোট পড়ে ৭৫ শতাংশ, হাউস অফ ক্লারজিতে ৭০.৫ শতাংশ এবং হাউস অফ লেইটিতে ৬৭.৩ শতাংশ। আসলে সবচেয়ে বড় কথা, প্রস্তাবটি শেষ পর্যন্ত গৃহীত হয়েছে। বিপক্ষে লোক আছে, সে তো থাকবেই। মেয়েরা মানুষের যোগ্য অধিকার অর্জন করবে- এতে বাধা তো দেবেই সমাজের বিচিত্র পুরুষেরা।

সাড়ে তিনশো বছর পর পোপ স্বীকার করেছেন, গ্যালিলিও ম্যালিলেইকে শাস্তি দিয়ে তাঁরা অন্যায় করেছেন। নারী-যাজক নিষিদ্ধ ছিল চার্চে, সেই নিষেধ উড়িয়ে নারী এখন যাজক হিসেবে চার্চে সম্মানিত।

আশা করছি, নারী এখন মন্দিরের পুরোহিত হবেন, মসজিদের ইমাম হবেন। পুরোহিত এবং ইমাম হওয়া নারীর জন্য এখনও নিষেধ। উপনয়নে নারীর অধিকার নেই, বেদাধ্যয়নে নেই, পৌরোহিত্য করবার অধিকার পাবার তো প্রশ্ন ওঠে না। মসজিদের ইমাম হওয়াও নারীর জন্য ধর্মমতে বৈধ নয়। ইমামতি করবার কাজ নারীর নয়। হাদিসে আছে, নারীর নেতৃত্ব মানলে জাতি ধ্বংস হয়ে যাবে। প্রিস্ট হওয়ার বিপক্ষে কিন্তু একই রকম সংস্কার ছিল।

তবে তো এ নিশ্চয়ই আশা করা যায়, নারীও একদিন ইমামতি করবে দেশের মন্দির-মসজিদে। চার্চ অফ ইংল্যান্ডের সিদ্ধান্ত নারীকে অগ্রগামী করেছে আরও।

তার শত শৃঙ্খলের এক শৃঙ্খল খুলে গেছে, ভেঙে গেছে একটি অনড় দেয়াল, বেঁকে গেছে ধর্মের শক্ত তর্জনী।

আজ জয়োল্লাস করবার দিন নারীর। এক সময় নারীর ভোট দেবার অধিকার ছিল না। এই অধিকারটি নারী পেয়েছে দীর্ঘ আন্দোলনের পর, মাত্র বাষট্টি বছর আগে। আর দীর্ঘ সতেরো বছরের সংগ্রামের পর নারী পেয়েছে চার্চের যাজক হওয়ার অধিকার।

আন্দোলন ছাড়া এ জগতে নারী কিছুই অর্জন করতে পারেনি। মানুষের ন্যূনতম মর্যাদাটুকুও সম্ভব নয় তার অধিকারভুক্ত করা। এই অবস্থায় নারীকে তার প্রাপ্য অধিকার পেতে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে সম্মুখ সমরে। এ ছাড়া মুক্তি নেই। ‘মুক্তি’ কেউ হাতে ধরিয়ে দেবে না, মুক্তিকে খুঁজে বার করতে হবে সকল বাধার পাহাড় ডিঙিয়ে।

মসজিদে নামাজ পড়বার চেয়ে নারীর জন্য ঘরে নামাজ পড়াকেই উত্তম বলা হয়েছে। আর যদি মসজিদেই নামাজ পড়তে হয় তবে পড়তে হবে সবচেয়ে পেছনের কাতারে। নারী চার্চের প্রার্থনাকারী থেকে যাজকে উত্তীর্ণ হয়েছে, নারী পেছনের কাতার থেকেও একদিন নিশ্চয়ই সামনে যাবে। মিলাদ মাহফিল, জানাজা, জুম্মা ইত্যাদি পরিচালনা করবে নারীই। তখন নারীর জন্য এতকালের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধেই জনতা ফুঁসে উঠবে। আমি বলছি না, ধর্মশালা এমন এক পবিত্র জিনিস যা ছোঁবার অধিকার নারীকে দিতেই হবে। আসলে এটি পবিত্রতা-অপবিত্রতার বিষয় নয়, সত্য-মিথ্যের বিষয়ও নয়। ধর্মপালন করে জগতের যে কোনও লাভ হচ্ছে— তাও আমি মানি না। কিন্তু আমার কেবল একটিই দাবি, নারী যেন জগতের সর্বত্র বাড়াতে পারে তার হাত, নারী যেন সর্বত্র বিচরণ করতে পারে দ্বিধাহীন। তার জন্য কোনও নিষেধের বেড়াজাল আমি স্বীকার করি না। মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা মানুষের কল্যাণের প্রতীক নয়, কিন্তু এ-সবের অস্তিত্ব এখনও আছে এই পৃথিবীতে, আর আছে বলেই এ-সবের কর্তৃত্ব করবার অধিকারও থাকা উচিত নারীর, অথচ একতরফা কর্তৃত্ব করছে কেবল পুরুষ।

বৃত্ত আঁকা হয়েছে কেবল নারীর চারদিকেই, তার জন্যই কেবল মাপা গণ্ডি, তার জন্যই শত নিষেধ, তার জন্যই ধরা যাবে না, বলা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না ইত্যাদির নিয়ম এবং নীতি। নারীর জন্যই পাতা থাকে জাল, পাতা থাকে ফাঁদ, নারীর জন্যই গড়া হয় অদৃশ্য শেকল।

চার্চ অফ ইংল্যান্ড থেকে শেকল ভাঙবার শব্দ ভেসে আসছে। বাংলার অসভ্য পুরুষেরা, আপনারা কি তবুও বধির?

সকল অধ্যায়

১. ‘আর রেখ না আঁধারে আমায় দেখতে দাও’
২. আশায় আশায় থাকি
৩. আমাদের বুদ্ধিজীবীরা
৪. আগ্রাসন
৫. নগর-যাপন
৬. ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’
৭. ‘কার নিন্দা কর তুমি। মাথা কর নত। এ আমার এ তোমার পাপ।’
৮. ‘দুঃখরাতের গান’
৯. বৃত্ত
১০. নাগরিক খাঁচা
১১. ‘নিজ বাসভূমে পরবাসী’
১২. সকল সন্তানই বৈধ
১৩. ‘জারজ’ শব্দের বিলুপ্তি চাই
১৪. নারীভোজ
১৫. ‘তৃষ্ণার শান্তি সুন্দর কান্তি’
১৬. ‘মুক্ত করো ভয়’
১৭. ‘সখী, আঁধারে একেলা ঘরে মন মানে না’
১৮. ‘নিশিদিন ভরসা রাখিস’
১৯. ‘আমাদের যাত্রা হল শুরু’
২০. ‘খসিল কি আপন পুরনো পরিচয়?’
২১. ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি’
২২. ঝরে পড়া শিক্ষার্থী
২৩. ‘বজ্রানলে বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে’
২৪. নাস্তিক্যবাদ
২৫. নিজের পায়ে নিজের কুড়োল
২৬. গোটা দুই ‘পতিত’, ছ’সাতটি ‘রক্ষিত’ হলে জমত বেশ
২৭. খারাপ মেয়ের গল্প
২৮. শব্দবাণবিদ্ধ নারী
২৯. থ্রি চিয়ার্স ফর হাসিবা
৩০. ‘বড় বিস্ময় লাগে’
৩১. ‘রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোকে পলাশে’
৩২. ‘মন কেমন করে’
৩৩. বিজ্ঞাপনের নারী
৩৪. ‘কে বলেছে তোমায় বঁধু এত দুঃখ সইতে…’
৩৫. ইসলামি থাবা
৩৬. নিজের গোলা শূন্য
৩৭. ‘নপুংসক’ বিষয়ক
৩৮. ‘MEGALOMANIA, THY NAME IS MAN’
৩৯. ধর্মের কাজ ধর্ম করেছে
৪০. কন্যাজন্মের প্রায়শ্চিত্ত
৪১. অবদমন
৪২. গিনিপিগ
৪৩. হিন্দুর উত্তরাধিকার
৪৪. বাঙালি মুসলমানের দুর্মতি ও দুর্গতি
৪৫. রাজনীতির ফাঁকফোকর
৪৬. নারীর নামপরিচয়
৪৭. কাজ
৪৮. পাকিস্তান-প্রীতি, অলৌকিকতা এবং অভিজ্ঞতা
৪৯. কবরের খবর
৫০. যদি সত্য কথা বলি
৫১. সংসার-চিতা
৫২. অনভ্যাস
৫৩. যে-কোনও নারীই আজ নুরজাহান
৫৪. ঘটনা-দুর্ঘটনা
৫৫. ‘উই শ্যাল ওভারকাম’
৫৬. ‘ভাবনার ভাস্কর্য’
৫৭. ‘একলা চলো রে…’
৫৮. অতঃপর নারী হবে মসজিদের ইমাম
৫৯. ‘ভালবেসে যদি সুখ নাহি…’
৬০. আইন বদল
৬১. প্ৰথা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন