‘তৃষ্ণার শান্তি সুন্দর কান্তি’

তসলিমা নাসরিন

এলিজাবেথ ডিউক নামে বিলেতে একটি নামকরা জুয়েলার্স আছে। এতে রবার্ট এডওয়ার্ড, ড্যানিয়েল ইত্যাদি নামাঙ্কিত ব্রেসলেট পাওয়া যায় ছেলেদের জন্য। এ-সব নামের লকেটও পাওয়া যায়। বিলেতের ছেলেরা এখন লম্বা চুল রাখে, শুধু লম্বা চুলই নয়, সেই চুলে তারা বেণিও বাঁধে। গলার হার, কানে মাকড়ি, নাকে নথ, কবজিতে ব্রেসলেট—সবই পরছে তারা। আমার প্রশ্ন, বিলিতি পুরুষদের এই ফ্যাশন এ-দেশে এখনও কেন সংক্রামিত হচ্ছে না? এখানে খুব কম ছেলেদের দেখি চুলের ফ্যাশন করতে, মুখে মেকআপ করতে, ভ্রূ প্লাক করতে, গলার মালা, কানের দুল পরতে। এখানকার জুয়েলার্সগুলো আফজাল, মিলন, হুমায়ুন, হারুন নামের লকেট বা ব্রেসলেট রাখতে পারে, পুরুষেরা সে-সব কিনে গলায় পরবে, কবজিতে পরবে। কানে নানা রকম দুল পরবে। নাকে নথ পরবে। ফ্যাশনের নিয়মই উন্নত বিশ্ব থেকে অনুন্নত বিশ্বের দিকে গড়িয়ে নামা। মাঝেমধ্যেই আমরা লক্ষ করি, শেরাটন, সোনারগাঁও-এর ফ্যাশন শো’তে মেয়েরা বিচিত্র পোশাক পরে মঞ্চের ওপর বিভিন্ন কায়দায় হেঁটে যাচ্ছে। পুরুষের পোশাকেও ফ্যাশন আসছে, একবার চোঙা, একবার ঢলঢলে। টেডি, বেলবটম, এলিফ্যান্ট, ব্যাগি নামের পোশাক তারা পেরিয়ে এসেছে—এখন তাদেরও ফ্যাশন শো প্রয়োজন। তারাও হাল-আমলের পোশাক পরে বড় বড় হোটেলে শরীর দুলিয়ে হাঁটবে। দর্শক হাততালি দেবে। পুরুষেরা মেকআপ করবে, কেশচর্চা করবে। বড় চুল রাখবে, বেণি করবে, অলংকার পরবে। জুয়েলারির দোকানগুলো পুরুষের ভিড়ে ফরে উঠবে। পুরুষের চুলের তেল, শ্যাম্পু, পুরুষের মুখে মাখবার স্নো-পাউডার, ক্রিম, ময়শ্চারাইজার, পুরুষের আফটারশেভ ও সুগন্ধিতে দোকান ছেয়ে যাবে। পুরুষ এবং নারীর সমান ভিড় হবে প্রসাধনীর দোকানে। যা ঘটছে এখন ইউরোপে, তা নিশ্চয় ঘটা উচিত এশিয়াতেও।

সেদিন এক সুদর্শন যুবকের চিবুকের নীচে দেখি সাত-আটটা আঁচিল। বললাম, ‘তোমাকে মোটেও ভাল দেখাচ্ছে না।’ যুবকটি সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের কাছে ছুটে গিয়ে ইলেকট্রিক কটারাইজেশন করে আঁচিলগুলো নির্মূল করে এল, ব্যথা পেয়েছে খুব তবু করেছে, করেছে তাকে ভাল দেখাবার জন্য। যেন তাকে ভাল বলি—এই লোভে। আরও এক যুবককে দেখেছি মেয়েদের সঙ্গে কথা বলবার আগে প্যান্টের পেছন-পকেট থেকে ছোট চিরুনি বের করে তড়িঘড়ি চুল আঁচড়ে নেয়, চুল যে খুব এলোমেলো থাকে তার—তা কিন্তু নয়। চুল আঁচড়াবার কারণ, তাকে আরও ভাল দেখা যাক, সে চায়।

পুরুষ যেহেতু চায় তাকে সুন্দর দেখাক, ‘বেশ সুন্দর লাগছে’ বলে মেয়েরা তার দিকে উড়ো চুমু ছুড়ে দিক তবে কেন এই শহরে পুরুষের সাজগোজের জন্য কোনও বিউটি পার্লার নেই? নিশ্চয় থাকা উচিত। মেয়েদের চুল কাটবার, সাজগোজ করবার পার্লার এই শহরে এখন সংখ্যায় কত তা আমার সাধ্য নেই হিসেব করি। পুরুষের জন্য প্রকাশ্যে সেলুন আছে, গোপনে ম্যাসাজ পার্লারও আছে, কচিকচি মেয়েরা সেখানে বুড়ো পুরুষদের গা-হাত-পা টিপে দেয়। কিন্তু এ তো কোনও কাজের কথা নয়। পুরুষদের সুন্দর হতে হবে। দেখতে সুন্দর। তাদের ফ্যাশন-সচেতন হতে হবে। তাদের অলংকার পরতে হবে। মুখে রং লাগাতে হবে।

সেদিন এক ছেলেকে বললাম, তোমার গায়ে ঘামের খুব গন্ধ, তুমি দুৰ্গন্ধনাশক কিছু ব্যবহার করো। কিছু সুগন্ধির নাম বললাম, সে ইদানীং সেগুলোই ব্যবহার করছে। আরেক যুবক এক শার্ট পরে আমার সঙ্গে তিনদিন দেখা করতে এল, জিজ্ঞেস করলাম, আপনার কি আর শার্ট নেই? যুবকটি পরদিন থেকে নতুন নতুন শার্ট পরে আসে। জুতো কালি করা। প্যান্টে শার্ট ইন করে বেশ ফিটফাট বসে থাকে। আমি প্রায়ই তার নাক, চোখ, চুল, চিবুক, বুক ও বাহুর সৌন্দর্য নিয়ে কথা বলি; তাকে দেখতে ভাল, তার জামা-জুতো ভাল—এইসব প্রসঙ্গ নিয়ে দীর্ঘ, দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করি। যুবকটির ঠোঁট ঘোর কালো, বলি –একটু লাল হলে ভাল মানাত কিন্তু। সে এর পর খানিকটা রংও মাখে গোপনে। এই সব গোপন করবার প্রয়োজন কী? ছেলেদের আলাদা পার্লারের ব্যবস্থা হোক, সেখানে তারা নিজেদের খুঁতগুলো সারাক। কিছু ছেলের আবার মুখভরতি ব্রণ, ওরা মাসে একবার ‘ফেশিয়াল’ করতে পারে। কারও কারও ভ্রূ একেবারে বেশি মোটা, ঘন—ওরা খানিকটা পাতলা করে আসতে পারে। গোঁফগুলোও নানা সাইজে কাটা যায়। অধিকাংশ পুরুষের মুখ থেকে বড় দুর্গন্ধ বেরোয়, মেয়েদের সামনে কথা বলতে গেলে তাদের পৌরুষ আর যথাস্থানে থাকে না, তাই মুখের দুর্গন্ধ দূর করবারও ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন, তাদের পার্লার এ-ব্যাপারে সচেতন হবে, আমার বিশ্বাস।

পুরুষেরা চায় নারী দেখতে সুন্দর হোক। নারীও তেমন চায় পুরুষ সুন্দর হোক, আকর্ষক হোক। পত্রিকায় ‘নারীর সৌন্দর্য’ রক্ষা করবার জন্য একটি বিভাগ থাকে, এদিক থেকে পুরুষকে বঞ্চিত করা কি উচিত? তারা কী করলে, কী পরলে, কীভাবে দাঁড়ালে, হাঁটলে, কী করে বসলে, কথা বললে মেয়েরা পছন্দ করবে তা নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা করবার জন্য দেশের দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় একটি বিভাগ খোলা প্রয়োজন। ছেলেরা নিজেদের সৌন্দর্য সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ এবং তা রক্ষা করতে আরও অজ্ঞ।

কেউ-কেউ এখন স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সচেতন হচ্ছে। সকাল-বিকেল ভুঁড়িওয়ালা পুরুষেরা শহরের উদ্যানগুলোয় হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়োয়, ওদের বেশির ভাগই অবশ্য বুড়ো। যুবকেরা স্বাস্থ্য সম্পর্কে তো নয়ই, নিজেদের রূপ সম্পর্কেও একেবারে উদাসীন।

আমাদের নারীরা নিজেদের রূপ নিয়ে এত বেশি মগ্ন যে, পুরুষেরও যে রূপ আছে তা তারা মোটেও স্বীকার করতে চায় না। নারীর এই স্বার্থপরতা আমাকে বড় আহত করে। পুরুষকে দু’চোখ মেলে দেখতে হয়, তাদের মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত সবকিছুকে দর্শনীয় বস্তু করে তুলতে হয়। পুরুষের মাথায় টাক থাকলে ঘনিষ্ঠ নারীরা তাদের উপদেশ দেন উইগ বা পরচুলা ব্যবহার করতে। তারা যেন টাক ঢাকতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। যেন তারা কখনও না ভাবতে পারে, টাক থাক বা না থাক, তারা এমনিতেই খুব মূল্যবান মানুষ, ইশারা করলেই নারী তাদের হাতের মুঠোয় উপস্থিত হবে। পুরুষদের দুর্বলতাগুলো আঙুল তুলে দেখিয়ে দেওয়া প্রয়োজন, দেখিয়ে দেবার দায়িত্ব কিন্তু নারীর।

পুরুষের কিন্তু হরেক রকম খুঁত। পুরুষেরা নখে ময়লা, দাঁতে ময়লা, গায়ে কালি, মুখে গন্ধ, গালে ব্রণ নিয়েও নিখুঁত সুন্দর, পরিচ্ছন্ন ফুটফুটে মেয়ে দাবি করে অনায়াসে। তা কেন হতে দিচ্ছে আমাদের নির্বোধ নারীরা বুঝি না। পুরুষেরা দু’বেলা স্নান করুক, পুরুষের জন্য নানা রকম সাবান উৎপাদন হোক এবং সেই সাবানের বিজ্ঞাপনে পুরুষের মুখ ব্যবহৃত হোক। পুরুষ এবং পণ্য একইসঙ্গে বিজ্ঞাপিত হোক। নারী কেন একা কেবল বিজ্ঞাপিত? নারী কি তাবৎ রূপ ও সৌন্দর্যের ইজারা নিয়েছে?

পুরুষ দাঁত মেলে হাসবে, টুথপেস্টের বিজ্ঞাপন দেবে, এই মুহূর্তে পেপসোডেন্ট টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনটি স্মরণ করছি এবং বিজ্ঞাপনদাতার সৌন্দর্যের তারিফ করছি। নারীর যদি ইচ্ছে করে পুরুষদের চুলে মুখ ঘষতে, পুরুষকে সতর্ক থাকতে বলছি— সেই চুল থেকে যেন কন্ডিশনারের সুঘ্রাণ পাওয়া যায়। নারী যেন মুগ্ধ হয়। নারীকে মুগ্ধ করবার দায়িত্ব কিন্তু পুরুষের। পুরুষেরা তাই নিজেদের খুঁত নিরাময়ে যত্নবান হোক, পুরুষেরা তাই ঘষেমেজে নিজেদের যোগ্য করে তুলুক। নারী কেন একা সাজবে? পুরুষও সাজবে। যদি ধর্ম দু’জনকে সমান অধিকার দেয়, যদি সমাজ এবং রাষ্ট্র সমান অধিকার দেয়—তা দিচ্ছে বলে অধিকাংশ মানুষেরই বিশ্বাস—তবে পুরুষের কেন সাজবার অধিকার থাকবে না? পুরুষের দু’হাতে জামার সঙ্গে ম্যাচ করা চুড়ি বেজে উঠুক টুংটাং। এদেশের পুরুষেরা আঙুলে আংটি পরছে, চেইন পরছে, কানে দুলও পরছে কেউ-কেউ, তবে চুড়ি পরতে দোষ কোথায়, নাকে নথ পরতেই বা দোষ কোথায়?

সকল অধ্যায়

১. ‘আর রেখ না আঁধারে আমায় দেখতে দাও’
২. আশায় আশায় থাকি
৩. আমাদের বুদ্ধিজীবীরা
৪. আগ্রাসন
৫. নগর-যাপন
৬. ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’
৭. ‘কার নিন্দা কর তুমি। মাথা কর নত। এ আমার এ তোমার পাপ।’
৮. ‘দুঃখরাতের গান’
৯. বৃত্ত
১০. নাগরিক খাঁচা
১১. ‘নিজ বাসভূমে পরবাসী’
১২. সকল সন্তানই বৈধ
১৩. ‘জারজ’ শব্দের বিলুপ্তি চাই
১৪. নারীভোজ
১৫. ‘তৃষ্ণার শান্তি সুন্দর কান্তি’
১৬. ‘মুক্ত করো ভয়’
১৭. ‘সখী, আঁধারে একেলা ঘরে মন মানে না’
১৮. ‘নিশিদিন ভরসা রাখিস’
১৯. ‘আমাদের যাত্রা হল শুরু’
২০. ‘খসিল কি আপন পুরনো পরিচয়?’
২১. ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি’
২২. ঝরে পড়া শিক্ষার্থী
২৩. ‘বজ্রানলে বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে’
২৪. নাস্তিক্যবাদ
২৫. নিজের পায়ে নিজের কুড়োল
২৬. গোটা দুই ‘পতিত’, ছ’সাতটি ‘রক্ষিত’ হলে জমত বেশ
২৭. খারাপ মেয়ের গল্প
২৮. শব্দবাণবিদ্ধ নারী
২৯. থ্রি চিয়ার্স ফর হাসিবা
৩০. ‘বড় বিস্ময় লাগে’
৩১. ‘রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোকে পলাশে’
৩২. ‘মন কেমন করে’
৩৩. বিজ্ঞাপনের নারী
৩৪. ‘কে বলেছে তোমায় বঁধু এত দুঃখ সইতে…’
৩৫. ইসলামি থাবা
৩৬. নিজের গোলা শূন্য
৩৭. ‘নপুংসক’ বিষয়ক
৩৮. ‘MEGALOMANIA, THY NAME IS MAN’
৩৯. ধর্মের কাজ ধর্ম করেছে
৪০. কন্যাজন্মের প্রায়শ্চিত্ত
৪১. অবদমন
৪২. গিনিপিগ
৪৩. হিন্দুর উত্তরাধিকার
৪৪. বাঙালি মুসলমানের দুর্মতি ও দুর্গতি
৪৫. রাজনীতির ফাঁকফোকর
৪৬. নারীর নামপরিচয়
৪৭. কাজ
৪৮. পাকিস্তান-প্রীতি, অলৌকিকতা এবং অভিজ্ঞতা
৪৯. কবরের খবর
৫০. যদি সত্য কথা বলি
৫১. সংসার-চিতা
৫২. অনভ্যাস
৫৩. যে-কোনও নারীই আজ নুরজাহান
৫৪. ঘটনা-দুর্ঘটনা
৫৫. ‘উই শ্যাল ওভারকাম’
৫৬. ‘ভাবনার ভাস্কর্য’
৫৭. ‘একলা চলো রে…’
৫৮. অতঃপর নারী হবে মসজিদের ইমাম
৫৯. ‘ভালবেসে যদি সুখ নাহি…’
৬০. আইন বদল
৬১. প্ৰথা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন