তসলিমা নাসরিন
১
দু’সপ্তাহ আগে ‘বিচিন্তা’র এক সাক্ষাৎকারে স্বনামখ্যাত হুমায়ুন আজাদ নিজের স্তুতি এবং অপরের নিন্দা করে সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন। কবিকুলের ঢালাও নিন্দা করতে গিয়ে আমার নামটিও তালিকা থেকে বাদ দেননি। তিনি নির্দ্বিধায় বলেছেন, আমি নাকি এখনও কবি হয়ে উঠিনি। এতে অবশ্য আমি দুঃখ করিনি সামান্যও। কারণ নির্মলেন্দু গুণের প্রেমের কবিতাগুলোকে বলেছেন, ‘ব্যক্তিগত কামনা-বাসনা থেকে উঠে আসা’। এ ছাড়া কবি বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন কেবল নিজেকে এবং নিজের দু’একজন খাতিরের লোককে। এই যদি হয় কে কবি এবং কে কবি নয় তা বিচার করবার স্পর্ধা—তবে আমি যে এখনও কবি হইনি, সে আমার সৌভাগ্য।
তো এই হুমায়ুন আজাদই গতকাল বইমেলার এক স্টলে আমার একটি ইংরেজি অনুবাদ-কবিতার বইয়ের পৃষ্ঠা উলটে দেখছিলেন এবং বলছিলেন, ‘সেই কবিতাটির অনুবাদ নেই, সেই যে, সাতসকালে খড় কুড়োতে গিয়ে, আমার ঝুড়ি উপচে গেছে ফুলে, এত আমার কাম্য ছিল না তো?’ অনুবাদক পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন, বললেন——নেই।’ হুমায়ুন আজাদ বললেন——তা তো থাকবেই না, ভাল কবিতার অনুবাদ কেউ করে না।’
তাঁর এই কথায় আমি অবাক হয়ে বলি, ‘আমার কবিতাকে আপনি ভাল বলছেন? আজাদ বললেন—‘আপনার অনেক কবিতাই আমার বেশ ভাল লাগে।’
এবার আমি হেসে উঠলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘তবে যে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন তসলিমা নাসরিন এখনও কবি হয়ে ওঠেনি?”
ভাষাবিদ হুমায়ুন আজাদের কণ্ঠে এরপর কোনও ভাষার খেলা দেখিনি। সম্ভবত তিনি প্রস্থানের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। দ্রুত প্রস্থান না করলে এই প্রৌঢ় লোকটিকে ‘বালক’ বলেও বিদ্রূপ করা যেত। কারণ আমি এবং হুমায়ুন আজাদ দু’জনই যখন এক পত্রিকায় কলাম লিখতাম, আমাদের দু’একদিন যা কথা হয়েছে, তাতে তিনি যে আমার কলাম নিয়মিত পড়েন তা বেশ স্পষ্ট করে জানিয়েছেন; মাঝে আমি ক’মাস লিখিনি বলে একদিন উপদেশও দিলেন—‘লেখা বন্ধ করবেন না, লিখে যান, লিখে যান।
তো এই হুমায়ুন আজাদই যখন তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘তসলিমা নাসরিনের কলাম হয়তো বালক-বালিকারা পড়তে পারে, আমার জন্য নয় ওর কলাম,’ তখন কি আমার বলতে ইচ্ছে করে না যে, তবে আপনি ‘বালক’ নিশ্চয়ই?
২
কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা বাংলা অ্যাকাডেমির একজন উপ-পরিচালক। তিনি মেলা- পরিচালনা কমিটির অন্যতম। সতেরোই ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় মেলায় কিছু সন্ত্রাসী একটি অশ্লীল বাক্য লেখা ব্যানার নিয়ে হাঁটে। এই খবর শুনে যে-কোনও দুর্ঘটনা এড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন মুহম্মদ নুরুল হুদা। আমার জন্য একটি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে তিনি সন্ত্রাসীদের সতর্ক করতে মেলাপ্রাঙ্গণ প্রদক্ষিণ করেন। তাঁর দায়িত্বশীলতা আমাকে মুগ্ধ করে।
অথচ একদিন তিনি বলে বসলেন, “ও-সব নেহাতই বানানো বা সাজানো ঘটনা ছিল।’ অর্থাৎ অশ্লীল ব্যানার নিয়ে হাঁটা, স্টলের বই ছিঁড়ে ফেলা, স্টলে আমার বই যেন না রাখা হয়—এই হুমকি দেওয়া—সবই ছিল বানানো জিনিস! কার বানানো? আমার? আমি আমার জন্য এত সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্রের জাল বুনেছি?
বুদ্ধিজীবী এখনও হইনি তাই বুদ্ধিও খোলেনি আমার, তা না হলে নিজের স্বাদের জন্য যে মাঝেমধ্যে নিজের জন্য ফাদও পাতা যায় তা আমি কিছুটা হলেও জানতাম।
৩
কথাসাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক আমাকে কন্যা বলে পরিচয় দিতেই বেশি পছন্দ করতেন। লেখাপ্রসঙ্গে উৎসাহ সব সময় এভাবেই দিতেন যে—লিখে যাও, আমি আছি বা আমরা আছি তোমার পাশে। পাশে তিনি সব সময় থাকেন বা ছিলেন কিন্তু যখন সত্যিকার পাশে থাকবার সময়, যখন তাঁর কন্যা বা একজন লেখকের ওপর শারীরিক আক্রমণের প্রতিবাদ করবার সময়, তখন তিনি গা বাঁচিয়ে দূরে চলে যান।
পাশে আমাদের বুদ্ধিজীবীরা থাকেন, তবে সব সময় নয়। দুঃসময় এলেই কন্যা যে সত্যিকারের কন্যা নয়, বা এ যে বানানো একটি ডাক, নিজের প্রয়োজনেই কেবল এই পরিচয়কে ব্যবহার করা তা তিনি পাশে না থেকে, পাশ কাটিয়ে গিয়ে বুঝিয়ে দিলেন।
৪
মানুষের জীবন খুব অল্প সময়ের। এ অল্প সময়ে মানুষ নানা রকম মানুষ দেখে। আমাদের বুদ্ধিজীবীরা মানুষ নন, ‘মহামানব’ গোছের কিছু হবেন। আমার মনে হয় মানুষ দেখা বা চেনার চেয়ে ‘মহামানব’ চেনা খুব আরামদায়ক। কারণ আমাদের বুদ্ধিজীবীরা প্রায়শ এত ‘চমকপ্রদ’ এবং ‘অসামান্য’ ঘটনার জন্ম দেন যে ‘মানুষের’ সাধ্য নেই তা ঘটায়। বুদ্ধিজীবীদের আর কিছু না থাক, এ-কথা স্বীকার করতেই হয় যে ‘বুদ্ধি’ আছে। তবে এই বুদ্ধিগুলোয়, দুঃখ এই যে, সারল্যের চেয়ে চাতুর্য বেশি।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন