কন্যাজন্মের প্রায়শ্চিত্ত

তসলিমা নাসরিন

কন্যাজন্মের প্রায়শ্চিত্ত

আমার বাবা আজকাল প্রায়ই মৃত্যুর কথা বলেন, আমি তাঁর শিয়রের কাছে নতমুখে দাঁড়িয়ে থাকি, তিনি ক্ষীণকণ্ঠে বলেন—আমি বোধহয় আর বেশিদিন বাঁচব না, মা। বাবার রক্তচাপ বেশি. ডায়াবেটিসও বেশি। বয়সও হয়েছে বেশ। তাঁর দুই পুত্র, দুই কন্যাকে প্রায়ই তিনি আজকাল কাছে পেতে চান। দুই কন্যা মেলে, দুই পুত্র কিন্তু সহজে মেলে না। দুই পুত্রের সময় নেই বাবার অসুস্থ শরীরের পাশে ঘনিষ্ঠ দাঁড়াবার, দুই পুত্রের সময় নেই বাবার মনের দিকে দৃষ্টি ফেরাবার। বাবার সঙ্গে সুখদুঃখের গল্প করবার। শৈশব-কৈশোর একবার ছুঁয়ে দেখবার।

কেবল আমাদের দু’বোনেরই দেখি যত মায়া আর মমতা। দু’বোনই থাকি বাবার যে কোনও আনন্দ বা বিষাদের কাছাকাছি। দু’বোনই ভালবাসার হাত বুলিয়ে দিই বাবার ক্লান্ত কপালে। তাঁর যে-কোনও অসুখে আমরাই রাত পার করি, না ঘুমিয়ে।

আমার বাবা প্রায়ই মৃত্যুচিন্তায় মগ্ন হন। তাঁর সন্তানদের আর্থিক, সামাজিক সুখকামনায় তিনি অস্থির হন। তাঁর দু’পাশে দাঁড়িয়ে থাকে তাঁর স্নেহের কন্যা দু’জন। তিনি তাঁর পুত্রদের জরুরি খবর দিয়ে কাছে ডাকেন, পুত্রদের সঙ্গে তাঁর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি নিয়ে আলোচনা করেন, কেবল পুত্র দু’জনের সঙ্গেই, সেখানে কন্যারা কিন্তু বাঞ্ছিত নয়, তাঁর দুই পুত্রকে তিনি তাঁর জমির দলিলপত্র কোথায় কী আছে দেখান। তাঁর দুই পুত্র জমিজিরেতের আলাপশেষে যে-যার বাড়ি চলে যায়। সম্ভবত তারা স্বপ্ন দেখে খোলা জায়গায় চমৎকার সব বাড়ি বানাবার, সম্ভবত তারা তৃষ্ণার্ত হয় রাতারাতি অঢেল সম্পদের অধিকারী হবার। সম্ভবত তারা কামনা করে না, অসুস্থ বিছানা থেকে বাবা আবার সুস্থসবল উঠে দাঁড়ান।

আমরা দু’বোন কিন্তু চাই বাবা আরও দীর্ঘ দীর্ঘ বছর বেঁচে থাকুন। বাবা আমাদের সঙ্গে বেড়াতে যান দূরের সমুদ্রতীরে। বাবা আমাদের সঙ্গে হাসি-গানে-আড্ডায় কাটিয়ে দিন দীর্ঘ জীবন, কোনও পরবে-উৎসবে বাবা আমাদের কোলের কাছে বসিয়ে পুরনো দিনের গল্প করুন।

বাবা তাঁর দুই কন্যাকে স্নেহ করছেন বেশি। কিন্তু তিনি জানেন তাঁর জায়গা, জমি, সহায়, সম্পদ বেশিরভাগ চলে যাবে দু’পুত্রের হাতে। কন্যারা সামান্য কিছু পাবে কি পাবে না। যদি বাড়িঘর, জমিজমা কারও প্রয়োজন হয় সে তাঁর দু’কন্যারই, দু’পুত্রের টাকাও অঢেল, জমিও আছে, অভাব নেই সম্পত্তি বা সম্পদের। আমরা দু’বোনই জীবনের স্রোতের তোড়ে নোঙরহীন ভেসে আছি। অথচ আমরাই কম পাব, পাবে ওরা বেশি, যাদের আছে।

আমরাই সর্বহারাদের দলে। যারা পায়, তারা পেয়েই যায়, সেই বেশি পায়, আছে যার ভূরিভূরি।

আমি সেদিন এক পিতাকে দেখেছি ক্ষুব্ধ। তাঁর এক কন্যা। তিনি তাঁর সকল সম্পত্তি কন্যাকে লিখে দিতে চান। কারণ কন্যা জন্মাবার দোষে এ-দেশের আইন উত্তরাধিকার আইনে চলে যায় পিতার ভাইয়ের দিকে। এই পিতা চান তাঁর সম্পত্তি তাঁর সন্তানের থাক। তিনি তাই রেজিস্ট্রি করে কন্যার নামে লিখে দিতে চান সব। না লিখে দিলে তাঁর সম্পত্তি সাত ভূতে লুটে খাবে। অথচ রেজিস্ট্রি করলে শতকরা দশ ভাগ ট্যাক্স দিতে হয়। ধরা যাক, সম্পত্তির মূল্য এক কোটি টাকা, এক্ষেত্রে রেজিস্ট্রি ফি লাগবে দশ লাখ টাকা। কন্যা জন্মেছে বলেই পিতাকে দশ লাখ টাকা দণ্ড দিতে হচ্ছে। যদি পুত্র জন্মাত তবে এক কোটি টাকার সম্পত্তি সেই পুত্রকে পেতে হলে দশ লাখ টাকার এই বাড়তি খরচটুকু নিশ্চয়ই পিতাকে করতে হত না।

সন্তান একটি হলেই যথেষ্ট, সে পুত্র হোক অথবা কন্যা হোক। এটি আমাদের সরকারি স্লোগান। সরকার একদিকে কন্যাকে সন্তানের মর্যাদা দেবার বাণী আওড়াচ্ছে, আরেক দিকে রেজিস্ট্রি ফি-ও নিচ্ছে। কন্যা কেন পিতার সম্পত্তির সবটুকু পাবে না, যদি না-ই পায় তবে পিতা যদি তাকে লিখে দিতে চান সব সম্পত্তি, তবে কেন দুর্ভোগ পোহাবেন পিতা, এই যদি হয় কন্যাজন্মের ভোগান্তি, সরকার কন্যাকে পুত্রের সমান উত্তরাধিকার দেবে না, পিতা যদি দিতে চান, তাঁকে অর্থদণ্ড দিতে হবে—তবে কেন দম্পতিরা উৎসাহী হবেন কন্যাজন্মে? কেন তাঁরা কন্যাজন্মের পর পুত্রপিপাসু হবেন না? নিশ্চয় হবেন। ওপরে উদারতা দেখালেও ভেতরে তো সেই গলাকাটা সংস্কারের চাকু। যে চাকু এক সময় কন্যা জন্মালে কন্যার গলা কেটে দিত। ভেতরে সেই তো ঘোর অন্ধকার।

কন্যার কল্যাণকামী পিতা আমাকে সেদিন বললেন, ‘আপাতত টেন পার্সেন্ট রেজিস্ট্রি ফি নেওয়াটা তো বন্ধ হোক।’ আমি বললাম, ‘আসলে উত্তরাধিকারের শরিয়তি আইনটি তুলে দেওয়া উচিত। পিতার সম্পত্তিতে কন্যা ও পুত্রের থাকবে সমান অধিকার। আন্দোলন করলে আমরা বড় কিছু চেয়ে মাঠে নামব, তাকালে হিমালয়ের দিকে তাকাব, উইয়ের ঢিবির দিকে তাকাব কেন?’ পিতা নিরুত্তাপ চোখে আমাকে দেখলেন।

পিতা বললেন, ‘একটি পুত্র জন্মালে আমার কোনও রেজিস্ট্রি ফি লাগত না! আমি তো একটি কন্যার পর কোনও পুত্রের প্রয়োজন অনুভব করিনি।’

পিতা চলে যান। আমার কেবলই মনে হয় এই বিবেকবান পিতা কোর্টে তাঁর দশ লক্ষ টাকা কন্যাজন্মের প্রায়শ্চিত্ত ফি দিয়ে এসে একদিন নিশ্চয়ই অনুশোচনা করবেন–কেন একটি পুত্রের জন্ম তিনি দিলেন না!

সকল অধ্যায়

১. ‘আর রেখ না আঁধারে আমায় দেখতে দাও’
২. আশায় আশায় থাকি
৩. আমাদের বুদ্ধিজীবীরা
৪. আগ্রাসন
৫. নগর-যাপন
৬. ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’
৭. ‘কার নিন্দা কর তুমি। মাথা কর নত। এ আমার এ তোমার পাপ।’
৮. ‘দুঃখরাতের গান’
৯. বৃত্ত
১০. নাগরিক খাঁচা
১১. ‘নিজ বাসভূমে পরবাসী’
১২. সকল সন্তানই বৈধ
১৩. ‘জারজ’ শব্দের বিলুপ্তি চাই
১৪. নারীভোজ
১৫. ‘তৃষ্ণার শান্তি সুন্দর কান্তি’
১৬. ‘মুক্ত করো ভয়’
১৭. ‘সখী, আঁধারে একেলা ঘরে মন মানে না’
১৮. ‘নিশিদিন ভরসা রাখিস’
১৯. ‘আমাদের যাত্রা হল শুরু’
২০. ‘খসিল কি আপন পুরনো পরিচয়?’
২১. ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি’
২২. ঝরে পড়া শিক্ষার্থী
২৩. ‘বজ্রানলে বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে’
২৪. নাস্তিক্যবাদ
২৫. নিজের পায়ে নিজের কুড়োল
২৬. গোটা দুই ‘পতিত’, ছ’সাতটি ‘রক্ষিত’ হলে জমত বেশ
২৭. খারাপ মেয়ের গল্প
২৮. শব্দবাণবিদ্ধ নারী
২৯. থ্রি চিয়ার্স ফর হাসিবা
৩০. ‘বড় বিস্ময় লাগে’
৩১. ‘রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোকে পলাশে’
৩২. ‘মন কেমন করে’
৩৩. বিজ্ঞাপনের নারী
৩৪. ‘কে বলেছে তোমায় বঁধু এত দুঃখ সইতে…’
৩৫. ইসলামি থাবা
৩৬. নিজের গোলা শূন্য
৩৭. ‘নপুংসক’ বিষয়ক
৩৮. ‘MEGALOMANIA, THY NAME IS MAN’
৩৯. ধর্মের কাজ ধর্ম করেছে
৪০. কন্যাজন্মের প্রায়শ্চিত্ত
৪১. অবদমন
৪২. গিনিপিগ
৪৩. হিন্দুর উত্তরাধিকার
৪৪. বাঙালি মুসলমানের দুর্মতি ও দুর্গতি
৪৫. রাজনীতির ফাঁকফোকর
৪৬. নারীর নামপরিচয়
৪৭. কাজ
৪৮. পাকিস্তান-প্রীতি, অলৌকিকতা এবং অভিজ্ঞতা
৪৯. কবরের খবর
৫০. যদি সত্য কথা বলি
৫১. সংসার-চিতা
৫২. অনভ্যাস
৫৩. যে-কোনও নারীই আজ নুরজাহান
৫৪. ঘটনা-দুর্ঘটনা
৫৫. ‘উই শ্যাল ওভারকাম’
৫৬. ‘ভাবনার ভাস্কর্য’
৫৭. ‘একলা চলো রে…’
৫৮. অতঃপর নারী হবে মসজিদের ইমাম
৫৯. ‘ভালবেসে যদি সুখ নাহি…’
৬০. আইন বদল
৬১. প্ৰথা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন