দেশনায়ক – ১০

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার পিছনে তাঁর বন্ধু দিলীপকুমার রায়ের সাহায্য, বি. এ. পরীক্ষার ফলাফল ও কলকাতায় ‘ইন্ডিয়ান ডিফেন্স ফোর্স’ বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনীতে তাঁর অভিজ্ঞতা অনেকটা সহায়তা করেছিল। এই IDF Service-এর পূর্ব অভিজ্ঞতা কেমব্রিজে ভর্তির ব্যাপারে কাজে লাগার কথা তিনি চিঠিতেও উল্লেখ করেছিলেন। সামরিক শিক্ষার প্রতি তাঁর আকর্ষণের সঙ্গে পরবর্তীকালে আজাদ হিন্দ ফৌজ গড়ে তোলা ও ‘নেতাজি’র ভূমিকা নেওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। তাই, সুভাষচন্দ্রের এই মানসিকতা ও অভিজ্ঞতার একটু বিশদ উল্লেখ প্রয়োজন।

ছোটবেলায় পি. ই. স্কুলে পড়ার সময় তিনি খেলাধুলা করতে ভালবাসতেন না। শুধু ড্রিল করাই তার পছন্দ ছিল। স্কুলের সময়ানুবর্তিতা ও নিয়মানুবর্তিতার পরিবেশ তাঁর মনে দাগ ফেলেছিল। কলকাতায় কলেজ জীবনের অভিজ্ঞতা, বিশেষ করে শ্বেতাঙ্গদের জাতি বিদ্বেষ ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ, কেমনভাবে তাঁকে বিচলিত করে তুলেছিল তা আমরা দেখেছি। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের পক্ষে সামরিক শক্তি যে কতখানি অপরিহার্য তা তিনি উপলব্ধি করতে শুরু করেন ওই সময় থেকেই। জাতির মুক্তি ও স্বাধীনতার পক্ষে সামরিক শক্তি অর্জনের কোনও বিকল্প নেই, এটি তাঁর বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিল। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হবার পর এক বছর কটকে কাটিয়ে কলকাতায় ফিরে এসে, অন্য কোনও কলেজে ভর্তি হবার আবেদন যখন বিবেচনাধীন রয়েছে তখন তিনি ‘49th Bengalee’ বাহিনীতে যোগ দেবেন মনস্থ করেন। অপেক্ষায় থেকে তিনি অধীর হয়ে উঠেছিলেন। নিজের কর্মশক্তিকে কাজে লাগাতে অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু দৃষ্টিশক্তি পরীক্ষায় পাস করতে না পারায় তাঁর সেই ইচ্ছা পূর্ণ হয়নি।

স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়ার সময় সামরিক ট্রেনিং নেওয়ার একটা সুযোগ তিনি পেলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারত-রক্ষা বাহিনীর একটি শাখা গঠিত হয়েছিল। এ শাখায় লোক সংগ্রহ করা হচ্ছিল। এখানে ভর্তির ব্যাপারে স্বাস্থ্যপরীক্ষা তেমন কঠোর না হওয়ায় সুভাষচন্দ্র সুযোগ পেয়ে যান। চারমাস রীতিমত সামরিক ট্রেনিং নিতে হয়েছিল তাঁকে। তিনি তা খুবই উপভোগ করেছিলেন। কিছুদিন তাঁদের কলকাতার অদূরে বেলঘরিয়ায় বন্দুক চালানো শিখতে হয়েছিল। মাত্র কিছুকাল পূর্বে সাধুসঙ্গের অভিজ্ঞতার সঙ্গে ব্রিটিশ সামরিক অফিসারের কাছে শিক্ষানবিস-এর অভিজ্ঞতার কথা ভেবে সুভাষচন্দ্র নিজেই অবাক হয়ে যেতেন। শিবির জীবনের নানান শিক্ষা ও তার সুফল প্রসঙ্গে সুভাষচন্দ্র বিশেষ করে উল্লেখ করেছেন, শিক্ষার্থীদের মধ্যে ‘ভাই ভাই ভাব’ জাগিয়ে তোলার দিকটি। সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ বাঙালি ছাত্ররা যখন প্রথম সামরিক শিক্ষা শুরু করে তখন তাদের সম্বন্ধে সামরিক অফিসারদের ধারণা ছিল খুবই খারাপ। ওইসব ছেলে কোনওদিন সত্যিই ভালভাবে বন্দুক রাইফেল চালাতে শিখবে, যুদ্ধ করতে পারবে এ তারা বিশ্বাসই করত না। কিন্তু মাত্র তিন সপ্তাহের ট্রেনিং-এর পর বন্দুক ছোঁড়ার প্রতিযোগিতায় যখন ওই ‘আনাড়ির দল’ তাদের শিক্ষকদেরই হারিয়েছিল তখন তারা অবাক হয়ে যায়। ছাত্রজীবনের এ সামরিক শিক্ষার কথা প্রসঙ্গে সুভাষচন্দ্র যা তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন তা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ, “এই শিক্ষা আমাকে এমন কিছু দিয়েছিল যা আমার প্রয়োজন ছিল অথবা যা আমার মধ্যে ছিল না। মানসিক শক্তি ও আত্মবিশ্বাসবোধ আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল। সৈনিক হিসাবে আমাদের এমন কতকগুলি অধিকার ছিল ভারতীয় হিসাবে যা আমাদের ছিল না। ⋯ আমরা প্রথম যেদিন আমাদের রাইফেল আনবার জন্য ফোর্ট উইলিয়ামের ভিতরে মার্চ করে ঢুকলাম, সেদিন অদ্ভুত এক ধরনের তৃপ্তিবোধ আমাদের হয়েছিল, যেন আমরা এমন একটা কিছুর দখল নিচ্ছি, যাতে আমাদের একটা জন্মগত অধিকার আছে, অথচ যার থেকে আমাদের অন্যায়ভাবে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে।” এই লেখা পড়লে যেন মনে হয় অদূর ভবিষ্যতের নেতাজি সুভাষচন্দ্রের ‘চলো দিল্লির’ ডাক শোনা যাচ্ছে!

কেমব্রিজে পড়ার সময়ও সুভাষচন্দ্র সামরিক শিক্ষালাভের জন্যে আগ্রহী ছিলেন। তিনি একটি বিজ্ঞাপন পড়ে ‘ইউনিভার্সিটি অফিসার্স ট্রেনিং কোর’-এ ভর্তির জন্যে আবেদন করেন। কিন্তু আবেদনকারী ভারতীয় ছাত্রদের জানানো হয় যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আপত্তি থাকায় তাদের আবেদন বিবেচনা করা সম্ভব হবে না। এর কারণ, ওই ট্রেনিংপ্রাপ্তদের ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীতে যোগদানের অধিকার জন্মায়। ভবিষ্যতে যদি কোনও ট্রেনিংপ্রাপ্ত দক্ষ ভারতীয় সম্মিলিত ব্রিটিশবাহিনীর অফিসার পদে নিযুক্ত হন তাহলে সঙ্কটজনক পরিস্থিতি দেখা দেবে। কেননা, ভারতীয়দের প্রতি বিরূপ মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিরা এটা মানতে চাইবে না। ওটিসি-তে যোগদানে ইচ্ছুক ছাত্ররা জানায় যে, তারা আশ্বাস দিতে প্রস্তুত যে ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীতে তারা চাকরি চাইবে না। তাদের আগ্রহ সামরিক শিক্ষালাভে; ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীতে যোগদানে নয়। কিন্তু তাতেও ফল হয়নি। কোনও কোনও মহলে ভারত-বিদ্বেষী মনোভাব এতই প্রবল ছিল যে ভারতীয় ছাত্রদের ওই সামরিক শিক্ষা লাভের পথে নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত থাকে।

একই সঙ্গে আই সি এস পরীক্ষার জন্যে প্রস্তুতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা করার ফলে সুভাষের ওপর চাপ পড়ে খুব বেশি। বহু বিচিত্র ধরনের বিষয় সম্বন্ধে তাঁকে পড়তে হত। মাত্র কয়েকমাস পরেই সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা থাকায় তাঁকে অবশ্য বেশি সময় দিতে হয়েছিল এ পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্যে। পড়াশোনার পর যেটুকু সময় পেতেন তা কাটাতেন ভারতীয় মজলিস ও ইউনিয়ন সোসাইটির সভা সমিতিতে যোগ দিয়ে। এই প্রসঙ্গে তিনি তাঁর বন্ধুকে লিখেছিলেন, “এখানে ভারতবাসীদের একটি সমিতি আছে। নাম Indian Majlis, সাপ্তাহিক অধিবেশন হয়। এবং মধ্যে মধ্যে বাহির হইতে বক্তারা আসেন। এই বক্তাদের মধ্যে ছিলেন সরোজিনী নাইডু, এন্ড্রুজ, বাল গঙ্গাধর তিলক প্রমুখ। ইংলন্ডে ভারতীয় ছাত্রদের মধ্যে তখন উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রবণতা প্রবল। তাদের ‘সুরটা’ ছিল ‘বড় চড়া’। নরম বক্তৃতা শুনতে তারা ভালবাসত না। এর কারণ, ভারতবর্ষে তখন ‘নরমপন্থী’ (Moderates) এবং ‘চরমপন্থী’ (Extremists) বিতর্ক-বিরোধে চরমপন্থীদের জয় হয়ে গেছে। মন্টেগু-চেমসফোর্ড রিপোর্টের (এপ্রিল, ১৯১৮) প্রস্তাবিত শাসন সংস্কার ও তা কার্যকর করার জন্যে ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন ভারতীয়দের সম্পূর্ণ হতাশ করেছিল। ইতিমধ্যে প্রথম মহাযুদ্ধের অবসানের পরও ভারতে দমনমূলক ব্যবস্থা চালু রাখার জন্যে রাওলাট আইনের প্রবর্তন, রাওলাট অ্যাক্ট বিরোধী আন্দোলন এবং অমৃতসরে জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ড বিদেশেও ভারতীয়দের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ, উত্তেজনা ও ব্রিটিশ শাসন-বিরোধী মনোভাবের সৃষ্টি করেছিল।

সুভাষচন্দ্র দেশ থেকেই এক তীব্র ব্রিটিশ বিরোধী মানসিকতা নিয়ে এসেছিলেন। তারই তীব্রতা প্রকট হয়েছিল সাদা চামড়ার লোককে তাঁর জুতো সাফ করতে দেখে খুশি হওয়ার মধ্যে। কিন্তু ওই চিঠিতে তিনি ইংলন্ডের লোকেদের উদ্যমশীলতা ও সজীবতার প্রশংসা করেছিলেন। তাদের সময়জ্ঞান, সব কাজে ‘method’, ছাত্রদের মর্যাদা, অধ্যাপকের ব্যবহার ও মানুষের প্রতি মানুষের ব্যবহার দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। এইসব গুণাবলী দেখে শ্রদ্ধায় তাঁর মাথা নত হয়েছিল। তিনি আরও মুগ্ধ হয়েছিলেন বিতর্ক-সভার পরিবেশ ও সকলের বাক্-স্বাধীনতা দেখে। যত নামী দামী বক্তাই হোন না কেন শোতারা প্রশ্ন-সমালোচনা করতে ছাড়ত না। কেমব্রিজে ব্রিটিশ ও ভারতীয় ছাত্রদের মধ্যে সম্পর্ক মোটামুটি সৌহাদ্যপূর্ণ হলেও খুব কমক্ষেত্রেই তাদের মধ্যে প্রকৃত বন্ধুত্ব গড়ে উঠত। সুভাষচন্দ্র লক্ষ্য করেছিলেন যে, অমায়িকতার আড়ালে ব্রিটিশদের মনে একটা শ্রেষ্ঠত্ব বোধ ছিল। তাছাড়া, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের নায়ক জেনাবেল ডায়ারের প্রতি মধ্যবিত্ত ইংরাজদের একটা সহানুভূতি ছিল। রাজনৈতিক সচেতন ভারতীয়দের পক্ষে এটা দুঃখজনক মনে হত। জাতি ও বর্ণের কারণে পক্ষপাতিত্ব থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিও সম্পূর্ণ মুক্ত ছিল না। কেমব্রিজেও তিনি এটা লক্ষ্য করেছিলেন।

স্বামী বিবেকানন্দের একটি কথা যে কতটা খাঁটি তা সুভাষচন্দ্র ইংলন্ডে গিয়ে গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। স্বামীজি বলেছিলেন পাশ্চাত্য জগৎ দেখিয়েছে “Power of the People”—জনগণের ক্ষমতা কতখানি। ভারতের উন্নতি কোনওদিনই হবে না যতক্ষণ না নিম্নবর্গের মানুষ ক্ষমতার অধিকারী হচ্ছে। শূদ্র জাগরণ, শ্রমিক শ্রেণীর উত্থান ও সংগঠন ভারতের উন্নতির জন্যে অপরিহার্য। একটি চিঠিতে (২৩ মার্চ, ১৯২০) সুভাষচন্দ্র স্বামীজির এই কথাগুলির ওপর জোর দিয়ে বলেন যে, তিনি ইংলন্ডে এসে এসব দেখে বুঝেছেন জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার ও শ্রমিক আন্দোলন ভারতের পক্ষে কতটা জরুরি।

আজকের দিনেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সম্বন্ধে সুভাষচন্দ্রের অভিমত ভেবে দেখার মতো। প্রশ্নটি হল: ভারতীয় ছাত্রদের বিদেশে পাঠানো বাঞ্ছনীয় কি না, এবং যদি হয়, তাহলে কোন বয়সে তাদের বিদেশে শিক্ষালাভের জন্যে পাঠানো উচিত। এই বিষয়ে তিনি যা দেখেছিলেন এবং তাঁর যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল তার ভিত্তিতে সুভাষচন্দ্রের অভিমত ছিল যে, কিছুটা সাবালকত্ব অর্জনের পরই বিদেশে যাওয়া উচিত। অপরিণত মন নিয়ে বিদেশে শিক্ষালাভ করলে বিশেষ সুফল হয় না। তিনি মনে করতেন, “নিম্নতর ধাপগুলিতে শিক্ষা অবশ্য ‘জাতীয়’ হওয়া চাই। দেশের মাটির সঙ্গে তার নাড়ির যোগ থাকা চাই। স্বদেশের সংস্কৃতি থেকে মনের খোরাক আমাদের অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। অল্প বয়সেই কাউকে অন্যস্থানে পাঠিয়ে দিলে তা কী করে সম্ভব হবে? না, ছেলেমেয়েদের অপরিণত বয়সে একেবারে একাকী বিদেশের স্কুলগুলিতে পাঠাবার চিন্তাকে আমাদের সচরাচর প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়। শিক্ষা আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠে উচ্চতর ধাপগুলিতে। তখনই শুধু ছাত্রেরা বিদেশে গিয়ে উপকৃত হতে পারে, এবং তখনই পারস্পরিক কল্যাণের জন্যে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিলন ঘটতে পারে।”

বর্তমান কালে ছেলেমেয়েদের বিদেশের স্কুলে পড়াশোনা করার চিন্তা অবশ্যই খুবই কমসংখ্যক পিতা-মাতা করেন। ওইরকম আর্থিক সামর্থ এবং সুযোগ-সুবিধা আছে এমন পরিবার বিরল। কিন্তু দেশের মধ্যেই এমন বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে যেগুলির পরিবেশ, পাঠ্যক্রম ও আচরণবিধি “বিদেশী” স্কুলের মতোই। স্বদেশের ভাষা ও সংস্কৃতি থেকে ওইসব স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা শুরু থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। দেশের মার্টির সঙ্গে নাড়ির টান খুবই দুর্বল হয়ে পড়ে। রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ বা সুভাষচন্দ্রের শিক্ষাদর্শ ও অভিমত সেই কারণেই জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্গঠনে তাৎপর্যপূর্ণ।

১৯২০ সালের জুলাই মাসে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা লন্ডনে শুরু হয়। ওই সময় যাদের যোগ্যতা ছিল তারা সকলে এই পরীক্ষা দিতে পারত (open competitive examination)। পরীক্ষা একমাস ধরে চলেছিল। দীর্ঘ পরীক্ষা চলার সময় সুভাষচন্দ্র মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করেছিলেন। কিন্তু ওই যন্ত্রণা পরীক্ষার চাপ ও উদ্বেগের জন্যে, না এরপর কী পরিস্থিতি হবে সেই চিন্তায় তা বলা কঠিন। পরীক্ষা শুরুর চারমাস আগে তিনি এক বন্ধুকে লিখেছিলেন, “কোন দিকে ভেসে যাচ্ছি জানি না। কোন তীরে গিয়ে উঠব তাও জানি না। তবে বিশ্বাস করি তোমাদের ভালবাসা ও আশীর্বাদ না হারাইলে পথভ্রষ্ট হইব না।” স্পষ্টতই তিনি তাঁর ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত ও কর্মপন্থা সম্বন্ধে গভীরভাবে চিন্তা করছিলেন। পরীক্ষা দিয়ে তিনি মোটেই সন্তুষ্ট হননি। একে তো প্রস্তুতির সময় পেয়েছিলেন মাত্র আট মাস। তার ওপর সংস্কৃত পরীক্ষা ভাল হয়নি। জানা সহজ প্রশ্ন ছেড়ে দিয়েছিলেন। এটি ঠিকভাবে লিখলে অনেক নিশ্চিন্ত থাকতে পারতেন। পরীক্ষা যে ভাল হয়নি তা তিনি বাড়িতে জানিয়েও দিয়েছিলেন। মনস্থির করে ফেলেছিলেন এবার ‘ট্রাইপোজে’র জন্যে মন দিয়ে পড়াশোনা করবেন। এই প্রসঙ্গে একটি প্রশ্ন মনে আসে। সুভাষচন্দ্র যদি সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় পাস করা বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব নাই দিয়ে থাকেন, পরীক্ষায় সফল হলেও সরকারি চাকরি নেবেন না বলে মনে মনে সঙ্কল্প করে থাকেন, তাহলে পরীক্ষায় ভাল না করা নিয়ে তাঁর মনস্তাপের কী কারণ ছিল? কেন তিনি ‘বোকার মত’ ১৫০ নম্বর ছেড়ে দিয়ে উত্তরপত্র জমা দিয়ে ‘আঙুল কামড়ে’ ছিলেন? এর থেকে মনে হতে পারে মুখে যাই বলুন না কেন, সুভাষচন্দ্র সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় সফল হতে চেয়েছিলেন। কথাটা সম্পূর্ণ ভুল নয়। সুভাষচন্দ্রের আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদাবোধ ছিল প্রবল। মেধাবী ছাত্র বলে তাঁর ব্যাপক পরিচিতি ছিল। তিনি নিজেও ওই বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। সুতরাং তাঁর পক্ষে কোনও পরীক্ষায় বা কোনও কাজেই ব্যর্থতা মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। তিনি সে ধাত্রে মানুষই ছিলেন না। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় বসে ফেল করা তাঁর মানসিকতায় ছিল না। পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে সরকারি চাকরি না নেওয়া, আর সফল হয়ে তারপর চাকরি প্রত্যাখ্যান করার মধ্যে যে তফাৎ তা তিনি ভালভাবেই জানতেন। সুতরাং সসম্মানে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তারপর তিনি সিভিল সার্ভিস থেকে পদত্যাগ করবেন এই ছিল তাঁর মনোগত ইচ্ছা। পরীক্ষায় ভাল না করায় তিনি হতাশ হয়েছিলেন ওই কারণে। কিন্তু বিরাট বিস্ময় তাঁর জন্যে অপেক্ষা করছিল। হঠাৎ একদিন রাত্রে এক বন্ধুর ‘তার’ পেলেন। বন্ধু তাঁকে পরীক্ষায় সাফল্যের জন্যে অভিনন্দন জানিয়েছে। পরের দিন সকালে কাগজ খুলে দেখলেন সত্যিই তিনি উত্তীর্ণ হয়েছেন। আর, শুধু উত্তীর্ণই নয়—চতুর্থ স্থান অধিকার করেছেন। উৎফুল্ল বিস্মিত সুভাষ বাড়িতে টেলিগ্রাম পাঠিয়ে দিলেন সুখবরটি জানিয়ে। কিন্তু, তাঁর কাছে এটা সত্যিই কতটা সুখবর ছিল?

সকল অধ্যায়

১. দেশনায়ক – ১
২. দেশনায়ক – ২
৩. দেশনায়ক – ৩
৪. দেশনায়ক – ৪
৫. দেশনায়ক – ৫
৬. দেশনায়ক – ৬
৭. দেশনায়ক – ৭
৮. দেশনায়ক – ৮
৯. দেশনায়ক – ৯
১০. দেশনায়ক – ১০
১১. দেশনায়ক – ১১
১২. দেশনায়ক – ১২
১৩. দেশনায়ক – ১৩
১৪. দেশনায়ক – ১৪
১৫. দেশনায়ক – ১৫
১৬. দেশনায়ক – ১৬
১৭. দেশনায়ক – ১৭
১৮. দেশনায়ক – ১৮
১৯. দেশনায়ক – ১৯
২০. দেশনায়ক – ২০
২১. দেশনায়ক – ২১
২২. দেশনায়ক – ২২
২৩. দেশনায়ক – ২৩
২৪. দেশনায়ক – ২৪
২৫. দেশনায়ক – ২৫
২৬. দেশনায়ক – ২৬
২৭. দেশনায়ক – ২৭
২৮. দেশনায়ক – ২৮
২৯. দেশনায়ক – ২৯
৩০. দেশনায়ক – ৩০
৩১. দেশনায়ক – ৩১
৩২. দেশনায়ক – ৩২
৩৩. দেশনায়ক – ৩৩
৩৪. দেশনায়ক – ৩৪
৩৫. দেশনায়ক – ৩৫
৩৬. দেশনায়ক – ৩৬
৩৭. দেশনায়ক – ৩৭
৩৮. দেশনায়ক – ৩৮
৩৯. দেশনায়ক – ৩৯
৪০. দেশনায়ক – ৪০
৪১. দেশনায়ক – ৪১
৪২. দেশনায়ক – ৪২
৪৩. দেশনায়ক – ৪৩
৪৪. দেশনায়ক – ৪৪
৪৫. দেশনায়ক – ৪৫
৪৬. দেশনায়ক – ৪৬
৪৭. দেশনায়ক – ৪৭
৪৮. দেশনায়ক – ৪৮
৪৯. দেশনায়ক – ৪৯
৫০. দেশনায়ক – ৫০

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন