দেশনায়ক – ৪৩

গান্ধীজির উদ্যোগ ও মধ্যস্থতায় সম্মানজনক ও গ্রহণযোগ্য সূত্রের সম্ভাবনার আশা সুভাষচন্দ্র ত্যাগ করেননি। গান্ধীজিকে তিনি লেখেন (৩১ মার্চ), “এই বিপদ থেকে কংগ্রেস ও দেশকে রক্ষা করা আপনারই হাতে। যে-সব মানুষ বিভিন্ন কারণে সর্দার প্যাটেল ও তাঁর গোষ্ঠীর প্রতি বিশেষ রূপে বিদ্বিষ্ট তাঁদের এখনও আপনার ওপর আস্থা আছে এবং তাঁরা বিশ্বাস করেন যে আপনি নৈর্ব্যক্তিক ও নির্দলীয় দৃষ্টিতে সব কিছু বিচার করতে পারেন। তাঁদের কাছে আপনি ‘জাতীয়’ ব্যক্তিত্ব—দল ও গোষ্ঠীর ঊর্ধ্বে—সুতরাং আপনি বিবদমান পক্ষগুলির মধ্যে ঐক্য পুনঃস্থাপন করতে পারেন।” সুভাষের এই আবেদনের উত্তরে গান্ধীজি জানালেন (২ এপ্রিল), “তুমি সম্পূর্ণরূপে স্পষ্ট বক্তা এবং তোমার মতামত স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করার জন্যে আমি তোমার পত্র পছন্দ করি।” কিন্তু এরপরই তিনি তাঁর অননুকরণীয় মিষ্টি ভাষায় সুভাষের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে লিখলেন, “আমি একজন বৃদ্ধ মানুষ, হয়তো আমি ভীরু হয়ে উঠছি এবং কিছুটা অতি সাবধানীও বটে। আর তোমার সামনে রয়েছে যৌবন এবং যৌবন হতে সঞ্জাত বাধাবন্ধহীন আশাবাদ। আমি আশা করি যে তুমি সঠিক এবং আমি ভ্রান্ত। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে আজ কংগ্রেস যে অবস্থায় আছে তাতে তার পক্ষে কার্যোদ্ধার করা সম্ভব নয় এবং উল্লেখ্যভাবে আইন অমান্যও সে করতে পারবে না। সুতরাং তোমার বিশ্লেষণ যদি ঠিক হয় তাহলে আমি অচল হয়ে দাঁড়িয়েছি এবং সত্যাগ্রহের সর্বাধিনায়ক হিসেবেও আমার ভূমিকার অবসান ঘটেছে।” সোজা কথায় গান্ধীজি জানালেন যে সুভাষচন্দ্রের যুক্তি ও বক্তব্য তিনি একেবারেই মানেন না। কোনও বড় রকমের আন্দোলন শুরু করার পরিস্থিতি নেই এবং এরকম চিন্তাও দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয়। যদি সুভাচন্দ্রের ইচ্ছা হয় তিনি নিজেই যা ভাল বোঝেন করুন। তার সঙ্গে তিনি কোনওরকম সম্পর্ক রাখতে চান না।

গান্ধীজির চিঠি ও মনোভাবে গভীরভাবে আহত সুভাষচন্দ্র লিখলেন (৬ এপ্রিল), “আপনি একটি পত্রে মন্তব্য করেছেন যে যাই ঘটুক না কেন আপনি আশা করেন আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ক্ষুণ্ণ হবে না। আমিও সবান্তকরণে এই আশা পোষণ করি। এই প্রসঙ্গে আমি কি বলতে পারি যে জীবনে যদি আমি কোনওকিছুর জন্যে গর্ববোধ করে থাকি, তবে তা এই যে আমি ভদ্রলোকের সন্তান এবং সেজন্য নিজেও একজন ভদ্রলোক। দেশবন্ধু আমাদের প্রায়ই বলতেন—‘জীবন রাজনীতি অপেক্ষা বৃহত্তর’। তার কাছ থেকে সেই শিক্ষা আমি পেয়েছি।” গভীর মর্মাহত, ক্ষুব্ধ, অভিমানী সুভাষচন্দ্র আহত সিংহের মতো গর্জে উঠলেন চিঠির শেষে: “আমাকে আপনি বিশ্বাস করুন মহাত্মাজি, যে গত কিছুদিন ধরে আমি শুধু একটি বিষয়ের জন্যে প্রার্থনা করছি। তা এই যে আমার ও আমার দেশের স্বাধীনতার জন্যে যা শ্রেষ্ঠ পথ সে বিষয়ে আলোকসম্পাত প্রয়োজন ও উপলক্ষ দেখা দিলে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে যাতে মুছে ফেলতে পারি সে জন্যে শক্তি ও প্রেরণা আমি প্রার্থনা করেছি…আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে একমাত্র যে ব্যক্তিসমষ্টি দ্বারা জাতি গঠিত তারা যদি প্রয়োজন দেখা দিলে জাতির জন্যে আত্মোৎসর্গে প্রস্তুত থাকেন তবেই সে জাতি বাঁচতে পারে। এই নৈতিক (কিংবা আধ্যাত্মিক) ‘হারাকিরি’ সহজ জিনিস নয়। যখনই দেশের স্বার্থে প্রয়োজন হবে তখনই মৃত্যুর সম্মুখীন হবার মতো শক্তি ঈশ্বর যেন আমাকে দেন।”

কলকাতায় নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির অধিবেশন শুরু হওয়ার কয়েকদিন পূর্বে (২৩ এপ্রিল, ১৯৩৯) সুভাষচন্দ্র এক জনসভায় পুনরায় জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার জন্যে আবেদন জানান। আসন্ন অধিবেশনে গণ্ডগোল ও বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা আছে এবং তার জন্যে অধিবেশনে দর্শকদের প্রবেশের অনুমতি দেওয়া উচিত হবে না, এরকম মন্তব্য ও প্রচারের উল্লেখ করে তিনি সকলের কাছে বিভিন্ন প্রদেশ থেকে আগত প্রতিনিধিদের রাজকীয় সম্মান জানাবার অনুরোধ জানান। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন যে বর্তমান বিতর্কে কোনও প্রাদেশিক প্রশ্ন জড়িত নয়। সমস্যাগুলির চরিত্র সর্বভারতীয়। সকলকে জাতীয়তাবোধের ভিত্তিতে চিন্তা করতে হবে।

শেষ মুহূর্তেও আশা ছিল যে, গান্ধীজি ও জওহরলালে সঙ্গে আলাপ আলোচনার ফলে সঙ্কটের অবসান হবে। নতুন ওয়ার্কিং কমিটি গঠিত হওয়ার অন্তরায় দূর হবে। কিন্তু গান্ধীজির সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা নিষ্ফল হয়। ৩০ এপ্রিল সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস সভাপতির পদ ত্যাগ করেন। জওহরলাল সুভাষচন্দ্রকে পদত্যাগ পত্র প্রত্যাহার করার আনুরোধ জানিয়ে এক প্রস্তাব উত্থাপন করেন। নেহরুর প্রস্তাব ছিল যে, পুরনো ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যরাই নতুন কমিটিতে থাকবেন। কিন্তু কমিটিতে শীঘ্রই দু’টি আসন শূন্য হবে। ওই দুটি পদে সুভাষচন্দ্র তাঁর মনোনীত দু’জন প্রার্থীকে নেবেন। রফি আহমদ কিদোয়াই ও জয়প্রকাশ নারায়ণ নেহরুর প্রস্তাব সমর্থন করেন। সে দিনের মতো অধিবেশন মুলতুবি রাখা হয়। পরের দিন সুভাষচন্দ্র জওহরলালকে তাঁর প্রস্তাবের জন্যে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন যে, নবগঠিত ওয়ার্কিং কমিটির চরিত্র যদি আরও প্রতিনিধিত্বমূলক হয় তবেই তাঁর পক্ষে সভাপতির পদে থাকা সম্ভব। তিনি বলেন যে কংগ্রেসের সর্বোচ্চ কর্ম-পরিষদ কয়েকজন “ব্যক্তিসমষ্টির নিজস্ব বিচরণ ক্ষেত্র হওয়া উচিত নয়…কগ্রেসের অভ্যন্তরে বিভিন্ন মতের প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা থাকা চাই।” সভায় পৌরোহিত্য করছিলেন সরোজিনী নাইডু। তিনি সুভাষচন্দ্রের বক্তব্য অস্পষ্ট বলে অভিহিত করেন। জহওরলাল তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাহার করেন। সরোজিনী নাইডু নতুন সভাপতি নির্বাচনের জন্যে আহ্বান জানান। নীহারেন্দু দত্ত মজুমদার ও কে. এফ. নরিম্যান এর প্রতিবাদ জানান। কিন্তু সরোজিনী নাইড় তা অগ্রাহ্য করেন। এরপর নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদকে কংগ্রেস সভাপতি রূপে নির্বাচন করেন। জওহরলাল ও সুভাষচন্দ্র দু’জনেই নতুন সভাপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ প্রস্তাবিত ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য হতে অসম্মতি জানালে তাঁদের স্থানে ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় ও ডঃ প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষকে ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ মনোনয়ন করেন। উল্লেখ্য হল, দু’জনই ছিলেন বাংলার প্রতিনিধি। প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ কট্টর গান্ধীপন্থী বলে পরিচিত ছিলেন। ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় বেশ কিছুদিন পূর্ব থেকেই নিজেকে গান্ধীপন্থীদের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন।

কয়েকদিন পরে গান্ধীজি বৃন্দাবনে গান্ধী সেবাসঙ্ঘের এক সভায় বলেন যে, তিনি এখনি ব্রিটিশ সরকারকে চরমপত্র দেবার সম্পূর্ণ বিরোধী। সংগ্রাম করার মতো প্রস্তুতি ও শক্তি বর্তমানে কংগ্রেসের নেই। সুভাষচন্দ্রের সত্যাগ্রহ সম্বন্ধে ধ্যান ধারণার সঙ্গে তাঁর নিজস্ব ধারণার কোনও মিল নেই। কংগ্রেসের মধ্যে ‘দুর্নীতি’ সম্পর্কেও তাঁর একই ধারণা। তিনি আরও বলেন যে, সমাজতন্ত্রীদের সঙ্গে তাঁর মতপার্থক্য সুবিদিত হলেও প্রতিদিনই তাঁরা তাঁর (গান্ধীজির) আরও কাছাকাছি আসছেন। জওহরলালের সঙ্গেও তাঁর মতপার্থক্য আছে। কিন্তু তা তেমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাঁকে ছাড়া তিনি নিজেকে অসহায় (crippled) বোধ করেন। জওহরলালেরও একই অনুভূতি। “আমাদের হৃদয় অভিন্ন (our hearty are one)।” সুভাষচন্দ্র ও তাঁর পদত্যাগ সম্পর্কে গান্ধীজির মনোভাব ও বক্তব্য কী ছিল এরপর তা বুঝতে আর কোনও অসুবিধা ছিল না।

দেশের সর্বত্র, বিশেষ করে বাংলায়, ব্যাপক ধারণা সৃষ্টি হয়েছিল যে, কংগ্রেসের গান্ধীপন্থী প্রবীণ নেতারা সুভাষচন্দ্রের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হয়ে অন্যায়ভাবে, তাঁকে অপমান করে পদত্যাগে বাধ্য করার চক্রান্ত করেছেন। ছাত্র-যুব সমাজে সুভাষচন্দ্রের প্রভাব ও জনপ্রিয়তা ছিল অসাধারণ। সুভাষ-অনুরাগীদের দৃষ্টিতে তিনি ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের নির্ভীক, আদর্শনিষ্ঠ ও এক অদ্বিতীয় সংগ্রামী বীর পুরুষের জীবন্ত আদর্শ। সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে ওয়ার্কিং কমিটির পদত্যাগী কিছু সদস্যদের সম্পর্ক অত্যন্ত তিক্ত হয়ে পড়েছিল। এঁদের মধ্যে ছিলেন সর্দার প্যাটেল ও কৃপালনী। কৃপালনী ওই সময় কংগ্রেসের মহাসচিব ছিলেন। তিনি শুধু পদত্যাগই করেননি, সুভাষচন্দ্র ‘নাটক’ করছেন এমন মন্তব্যও করেছিলেন, তা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। বল্লভভাই প্যাটেলের সুভাষ-বিরোধিতার পিছনে রাজনৈতিক মতপার্থক্য ছাড়াও একটি ব্যক্তিগত কারণ ছিল। বিঠলভাই প্যাটেল তাঁর উইলে বিদেশে জাতীয় কংগ্রেস ও স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে প্রচারকার্যের জন্যে যে টাকা রেখে গিয়েছিলেন তার দায়িত্ব সুভাষচন্দ্রকে ন্যস্ত করে গিয়েছিলেন তা বল্লভভাই মেনে নেননি। এই নিয়ে তিনি আদালতে পর্যন্ত যান ও ওই মামলা বেশ কিছুকাল চলেছিল। এর ফলে সুভাষচন্দ্রের প্রতি তাঁর বিরূপতা অন্য রূপ নিয়েছিল। গুরুতর অসুস্থতার জন্যে সুভাষচন্দ্র ফেব্রুয়ারি মাসে ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে যোগদানের অক্ষমতা জানিয়ে যখন সর্দার প্যাটেলকে বার্তা পাঠান এবং অনুরোধ জানান ওই বৈঠক স্থগিত রেখে কয়েকদিন পরে করতে, তখন সর্দার প্যাটেল সুভাষচন্দ্রের ‘অসুস্থতা একটি ভান’, বৈঠকে যোগদান না করার অছিলা মাত্র বলে মন্তব্য করেছিলেন। এই মন্তব্য কতখানি অশোভন ও মিথ্যা ছিল তা বলা বাহুল্যমাত্র। সুভাষচন্দ্র এতে গভীর আঘাত পেয়েছিলেন। তাঁর সম্পর্কে এমন অবিশ্বাস ও সন্দেহ কারও থাকতে পারে, বিশেষ করে যাঁরা তাঁর শ্রদ্ধেয়, অগ্রজতুল্য ও দীর্ঘকালের সহকর্মী, তা তিনি ভাবতেও পারেননি। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘মর্ডান রিভিউ’ পত্রিকায় তিনি ‘আমার অদ্ভুত অসুখ’ (My Strange Illness) শীর্ষক একটি রচনায় (এপ্রিল ১৯৩৯) এই বিষয়ে সমস্ত তথ্য দিয়ে তাঁর মনোবেদনা ব্যক্ত করেন। সুভাষচন্দ্র সম্পর্কীয় প্রামাণিক গ্রন্থগুলিতে এই রচনাটির উল্লেখ থাকলেও তেমন গুরুত্ব পায়নি। কিন্তু ত্রিপুরী কংগ্রেসে গান্ধী-সুভাষ তথা গান্ধীভক্ত কংগ্রেস নেতাদের শক্তিশালী জোটের সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের বিরোধ কেন এত তীব্র ও তিক্ত রূপ নিয়েছিল তা উপলব্ধি করার জন্যে এই রচনাটি মূল্যবান। মানুষ সুভাষচন্দ্র ও তাঁর মানসিক গঠনের ওপরেও এই রচনাটি আলোকপাত করেছিল।

নিজের অসুস্থতার পূর্ণ বিবরণ দিয়ে সুভাষচন্দ্র লেখেন যে, ত্রিপুরীতে যখন তিনি পৌঁছন তখন তাঁর ১০২° জ্বর। ওয়ার্কিং কমিটির পদত্যাগী সদস্যদের একজন তা বিশ্বাস না করে কংগ্রেস শিবিরের ডাক্তারকে প্রশ্ন করেন যে, তিনি নিজে তাপগ্রহণ করেছিলেন কি না। সুভাষচন্দ্রের অসুস্থতার সংবাদে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নানান ধর্ম ও শ্রেণীর মানুষ গভীর উদ্বেগের সঙ্গে চিঠিপত্র, টেলিগ্রাম পাঠাতে থাকেন। অনেকে ওষুধের নমুনা, কবচ আশীর্বাদী ফুল, পাতা, যজ্ঞভস্ম, নির্মাল্য পাঠান। বহু মহিলা তাতেও সন্তুষ্ট না হয়ে কবচ, মালা, প্রসাদী ফুল ইত্যাদি তাঁর বালিশের তলায় রাখার জন্যে পীড়াপীড়ি করেন। এই প্রসঙ্গে সুভাষচন্দ্র লেখেন, “ব্যক্তিগত ভাবে আমি অত্যন্ত যুক্তিবাদী মানসিকতার মানুষ, কিন্তু আমি যেখানে একমত হতে পারি না সেখানেও আমি অপরের সহানুভূতি ও আবেগের মর্যাদা রক্ষা করে চলি… এই সব নিদানপত্র, ওষুধ, কবচ, ফুল যজ্ঞভস্ম প্রভূতির প্রকৃত মূল্য কী তা আমি নিজের মনে চিন্তা করতে থাকি। এগুলি আসে বিশাল ভারতীয় জনসমাজের প্রত্যেক শ্রেণী হতে এবং কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত ভারতের সকল প্রান্ত হতে—এটা আমাকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। আমার এত বিশাল সংখ্যক শুভার্থী ও সহানুভূতিকারী আছেন দেখে আমার চোখে কৃতজ্ঞতার অশ্রু ভরে যায়।” এই অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি সুভাষচন্দ্রের ভবিষ্যতের রাজনৈতিক মনোভাবই শুধু নয়, সমগ্র জীবন সম্বন্ধে তার বিশ্বাস এবং দৃষ্টিভঙ্গিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।

ত্রিপুরীর নৈতিক অসুস্থতা সৃষ্টিকারী আবহাওয়া সুভাষচন্দ্রের মনে রাজনীতি সম্পর্কে তীব্র ঘৃণা ও বিরক্তি সৃষ্টি করেছিল। দিনের পর দিন তিনি সংশয় ও অনিশ্চয়তার মধ্যে কাটিয়েছিলেন। কিন্তু শত শত মানুষের ওই সব পত্র, নিদানপত্র, ওষুধ, কবচ ও প্রসাদীফুল তাঁর কাছে এক অন্য ভারতের রূপ প্রকাশ করেছিল। তিনি স্বীকার করেন যে, তাঁর মধ্যে যে ক্ষোভ জন্মেছিল, ভারতবর্ষ ও ভারতবর্ষের মানুষ সম্বন্ধে যে আস্থা চলে যেতে বসেছিল তা ফিরে আসে। তিনি উপলব্ধি করেন, ‘মানুষকে অবিশ্বাস করার অর্থ হল তার মধ্যে দেবত্বকে অবিশ্বাস করা—নিজের অস্তিত্বকে অবিশ্বাস করা…আমি আবার আমার স্বাভাবিক সুস্থ আশাবাদ ফিরে পেয়েছিলাম।” মানুষের ওপর এই বিশ্বাসের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ছিল তাঁর জীবনের উৎসাহ অনুপ্রেরণার অন্যতম প্রধান উৎস স্বামী বিবেকানন্দের বাণীতে অবিচল বিশ্বাস। তারই সঙ্গে আশ্চর্যজনকভাবে রবীন্দ্রনাথের ‘সভ্যতার সঙ্কট’ ভাষণের শেষ ঘোযণা ও সতর্কবাণী—‘মানুষের ওপর বিশ্বাস হারান মহামাপ’-এর পূর্বাভাস। সুভাষচন্দ্র ওই রচনার পরিসমাপ্তিতে তাঁর আত্মাপলব্ধি ঘোষণা করে বলেন, “একটা জিনিস আমি জানি। এই ভারতের জন্যই পরিশ্রম করা হয় ও যন্ত্রণা ভোগ করা হয়। এই সেই ভারত যার জন্য জীবন বিসর্জন দেওয়া চলে। ত্রিপুরী যাই বলুক বা যাই করুক এই সেই প্রকৃত ভারত যাতে মৃত্যুহীন আস্থা স্থাপন করা যেতে পারে।’

ত্রিপুরীর পর এক নতুন সুভাষচন্দ্রের আবির্ভাব ঘটেছিল এটা বলা অত্যুক্তি হবে না। ত্রিপুরীর অভিজ্ঞতা, আঘাত, হতাশা ও অবমাননা সুভাষচন্দ্রকে ইস্পাতের মতো কঠিন ও তরবারীর মতো শাণিত করেছিল। তিনি আরও নির্ভীক, আত্মবিশ্বাসী ও মাতৃভূমির মুক্তি সংগ্রামে আত্মোৎসর্গ করার জন্যে সঙ্কল্পবন্ধ হয়েছিলেন। ‘দেশনায়ক’ সুভাষচন্দ্রের ‘নেতাজি’ সুভাষচন্দ্রে রূপান্তরের পটভূমি সূচিত হয়েছিল। শেষপর্যন্ত সুভাষচন্দ্রের পদত্যাগের এক প্রধান কারণ ছিল কংগ্রেস সোস্যালিস্ট পার্টি ও অন্যান্য বামপন্থী দলগুলির ভূমিকা। দক্ষিণপন্থীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সুভাষচন্দ্র বামপন্থীদের ওপর খুব বেশি নির্ভর করেছিলেন। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র National Front-এ সুভাষচন্দ্রের পুনর্নির্বাচনের দাবিতে সম্পাদকীয় লেখা হয়েছিল। মানবেন্দ্রনাথ রায়-পন্থীরা ও অন্যান্য বামপন্থীরাও সুভাষচন্দ্রকে সমর্থন জানান। ত্রিপুরীতে জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে কংগ্রেস সোস্যালিস্টদের এক বড় প্রতিনিধি দল এসেছিলেন। কিন্তু জয়প্রকাশ রাজনৈতিক চিন্তায় তখনও গান্ধীর অনেক কাছাকাছি ছিলেন। ব্রিটিশ সরকারকে চরমপত্র দেবার প্রস্তাব তিনি সমর্থন করতে পারেননি। তিনিও মনে করতেন যে, গান্ধীজি ছাড়া কোনও বড় আন্দোলন করা সম্ভব নয়। জয়প্রকাশ ব্রিটিশ সরকারকে একটি ‘জাতীয় দাবিপত্র’ দেবার প্রস্তাব করেন কিন্তু তা মেনে নেবার জন্যে কোনও সময়সীমা বেঁধে দেবার পক্ষে তিনি ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত জয়প্রকাশের নেতৃত্বে কংগ্রেস সোস্যালিস্ট দলের প্রতিনিধিদের এক বড় অংশ পন্থ-প্রস্তাবের ওপর ভোটদানে বিরত থাকেন। এর ফলে ওই প্রস্তাব গৃহীত হওয়া অনেক সহজ হয়েছিল। কংগ্রেস সোস্যালিস্ট দলের কিছু সদস্য জয়প্রকাশের সিদ্ধান্তে খুব অখুশি হয়েছিলেন। তাঁরা প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা ছিলেন সংখ্যালঘু। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের মধ্যে অনেকেও খুব ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু প্রকাশ্যে তাঁদের পার্টির পক্ষে জয়প্রকাশের নীতির বিরোধিতা করা সম্ভব ছিল না। এর কারণ ব্যাখ্যা করে সুধী প্রধান (তিনি ত্রিপুরীতে উপস্থিত ছিলেন) লিখেছেন, “অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির কাছে সমস্যা ছিল ভারতের অন্যান্য প্রদেশে কম্যুনিস্ট কর্মীরা সকলেই কংগ্রেস সোস্যালিস্ট সংগঠনের মধ্যে কাজ করছিল।’ অসন্তুষ্ট কম্যুনিস্ট প্রতিনিধিরা বঙ্কিম মুখার্জীকে দিয়ে পন্থ-প্রস্তাবে বিরোধিতা করেছিলেন। তাঁর সুবিধা ছিল তিনি একাধারে কিষাণ সভার নেতা ও বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সদস্য ছিলেন। কলকাতায় নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির অধিবেশনে সুভাষচন্দ্রের পদত্যাগের প্রশ্নে জয়প্রকাশের ভূমিকা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে।

সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস সোস্যালিস্ট দলের নেতাদের তীব্র সমালোচনা করে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র অমিয়নাথ বসুকে লিখেছিলেন (১৭ এপ্রিল, ১৯৩৯), “কংগ্রেস সোস্যালিস্ট পার্টির নেতৃত্বের বিশ্বাসঘাতকতার জন্যেই আমাদের পরাজয় ঘটেছে।” CSP-র ‘বিবেকহীন বিশ্বাসঘাতকতার’ তীব্র সমালোচনা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিও করেছিল। আনন্দবাজার পত্রিকায় (১৯ মার্চ, ১৯৩৯) তৎকালীন বঙ্গীয় প্রগতি লেখক সঙেঘর সম্পাদক কমিউনিস্ট পার্টির সুরেন গোস্বামীর ‘ত্রিপুরীর গান’ নামে একটি ব্যঙ্গ কবিতা অমলেন্দু ঘোষ তাঁর গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন। এটিতে বাংলার কমিউনিস্টদের মনোভাব ফুটে উঠেছিল।

মোরা সব কংগ্রেস সোস্যালিস্ট দল

লাল বুলি আওড়ানো আমাদের ছল

কাজে মোরা কংগ্রেসী পাণ্ডা

জওহরলালের ধরি ঝাণ্ডা

চিৎকার করে শুধু বাড়ায়েছি গান্ধীর বল

মোরা সব কংগ্রেস সোস্যালিস্ট দল।…

লক্ষণীয় হল কবিতাটিতে জহরলালের পৃথক উল্লেখ। অমিয়নাথ বসুকে লেখা চিঠিতেও সুভাষচন্দ্র অভিযোগ করেছিলেন যে, তাঁর আদর্শ ও ব্যক্তিগতভাবে তাঁর প্রতি, জওহরলালের চেয়েও বেশি অন্য কেউ ক্ষতি করেনি।

জওহরলাল ও সুভাষচন্দ্রের পারস্পরিক সম্পর্ক, মতান্তর এবং মনান্তরের জন্যে কে কতখানি দায়ী ছিলেন, সুভাষচন্দ্রের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের প্রবীণ নেতাদের সঙ্ঘবদ্ধ আক্রমণে জওহরলালের ভূমিকা কী ছিল ইত্যাদি প্রশ্নগুলি এখনও খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। সাম্প্রতিক আলোচনার মধ্যে লিওনার্ড গর্ডন ও অমলেশ ত্রিপাঠীর বক্তব্য উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া বি. আর. নন্দ-র (Jawaharlal Nehru: Rebel and Statesman) এবং এস. গোপাল-এর জওহরলাল নেহরুর জীবনীতে এই বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। অন্যান্য অনেকেও লিখেছেন।

নেহরু পরিবারের সঙ্গে বসু পরিবারের হার্দিক সামাজিক সম্পর্ক ছিল। মতিলাল সুভাষচন্দ্রকে স্নেহ করতেন, যদিও দু’জনের মধ্যে মতপার্থক্য হয়েছিল। সুভাষচন্দ্র তখন এক উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় রাজনৈতিক কর্মী। সর্বভারতীয় পরিচিতি ও প্রবীণ নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তাঁর দক্ষতা এবং সাংগঠনিক ক্ষমতার জন্যে। জওহরলাল ও সুভাষচন্দ্র প্রথম দিকে ছিলেন রাজনৈতিক আদর্শের দিক থেকে খুব কাছাকাছি। দুজনেই সমাজতান্ত্রিক প্রগতিশীল চিন্তাধারার এবং কংগ্রেসের মধ্যে বামপন্থী মতবাদের শ্রেষ্ঠ প্রতীক রূপে চিহ্নিত হয়েছিলেন। জওহরলাল ছিলেন গান্ধীজির সবচেয়ে স্নেহভাজন। গান্ধীজি তাঁর উত্তরাধিকারী রূপে তখনই জওহরলালকে পছন্দ করতে শুরু করেছেন। বহু ক্ষেত্রে গান্ধীজির সঙ্গে তাঁর মতের মিল না হলেও এবং প্রকাশ্যে তা ব্যক্ত করলেও নেহরু শেষপর্যন্ত গান্ধীজির বিরুদ্ধে যেতে পারতেন না। গান্ধীজির প্রতি তাঁর আনুগত্য প্রশ্নাতীত। এই নিয়ে সুভাষচন্দ্রের ক্ষোভ ছিল। তিনি নিজেও ছিলেন গান্ধীজির অনুরাগী। তাঁর প্রতি সুভাষচন্দ্রের গভীর শ্রদ্ধা ছিল। কিন্তু তিনি স্পষ্টভাবেই জানিয়েছিলেন যে, তিনি অন্যদের মতো অন্ধভক্ত ছিলেন না। নীতির প্রশ্নে তিনি গান্ধীজির সঙ্গে ভিন্ন মত ব্যক্ত করতে, প্রকাশ্যে বিরোধিতা করতে তাঁর কুণ্ঠা ছিল না। গান্ধীজিও সুভাষচন্দ্রকে খুব স্নেহ করতেন। তাঁর প্রশ্নাতীত যোগ্যতা, দক্ষতা এবং দেশপ্রেমকে শ্রদ্ধা করতেন। কিন্তু গান্ধীজি তাঁর অনুরাগীদের পূর্ণ আনুগত্য চাইতেন। তাঁর কথাই (আলোচনা-বিতর্কের পর) শেষ কথা এটি কংগ্রেস মেনে নেবে তা তিনি চাইতেন। সুভাষচন্দ্র ছিলেন ভিন্ন ধাতুতে গড়া, প্রয়োজনে বিদ্রোহ করতে তাঁর দ্বিধা ছিল না। গান্ধী-নেহরু-সুভাষের ত্রিকোণী সম্পর্ক নেহরু-সুভাষের সম্পর্ককে প্রভাবিত ও অনেকটা নিয়ন্ত্রিত করেছিল। গান্ধী-সুভাষ ক্রমবর্ধমান মতপার্থক্য ও বিরোধে (যা ত্রিপুরী অধিবেশনে ও পরে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল) জওহরলালের পক্ষে গান্ধীজির পক্ষে থাকা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। সুভাষচন্দ্র কিন্তু তবুও আশা করেছিলেন যে, জওহরলাল দক্ষিণপন্থী গান্ধীভক্তদের বিরুদ্ধে তাঁর পক্ষে দাঁড়াবেন। এই অবান্তর অলীক আশার মূল কারণ ছিল যে, সুভাষচন্দ্র তখনও উপলব্ধি করতে পারেননি যে তাঁর আসল প্রতিপক্ষ স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী। অন্যরা তাঁর সেনাপতি মাত্র।

সুভাষচন্দ্র জওহরলালকে অগ্রজের মতো শ্রদ্ধা করতেন। তাঁর স্থির বিশ্বাস ছিল জওহরলাল ও তিনি কংগ্রেসের মধ্যে প্রগতিশীল বামপন্থীদের শক্তিশালী ও আরও সংগ্রামী করে তুলতে পারবেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সঙ্গে আপস করবেন না। সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিকল্পনা গ্রহণ এবং কার্যকর করবেন। ইউরোপ প্রবাসকালে জওহরলালের কাছে তিনি তাঁর আশা ব্যক্ত করেছিলেন। অনুজের মতো অগ্রজতুল্য জওহরলালের সহযোগিতা কামনা করেছিলেন। কমলা নেহরু যখন বিদেশে মৃত্যুশয্যায় তখন সুভাষচন্দ্র জওহরলাল ও কমলার পাশে ছিলেন। ফৈজপুর কংগ্রেসে জওহরলাল সভাপতি নির্বাচিত হলে সুভাষচন্দ্র ওই অধিবেশনে যোগ দেবার জন্যে সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করার সঙ্গে সঙ্গেই গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। জওহরলাল তাঁকে দেশে না ফেরার উপদেশ দিলেও সুভাষচন্দ্র তা শোনেননি। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ও আসন্ন সঙ্কটের সময় কংগ্রেসের কী নীতি গ্রহণ করা উচিত এই নিয়ে দু’জনের মধ্যে গভীর মতপার্থক্য ইতিপূর্বেই দেখা দিয়েছিল। তবুও তখনও দু’জনের মধ্যে কোনও অলঙ্ঘ্য প্রাচীর গড়ে ওঠেনি। সুভাষচন্দ্রের বিশেষ অনুরোধে জওহরলাল প্ল্যানিং কমিটির সভাপতি হয়েছিলেন। কিন্তু এ সব সত্ত্বেও রাজনৈতিক প্রশ্ন এবং কংগ্রেসের মধ্যে দক্ষিণপন্থী ও বামপন্থীদের ক্রমবর্ধমান বিরোধকে কেন্দ্র করে দু’জনের মধ্যে দূরত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছিল।

বামপন্থী-দক্ষিণপন্থী মতপার্থক্য সম্পর্কে সুভাষচন্দ্র ও নেহরুর মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য ছিল। নেহরুর মতে দুই বিবদমান দলের মধ্যে স্বাধীনতা সংগ্রামে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে ওঠা অসম্ভব ছিল না। প্রবীণ নেতাদের অবদান কিছু কম ছিল না। তাঁদের ‘দক্ষিণপন্থী’ বলে অভিহিত করা সমীচীন নয়। গান্ধীজি ছাড়া কোনও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন চিন্তা করাই সম্ভব নয়। সুভাষচন্দ্র গান্ধীপন্থী নেতাদের সম্বন্ধে নেহরুর মতো উচ্ছ্বসিত ছিলেন না। নেহরুর মতো গান্ধীজির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ‘অভিন্ন হৃদয়’ ছিল না। নেহরুর তা অজানা ছিল না। তাই তিনি সুভাষচন্দ্রের পুনর্নির্বাচন চাননি। তাঁর বিশ্বাস ছিল যে সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে ওয়ার্কিং কমিটির গান্ধীপন্থী সদস্যদের বিরোধ এবং পারস্পরিক বিশ্বাস ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক এমন দাঁড়িয়েছে যে সুভাষচন্দ্র পুনর্নির্বাচিত হলে কংগ্রেসের সংহতি ব্যাহত হবে। সংগঠনের পক্ষে ক্ষতিকর হবে। ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের পদত্যাগ এবং পরে পন্থ-প্রস্তাব গ্রহণের সময় যে সঙ্কট দেখা দিয়েছিল তাতে জওহরলালের ভূমিকা মোটেই সুভাষচন্দ্রের অনুকূলে ছিল না। বাক্যজাল সত্ত্বেও এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ ছিল না যে, নেহরুর সুভাষ-বিরোধীদের পক্ষেই ছিলেন। সুভাষচন্দ্রের পক্ষে এটা মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। তাঁর ধারণা বদ্ধমূল হতে থাকে যে, জওহরলাল, যাঁকে তিনি অগ্রজতুল্য সহযোদ্ধা বলে শ্রদ্ধা করেন তিনি চরম সঙ্কটের মুহূর্তে তাঁর প্রতি ও বামপন্থী আদর্শের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। কলকাতায় নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সভায় যখন সুভাষচন্দ্র পদত্যাগ করেন তখন সুভাষচন্দ্র জওহরলালের ভূমিকায় মর্মাহত ও ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। জওহরলাল অবশ্য সুভাষচন্দ্রকে পদত্যাগ প্রত্যাহার করতে অনুরোধ করেন। কিন্তু ওয়ার্কিং কমিটি পুনর্গঠনের যে প্রস্তাব জওহরলাল করেছিলেন তাতে কার্যত পুরানো পদত্যাগী সদস্যদের প্রায় নিরঙ্কুশ প্রাধান্যই প্রতিষ্ঠিত হত। স্বভাবতই সুভাষচন্দ্রের পক্ষে এ শর্তে পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করা সম্ভব ছিল না।

সকল অধ্যায়

১. দেশনায়ক – ১
২. দেশনায়ক – ২
৩. দেশনায়ক – ৩
৪. দেশনায়ক – ৪
৫. দেশনায়ক – ৫
৬. দেশনায়ক – ৬
৭. দেশনায়ক – ৭
৮. দেশনায়ক – ৮
৯. দেশনায়ক – ৯
১০. দেশনায়ক – ১০
১১. দেশনায়ক – ১১
১২. দেশনায়ক – ১২
১৩. দেশনায়ক – ১৩
১৪. দেশনায়ক – ১৪
১৫. দেশনায়ক – ১৫
১৬. দেশনায়ক – ১৬
১৭. দেশনায়ক – ১৭
১৮. দেশনায়ক – ১৮
১৯. দেশনায়ক – ১৯
২০. দেশনায়ক – ২০
২১. দেশনায়ক – ২১
২২. দেশনায়ক – ২২
২৩. দেশনায়ক – ২৩
২৪. দেশনায়ক – ২৪
২৫. দেশনায়ক – ২৫
২৬. দেশনায়ক – ২৬
২৭. দেশনায়ক – ২৭
২৮. দেশনায়ক – ২৮
২৯. দেশনায়ক – ২৯
৩০. দেশনায়ক – ৩০
৩১. দেশনায়ক – ৩১
৩২. দেশনায়ক – ৩২
৩৩. দেশনায়ক – ৩৩
৩৪. দেশনায়ক – ৩৪
৩৫. দেশনায়ক – ৩৫
৩৬. দেশনায়ক – ৩৬
৩৭. দেশনায়ক – ৩৭
৩৮. দেশনায়ক – ৩৮
৩৯. দেশনায়ক – ৩৯
৪০. দেশনায়ক – ৪০
৪১. দেশনায়ক – ৪১
৪২. দেশনায়ক – ৪২
৪৩. দেশনায়ক – ৪৩
৪৪. দেশনায়ক – ৪৪
৪৫. দেশনায়ক – ৪৫
৪৬. দেশনায়ক – ৪৬
৪৭. দেশনায়ক – ৪৭
৪৮. দেশনায়ক – ৪৮
৪৯. দেশনায়ক – ৪৯
৫০. দেশনায়ক – ৫০

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন