তসলিমা নাসরিন
ছোটবেলায় ইদের চেয়ে বেশি আনন্দ করতাম পুজোয়। দুর্গাপুজো শুরু হত আর আমাদের পাড়ার অন্ধকার গলিগুলো আলোয় ভরে উঠত, গাছের পাতায় পাতায় আলো, বাড়ির দেওয়াল জুড়ে আলো, রাস্তার এক ল্যাম্পপোস্ট থেকে আরেক ল্যাম্পপোস্ট পর্যন্ত তার বেঁধে তার উপর ঝুলিয়ে দেওয়া হত নানা রঙের বাতি। চারদিকে মাইক। ভোরবেলা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত গান হত। এক-একটি প্রিয় গান শুনে লাফিয়ে উঠতাম আনন্দে। মণ্ডপের পেছনে গিয়ে মাইকওয়ালার সঙ্গে গোপনে খাতির জমাতাম, বলতাম—ওই গানটি আবার দিন, ‘আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে’…
পুজো এলে আমাদের পড়ালেখা সব বন্ধ। মাইকে গান হচ্ছে সারাদিন, চারদিকের গানের শব্দে পড়া যে কিছু হবে না, সে বাবাও বুঝতেন। তাই পুজোর সময় বাবাও আর ঘন ঘন পড়া দেখতে আসতেন না। আমরা সারাদিন ছুটে বেড়াতাম। কোন মূর্তি বেশি বড়, কোন মণ্ডপ বেশি সাজানো এ-নিয়ে হইহল্লা, প্রসাদ খাবার ধুম, আরতির উৎসব, সে যে কী ভীষণ আনন্দ ছিল আমাদের। বিসর্জনের দিন আমরাও চোখের জল মুছতে মুছতে ব্ৰহ্মপুত্রের দিকে যেতাম। আমার সেই আশ্চর্য সুন্দর শৈশবকে এখনও বড় ইচ্ছে করে ছুঁয়ে দেখি।
কেবল ইচ্ছে করলেই কি হয়? আমাদের বাড়ির ঠিক উলটোদিকের বাড়ি ছিল স্বপন-সরস্বতীদের, এখন সে-বাড়িতে এসে ঢুকেছে আব্দুস সালাম। পেছনে গৌরীদের বাড়ি কিনে নিয়েছে রইসউদ্দিন। আমাদের বাড়ির পশ্চিমের বাড়িটি প্রফুল্লদের বাড়ি। এখন কেউ নেই আর, প্রফুল্ল নেই, প্রফুল্লর না-থাকা জুড়ে ছিল প্রফুল্লর বউ। ঘিয়ের কৌটো, এলাচ, দারুচিনির কৌটো আগলে আগলে রাখতেন, সব ফেলে একদিন তিনিও চলে গেলেন, মরে কাঠ হয়ে পড়েছিলেন বিছানায়, পড়শিরা খবর পেয়ে ‘বোল হরি হরি বোল’ বলে কাঁধে তুলে তাঁকে শ্মশানে নিয়ে গেল। তাঁর মুখাগ্নি করল পাশের বাড়ির পরিতোষ। তাঁর ঘিয়ের কৌটো পড়ে আছে, পড়ে আছে দারুচিনির কৌটো। উঠোনে বড় বড় ঘাস গজিয়ে গেছে।
পুজোয় অনেকদিন যাই না ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে একলা পড়ে থাকা আমার প্রিয় শহরটিতে। আমি জানি, এখন আর আগের মতো কালীপুজোর উৎসব হয় না, এখন আর সরস্বতী পুজোয় বইখাতা নিয়ে ছেলে-মেয়েরা মণ্ডপে তেমন দৌড়োয় না, এখন আর ঘরে ঘরে লক্ষ্মীপুজোর নাড়ু হয় না, এখন আর আগের মতো ব্ৰহ্মপুত্রে অষ্টমী স্নানের ভিড় হয় না, এখন আর অষ্টমীর বিশাল মেলা বসে না আমপট্টি স্বদেশি বাজার, ছোট বাজারের ফুটপাতে, মাঠে, সিদ্ধেশ্বরীরা কোথায় যেন চলে গেছে, মিঠুদিরা আর নেই, গৌতম নেই, যাদব নেই, নিয়তিদি, মায়াদি, রতনকাকু, শোভা, যমুনাদি, সুধীরদা, শ্যামলদা, কোথায় যেন চলে যাচ্ছে।
শুনেছি, জিনিসপত্র সব বেচে দিয়ে ওরা ভারত চলে যাচ্ছে। সীমান্ত পেরিয়ে ওরা একটি নিরাপদ আশ্রয়ে যাচ্ছে। বাপ-ঠাকুরদার ভিটে ছেড়ে ওরা এক কাপড়ে দেশত্যাগ করছে। ঘরবাড়ি ফেলে ওরা আরেক দেশের উদ্বাস্তু হচ্ছে। লক্ষ লোক দেশ ছেড়ে, নিজের মাতৃভূমি ছেড়ে রাতের অন্ধকারে সীমান্তপ্রহরীকে দুশো-পাঁচশো টাকা ঘুষ দিয়ে কাঁটাতার পার হচ্ছে। পাকিস্তানের বর্বর পশুগুলো বাঙালির লুঙ্গি তুলে পরীক্ষা করত তার ধর্ম। এখনও স্বাধীনতার একুশ বছর পরও বাঙালির লুঙ্গি তুলে পরখ করা হয় তার ভোট দেবার অধিকার আছে কি নেই, চাকরিতে তার পদোন্নতি হবে কি না, তার ঘরদোর লুট হবে কি না।
কেরানিগঞ্জের ভালবাসা সরকার আমাকে জানিয়েছেন, যাঁরা শাঁখা-সিঁদুর পরেন, তাঁদের কাউকে ভোটকেন্দ্রে যেতে দেওয়া হয়নি গত নির্বাচনে। আগের রাতে কারা যেন বাড়ি বাড়ি এসে বলে গেছে, ‘কাল তোরা কেউ ঘরের বার হবি তো গলা কাইট্টা ভাসাইয়া দিমু বুড়িগঙ্গায়।’ ভোট দিতে ভালবাসা যাননি, হরিপদ যাননি, নীলরতন যাননি। নব্বইয়ের দাঙ্গায় লুট হয়েছে দেবব্রতদের ঘরবাড়ি। নারায়ণ বসু রিটায়ার করেছেন, পদোন্নতি হয়নি তাঁর, জুনিয়ররা তাঁকে কবেই টপকে গেছে।
খুব গোপনে এই দেশ কিন্তু বড় নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছে। শেকড় উপড়ে চলে যাচ্ছে দেশের মানুষ। তারা আর ফিরবে না। শেকড়ের গভীর ক্ষত বুকে নিয়ে বেঁচে থাকা এই দুর্ভাগা দেশের দীর্ঘশ্বাস আমাদের গায়ে কি কাঁটার মতো বিঁধবে না? আমরা কি কোনওদিন দগ্ধ হব না অনুশোচনার তীব্র আগুনে?
কল্যাণী মুখার্জি আমার মায়ের মতো ভালবাসেন আমাকে। ছোটবেলায় তাঁর ছোট মেয়ে মিতালি মুখার্জির গানের মুগ্ধ শ্রোতা ছিলাম আমি। বিদ্যাময়ী স্কুলের অডিটোরিয়ামে গানের আসর বসত, মিতালির গান শুনতে আমি সামনের সারিতে গিয়ে বসতাম। সেই মিতালি এখন বড় শিল্পী। আর এই শিল্পীর গর্বিত মা ঘরবাড়ি বিক্রি করে, বাপ-ঠাকুরদা স্বামী-শ্বশুরের ভিটে ফেলে, স্বজন-পড়শি, জন্মজন্মান্তরের গাছপালা, নদী-মাঠ ফেলে চলে যাচ্ছেন সীমান্তের ওই পারে। আমি তাঁর চলে যাওয়ার দিকে অবাক তাকিয়ে আছি; আমার মায়ের সমান মানুষটি তাঁর মায়ামমতার শেকড় উপড়ে নিয়ে চলে যাচ্ছেন, দীর্ঘ জীবনের স্মৃতি এবং স্বপ্ন মাড়িয়ে যাচ্ছেন। তাঁর এই চলে যাওয়ার জন্য দায়ী কি তাঁর দুর্মতি? নাকি অন্য কিছু? তাঁর শাঁখা-সিঁদুর, তাঁর নামের পদবি? অমাবস্যার শব্দে তাঁর হঠাৎ জেগে ওঠা, ঘোর অনিশ্চয়তা, নিদ্রাহীন দীর্ঘ রজনি? ঝিঁঝির ভুতুড়ে ডাক, ঘর লুট, তুলসীতলায় কুডুলের কোপ? কল্যাণী মুখার্জি দু’চোখ বুজলেই শোনেন ‘বোল হরি হরি বোল’ বলে কালীবাড়ি শ্মশানঘাটের দিকে চলে যাওয়া দু’কোটি মানুষের পায়ের শব্দ।
আমি তাঁকে কী বলে ফেরাব? এ তো তাঁরই দেশ—এই দেশ তাঁকে মাটির কামড় দিয়ে আটকাবে কী, তাঁকে তো দেশের মানুষই কামড়াচ্ছে ঢের বেশি। গত পয়লা আগস্ট কলকাতার কলেজ স্কোয়ারে বাঙালি সম্মেলন অনুষ্ঠানে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির সভাপতি প্রখ্যাত সাহিত্যিক অন্নদাশংকর রায় বলেছেন, ‘দেশকে দ্বিখণ্ডিত করা হয়েছে, এর জন্য পরকে দোষ দিতে পারি। কিন্তু লোক বিনিময়ের দুর্মতি এল কোন সূত্র থেকে? এখনও সে-রকম প্রয়াসের অন্ত হয়নি। বাঙালির দুর্গতির মূলে তাঁর দুর্মতি। আর এই দুর্মতি দূর না হলে তাঁর দুর্গতিও দূর হবে না।’
বাঙালির দুর্মতি কবে দূর হবে, আমি জানি না। ওখানকার শওকত ওসমান, রশিদ করিম, শওকত আলি, শফি আহমেদ এখন এখানে—এখানকার বুদ্ধদেব বসু, শ্ৰীপান্থ, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, গৌরকিশোর ঘোষ ওখানে। ‘লোক বিনিময়’ চলছেই। শেকড় ওপড়ানো ক্ষত অধিকাংশের বুকে। রক্তাক্ত হৃদয় তাঁদের। আর সকল জাতির দুর্গতি তো দূর হয়, কেবল বাঙালির হয় না।
আমরা এক ‘নেশন’ ছিলাম। দুই ধর্মবিশ্বাসের মানুষকে সাতচল্লিশে দুই ‘নেশন’ বলে রায় দেওয়া হল। এক বোম্বেওয়ালা মুসলমান ক্ষমতার লোভে এক নেশনকে দুই নেশনে ভাগ করল, ভাগ করল দেশ, প্রদেশ। সাতচল্লিশের পাপ আমরা ধুয়ে ফেলেছি একাত্তরে। একাত্তরে আমরা দেখিয়েছি ধর্ম কখনও জাতিগঠনের ভিত্তি নয়।
বাঙালির জাতীয়তাবাদের জন্য আমরা এখনও লড়াই করছি, বাঙালির কৃষ্টি, ঐতিহ্য, বাঙালির শিল্প-সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখবার জন্য সভাসমিতিতে বক্তৃতা দিচ্ছি। অথচ আমাদের বাঙালি স্বজন, বাঙালি পড়শি মাটির মায়া ত্যাগ করে যাচ্ছেন নিরুদ্দেশযাত্রায়। তাঁদের আমরা বেঁচে থাকবার ন্যূনতম নিশ্চয়তাটুকু দিতে পারি না। আর এদিকে ‘বাঙালি’ বলে আমরা গর্ববোধ করি। বাঙালি কি আদৌ কোনও মানুষের জাত?
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন