দেশনায়ক – ৪৭

‘ফ্রি ইন্ডিয়া সেন্টার’ কার্যত ছিল সুভাষচন্দ্রের মুখ্য প্রশাসনযন্ত্র। ফ্রি ইন্ডিয়া সেন্টার স্বাধীন ভারতের পুনর্গঠনের বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেবার ব্যবস্থা করে। ১৯৪৩ সালে সুভাষচন্দ্র যখন জাপানে যান তখন তিনি তাঁর সঙ্গে অস্থায়ী ভারত সরকারের একটি বিশদ খসড়া পরিকল্পনা নিয়ে গিয়েছিলেন। ওই সেন্টারের অন্যান্য কয়েকটি উদ্ভাবন ছিল: স্বাধীন ভারতের প্রতীক ত্রিবর্ণ পতাকায় লম্ফোদ্যত ব্যাঘ্র-চিহ্ন (The Springing Tiger); জাতীয় সঙ্গীত রূপে ‘জনগণমন অধিনায়ক’ গানটির ব্যবহার; পরস্পরের সম্ভাষণ বাক্যরূপে ‘জয় হিন্দ’ ব্যবহার এবং সুভাষচন্দ্রকে ‘নেতাজি’ রূপে সশ্রদ্ধ সম্ভাষণ। ভারতে বেতার-প্রচার সেন্টারের আর এক উল্লেখযোগ্য কর্মসূচী ছিল। তিনটি গোপন প্রচারের স্টেশন ছিল—‘আজাদ হিন্দ’ রেডিও, ‘ন্যাশনাল কংগ্রেস’ রেডিও এবং ‘আজাদ মুসলিম’ রেডিও। ভারতবর্ষের অভ্যন্তরে স্বাধীনতা সংগ্রামকে গতিশীল করা ও সংগ্রামীদের উৎসাহ দান ছিল ওই প্রচারের লক্ষ্য। আজাদ হিন্দ রেডিও থেকে নিয়মিত ইংরাজি, হিন্দি, ফারসি, পুস্তু, তেলুগু, গুজরাতি, বাংলা প্রভৃতি ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচারিত হত।

অন্তর্ধানের পর সুভাষচন্দ্র তাঁর স্বদেশবাসীর উদ্দেশে প্রথম বেতারভাষণ দেন ১৯৪২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি (১৫ ফেব্রুয়ারি সিঙ্গাপুরের পতনের পর)। ইতিপূর্বেই ৭-৮ ডিসেম্বর মধ্যরাত্রে জাপান পার্ল হারাবার আক্রমণ করার ফলে আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। ১১ ডিসেম্বর শরৎচন্দ্র বসু ভারত রক্ষা আইনে গ্রেপ্তার হন। কলকাতায় জাপানী কন্‌সাল-জেনারেলের মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে গোপন বার্তায় সুভাষচন্দ্রের যোগাযোগ ছিল। জার্মানী থেকে তাঁর বেতারভাষণে নেতাজি ভারতবাসীকে জানান যে তাঁর অন্তর্ধান কোনও হঠাৎ চমক নয়। ভারতের স্বাধীনতাই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। তিনি দু’টি উদ্দেশ্য নিয়ে দেশ ছেড়েছেন। প্রথমটি হল, বিশ্বে কী ঘটছে তা স্বচক্ষে দেখা। দ্বিতীয়টি হল, স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের কোনও মিত্র আছে কি না তা বিচার করে দেখা। তিনি নিজে যেখানেই থাকুন না কেন, তাঁর আনুগত্য একমাত্র ভারতবর্ষের প্রতিই থাকবে। যুদ্ধের সময় নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকলে ভারতের আত্মহত্যার সামিল হবে। স্বাধীনতার নাগপাশ মুক্ত আর হবে না। এই যুদ্ধে বৈদেশিক সাহায্য নিতেই হবে। তিনি একটি বিষয় সম্পর্কে তাঁর নীতি ও সঙ্কল্প সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেন। সেটি হল অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতের সম্পূর্ণ আত্মনিয়ন্ত্রণের ও সিদ্ধান্তগ্রহণের স্বাধীনতা। অক্ষশক্তির (জার্মানী, জাপান ও ইতালী) সঙ্গে সহযোগিতার অর্থ কোনওমতেই এই নয় যে, ভারত তাদের প্রাধান্য মেনে নেবে বা অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে তাদের মতাদর্শ গ্রহণ করবে।

জার্মানীতে যুদ্ধবন্দী ভারতীয় সৈন্যদের নিয়ে একটি জাতীয় সেনাবাহিনী গঠনের পরিকল্পনা করেন সুভাষচন্দ্র। ওই রকম একটি বাহিনী গঠনের চিন্তা তাঁর মনে প্রথম আসে কয়েকজন ভারতীয় যুদ্ধবন্দীদের কথা শুনে। এই বন্দীদের বার্লিনে প্রতিদিন নিয়ে আসা হত বি বি সি-র হিন্দুস্তানী অনুষ্ঠান শুনে অনুবাদ করার জন্যে। এদের সঙ্গে কথা বলে তাঁর মনে হয় যে, এদের মতো আরও অনেক ভারতীয় যুদ্ধবন্দী জার্মানীতে আছে যারা অসহায়, নিষ্ক্রিয়, হতাশাগ্রস্ত হয়ে দিন কাটাচ্ছে। এইসব স্বাস্থ্যবান ভারতীয় যুবকদের নিয়ে দেশের মুক্তি সংগ্রামের জন্যে বিদেশের মাটিতে এক সশস্ত্র বাহিনী গঠন করার উদ্যোগ নিতে তিনি মনস্থ করেন। তাঁর এই প্রস্তাবে নাৎসী সরকারের অনুমোদন লাভ করা সহজ হয়নি। শেষপর্যন্ত অনুমোদন দিলেও জার্মান সরকার এই বাহিনীর ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ তথা জাতীয় সেনাবাহিনী নামকরণে আপত্তি করে। বাহিনীর নামকরণ হয় ‘ইন্ডিয়ান লিজিয়ন’ (Indian Legion)। শুধুমাত্র জার্মান সরকারের আপত্তিই নয়, ভারতীয় যুদ্ধবন্দীদের অনেকের এতে আপত্তি ছিল। ব্রিটিশ রাজের প্রতি ভক্তি এবং সুভাষচন্দ্র ও তাঁর প্রস্তাবের প্রতি তাদের সন্দিগ্ধ মনোভাব দূর করা সহজ হয়নি। কিন্তু সুভাষচন্দ্র শেষপর্যন্ত সফল হয়েছিলেন এই বাহিনী গড়তে। যুদ্ধের পর আই. এন. এ. বন্দীদের বিচারের সময় এই বাহিনীকে হিটলার অনুপ্রাণিত পঞ্চম বাহিনী (Hitler inspired Fifth-Columnist) বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল। লাডলি মোহন রায়চৌধুরী তাঁর ‘আজাদহিন্দ ফৌজের কোর্ট মার্শাল ও গণ-বিক্ষোভ’ গ্রন্থে এই প্রসঙ্গে দিল্লির ‘নেহরু লাইব্রেরি ও মিউজিয়ম’-এ রক্ষিত গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকারভিত্তিক তথ্যের উল্লেখ করেছেন। ইন্ডিয়ান লিজিয়নে সৈন্য সংগ্রহের সময় সুভাষচন্দ্র সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছিলেন যে এই বাহিনীকে কোনওমতেই সোভিয়েট রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে না। এই বিষয়ে প্যারিসবাসী ভারতীয় কমিউনিস্ট প্রমোদ সেনগুপ্তের সঙ্গে তাঁর খোলাখুলি কথা হয়েছিল। সুভাষচন্দ্রের ওই প্রতিশ্রুতিতে আস্থা স্থাপন করে নিজে কমিউনিস্ট হয়েও প্রমোদ সেনগুপ্ত ওই বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন।

গণপুলের গ্রন্থে ইন্ডিয়ান লিজিয়ন (যা আজাদ হিন্দ ফৌজ নামেই পরিচিত পেয়েছিল) কীভাবে মাত্র পনেরোজনকে নিয়ে গঠিত হয়ে এক বছরের মধ্যে চার ব্যাটেলিয়নের এক সুশৃঙ্খল, শিক্ষণপ্রাপ্ত ও আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত বাহিনীতে পরিণত হয়েছিল তার প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা আছ। সুভাষচন্দ্র ভারতবর্ষের একজন বড় কংগ্রেসী নেতা থেকে তাঁর বাহিনীর প্রতিটি সৈনিক, সহকর্মী এবং সহযোদ্ধার কাছে ‘নেতাজি’ রূপে স্বীকৃতি ও সম্মান অর্জন করে কীভাবে তাদের মনের গভীরে স্থান করে নিয়েছিলেন তা পড়লে অভিভূত না হয়ে উপায় নেই। এই কাজটি সহজ ছিল না। যেসব ভাবতীয় যুদ্ধবন্দী ইন্ডিয়ান লিজিয়নে যোগ দিয়েছিল এবং যারা দূর প্রাচ্যে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মিতে (INA) যোগ দিয়েছিল তাদের মধ্যে অল্পসংখ্যকই প্রথম থেকেই দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ ছিল। তাদের অনেকের মনেই সংশয় ও সন্দেহ ছিল। রাজভক্তি ও রাজভীতিও কম ছিল না। অনেকে বাধ্য হয়ে যোগ দিয়েছিল কারণ, যুদ্ধবন্দীর জীবন সুখকর ছিল না। অনেকে এমন আশাও করেছিল যে, এর ফলে তাদের ভবিষ্যত কর্মজীবনের পক্ষে সুবিধা হতে পারে। সুভাষচন্দ্রের নাম ও জাতীয় কংগ্রেস তথা স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর অসাধারণ ভূমিকার কথা তাদের জানা থাকলেও খুব স্বচ্ছ ধারণা ছিল না। যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ ও জাতির মানুষ ছিল; শিক্ষা, মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রচুর পার্থক্য ছিল। এদের অনেকেই ছিল অশিক্ষিত বা অল্প শিক্ষিত। এই বিবিধ জাতি, ধর্ম ও চরিত্রের যুদ্ধবন্দীদের নিয়ে নেতাজি সুভাষ যেভাবে প্রতিকূলতার মধ্যে, প্রথমে জার্মানীতে ইন্ডিয়ান লিজিয়ন ও পরে দূরপ্রাচ্যে INA গড়ে তুলেছিলেন তার তুলনা নেই। সুভাষচন্দ্রের জীবনের এটি ছিল এক অসাধারণ কৃতিত্ব।

সুভাষচন্দ্র তাঁর সৈন্যবাহিনীর উদ্দেশে ভাষণ দিতেন সহজ হিন্দুস্তানি ভাষায়। তাঁর ভাষণে ফুটে উঠত পরাধীনতার দুঃখ-বেদনা, মাতৃভূমি ও স্বদেশবাসীর প্রতি গভীর ভালবাসা। তিনি আবেদন করতেন তাদের হৃদয়ের কাছে। সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করতেন যে, তাঁর একমাত্র লক্ষ্য হল ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ও ভারতবাসীর সুখ-সমৃদ্ধি। কোনও রকম মিথ্যা প্রতিশ্রুতি তিনি দিতেন না। মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়া ছিল তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। তিনি এও জানতেন যে, যে সত্যের কথা তিনি বলছেন (ভারতের সুনিশ্চিত স্বাধীনতা অর্জন) সেখানে পৌঁছনর পথ অত্যন্ত কঠিন ও বিপজ্জনক। পদে পদে রয়েছে মৃত্যুর আশঙ্কা। তাই তিনি দেশের জন্যে আত্মোৎসর্গের আবেদন করতেন তাদের হৃদয়, বিবেক ও শুভবুদ্ধির কাছে। সুভাষচন্দ্রকে তারা অবিশ্বাস করেনি। তবে প্রথমেই তাদের পূর্ণ আস্থা অর্জন করা সহজসাধ্য ছিল না। নেতাজি জানতেন যে, তিনি যাই বলুন না কেন, যুদ্ধবন্দী জওয়ানদের আস্থা অর্জন করা ও তাদের মরণপণ স্বাধীনতা সংগ্রামী বাহিনীতে পরিণত করা খুবই দুরূহ। কিন্তু তিনি সফল হয়েছিলেন। মনে প্রাণে তাঁর বাহিনী তাদের নেতাকে সর্বাধিনায়ক ‘নেতাজি’ রূপে গ্রহণ করেছিল। গনপুলে লিখেছেন যে, যদি সুভাষচন্দ্র মিথ্যা আশ্বাস ও তাঁর বাহিনীতে যোগ দিলে এক রঙীন ভবিষ্যতের চিত্র দিতেন তাহলে আরও বহু জওয়ান তাঁর বাহিনীতে যোগ দিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে অক্ষশক্তির বিপর্যয়ের সময়ে নেতাজির বাহিনীর কিছু সৈনিক দুর্বলতা, স্বার্থপরতা ও বিশৃঙ্খলতার পরিচয় যে দেয়নি তা নয়। চরম সামরিক বিপর্যয়ের মধ্যে এরকম ঘটা অস্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু সামগ্রিকভাবে নেতাজির মুক্তিফৌজ সাহস ও আত্মোৎসর্গের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। তাদের প্রতি নেতাজির বিশ্বাস ও দেশের মুক্তির জন্যে চরম ত্যাগস্বীকারের আহ্বানের মর্যাদা তারা রক্ষা করেছিল।

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর পরিকল্পনা ও তাঁর নেতৃত্ব গ্রহণ সম্পর্কে তাদের মনোভাব ও সিদ্ধান্ত জানিয়ে ভারতীয় যুদ্ধবন্দীরা মেজর ফুজিয়ারাকে যে চিঠি দিয়েছিল (১ জানুয়ারি, ১৯৪২) তা নেতাজি ও তাঁর মুক্তিবাহিনীর মধ্যে সম্পর্কের ভিত কী ছিল তা বুঝতে সহায়তা করে। ওই চিঠিতে যুদ্ধবন্দীরা জানান যে, তারা সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্ব স্বীকার করা বিশেষ সম্মানজনক ও মূল্যবান বলে মনে করে। তিনি এমন একজন চরমপন্থী নেতা যিনি বিপ্লব ও আমূল পরিবর্তনে বিশ্বাস করেন। ভারতের জনগণ তাঁর নেতৃত্বে আন্দোলন শুরু হওয়ার জন্যে সাগ্রহে অপেক্ষা করছে। তাঁর জনপ্রিয়তা ও তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা সারা দেশব্যাপী। তিনি এমন একজন নেতা যাঁর নামেই ভারতের জনগণের মধ্যে এক আলোড়ন ও ভারতীয় সৈন্যবাহিনীতে এক প্রবল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে। “আমরা INA-র সদস্যরা তাঁর জন্য আমাদের প্রতিটি রক্তবিন্দু দিতে প্রস্তুত আছি। তাঁর নাম আমাদের মধ্যে নতুন প্রাণসঞ্চার করে।” স্বাক্ষরকারীরা জাপান সরকার যে সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে সহযোগিতা করতে উদ্যোগী হয়েছে তার জন্যে তারা ধন্যবাদ জানায়। তারা ঘোষণা করে যে, সুভাষচন্দ্র যেদিন তাদের সামনে উপস্থিত হবেন সেইদিনই, যদি প্রয়োজন হয়, তারা প্রকাশ্যে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের নিন্দা করবে। জাপান সরকার ও সুভাষচন্দ্রের মধ্যে যে কোনও বোঝাপড়া হোক না কেন তা মেনে নিতে তারা সম্মত আছে। ওই চিঠিতে তারা আরও জানায় যে, যুদ্ধে তারা সক্রিয় অংশ নিতে চায়। কিন্তু মালয়ে বহু ভারতীয় সৈন্য আছে যারা তাদের নিকট সম্পর্কীয়। স্বভাবতই তারা তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চায় না। INA-র জওয়ানরা বর্মা বণক্ষেত্রের সম্মুখভাগে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত। আরও ভাল হবে যদি ভারতীয় সীমান্তের যুদ্ধে তাদের নিয়োগ করা হয়। ভারতের মাটিতে যুদ্ধ হলে আরও বহু সংখ্যক ভারতীয় INA-তে যোগ দেবে।

এই চিঠি থেকে বোঝা যায় সুভাষচন্দ্র টোকিও পৌঁছবার (১৬ মে, ১৯৪৩) বহু পূর্বেই কীভাবে তাঁকে স্বাগত জানিয়ে INA-র নেতৃত্বপদে বরণের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিল। জার্মানীতে ইন্ডিয়ান লিজিয়নের ‘নেতাজি’কে জাপান ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্বাধীনতাকামী ভারতীয়রা ও ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর যুদ্ধবন্দী ভারতীয় সৈনিকরা ভারতীয় মুক্তিবাহিনীর তথা স্বাধীনতা আন্দোলনের সর্বাধিনায়করূপে স্বাগত জানাতে কতখানি উদগ্রীব হয়েছিল।

সুভাষচন্দ্রের পক্ষে জার্মানীতে তাঁর উদ্দেশ্য ও পরিকল্পিত কর্মসূচী কার্যকর করা মোটেই সহজসাধ্য ছিল না। হিটলার নিজেই যে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং আন্দোলন সম্বন্ধে সভানুভূতিশীল ছিলেন না, তা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। জার্মান সরকার ও নাৎসী দলেও স্বভাবতই একই মনোভাব প্রতিফলিত হয়েছিল। জার্মান বৈদেশিক দপ্তরে একটি বিশেষ ভারতীয় শাখা (Special India Division) ছিল। এই দপ্তরের ভারত ‘বিশেষজ্ঞ’ বলে পরিচিত বেশির ভাগ অফিসাররা প্রকৃতপক্ষে ভারতবর্ষ সম্বন্ধে প্রায় অজ্ঞ ছিলেন। এঁদের নীতি নির্ধারণের কোনও ক্ষমতাও ছিল না। সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা ছিল জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিবেনট্রপের (Ribbentrop)। কিন্তু সুভাষচন্দ্র বার্লিনে পৌঁছলে রিবেনট্রপ তাঁর উপস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারেননি। এর ফলে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে জার্মান সহযোগিতার প্রস্তাব, ওই সহযোগিতা জার্মানীর পক্ষে কতকটা সহায়ক হতে পারে সেই সম্বন্ধে সুভাষচন্দ্রের বক্তব্য জার্মান পররাষ্ট্র দপ্তরে ও নাৎসী দলের উচ্চ মহলে তেমন কোনও উৎসাহ সৃষ্টি করতে পারেনি। কিন্তু প্রাথমিক ব্যর্থতায় সুভাষচন্দ্র হতাশ হননি। কিছুকালের মধ্যেই জার্মান সরকারের মনোভাবে পরিবর্তন দেখা দেয়। সুভাষচন্দ্রের গুরুত্ব তাঁরা উপলব্ধি করতে থাকেন। এর জন্যে বহুলাংশে দায়ী ছিলেন Special India Division-এর অ্যাডাম ফন ট্রট (Adam Von Trott) ও তাঁর সহকারী অ্যালেকজান্ডার ভেৰ্থ (Alexander Werth)। ট্রট অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। ভারতের সমস্যার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল। ভের্থ ব্যারিস্টারি পাশ করেছিলেন। তাঁরও ভারতবর্য সম্বন্ধে জ্ঞান ও আগ্রহ ছিল। এঁদের দু’জনের চেষ্টায় নাৎসী দলের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের যোগাযোগ গড়ে ওঠে।

১৯৪১ সালের ২২ জুন জার্মানী সোভিয়েত রাশিয়া আক্রমণ করার পর যুদ্ধের ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে। সুভাষচন্দ্রের পরিকল্পনা ছিল যে, জার্মান-রুশ অনাক্রমণ চুক্তির ফলে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে ভারতবর্ষের ওপর সশস্ত্র অভিযান করার সুযোগ-সুবিধা আছে। ওই সুযোগ গ্রহণ করে ভারতে ব্রিটিশ শক্তিকে পরাজিত করতে পারলে জার্মানীর যেমন যুদ্ধে বিরাট সাফল্য হবে, তেমনি ভারতবর্ষ স্বাধীন হবে। এই মর্মে ঘোষণা ও প্রতিশ্রুতি তিনি নাৎসী সরকারের কাছে চেয়েছিলেন তা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। হিটলার ওইরকম ঘোষণায় সম্মত হননি। কিন্তু এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জার্মানীর মনোভাবেরও কিছু পরিবর্তন হতে থাকে। সম্পূর্ণ না হলেও আংশিকভাবে সুভাষচন্দ্রের প্রস্তাবগুলি জার্মান সরকার অনুমোদন করে। এর ফলেই ‘ফ্রি ইন্ডিয়ান সেন্টার’ স্থাপন ও ‘ইন্ডিয়ান লিজিয়ন’ গড়া সুভাষচন্দ্রের পক্ষে সম্ভব হয়।

জার্মানীতে সুভাষচন্দ্রের কর্মতৎপরতা ও নাৎসী সরকার এবং দলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের তথ্যবহুল বিবরণ ও বিশ্লেষণ রয়েছে নন্দ মুখোপাধ্যায়ের পূর্বে উল্লিখিত গ্রন্থে। জার্মান সরকারের কাছে যে স্মারকলিপি তিনি দিয়েছিলেন (৯ এপ্রিল, ১৯৪১) তা ব্যাখ্যা করার জন্যে সুভাষচন্দ্র হিটলারের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের অনুমতি চেয়েছিলেন। এই অনুমতি প্রত্যাখ্যাত হলেও ১৯৪১ সালের ২৯ এপ্রিল ভিয়েনার হোটেল ইম্পিরিয়ালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিবেনট্রপ সুভাষচন্দ্রকে প্রথম অভ্যর্থনা জানান। সুভাষচন্দ্র রিবেনট্রপকে স্পষ্টভাবেই জানান যে, ভারতীয়রা অন্যান্য জাতিসমূহের প্রতি জাতীয় সমাজতন্ত্রী ও ফ্যাসিস্টদের মনোভাবের বিরোধী। ভারতীয় জনগণের আস্থা ও সমর্থন অর্জনের জন্যে জার্মানীর প্রকাশ্য বিবৃতি দেওয়া উচিত যে, ‘জার্মানীর বিজয় ভারতের মুক্তি আনবে।’ বসুর সঙ্গে তাঁর সব কথাবার্তার বিবরণ রিবেনট্রপ হিটলারকে জানান। হিটলারের তা মোটেই পছন্দ হয়নি।

সুভাষচন্দ্র ভারতবর্ষের স্বার্থেই রাশিয়া ও জার্মানীর মধ্যে বোঝাপড়া চেয়েছিলেন। জার্মানীর নিজের স্বার্থেও যে রুশ-জার্মান বোঝাপড়া অত্যন্ত প্রয়োজন তাও তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন। তাঁর এই বক্তব্য নাৎসী সরকারের কাছে কোনও গুরুত্ব পায়নি কেননা ইতিমধ্যেই হিটলারের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটছিল। তিনি রাশিয়া আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত করে ফেলেছিলেন। জার্মানী রাশিয়া আক্রমণ শুরু করলে সুভাষচন্দ্র উপলব্ধি করেন যে জার্মানী এক বিরাট ভুল করেছে। এরপর আর জার্মানীতে থেকে ভারতের মুক্তি সংগ্রামের জন্যে কোনও কার্যকরী পরিকল্পনা অসম্ভব। তিনি রোমে জার্মান বৈদেশিক দপ্তরের ডঃ ভোরম্যান-কে সোজাসুজি জানিয়ে দেন যে, সোভিয়েত রাশিয়া ভারতের মানুষের কাছে, বিশেষ করে বুদ্ধিজীবীদের কাছে জনপ্রিয়। রুশ-জার্মান যুদ্ধে স্বভাবতই তাঁদের সহানুভূতি রাশিয়ার দিকে। তিনি পুনরায় ভোরম্যানের কাছ তাঁর অভিমত ব্যক্ত করেন যে, জার্মানী যদি এখনও দ্রুত ঘোষণা করে যে এই যুদ্ধে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা তার অন্যতম লক্ষ্য তাহলে ভারতীয়দের ওপর তার প্রভাব পড়বে।

তাঁর এই অভিমতে নাৎসী জার্মানী কোনও গুরুত্ব দেবে এ আশা ছিল অবাস্তব। যুদ্ধ সম্বন্ধে ভারতীয়দের মতামত জার্মানীর পক্ষে না বিপক্ষে এই নিয়ে জার্মান সরকারের আদৌ কোনও উদ্বেগ যুদ্ধের তৎকালীন পরিস্থিতিতে হিটলারের ছিল না। সুভাষচন্দ্র নিজেরও তা অজানা ছিল না। কিন্তু যা তিনি ন্যায় বা সত্য বলে মনে করতেন, যা ভারতের স্বাধীনতা ও কল্যাণের জন্যে তিনি বলা বা করা প্রয়োজন বলে বিশ্বাস করতেন তা নির্ভীকভাবে করতে বা বলতে সুভাষচন্দ্রের এতটুকু ভয় ছিল না। রাশিয়া আক্রমণের পরেও ইতালীতে থেকে ও পরে জার্মানীতে অবস্থানকালে রাশিয়া আক্রমণের প্রকাশ্য নিন্দা করার সাহস (বা দুঃসাহস) একমাত্র সুভাষচন্দ্রের মতো মানুষেরই পক্ষে সম্ভব ছিল। মানুষটি যে সত্যিই অসাধারণ এবং তাঁকে একেবারে উপেক্ষা করা ঠিক হবে না এটি কিন্তু নাৎসীরা বুঝতে পারে। তার প্রমাণ হল রিবেনট্রপ পুনরায় বার্লিনে সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে সম্মত হয়েছিলেন (২৯ নভেম্বর, ১৯৪১)। সুভাষচন্দ্রের প্রস্তাবিত ‘ভারত ঘোষণা’ সম্পর্কে রিবেনট্রপের মানসিকতার কিছুটা পরিবর্তন হয়েছিল।

১৯৪১ সালের শেষে জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেবার ফলে পরিস্থিতির গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে। বার্লিনে জাপানের রাষ্ট্রদূত ওসিমা-র (Oshima) সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের যোগাযোগ ছিল। সুভাষচন্দ্র তাঁকেও যুদ্ধের উদ্দেশ্য ঘোষণায় ভারতবর্ষের স্বাধীনতার প্রশ্নটি যুক্ত করার কথা বলেছিলেন। ওসিমা সুভাষচন্দ্রের ওই প্রস্তাবের গুরুত্ব বুঝেছিলেন। তিনি সে কথা হিটলারকেও বলেছিলেন। কিন্তু হিটলারের মতের পরিবর্তন হয়নি। মুসোলিনী ভারত ও আরবের ব্যাপারে অক্ষশক্তির ঘোষণার অনুকূলে ছিলেন। এর পিছনে ছিল সুভাষচন্দ্রের প্রচেষ্টা ও প্রভাব।

প্রধানত ইতালী ও জাপানের চাপে হিটলার শেষপর্যন্ত সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে সম্মত হন। দিনটি ছিল ২৭ মে, ১৯৪২ (আর একটি মতে ২৯ মে)। এই একবারমাত্র উভয়ের সাক্ষাৎকার ঘটেছিল। দু’জনের মধ্যে কী কথাবার্তা হয়েছিল এই বিষয়ে বেশ কিছু পরস্পর-বিরোধী বিবরণ আছে। রিবেনট্রপ ও বৈদেশিক দপ্তরের Special Bureau for India-র ভারপ্রাপ্ত কেপলার (Keppler) আলোচনার সময় উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও সম্পূর্ণ নির্ভরযোগ্য বিবরণ পাওয়া যায় না। হিটলারই বেশি কথা বলেছিলেন। তিনি বিশ্ব পরিস্থিতি সম্বন্ধে একটি ছোটখাটো বক্তৃতা সুভাষচন্দ্রকে শুনিয়ে ছিলেন। জার্মানী থেকে ভারতের দূরত্ব, রাশিয়ার মধ্যে দিয়ে ভারতে অভিযান করা কতটা কঠিন ও প্রায় অসম্ভব তা বোঝাতে চেষ্টা করেন।

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সম্বন্ধে তখনি কোনও প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করা অনুচিত ও অসম্ভব বলে তিনি জানান। যুদ্ধের পর ভারতবর্ষকে জার্মান অর্থনৈতিক সাহায্য দেওয়া সম্ভব হতে পারে সাধারণভাবে এইটুকু তিনি বলেন। ‘মাইন ক্যাম্ফ’-এ হিটলার ভারতবর্ষ সম্বন্ধে যেসব অত্যন্ত আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন তা সংশোধন করার কথা সুভাষচন্দ্র তুললে হিটলার ওই প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান। সুভাষচন্দ্রকে তিনি বলেন যে, জাপান যুদ্ধে যোগ দেবার ফলে দূর প্রাচ্যে যুদ্ধ এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিরাট পরিবর্তন ঘটেছে। এই পরিস্থিতিতে জাপান ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে তাঁর কর্মক্ষেত্র করলে সুভাষচন্দ্র তাঁর পরিকল্পনা কার্যকর করতে অনেক বেশি সফল হবেন। সুভাষচন্দ্র যাতে জাপানে যেতে পারেন, তার জন্যে সব ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ তিনি দেবেন বলে জানান।

হিটলারের সঙ্গে কথা বলে সুভাষচন্দ্র সম্পূর্ণ হতাশ হয়েছিলেন। তিনি তাঁর ভারতীয় সহকর্মীদের বলেছিলেন যে হিটলারের সঙ্গে কয়েক মিনিটের জন্যেও যুক্তিগ্রাহ্য কোনও আলোচনা করা সম্ভব নয়। সুভাষচন্দ্র পূর্বেই বুঝেছিলেন জার্মানীতে তাঁর পক্ষে আর তেমন কিছু করা সম্ভব হবে না। তাঁর পক্ষে জাপান ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নিজের পরিকল্পনা সফল করে লক্ষ্যে পৌঁছনোর সম্ভাবনা অনেক বেশি। ১৯৪২-এর ২২ মে তিনি জার্মান পররাষ্ট্র দপ্তরকে জানিয়েছিলেন, “ভারতে বিপ্লব ঘটবার সময় এসে গেছে। ব্রিটিশ জোয়াল ছুড়ে ফেলে স্বাধীনতা অর্জনের সময় এসেছে এবং সেজন্য আমার পূর্বে উপস্থিত থাকা প্রয়োজন বিপ্লবের নেতৃত্ব দিতে।” হিটলারের সঙ্গে কথাবার্তার পর ওই বিষয়ে তিনি স্থির নিশ্চিত হন। হিটলার তাঁর জাপান যাত্রার ব্যবস্থা করে দিতে যে সম্মত হয়েছিলেন এটাই ছিল সুভাষচন্দ্রের সবচেয়ে বড় লাভ। সুভাষচন্দ্রের বিশ্বাস ছিল যে হিটলারের সঙ্গে সামনা-সামনি কথা বলার সুযোগ পেলে তিনি হিটলারের ভারতবর্ষ ও ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে মনোভাব ও ভ্রান্ত ধারণার পরিবর্তন ঘটাতে পারবেন। তা হয়নি। হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই ছিল না। হিটলারকে তিনি চিনতে ও বুঝতে ভুল করেছিলেন। এই ভুল তিনি একলা করেননি। স্ট্যালিনও করেছিলেন। হিটলার ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরোধী ছিলেন না, বরং গুণগ্রাহী ছিলেন। ভারতের ব্রিটিশ শাসনের অবসান তিনি চাননি। কিন্তু ঘটনাচক্রে ব্রিটেনের সঙ্গে জার্মানীর যুদ্ধ বেধেছিল। জার্মানী যুদ্ধে পরাজিত হলেও, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অবলুপ্তির জন্যে হিটলার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অনেকখানি দায়ী ছিলেন।

বার্লিন থেকে আজাদ হিন্দ বেতারে প্রচারিত নেতাজি সুভাষের ভাষণগুলি কতখানি কার্যকর হয়েছিল ও ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল তার দুটি দৃষ্টান্ত বিশেষ উল্লেখযোগ্য। গোয়েব্‌লস তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেন, “বার্লিন থেকে পরিচালিত বসুর প্রচারকার্য ইংজেদের পক্ষে অত্যন্ত অস্বস্তিকর হচ্ছে।” সুভাষচন্দ্রের ভাষণ শোনার জন্যে ভারতবর্ষের অগণিত মানুষ অধীর আগ্রহ ও উত্তেজনা সহকারে অপেক্ষা করত। এই ব্যাকুলতা শুধুমাত্র যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাঁদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সাধারণ মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছিল। আমার বাল্যস্মৃতি এখনও উজ্জ্বল হয়ে আছে। আমরা সব ভায়েরা বাবা ও মা’র সঙ্গে বাড়ি একটি নির্দিষ্ট ঘরে বসে নেতাজির কণ্ঠস্বর শোনার জন্যে উৎকণ্ঠিত হয়ে রেডিও খুলে বসতাম। প্রচারে বিঘ্ন ঘটলে অসহিষ্ণু হয়ে উঠতাম, কেউ কোনও কথা বললে বাবা ধমক দিয়ে একেবারে চুপ করে শুনতে বলতেন। সে এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। ভারতীয়দের মনে সুভাষচন্দ্রের জার্মানী থেকে প্রচারকার্য সম্বন্ধে ইংরাজরা এত বিচলিত হয়েছিল যে, ১৯৪২ সালের ২৫ মার্চ বি বি সি থেকে প্রচার করা হয় যে সুভাষচন্দ্র পূর্ব এশিয়ায় এক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। সুভাষচন্দ্র নিজে এই মিথ্যা প্রচারের কথা জেনে, তাঁর বৃদ্ধা মা ও পরিবারের অন্যান্যদের মানসিক প্রতিক্রিয়ার কথা চিন্তা করে খুবই বিচলিত হন। তিনি আরও উদ্বিগ্ন হন যখন তিনি শোনেন যে গান্ধীজি ওই “দুঃসংবাদ” শুনে তাঁর মা’কে একটি শোকবার্তা পাঠিয়েছেন। পরের দিনই অবশ্য জার্মান ও জাপানী সংবাদে এই মিথ্যা ফাঁস হয়ে যায়।

হিটলারের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের পর সুভাষচন্দ্র আর কোনও সময় নষ্ট না করে পূর্ব এশিয়ায় যাওয়ার জন্যে অধীর হয়ে পড়েন। কিন্তু হিটলার প্রতিশ্রুতি দিলেও সব প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করতে প্রায় ন’ মাস লেগেছিল। সুভাষচন্দ্রের নিজের ইচ্ছা ছিল বিমানে যাত্রা করা। বিমানে ওই দীর্ঘপথ অতিক্রম করা অত্যন্ত বিপজ্জনক ও খুব বেশি ঝুঁকি নেওয়া হবে মনে হওয়ায় স্থির হয় যে, সাবমেরিনে দূর প্রাচ্যে জলযাত্রা করাই সমীচীন হবে। অবশ্য সাবমেরিনে দীর্ঘ সমুদ্রপথ অতিক্রম করাও কম বিপদসঙ্কুল ছিল না। যথাসম্ভব এক নিচ্ছিদ্র পরিকল্পনা স্থির করা নিয়ে জার্মান ও জাপানী সামরিক কর্তৃপক্ষের মধ্যে গোপনে দীর্ঘ কথাবার্তা হয়েছিল। শেষপর্যন্ত ১৯৪২-এর ৮ ফেব্রুয়ারি আবিদ হাসানের সঙ্গে সুভাষচন্দ্র সাবমেরিনে জার্মানী ত্যাগ করে তাঁর ঐতিহাসিক জলযাত্রা শুরু করেন। কিয়েল বন্দরে কেপলার, নামবিয়ার ও ভের্থ তাঁকে বিদায় জানান। তিনি যে জার্মানী ত্যাগ করে জাপানে পাড়ি দিয়েছেন তা গোপন রাখার জন্যে তাঁর যাত্রা শুরু হওয়ার পরও বেতারে তাঁর রেকর্ড করা বাণী প্রচার করা হতে থাকে। যাত্রার দু’ সপ্তাহ পূর্বে, ২৬ জানুয়ারি, বার্লিনে ভারতীয় স্বাধীনতা দিবস পালনের এক অনুষ্ঠানে সুভাষচন্দ্র ভাষণ দিয়েছিলেন। এই গুরুত্বপূর্ণ ভাষণে ইতিমধ্যে ভারতবর্ষে জাতীয় কংগ্রেসের পরিচালনায় ও গান্ধীজির নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রামে যে নতুন মোড় নিয়েছিল সে সম্পর্কে সুভাষচন্দ্রের অভিমত ব্যক্ত হয়েছিল।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জাপানী বাহিনীর সাফল্য, বিশেষ করে রেঙ্গুনের পতনে (৮ মার্চ, ১৯৪২) উদ্বিগ্ন হয়ে ব্রিটিশ সরকার আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসার সূত্র বার করার জন্যে ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস-কে ভারতবর্ষে প্রেরণ করেন। ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার পর ভারতের রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক সমস্যাগুলির সমাধানের জন্যে একগুচ্ছ প্রস্তাব করে ক্রিপস এক বিবৃতি দেন (৩০ মার্চ, ১৯৪২)। কিন্তু ক্রিপসের প্রস্তাব কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয়েই প্রত্যাখ্যান করে। লীগ ঘোষণা করে যে, ভারত-বিভাগ করে দু’টি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া অন্য কোনও সমাধান নেই। ক্রিপসকে ভারতে পাঠানোর সিদ্ধান্তের পিছনে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্কলিন ডেলানা রুজভেল্টের কিছুটা হাত ছিল। তিনি ভারতবর্ষের সমস্যার সমাধানে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু ক্রিপসের প্রস্তাবে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার স্বীকৃতির উল্লেখ ছিল না। জওহরলাল রুজভেল্টকে জানান যে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে কংগ্রেসের পূর্ণ সমর্থন আছে। কিন্তু অবিলম্বে ভারতে একটি জাতীয় সরকারের যুক্তিসঙ্গত দাবি ব্রিটিশ সরকার অগ্রাহ্য করায় কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছন সম্ভব হয়নি। ক্রিপস-মিশনের ব্যর্থতার পর কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি ঐতিহাসিক ‘ভারত ছাড়ো’ (Quit India) প্রস্তাব গ্রহণ করে। ৭ আগস্ট দেশব্যাপী অহিংস গণ-আন্দোলন শুরু করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। গান্ধীজি ঘোষণা করেন, “আমরা পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া অন্য কিছুতেই সন্তুষ্ট হব না। আমরা দেশকে স্বাধীন করব নয়তো ওই প্রচেষ্টায় মৃত্যুবরণ করব।” ৯ আগস্ট গান্ধীজি ও অন্যান্য কংগ্রেস নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়। কংগ্রেস বেআইনী সংগঠন রূপে ঘোষিত হয়। এই সংবাদ রাষ্ট্র হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বতস্ফূর্তভাবে ‘ভারত ছাড়’ বা ’৪২-এর আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। এই আন্দোলন শান্তিপূর্ণ থাকেনি। কোনও কোনও অঞ্চলে তা গণ-অভ্যুত্থানের রূপ ধারণ করে। ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন দমন করার জন্যে ব্রিটিশ প্রশাসন সর্বপ্রকার নির্যাতন ও দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। তাৎক্ষণিক সাফল্য লাভ না করলেও ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন সুস্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করে যে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আসন্ন। ভারতবর্ষের মানুষ পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া অন্য কিছুই মেনে নেবে না।

‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের সিদ্ধান্ত ও দেশব্যাপী গণ-বিক্ষোভ প্রমাণ করেছিল যে, সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ও অবিলম্বে সর্বাত্মক মুক্তি সংগ্রামের দাবি অযৌক্তিক ছিল না। বার্লিনে তাঁর ২৬ জানুয়ারির ভাষণে সুভাষচন্দ্র বলেন, “একই সঙ্গে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদ টিকে থাকতে পারে না। একটিকে বাঁচতে হলে অন্যটিকে সরতে হবে এবং যেহেতু ভারতীয় জাতীয়তাবাদ বেঁচে থাকবে, সেইজন্যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে সরতে হবে। বর্তমানে ভারতে যে সংগ্রাম চলছে তা বস্তুত ১৮৫৭ সালের মহান বিপ্লবের সম্প্রসারণ মাত্র।” অহিংস সত্যাগ্রহ সম্বন্ধে তিনি বলেন যে, গান্ধীজি প্রমাণ করেছেন, “পরোক্ষ প্রতিরোধের অস্ত্র দ্বারা প্রশাসনকে অচল করে দেওয়া সম্ভব। ভারতের তরুণতর প্রজন্ম অবশ্য গত কুড়ি বছরের অভিজ্ঞতায় শিখেছেন যে পরোক্ষ প্রতিরোধের দ্বারা বিদেশী প্রশাসন প্রতিহত কিংবা অচল করা সম্ভব হলেও দৈহিক শক্তি প্রয়োগ করা ছাড়া একে বিনষ্ট করা কিংবা বিতাড়িত করা সম্ভব নয়।”

এই লক্ষ্য সিদ্ধ করার উদ্দেশ্য নিয়েই প্রথমে জার্মানী ও পরে দূর প্রাচ্যে যাত্রা করেছিলেন নেতাজি সুভাষ।

সকল অধ্যায়

১. দেশনায়ক – ১
২. দেশনায়ক – ২
৩. দেশনায়ক – ৩
৪. দেশনায়ক – ৪
৫. দেশনায়ক – ৫
৬. দেশনায়ক – ৬
৭. দেশনায়ক – ৭
৮. দেশনায়ক – ৮
৯. দেশনায়ক – ৯
১০. দেশনায়ক – ১০
১১. দেশনায়ক – ১১
১২. দেশনায়ক – ১২
১৩. দেশনায়ক – ১৩
১৪. দেশনায়ক – ১৪
১৫. দেশনায়ক – ১৫
১৬. দেশনায়ক – ১৬
১৭. দেশনায়ক – ১৭
১৮. দেশনায়ক – ১৮
১৯. দেশনায়ক – ১৯
২০. দেশনায়ক – ২০
২১. দেশনায়ক – ২১
২২. দেশনায়ক – ২২
২৩. দেশনায়ক – ২৩
২৪. দেশনায়ক – ২৪
২৫. দেশনায়ক – ২৫
২৬. দেশনায়ক – ২৬
২৭. দেশনায়ক – ২৭
২৮. দেশনায়ক – ২৮
২৯. দেশনায়ক – ২৯
৩০. দেশনায়ক – ৩০
৩১. দেশনায়ক – ৩১
৩২. দেশনায়ক – ৩২
৩৩. দেশনায়ক – ৩৩
৩৪. দেশনায়ক – ৩৪
৩৫. দেশনায়ক – ৩৫
৩৬. দেশনায়ক – ৩৬
৩৭. দেশনায়ক – ৩৭
৩৮. দেশনায়ক – ৩৮
৩৯. দেশনায়ক – ৩৯
৪০. দেশনায়ক – ৪০
৪১. দেশনায়ক – ৪১
৪২. দেশনায়ক – ৪২
৪৩. দেশনায়ক – ৪৩
৪৪. দেশনায়ক – ৪৪
৪৫. দেশনায়ক – ৪৫
৪৬. দেশনায়ক – ৪৬
৪৭. দেশনায়ক – ৪৭
৪৮. দেশনায়ক – ৪৮
৪৯. দেশনায়ক – ৪৯
৫০. দেশনায়ক – ৫০

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন