তসলিমা নাসরিন
সেদিন একটি ঝকঝকে টয়োটা স্প্রিন্টার হাতের কাছে পেয়ে মন নেচে ওঠে। শহরের প্রিয় রাস্তাগুলোয় নিরুদ্দেশ ঘুরে বেড়াই, গাড়ির ভেতর গান ছেড়ে দিই—“আমি কান পেতে রই,’শান্তিদেবের খোলা গলা আমাকে বিহ্বল করে রাখে। হাতে স্টিয়ারিং, ডান পায়ে চাপ দিই একস্যালেটরে, বাঁ হাতে আলতো করে বদলে দিই গিয়ার। গতি চিরকালই আমাকে আকর্ষণ করে, গতিহীন স্থবির জীবনে আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।
ব্যবহারের জন্য কোনও গতিময় যান আমার নেই। হঠাৎ হঠাৎ কোনও স্বজন বা বন্ধু থেকে টয়োটা বা মার্সিডিজ পেলে আমি গতির সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে দেখি, দেখি জীবন যদি টপ গিয়ারে আশি কিলোমিটার স্পিডে পার করতে পারি—তবে কতদূর বেশি পৌঁছোতে পারি ঠেলা বা মানুষচালিত তিন চাকার সাইকেল রিকশার চেয়ে।
মানুষের তো নিয়মই এই, মানুষ এগোবে বেশি, কম সময়ে। আমাদের সময় বড় মাপা, বিজ্ঞান অনেক দূর অগ্রসর, এই দরিদ্র দেশের মানুষেরা আমরা অগ্রসর বিজ্ঞানকে ছুঁতে পারি না। আমরা পিছিয়ে পড়া হতশ্রী মানুষ। যানজট পেরিয়ে আমার কর্মক্ষেত্রে যেতে, যা বড়জোর দু’কিলোমিটার পথ, সময় লাগে প্রায় দেড় ঘণ্টা। মানুষ এখনও দু’পায়ে চাকা চালিয়ে মানুষ বহন করে। এ এক অদ্ভুত যান, রিকশা। সভ্যতা বোধহয় তৃতীয়ে বিশ্বে থমকে দাঁড়িয়ে থাকে, সম্ভবত এখানকার যানজটে সভ্যতা আটকা পড়েছে।
যানজটে, নাকি অশিক্ষার জটে? ভুল রাজনীতি ও ভুল অর্থনীতির জটে? ভুল ধর্মের জটে? সভ্যতা আটকা পড়েছে আসলে এসবেরই জটে। এই যে স্টিয়ারিং ছিল আমার হাতে, আমাকে চারদিক থেকে দেখছিল ওরা, রিকশাওয়ালা, রিকশা-আরোহী, মোটর সাইকেল চালক, বেবি-ট্যাক্সিচালক ও আরোহী, পথচারী সকলে আমাকে দেখে হাসছিল, কেউ শিস দিচ্ছিল, কেউ অশোভন মন্তব্য করছিল, কেউ ছুড়ছিল গালি, অশ্লীল বাক্য। আমি ওদের দৃষ্টি, শব্দ, বাক্যবাণে বিদ্ধ হতে হতে ভাবছিলাম—এ কীরকম দেশ, কীরকম তার মানুষ, দেশটিকে যত দেখি তত অবাক হই। সেই জন্ম থেকে আমার বিস্ময়ের ঘোর কাটে না।
আমাকে কেউ সাইড দিতে চায় না সামনে যাবার জন্য। ইনডিকেটর জ্বললেও আমাকে কেউ জায়গা দিতে চায় না এগোবার। সকলে ভিড় করে আমাকে দেখে। আসলে আমাকে দেখে না, আমার নাক-চোখ-মুখ-চুল সবই তো আর দশটি মানুষের মতোই দেখতে—-আসলে ওরা মেয়েমানুষ দেখে। মেয়েমানুষের হাতে স্টিয়ারিং- এই অদ্ভুত কাণ্ডটি ওরা দেখে। দেখে ওদের বড় আনন্দ হয়, যেন চিড়িয়াখানার বাঁদর দেখছে, যেন শিম্পাজিকে দেখছে মানুষের মতো খোসা ভেঙে বাদাম খেতে। আমি বুঝি, ওরা মেয়েমানুষের এই অদ্ভুত আচরণে বড় মজা পায়, মেয়েমানুষ যে পুরুষের মতো স্টিয়ারিং হাতে নিতে পারে তা দেখে ওরা কেউ বিস্মিত হয়, কেউ রাগ হয়, কেউ নাক সিটকে ব্যঙ্গ করে।
আমি ধলেশ্বরীর দিকে যাই, বুড়িগঙ্গা ব্রিজের ওপর দিয়ে ধলেশ্বরী নদীর দিকে চলে গেছে সবুজ বৃক্ষে ছাওয়া দীর্ঘ নির্জন পথ। লোকালয় ছেড়ে ওই নির্জনতার দিকে যেতে যেতে মনে হয় এখনও সবুজ গ্রামের মধ্যেই বোধ হয় আছে সততা ও সরলতা। সভ্যতার ক্লেদ বোধহয় ওদের মধ্যে ততটা নেই, যত আছে কলকারখানার ধুলো ও ধোঁয়ার নাগরিক জীবনে। যেতে যেতে মনে হয় আমি যদি গতিময় হতে চাই, কোথায় হব? নাগরিক ব্যস্ত পথে—নাকি নির্জন শ্যামল গ্রামে?
আমার গতিময় জীবনকে বারবারই আটকে দিচ্ছিল নাগরিক যান ও যানযাত্রীরা। বৃক্ষ আমাকে ছায়া দিচ্ছে, হাওয়া দিচ্ছে, শহর পেরিয়ে এসে দেখি মাল্টিস্টোরিড নগরের চেয়ে স্নিগ্ধ সবুজই আমাকে সম্ভাষণ জানাচ্ছে বেশি। আমি প্রকৃতির প্রতি নত হই, নম্র হই, মগ্ন হই।
একসময় গাড়ি এসে থামে ধলেশ্বরীর পাড়ে। নেমে হাঁটতে থাকি সূর্যাস্তের দিকে। আমাকে ভিড় করে দেখে বালক-বালিকারা, যুবকেরা, প্রৌঢ়রা। তাদের জিজ্ঞাসা— আমি কে? এখানে কী চাই?
বলি, দেখতে এসেছি ধলেশ্বরী দেখতে কেমন?
ওরা অবাক হয়—জল তো দেখতে সব একই, নদীর জল, পুকুরের জল, টিউবওয়েলের জল, কোনও জলে কি পার্থক্য আছে কোনও?
না, সব জল হয়তো একই, যে পাত্রে যায়, সে পাত্রের রং ধরে। তবু ধলেশ্বরী- ধলেশ্বরী কি অনেকটা ব্রহ্মপুত্রের মতো? গোড়ালি ভেজালে ঢেউ এসে চুম্বন করে পায়ে? ধলেশ্বরী কি তেমন প্রাণবান প্রেমিক? সূর্যাস্তের আলো ধলেশ্বরীর জলে খেলা করে—সেদিকে তাকিয়ে থাকি, কিন্তু স্নায়ু আমাকে উদাস হতে দেয় না, নিবিড় হতে দেয় না, ওরা সব ভিড় করে আমার কাপড়চোপড় দেখে, চুল দেখে, মুখের কথা দেখে, হাঁটা দেখে, হাসি দেখে, দৃষ্টি দেখে।
ওদের জিজ্ঞাসা—আমি মেয়েমানুষ, আমি বাইরে এসেছি কেন? আমার চুল ছোট কেন? আমি একা কেন? আমি গাড়ি চালাচ্ছি কেন?
এ-সবের উত্তর আমার দিতে ইচ্ছে করেনি। ওরা একটু-একটু করে ঘিরে ধরছিল আমাকে, আমি ওদের থাবা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে আমার যানযন্ত্রের দিকে এগোলাম। স্টার্ট দিচ্ছি, ওরা কেউ ঢিল ছুড়ছে, কেউ চড় দিচ্ছে, কেউ কিল দিচ্ছে স্প্রিন্টারের ধাতব শরীরে। আমার মনে হল স্প্রিন্টারের ধাতব শরীরে নয়, ওরা আমার শরীরে দিচ্ছে চড়, কিল, ঢিল। আমার শরীরে এসে লাগছে ওদের ছুড়ে দেওয়া অবজ্ঞা।
ওদের জিজ্ঞাসা, মেয়ে হয়ে আমার এত পুরুষের মতো ঢং কেন? পুরুষেরা গাড়ি চালাবে, পুরুষেরা একা ঘুরবে, সূর্যোদয় দেখবে, সূর্যাস্ত দেখবে। মেয়েদের এ-সব সাজে না, মেয়েরা এ-সব করলে লোকে তাদের পাগল বলে, পেছনে ভিড় জমে ওঠে ঢিল ছোড়া বালকদের।
নগর আমাকে গ্রহণ করেনি। সুজলা-সুফলা গ্রামও নয়। ফিরে এসে নিজের বাড়ির গেটে জোরে ব্রেক কষি। যান নয়, যানজট নয়, আসলে এত গতি মেয়েদের মানায় না। এত গতি মেয়েরা ধারণ করুক—তা কেউ চায় না। সমাজের লোকেরা মেয়েদের পথে অসংখ্য গতিরোধক বসিয়েছে। মেয়েরা যেন স্থির হয়, স্থবির হয়, মেয়েরা যেন দুরন্ত না হয়, দুর্দান্ত না হয়, অপ্রতিরোধ্য না হয়। মেয়েরা যেন গতিহীন স্থবির বসে চুল বাঁধে, রান্না করে, ঠোটে লিপস্টিক মাখে, গালে পাউডার ঘষে আর স্বামীর অপেক্ষা করে—এর বাইরে বেরোলে প্রকৃতি হয়তো তাকে গ্রহণ করে, মানুষ কিন্তু করে না। মানুষ তাকে ছি ছি বলে। মানুষ তাকে দুয়ো দেয়।
যে মেয়েই তার জীবনে গতিসঞ্চার করে সেই দেখি জোরে ব্রেক কষে বসে। আমি কার জন্য দুঃখ করব, থেমে থাকা মেয়েদের জন্য? নাকি যারা মেয়েদের থামায় সেই বর্বরদের জন্য? কার জন্য?
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন