গান্ধীজির নীতি, কর্মসূচী ও চূড়ান্ত লক্ষ্য সম্পর্কে সুভাষচন্দ্রের যাই সংশয় থাকুক না কেন, কলকাতায় ফিরে ওই আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার পর তাঁর আন্তরিকতা, উৎসাহ ও উদ্দীপনার কোনও সীমা ছিল না। গান্ধীজির অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা, জাতীয় আন্দোলনে এক নতুন আলোড়ন, জনজাগরণ সৃষ্টি করায় তাঁর সাফল্য, ব্যক্তিগত জীবন ও চরিত্র মাধুর্যের প্রতি সুভাষচন্দ্রের গভীর আকর্ষণ ও অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ছিল। কংগ্রেস সংগঠনে, ব্যাপকভাবে গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষের মনে যে পরিবর্তন এসেছিল তার প্রধান কৃতিত্ব যে গান্ধীজির, তা তিনি মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করতেন। গান্ধীজিই সর্বপ্রথম আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেশকে একটি সুসংহত রাজনৈতিক সংগঠন দিয়েছিলেন, বক্তৃতা-সর্বস্ব একটি দল থেকে কংগ্রেসকে জাতীয় ভিত্তি দিয়েছিলেন তা সুভাষচন্দ্র তাঁর বিভিন্ন বক্তৃতায় ও লেখায় উল্লেখ করেছেন। গান্ধীজির নেতৃত্বের ফলেই “আধুনিক রাজনৈতিক দলের সব বৈশিষ্ট্য ভারতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে” বলে তিনি মনে করতেন। কিন্তু একই সঙ্গে গান্ধীজির দুর্বলতা ও ব্যর্থতা সম্বন্ধেও প্রথম থেকেই সুভাষচন্দ্র সচেতন ছিলেন। প্রয়োজনে তা প্রকাশ করতেও তাঁর দ্বিধা ছিল না। যে দলে একজন মানুষই হিমালয় প্রমাণ ব্যক্তিত্ব ও ক্ষমতার অধিকারী, তিনি ‘হিমালয় প্রমাণ’ ভুল করলে ক্ষতিও যে তেমনি বিরাট হবে তা ছিল অবশ্যম্ভাবী। গান্ধীজি ও তাঁর নেতৃত্ব সম্বন্ধে সুভাষচন্দ্রের ক্ষোভ ও অনাস্থা ক্রমেই বেড়েছিল। গান্ধীজিরও সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে একই মনোভাব দেখা দিতে থাকে। উভয়ের মধ্যে মানসিক দূরত্ব বাড়তে থাকে।
‘ভারতের মুক্তি সংগ্রাম’ (The Indian Struggle) বইটি স্বাধীনতা সংগ্রামের এক প্রামাণ্য দলিল। বইটির প্রথম অংশ (১৯২০-১৯৩৪) সুভাষচন্দ্র ১৯৩৪ সালে ইউরোপে লিখেছিলেন। দ্বিতীয় অংশ (১৯৩৫-১৯৪২) তিনি বার্লিনে লিখেছিলেন ১৯৪২ সালে। বইটির প্রথম অংশ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৩৫ সালের জানুয়ারি মাসে, লন্ডন থেকে। ইংলন্ডের পত্র-পত্রিকায় প্রশংসিত হলেও ভারত সরকার বইটি ভারতে প্রবেশ করতে দেয়নি। ওই নিষেধাজ্ঞার কারণ, সরকারের মতে বইটিতে সন্ত্রাসবাদ ও সক্রিয় প্রতিরোধের প্রতি সমর্থন আছে। ইংলন্ডের কাগজে যেসব সমালোচনা বেরিয়েছিল তার মধ্যে ‘ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান’ ও ‘ডেইলি হেরাল্ড’-এর দু’টি মন্তব্য বর্তমান আলোচনা প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। ‘ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান’ লেখে যে, সুভাষচন্দ্রের বিরোধীরা তাঁর গুরুত্ব কম করে দেখেন এই যুক্তিতে যে, আত্মম্ভরিতা ও অসহিষ্ণুতা তাঁর কর্মদক্ষতায় বাধা সৃষ্টি করে। কিন্তু সুভাষচন্দ্রের আলোচ্য বইটি তাঁর সম্বন্ধে এক সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারণা সৃষ্টি করে। একজন সক্রিয় রাজনীতিবিদ হয়েও লেখক অন্যসব দল ও ব্যক্তির প্রতি যতটা সুবিচার করেছেন তার বেশি আশা করা যায় না। বইটিতে কঠোরতম সমালোচনা রয়েছে গান্ধীজির। কিন্তু গান্ধীজির “অনুগামীরাও স্বীকার করবেন যে সমালোচনায় যুক্তি আছে এবং হীন মনোভাবের লেশমাত্র নেই।” “ডেইলি হেরাল্ড’ লেখে যে, শান্ত, যুক্তিপূর্ণ, ধীর চিত্তে লেখক বইটি লিখেছেন। তাঁর নিজের মতামত দৃঢ় হলেও সেগুলি লিখতে গিয়ে তিনি অন্যের প্রতি অবিচার করেননি। লেখক মোটেই গোঁড়া নন। বয়স চল্লিশের কম হলেও সুভাষচন্দ্র “যে কোনও দেশের রাজনৈতিক গর্ব ও অলঙ্কার হতে পারেন।”
প্রকৃতপক্ষে, তাঁর গ্রন্থে সুভাষচন্দ্র সম্ভবত সবচেয়ে বেশি নীরব নিজের প্রসঙ্গে। স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন আন্দোলনে ও গঠনমূলক কাজে তাঁর নিজের ভূমিকা সম্বন্ধে তিনি প্রায় উল্লেখই করেননি। এই নীরবতা বিশেষ করে প্রকট তাঁর রাজনৈতিক জীবনের প্রথম দিক সম্বন্ধে। অথচ, এই সময়েই সুভাষচন্দ্র জাতীয় আন্দোলনে, ভারতীয় যুবকদের কাছে যৌবনের প্রতীক রূপে চিহ্নিত হয়েছিলেন। সেই ভাবমূর্তি আজও অম্লান আছে বললে অত্যুক্তি হবে না। নিজের ভূমিকা সম্পর্কে তাঁর নীরবতার কয়েকটি দৃষ্টান্ত প্রাসঙ্গিক হবে। ১৯২১ সালের ১ আগস্ট তিলকের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে দেশব্যাপী বিদেশী বস্ত্রের যে বিরাট বহ্নুসব শুরু হয়েছিল, দলে দলে ছাত্র বিদেশী বর্জন, চরকা ও তাঁত শিল্পের পুনরুজ্জীবনের কাজে নেমেছিল, ব্রিটিশ যুবরাজের ভারতে আগমন ও তাঁর ‘সংবর্ধনা বয়কট’ কলকাতায় যে অভূতপূর্ব সাড়া জাগিয়ে সফল হয়েছিল তার কৃতিত্বের মূলে যাঁরা ছিলেন তাঁদের অন্যতম সুভাষচন্দ্র। এই সাফল্যের জন্যে পরোক্ষভাবেও তিনি কোনও দাবি করেননি।
১৯২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিতে হঠাৎ ভয়াবহ বন্যা হয়। ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ ছিল বিপুল। লক্ষ লক্ষ মানুষ অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়েন। বাংলা প্রদেশ কংগ্রেস ত্রাণ কার্যের জন্যে আবেদন করে। বিপুল সাড়া পাওয়া যায়। প্রথম যে দলটি বন্যাপ্লাবিত অঞ্চলে পৌঁছয় তাতে ‘আমিও ছিলাম’, এইটুকু মাত্র সুভাষ বলেছেন। তারপর তিনি ত্রাণ সমিতির সভাপতি প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের ও জনসাধারণের বদান্যতার কথা উল্লেখ করেছেন। কংগ্রেসের এই ত্রাণ কার্যের যে সাফল্য, কংগ্রেসের সম্মান বৃদ্ধি, এমনকি বাংলার গভর্নর লর্ড লিটনের বন্যাপ্লাবিত অঞ্চল পরিদর্শনের পর কংগ্রেসের ত্রাণ কার্যের প্রশংসা—সবকিছুর জন্যেই তিনি কৃতিত্ব দিয়েছেন কংগ্রেস সদস্যদের। কিন্তু এই বিরাট সেবামূলক কাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা, কংগ্রেস সদস্য ও অন্য সকলকে এই কাজে অনুপ্রাণিত করার পিছনে তাঁর যে অমানুষিক পরিশ্রম ও ক্লেশ ছিল সে বিষয়ে একটি কথাও লেখেননি। আর্তত্রাণ সমিতির প্রধান কর্মকেন্দ্র সান্তাহারে বিরাট তাঁবুতে ভোর থেকে রাত পর্যন্ত তিনি সব কিছু তত্ত্বাবধান করতেন। প্রতিটি কাজ তিনি নিজে দেখতেন। স্বেচ্ছাকর্মী, বন্যাক্লিষ্ট হাজার হাজার মানুষ, অসুস্থ মানুষ, আসতেন অবিরাম। দু’মাস সুভাষচন্দ্র শুয়েছিলেন তাঁবুতে, ছোট্ট একটি তক্তপোশে, দুটো মোটা কম্বল গায়ে দিয়ে। রাত্রে তাঁর টেবিলের আলো আদৌ নিবত কিনা বা কখন আলো আবার জ্বেলে টেবিলে রাখা হত কেউ জানত না। ভোরে অন্য সব স্বেচ্ছাসেবীদের সঙ্গে লাইনে দাঁড়াতেন, সকলের সঙ্গে একই জলখাবার খেতেন—আদার কুচি, ভিজে ছোলা, চিঁড়ে ভাজা। দুপুরের খাবার খেতেন সবার শেষে। তার আগে স্টেশনের পাশে ছোট ডোবায় দুটো ডুব দিয়ে আসতেন। ‘মেনু’—ভাত, ডাল, তরকারি। রাতেও তাই। শুধু ভাতের বদলে রুটি। সুভাষচন্দ্রের অনুগত সহকর্মী গোপাললাল সান্যাল তাঁর ‘যে কথার শেষ নেই’ স্মৃতিচারণমূলক বইটিতে সেবাব্রতী সুভাষের এক হৃদয়গ্রাহী চিত্র ধরে রেখেছেন। গোপাললাল সান্যালকে তিনি তাঁর ‘তরুণের স্বপ্ন’ গ্রন্থের স্বত্বদান করেছিলেন। একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন গোপাললাল সান্যাল। ভাইফোঁটার দিন সকাল বেলা বগুড়ার হরিপুরের জমিদার বাড়ি থেকে বাঁকে বাঁকে এল দই, ক্ষীর, নানান রকমের মিষ্টি, খই, মুড়কি, মোয়া, কলা ইত্যাদি। জমিদার বাড়ির মেয়েরা ভাইফোঁটা উপলক্ষে ওইসব পাঠিয়েছেন সুভাষচন্দ্র ও স্বেচ্ছাসেবকদের জন্যে। সবাই বোনেদের অনুরোধ রক্ষা করলেন। শুধু সুভাষচন্দ্রকে কিছুতেই খাওয়ানো গেল না। তিনি বললেন, “আমরা এখানে ভোজ খেতে আসিনি।”
আর্তত্রাণের অর্থ নিয়ে কেনাবেচার নৈতিক ও আইনগত সমস্যার কথা চিন্তা করে ‘খাদি প্রতিষ্ঠান’ নামে একটি পল্লী উন্নয়নমূলক উৎপাদন ও বিক্রয়কেন্দ্র স্থাপিত হয়। গান্ধীজির আর্থিক পুনর্গঠন, গ্রামীণ স্বনির্ভরতা ও রাজনৈতিক কর্মসূচীতে এই রকমের উদ্যোগের ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল। সুভাষচন্দ্র সেই আদর্শের ভিত্তিতে এই প্রতিষ্ঠান গড়ায় উৎসাহী হয়েছিলেন। মূলত তাঁরই কর্মক্ষমতা ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় ‘খাদি প্রতিষ্ঠান’ গড়ে উঠেছিল। কিন্তু সুভাষচন্দ্রের সহকর্মী ও অনুরাগীদের এক দুঃখ ও অভিযোগ ছিল যে, ১৯২৩ সালে ‘স্বরাজ্য’ দল গঠনের পর থেকেই ‘খাদি প্রতিষ্ঠান’ গান্ধীবাদী রাজনৈতিক গোষ্ঠীর অঙ্গরূপে পরিচিত হয়। পরে গান্ধী-সুভাষ বিরোধের সময় এই সংস্থা সুভাষ-বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিল। উত্তরবঙ্গে বন্যাত্ৰাণ কার্যে সুভাষচন্দ্র ‘সেবাধর্ম-জনকল্যাণ’ এবং ‘স্বদেশ প্রেম-স্বদেশ কল্যাণ’-এর সমন্বিত রূপ দেখেছিলেন। নিজের কৈশোর ও ছাত্র জীবনের স্বপ্ন তাঁর কাছে সার্থক হয়ে উঠেছিল। পারিবারিক দুর্গাপূজায় যোগ দিতে যাওয়ার পথে জানকীনাথ পুত্রের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে দেশের বাড়ির পুজোয় যাবার জন্যে বলেন। সুভাষ পিতাকে বলেন, “না বাবা। আপনারা সবাই গৃহে মা দুর্গার পূজার জন্যে যান। আমি আমার প্রকৃত মা দুর্গাকে অসহায় মানুষদের মধ্যে পূজা করতে যাব।”
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন সুভাষচন্দ্রকে একাধিক গুরু দায়িত্ব দিয়েছিলেন। অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করে কারাবরণ করার পূর্বে ও মুক্তি পাওয়ার পরে। জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, জাতীয় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠনে তাঁর ভূমিকার কথা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। সুভাষচন্দ্র ইংলন্ড থেকে দেশবন্ধুকে যে চিঠি দিয়েছিলেন তাতে তিনি সাংবাদিকতা, সংবাদপত্র-পত্রিকায় সম্পাদনে সহযোগিতা করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি কংগ্রেসের কার্যসূচী ও তা কার্যকর করার ব্যাপারে প্রচার মাধ্যমের গুরুত্বের ওপর বিশেষ জোর দিয়েছিলেন। তাঁর সেই ইচ্ছার কথা দেশবন্ধুর মনে ছিল। বিচক্ষণ নেতা অল্প দিনেই বুঝেছিলেন এই কাজে সুভাষচন্দ্রের যোগ্যতা, দক্ষতা ও আন্তরিকতা কতখানি। তাই ১৯২১ থেকে ১৯২৩ সালের মধ্যে সুভাষচন্দ্রের ওপর দায়িত্ব পড়েছিল একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পত্র-পত্রিকা সম্পাদনা ও পরিচালনার। এইগুলির মধ্যে ছিল ‘বাঙ্গলার কথা’ (১৯২১), ‘আত্মশক্তি’ (১৯২২) ও ‘ফরওয়ার্ড’ (১৯২৩)। দেশবন্ধু জেলের মধ্যে তাঁর সমর্থকদের সঙ্গে আলোচনায় প্রায়ই বলতেন ইংরাজি ও মাতৃভাষায় দৈনিক কাগজ প্রকাশের প্রয়োজন কতখানি। ‘ফরওয়ার্ড’ প্রকাশের সিদ্ধান্ত স্বরাজ্য দলের প্রতিষ্ঠা (১৯২৩), তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও প্রয়োজনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিল।
অসহযোগ আন্দোলনের ব্যর্থতা এবং গান্ধীজির কারাদণ্ড কংগ্রেস নেতাদের জাতীয় আন্দোলনের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্বন্ধে চিন্তিত করে তোলে। চিত্তরঞ্জন দাশ, মতিলাল নেহরু প্রমুখ কয়েকজন নেতা অসহযোগের বিকল্প কর্মসূচীর কথা চিন্তা করেন। তাঁরা স্থির করেন, আইনসভাগুলিকে সম্পূর্ণ বর্জন না করে আইনসভার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা উচিত এবং নির্বাচিত হবার পর ভিতর থেকে ‘সুসংবদ্ধ’, নিয়মিত এবং নিরন্তর বাধা সৃষ্টি করে আইনসভা তথা শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা বানচালের চেষ্টা করার কর্মসূচী গ্রহণ করা উচিত। কিন্তু অন্য অনেক কংগ্রেস নেতা এই পরিবর্তিত নীতির প্রস্তাব সমর্থনযোগ্য মনে করেননি। তাঁরা গান্ধীজির নীতি ও পথ অপরিবর্তিত রাখার সমর্থক ছিলেন। এর ফলে কংগ্রেসের মধ্যে দুটি বিরোধী মতবাদের সৃষ্টি হয়। যাঁরা পরিবর্তনের পক্ষে তাঁরা ‘Pro-changers’ নামে, আর, যাঁরা পরিবর্তনের বিপক্ষে তাঁরা ‘No-changers’ নামে পরিচিত হন। ১৯২২ সালে গয়া শহরে অনুষ্ঠিত কংগ্রেস অধিবেশনে ‘পরিবর্তন বিরোধী’ অর্থাৎ গান্ধীজির সমর্থকদের জয় হয়। চিত্তরঞ্জন দাশ ও মতিলাল নেহরুর নেতৃত্বে ‘স্বরাজ্য দল’ প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু স্বরাজ্য দল কংগ্রেসেরই একটি শাখা রূপে কাজ করতে থাকে।
গয়া কংগ্রেসের অধিবেশনে অনেক প্রত্যাশা নিয়ে চিত্তরঞ্জন, সুভাষচন্দ্র ও অন্যান্যরা গিয়েছিলেন। তাঁদের স্থির বিশ্বাস ছিল যে, বাস্তব অবস্থা বিচার করে অসহযোগ আন্দোলনের নীতি পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। স্বরাজ্য দলের প্রস্তাবিত কার্যসূচীর জরুরি প্রয়োজন গান্ধীজি ও তাঁর সমর্থকরা উপলব্ধি করবেন। তা না হওয়ায় চিত্তরঞ্জন বিশেষভাবে অনুভব করেন যে, তাঁদের নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে ব্যাপকভাবে প্রচার শুরু করা জরুরি প্রয়োজন। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই দৈনিক ‘ফরওয়ার্ড’ পত্রিকার প্রকাশ শুরু হয়। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই কাগজটি জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্রগুলির মধ্যে অন্যতম প্রধানের মর্যাদা ও জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ‘ফরওয়ার্ড’-এ নানান বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হত। লেখার মান ছিল উন্নত। আর একটি বৈশিষ্ট্য ছিল, গোপন সরকারি সংবাদ আবিষ্কার করে সুকৌশলে তা ফাঁস করা।
‘ফরওয়ার্ড’-এর অসাধারণ জনপ্রিয়তা ও সাফল্যের মূলে ছিল সুভাষচন্দ্রের দক্ষতা ও অক্লান্ত প্রচেষ্টা। যখন কাগজটি প্রথম প্রকাশ হয় তখন, দেশবন্ধু তথা স্বরাজ্য দলের পক্ষে পরিবেশ খুবই প্রতিকূল। গয়া কংগ্রেসে দেশবন্ধুর ‘পরাজয়’ তাঁকে এক কঠিন পরীক্ষার মধ্যে ফেলে দেয়। স্বপক্ষে কিছু লেখা তো দূরের কথা, বেশির ভাগ কাগজেই বিরূপ মন্তব্য ও ভুল সংবাদে ভরা। সেই দুর্দিনের কথা স্মরণ করে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দেশবন্ধুর মৃত্যুর পর লিখেছিলেন, “লোক নাই, অর্থ নাই, হাতে একখানা কাগজ নাই ; অতি ছোট যাহারা তাহারও গালিগালাজ না করিয়া কথা কহে না, দেশবন্ধুর সে কি অবস্থা।” সুভাষচন্দ্রও লিখেছেন, “যখন অর্থের প্রয়োজন, তখন অর্থ পাওয়া যায় না। যে বাড়িতে এক সময় লোক ধরত না, সেখানে কি বন্ধু, কি শত্ৰু—কাহারও চরণধূলি আর পড়ে না। কাজেই আমরা কয়েকটি প্রাণী মিলে আসর জমাতুম।” ‘ফরওয়ার্ড’ কাগজ পরিচালনায়, কাগজটিকে সর্বাংশে একটি আধুনিক উচ্চমানের জনপ্রিয় ইংরাজি দৈনিকে পরিণত করার কাজে সুভাষচন্দ্র, উপেন্দ্রনারায়ণ নিয়োগী, হেমচন্দ্র নাগ, সত্যরঞ্জন বক্সী প্রমুখের সহযোগিতা পান। সংবাদ সংগ্রহ, সরবরাহ, রিপোর্ট ও লেখার মান লক্ষ্য করা ছাড়াও সংবাদ সাজানো, ভাল ছাপা, ভাল কালি, ভাল টাইপ ইত্যাদি সবকিছুর প্রতি সুভাষচন্দ্র নিজে লক্ষ্য রাখতেন। ‘ফরওয়ার্ড’ ও অন্য কাগজগুলির চাহিদা কেমন তা পর্যবেক্ষণ করার জন্যে তিনি প্রায়ই কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে, চৌরঙ্গির ট্রাম ডিপোতে কাগজের হকারদের স্টলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতেন। সুভাষচন্দ্রের চেষ্টায় শুধু ‘ফরওয়ার্ড’ই নয়, ‘আত্মশক্তির’ মতো অপেক্ষাকৃত কম প্রচলিত পত্রিকার সাফল্য সম্পর্কে উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, “আমরা আগেও লিখতাম, এখনও লিখছি ; কিন্তু তখন সপ্তাহে এক হাজারও বিক্রি হত না, অথচ এখন এরা দশ হাজার ছেপেও কুলিয়ে উঠতে পারছে না। হকারেরা আরো দাও আরো দাও করছে। কাগজের জন্যে বিজ্ঞাপন সংগ্রহের জন্যে সুভাষচন্দ্র নিজে লোকের কাছে, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের অফিসে যেতেন।” খ্যাতনামা সাংবাদিক, সুভাষের সহপাঠী বন্ধু পূর্ণচন্দ্র সেন লিখেছেন যে, “ফরওয়ার্ডের প্রথম অবস্থার ইতিহাসই সুভাষচন্দ্র বসুর ইতিহাস।” সুভাষচন্দ্রের পরিচালনায় কাগজগুলি জনসাধারণের মনে গভীর প্রভাব ফেলতে শুরু করে। সরকারি পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগ উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন