তসলিমা নাসরিন
১
আপনার স্ত্রী কী করেন? স্বামীকে প্রশ্ন করলে, অথবা স্ত্রীকে প্রশ্ন করলে আপনি কী করেন—প্রায়ই একটি উত্তর পাওয়া যায়, উত্তরটি হল—‘হাউজওয়াইফ’। বাংলায় এর অর্থ দাঁড়ায় গৃহবধূ। পেশা হিসেবে গৃহবধূত্ব ঠিক কোন পর্যায়ের তা আমার এখনও বুঝে ওঠা হয়নি।
গৃহভৃত্যত্ব এক ধরনের পেশা। গৃহভৃত্য ও গৃহবধূকে পেশাজীবী হিসেবে আলাদা স্থান দেওয়া হয়, কিন্তু গৃহস্বামীকে নয়। গৃহস্বামিত্বকে কোনও পেশা বলে মনে করা হয় না। একজন বেকার গৃহস্বামীকে কখনও পেশার পরিচয় ‘গৃহস্বামী’ দিতে হয় না। যদিও ‘হাউজওয়াইফ’-এর পেশা এ-দেশে বেশ জনপ্রিয়।
গৃহবধূ তাঁর পারিশ্রমিক পান শাড়ি, গহনা, দু’বেলা ভাত-তরকারি ইত্যাদি। বিনিময়ে রান্নাবান্না, ঘর গোছানো, কাপড় ধোয়া, বাচ্চা লালন, বাচ্চা পড়ানো ইত্যাদি কাজ করতে হয়। নিজের হাতে না করলেও অন্তত পরিচালনা তো করতেই হয়। ভৃত্যের কাজও প্রায় একই। ভৃত্য এবং ভার্যা শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ যেহেতু এক, কাজের ধরনও তাই এক। তবে ভৃত্যের যেটুকু স্বাধীনতা আছে, ভার্যার তা নেই। ভৃত্য যখনতখন ঘর ছাড়তে পারে, ভার্যা পারে না। ভার্যার আছে একশো রকম শৃঙ্খল। ভৃত্যের আছে যখন যেখানে খুশি সেখানে চলে যাবার অবাধ স্বাধীনতা। . ভার্যার সামনে বৃত্ত আঁকা—পরাধীনতার, সীমিত চলাচলের।
২
‘স্বামী’ শব্দের অর্থ প্রভু, মনিব, মালিক, অধিপতি। আমাদের শিক্ষিত, সচেতন মেয়েরা তাঁদের বিবাহিত বন্ধুকে ‘স্বামী’ বলতে কোনও দ্বিধা করেন না। তাঁরা নিঃসংকোচে তাঁদের বিবাহিত বন্ধুকে প্রভু, মনিব, মালিক বা অধিপতি হিসেবে ঘোষণা করেন। তাঁরা কি জানেন না ‘স্বামী’ শব্দের আভিধানিক অর্থ? তাঁরা যদি তা জানেনই তবে ‘স্বামী’ শব্দটি তাঁরা ব্যবহার করছেন কেন, যেখানে এই শব্দ ব্যবহার করবার অর্থ নিজেদের দাসী প্রমাণ কর।! ‘স্বামী’র স্থলে এমন কোনও শব্দ তাঁদের ব্যবহার করা উচিত, যে শব্দের অর্থ অন্তত প্রভু, মনিব বা মালিক নয়।
‘বিয়ে বসা’ এবং ‘বিয়ে করা’ দু’রকমের ক্রিয়া। বিয়ে বসা মেয়ের বেলায় আর বিয়ে করা ছেলের বেলায়। ছেলে করে, মেয়ে বসে। মেয়ে নিষ্ক্রিয় বসে থাকে আর ছেলেটি করে। ক্রিয়ার এই পার্থক্য ছেলে-মেয়ের বিবাহিত জীবনেও প্রবল প্রভাব ফেলে। বৈষম্যের ব্যবস্থাগুলোও তাই বেশ ঘটা করে করা হয়। ছেলেরা ঘরের বার হবে, কাজ করবে, মজা করবে, খেলবে, দুলবে, হাসবে। আর মেয়েরা ঘরে বসে ছেলের প্রতীক্ষা করবে, ঘরে বসে কাঁদবে, গোঙাবে।
মেয়েরা, আমি দেখেছি, নিজেরাই ‘বিয়ে বসা’ শব্দদ্বয় সানন্দে ব্যবহার করেন। শুনে আমি বিস্মিত হই। সচেতন এবং বুদ্ধিমান মেয়েরা, যাঁরা নিজেদের ব্যক্তিত্বকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে চান না, তাঁরা কি ইচ্ছে করলেই ‘বিয়ে বসা’র মতো অনর্থক শব্দকে নির্মূল করতে পারেন না, অন্তত করে নিশ্চয় দেখিয়ে দিতে পারেন যে, তিনি করেছেন, খামোখা বসে থাকেননি।
৪
বাংলাভাষায় একটি অত্যন্ত নোংরা শব্দ আছে, শব্দটির নাম ‘অসতী’। অসতী শব্দের অর্থ ব্যভিচারিণী, ভ্রষ্টা, কুলটা। অসতীর পুংলিঙ্গ প্রতিশব্দ যদি অসৎ ধরা হয় তবে অসতী শব্দের যা অর্থ, অসৎ-এর কিন্তু সেই অর্থ হয় না। অসৎ শব্দের অর্থ মন্দ, অসাধু, সত্তাহীন, অবিদ্যমান। আসলে অসতী শব্দের কোনও পুংলিঙ্গ প্রতিশব্দ নেই, যেমন সতী শব্দের নেই। সতী-অসতী শব্দগুলো স্রেফ মেয়েদের জন্য আলাদা করে রাখা। এই সব শব্দবাণে তাঁদের বিদ্ধ করবার জন্য। মেয়েরা যদি শব্দনিয়ন্তাদের চাতুর্য অনুধাবন করতে পারেন, তবে নিশ্চয় কোনও শব্দবাণেই তাঁরা আর আহত হবেন না।
৫
‘অলক্ষ্মী’ও এমন এক শব্দ। অর্থ হচ্ছে দুর্ভাগ্যের দেবী, দুর্ভাগিনী বা দুর্ভাগ্যদায়িনী নারী। দুর্দশাগ্রস্ত হওয়াকে অলক্ষ্মীতে পাওয়া বলে। শ্রীহীনতা বা দারিদ্র্যকে অলক্ষ্মীর দশা বলে। অলক্ষ্মীরও কোনও পুংলিঙ্গ প্রতিশব্দ নেই। অলক্ষ্মী কেবল নারীর জন্য প্রযোজ্য। পুরুষের জন্য ময়। পুরুষেরা দুর্ভাগ্যের দেবতা হয় না, পুরুষের জন্য মানুষ দুর্দশাগ্রস্ত হয় না, শ্রীহীনতা, দারিদ্র্য পুরুষের প্রতীক নয়।
৬
‘পতিতা’ শব্দের অর্থ ভ্রষ্টা, কুলটা, কুচরিত্র, বেশ্যা। ‘পতিত’ শব্দের অর্থ ভ্রষ্ট, স্খলিত, অধোগত, দুর্দশাপ্রাপ্ত, পাপী। কিন্তু তবুও পতিতা যে অর্থে ব্যবহৃত হয়, পতিত সেই অর্থে নয়। সমাজে পতিতার জন্য আলয় আছে, পতিতের জন্য নেই। মেয়েরা যাঁরা নিজেদের সম্মান সম্পর্কে সচেতন, তাঁরা ‘পতিত’ বলবার রীতি তৈরি করুন সেই পুরুষদের, যারা পতিতাদের দিকে হাত বাড়ায়, যারা ব্যভিচারে অভ্যস্ত। আমার বিশ্বাস, এদেশে ‘পতিত’ খুঁজতে গেলে ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়’-এর অবস্থা হবে।
৭
যেহেতু এখনও ভোগের বস্তু হিসেবে নারীর মূল্যায়ন হয়, যেহেতু ঘর ও উঠোনেই নারীকে বন্দি করা হয়, তাই গৃহ থেকে ‘গৃহিণী’, রমণ থেকে ‘রমণী’, অঙ্গন থেকে উদ্ভূত ‘অঙ্গনা’ শব্দ নিয়ে কারও কোনও আপত্তি দেখি না।
নারীকে আমি ভোগের বস্তু বলে ভাবি না, ‘মানুষ’ ভাবি। নারীর জন্য কোনও শৃঙ্খল আমি স্বীকার করি না—তাই নারীর নাম হিসেবে ব্যবহৃত এই অশ্লীল গৃহিণী, রমণী, অঙ্গনা শব্দগুলো নিষিদ্ধ করতে বলি।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন