তসলিমা নাসরিন
পাঁচতারা হোটেলে ‘লেডিস টয়লেট’ পরিষ্কার করেন এমন এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে সেদিন আলাপ হল আমার। জিজ্ঞেস করলাম, বেতন কত পান? তিনি যা বেতন বললেন, চিকিৎসকের চাকরি করে আমি তার চেয়ে কম পাই। সংসারে কে কে আছে জিজ্ঞেস করাতে বললেন, তিন ছেলে-মেয়ে এবং এক স্বামী। স্বামী কী করেন? না, স্বামী কিছুই করেন না। সাত বছর যাবৎ বিছানায় শোয়া। বিছানায় শোয়া, কারণ তিনি পঙ্গু। সাত বছর আগে কী এক অসুখে শরীরের ডান অর্ধেক অবশ হয়ে গেল—সেই থেকে ভদ্রমহিলাই চাকরি করে সংসার চালাচ্ছেন। ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া শেখাচ্ছেন, স্বামীকে খাওয়াচ্ছেন, পরাচ্ছেন, চিকিৎসা করাচ্ছেন।
জিজ্ঞেস করলাম, একা আপনিই সংসারের সব খরচ বহন করছেন, স্বামীর বাবা-মা-ভাই-বোনেরা বহন করছে না? না, তারা করছে না। একা ভদ্রমহিলার কাঁধেই সকল দায়িত্ব। জিজ্ঞেস করলাম, আপনাদের যৌনজীবন? ভদ্রমহিলা অবাক চোখে তাকালেন আমার দিকে। সম্ভবত এই প্রশ্ন তাঁকে কেউ করেনি কখনও, এই যে এক পঙ্গু স্বামী থাকে ঘরে, যৌনজীবনে ব্যর্থ এক পুরুষ—এই অক্ষম পুরুষ নিয়ে দীর্ঘ সাত বছর তিনি কীরকমভাবে বেঁচে আছেন—কেউ তাঁকে জিজ্ঞেস করেনি। ভদ্রমহিলার বুকের ভেতর এবং তাঁর পঁয়ত্রিশ বছরের শরীরের প্রতি লোমকূপে যে অসম্ভব এক কষ্ট বাসা বেঁধেছে—সেই কষ্টের দরজা-জানালা যেন সেদিন হাট করে খুলে যায় সব। বললেন, আমার স্বামী যে অক্ষম প্রাণী। সেই আটাশ-উনত্রিশ বছর বয়স থেকে যৌনজীবন যাপন করি না।
বিয়ে করেননি কেন?
স্বামীকে কোথায় ফেলি?
ধরুন, আপনার যদি এ অবস্থা হত, সাত বছর চলনশক্তিহীন হয়ে পড়ে থাকতেন ঘরে, তবে কি আপনি মনে করেন আপনার স্বামী আবার বিয়ে করত না?
মাথা নাড়েন ভদ্রমহিলা, নিশ্চয় করত, নিশ্চয় করত।
তবে আপনি কেন করেননি?
বাচ্চাকাচ্চা আছে। এদের যে অসুবিধে হত!
ঠিক আছে, বিয়ে না করলেন, শরীরকে কষ্ট দিচ্ছেন কেন? প্রয়োজনে একে তৃপ্ত করছেন না কেন?
ভদ্রমহিলা জিভে কামড় দিলেন, বললেন–ছি ছি তা কী করে হয়?
আপনার স্বামী কি সুস্থ অবস্থায় থাকলে এ-রকম একা কাটাত? সাত বছর? সাত বছর কি সে একজন পঙ্গু স্ত্রীকে ভালবেসে সন্ন্যাস যাপন করত?
ভদ্রমহিলা ভাবলেন। ভ্রূকুঞ্চিত হল তাঁর। বললেন—অসম্ভব।
তবে আপনার বেলায় তা সম্ভব হচ্ছে কেন? আমি বুঝিয়ে বললাম, সম্ভব হচ্ছে কারণ আপনি হচ্ছেন এই সমাজের ‘মেয়েমানুষ’। সমাজের মেয়েমানুষদের ‘যৌন অবদমন’ করা ‘অবশ্যকর্তব্য’—যদি সে অবিবাহিত হয়, যদি সে বিধবা হয়, যদি তালাকপ্রাপ্তা হয়, তালাকদাতা হয় এবং বিবাহিত হলে স্বামী যদি নপুংসক হয়, অথবা যৌনসঙ্গমে যে-কোনও কারণেই হোক, যদি স্বামী অক্ষম হয়—তবে।
সমাজের মেয়েমানুষেরা এ-সব ক্ষেত্রে যদি যৌন অবদমন না করেন তবে আর রক্ষে নেই। তাই রক্ষে পাবার আশায় আমাদের ভদ্রমহিলাটি সাত বছর কোনও ‘পরপুরুষ’কে স্পর্শ করেননি। পঙ্গু-অথর্ব স্বামী নামক জীবটিকে খাইয়ে-পরিয়ে বেশ বাঁচিয়ে রাখছেন। সমাজের লোকেরা বাহবা দিচ্ছে। ভদ্রমহিলার যৌন অবদমন সমাজের চোখে এখন বেশ ‘সতীসাধ্বী স্ত্রীর কাজ, ‘পুণ্যের কাজ’, ‘বেহেশত নসিব’-এর কাজ। পুরুষেরা সম্ভবত এমন অদ্ভুত ‘যৌন অবদমন’-এর বাধ্যবাধকতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। ‘যৌন অবদমন’ নারীর জন্য বাধ্যতামূলক হলেও পুরুষের জন্য নয়।
সারা দেশে রোগী বাড়ছে। গ্রামেগঞ্জে, শহরে, নগরে ইউনানি ও আয়ুর্বেদ চিকিৎসা কেন্দ্র যেমন বাড়ছে, তেমন বাড়ছে এদের রোগীসংখ্যা। দেশব্যাপী এদের প্রচার এবং প্রসার। এদের রোগীদের রোগের লক্ষণ এ-রকম—অতিরিক্ত সহবাসে বা হস্তমৈথুনে পুরুষাঙ্গ নরম ও রগ ঢিলা হবে। পুরুষাঙ্গ আকারে ছোট বা বেঁটে, আগা মোটা, গোড়া চিকন হবে। হঠাৎ গরম হয়ে আবার ঠান্ডা হবে। স্ত্রী-মিলন ২/১ মিনিটের অধিক স্থায়ী হবে না। ঘনঘন স্বপ্নদোষ, ধাতু তরল, প্রস্রাবের আগে-পরে নির্গত হবে, প্রস্রাবের যন্ত্রণা …ইত্যাদি।
যেহেতু রোগী বাড়ছে, সেহেতু আমাদের অনুমান করতে অসুবিধে হয় না, যৌনজীবনে জটিলতাও বাড়ছে। এ-দেশের মানুষকে যৌনশিক্ষায় শিক্ষিত করবার নিয়ম নেই। অধিকাংশ মানুষ নানা রকম ‘তেল, তাবিজ, বটিকা, সুধা’র ওপর নির্ভর করে আছে। যেহেতু রোগী বাড়ছে, সেহেতু আমাদের অনুমান করতেই হবে যে, যৌন অবদমনকারী নারীর সংখ্যাও সে হারে বাড়ছে।
কেবল নারীর বেলায়ই অবদমন। নারীই যেন দায়িত্ব নিয়েছে শরীর ও মনের স্বাভাবিক বাসনা অবদমনের। তাঁকে ‘দেবী’ বানানো হয়, ‘সতী’ বানানো হয়, ‘লক্ষ্মী’ বানানো হয়—বানিয়ে তাঁকে পুজো করা হয়, সম্মান করা হয়, মর্যাদা দান করা হয়; যেন পুজো বা সম্মানের লোভেই নারী দেবীসতীলক্ষ্মী হয়ে বেঁচে থাকে। তাবৎ ‘শুচিতা’ যেন একাই তাঁর অঙ্গে ধারণ করতে হবে। পুরুষেরা রমণীর ‘শুচির সমুদ্রে অবগাহন করে প্রভুত্বর আনন্দ লাভ করে। পুরুষকে ‘আনন্দদান’ করবার দায়িত্ব নারীর ওপরই যেহেতু বর্তেছে সেহেতু পুরুষের ‘সুখ ও শখ’ মেটাতে ‘সতীলক্ষ্মীদেবী’ হতে হয়, হতে হয় ‘পূতপবিত্র’।
সমাজের পুরুষেরা অর্থাৎ কর্তারা নারীর যৌন অবদমনকেই নারীর ‘পবিত্রতা’ বলে রায় দিয়েছে। পুরুষেরা চায় স্বচ্ছ জলে সাঁতার কাটতে। ঘোলা জলে তাদের আরাম নেই। শরীর-মন ঘিনঘিন করে। নারী হচ্ছে জলের মতো। নারীকে স্বচ্ছ বানাবার জন্য পুরুষের তৈরি সমাজের কৌশলের অন্ত নেই। পুরুষের ‘কালিকলঙ্ক’ নিজের ভেতর ধারণ করে নারী ‘ঘোলা’ হয়, আর ‘ঘোলা’ হলেই তাকে গাল দেয় পুরুষ, ‘ঘোলা’ জল ত্যাগ করে পুরুষেরা তখন নতুন কোনও স্বচ্ছ জলে ‘ডাইভ’ দেয়। এই তো নিয়ম।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন