দেশনায়ক – ২৩

জাতীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ নানান সমস্যা, দেশবন্ধুর মৃত্যুর পর স্বরাজ্য দলের শক্তি ও জনপ্রিয়তা হ্রাস, প্রদেশ কংগ্রেসের মধ্যে দলাদলি, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা, সংঘর্ষ ও অন্যান্য নানান কারণে জাতীয় আন্দোলন যখন কিছুটা অবসন্ন ও লক্ষ্যহীন হয়ে পড়েছে এই সময় ব্রিটিশ সরকার স্যার জন সাইমনের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন (নভেম্বর ১৯২৭)। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ক্রমশ উপলব্ধি করছিলেন যে ১৯১৯ সালের আইন অনুসারে প্রবর্তিত শাসন ব্যবস্থা ঠিকভাবে কাজ করছে না। ভারতীয়দের স্বায়ত্তশাসনের দাবির প্রতি সম্পূর্ণ উপেক্ষা প্রদর্শন আর সম্ভব নয়। সমগ্র বিষয়টিকে পর্যালোচনা করে নতুন নীতি অনুসরণ করা আবশ্যক হয়ে পড়েছে। এই উদ্দেশ্য নিয়ে সাইমন কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনের সাতজন সদস্যই ছিলেন শ্বেতাঙ্গ। সাইমন কমিশন গঠনের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই ভারতবর্ষে দারুণ বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সমস্ত রাজনৈতিক দল ও মতের মানুষ বিক্ষুব্ধ হন। কংগ্রেস ওই কমিশনের বিরোধিতা করে ঘোষণা করে যে, ভারতীয়দের স্বরাজ বা স্বায়ত্তশাসন লাভের যোগ্যতা নির্ণয় করার জন্যে অনুসন্ধান ও সুপারিশ করার কোনও যোগ্যতা বা অধিকার ওই কমিশনের নেই। এই রকম এক কমিশন গঠন করে ভারতবাসীকে অপমান করা হয়েছে বলে সকলেই মনে করেন। কংগ্রেস স্থির করে এই কমিশনকে সম্পূর্ণ বর্জন করবে। এমনকি উদারনৈতিক দলও মনে করে যে, কোনও ভারতীয় সাইমন কমিশনে না রেখে এদেশের মানুষকে হেয় করা হয়েছে। স্বদেশের শাসনতন্ত্র রচনায় তাদের অধিকার অস্বীকার করা হয়েছে।

১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সাইমন কমিশনের সাতজন সদস্য ভারতে এসে পৌঁছনোর পূর্বে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। নভেম্বর মাসে এক ঐক্য সম্মেলন হয়। পরের মাসে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সম্মেলন হয়। এর ফলে জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের চিন্তাধারার জয় হয়। স্থির হয়, সাইমন কমিশন তাঁরাও বর্জন করবেন। এ মাসেই কানপুরে নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের অধিবেশনে কমিউনিস্টদের একটি সুসংবদ্ধ দল প্রথম দেখা দেয়। তাঁরা স্বাধীন সমাজবাদী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি তোলেন। ১৯২৭ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষাশেষি মাদ্রাজে ডাঃ এম, এ, আন্সারীর পৌরোহিত্যে কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন বসে।

মাদ্রাজ কংগ্রেসে প্রস্তাব গৃহীত হয় যে, “সর্বক্ষেত্রে সর্বপ্রকারে সাইমন কমিশনকে বর্জন করা হবে। সকল দলের পক্ষে গ্রহণযোগ্য একটি শাসনতন্ত্র রচনার জন্যে একটি সর্বদলীয় সম্মেলন আহ্বান করা হবে।” ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’ ভারতবাসীর লক্ষ্য বলে এই কংগ্রেসের একটি প্রস্তাবও গৃহীত হয়। মাদ্রাজ কংগ্রেসের ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’র (Complete Independence) প্রস্তাব গ্রহণ ছিল এক ঐতিহাসিক ঘটনা। স্বরাজ বা স্বায়ত্তশাসনের দাবির তুলনায় পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি ছিল অনেক বেশি সুস্পষ্ট ও জোরাল। সদ্য বিলাত ও মস্কো প্রত্যাগত তরুণ জওহরলাল নেহরু এই কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন। ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’র প্রস্তাব গ্রহণের পিছনে তাঁর ও শ্রীনিবাস আয়েঙ্গারের এক বড় ভূমিকা ছিল। সুভাষচন্দ্র শারীরিক অসুস্থতার কারণে মাদ্রাজ কংগ্রেসে যোগ দিতে পারেননি। এক বিবৃতিতে তিনি এই কংগ্রেসের সাফল্যের জন্যে তাঁর আনন্দ ও অভিনন্দন জানান এবং জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্যে আবেদন জানান। সর্বসম্মতিক্রমে ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’র প্রস্তাবটি গৃহীত হলেও অধিবেশন শেষ হবার পরেই গান্ধীজি ঘোষণা করেন যে, ঐ প্রস্তাবটি “তাড়াহুড়ো করে রচনা ও পরিণামের কথা না ভেবেই গ্রহণ করা হয়েছে।” গান্ধীজির এই বক্তব্য ও মনোভাবে সুভাষচন্দ্র, জওহরলাল প্রমুখ তরুণ নেতারা খুশি হননি। পরবর্তী কংগ্রেস অধিবেশনে এই মতপার্থক্য ফুটে উঠেছিল। লাহোর কংগ্রেসে দলের সাধারণ সম্পাদক রূপে জওহরলাল নেহরু, সাহেব কুরেশী ও সুভাষচন্দ্র বসু নিযুক্ত হয়েছিলেন। এর ফলে সর্বভারতীয় স্তরে তাঁদের গুরুত্ব ও মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছিল। সুভাষচন্দ্রের দৃষ্টিতে লাহোর কংগ্রেস সুনির্দিষ্টভাবে বামপন্থী নীতির দিকে গতি ফেরার ইঙ্গিত দিয়েছিল।

১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে সাইমন কমিশনের সাত সদস্য ভারতে পৌঁছলে দেশজুড়ে ‘হরতাল’ ডেকে বিক্ষোভ জানান হয়। হরতাল ও ‘বয়কট’ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয় কংগ্রেস। গণ-বিক্ষোভ সবচেয়ে তীব্র ও সফল হয় বাংলাদেশে। এই সাফল্যের কৃতিত্বের সিংহভাগ ছিল সুভাষচন্দ্রের। সাইমন কমিশন পৌঁছবার পূর্ব থেকেই প্রদেশ কংগ্রেস হরতাল, বিদেশীদ্রব্য বর্জন, জনসভা ও মিছিলের মাধ্যমে জনগণের বিক্ষোভ প্রদর্শনের কর্মসূচী গ্রহণ করে। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে সুভাষচন্দ্র দিনের পর দিন সাইমন কমিশন-বিরোধী বক্তৃতা দেন। তিনি তাঁর উদ্দীপ্ত ভাষণে ঘোষণা করেন যে, বিদেশী সরকারের আদেশে, বিদেশী সদস্যদের নিয়ে গঠিত কোনও কমিশনের ভারতীয়দের স্বায়ত্তশাসনের যোগ্যতা আছে কি না তা তদন্ত করে দেখার অধিকার নেই। পৃথিবীর সব স্বাধীন দেশের মানুষের যেমন সুবিধা ও অধিকার আছে আমরা তাই-ই চাই— তার থেকে বিন্দুমাত্র কমও নয়, বেশিও নয়। ভারতবর্ষের মতো এক বিরাট দেশের মানুষের ওপর মুষ্টিমেয় ইংরাজ শাসনের চাবিকাঠি হল এক মোহ— “ইংরাজরা শ্রেষ্ঠতর জাতি এবং ভারতীয়রা অপদার্থ, ঘৃণ্য, নিম্নস্তরের মানুষ।” এই মোহ মুক্ত হতে হবে। ‘হরতাল’ ও বিদেশী ‘বয়কট’ করে প্রমাণ করতে হবে ভারতের মানুষ ব্রিটিশ শাসন চায় না। তারা চায় স্বাধনীতা। সাইমন কমিশন-বিরোধী জন-বিক্ষোভ দমন করার জন্যে ইংরাজ প্রকার নির্বিচারে যে নিপীড়ন, নৃশংসতার আশ্রয় নিয়েছিল তাকে সুভাষচন্দ্র ব্রিটিশ চরিত্রের ‘পশুশক্তির নগ্ন প্রকাশ’ বলে ধিক্কার জানিয়েছিলেন। কিন্তু তারই সঙ্গে তিনি বলেছিলেন, “ইংরাজদের প্রতি আমার কোনো বিদ্বেষ নেই। আমাদের কাছে সকল মানুষই ভ্রাতৃতুল্য।” কিন্তু তাদের যদি স্বাধীন জাতি রূপে বাঁচার অধিকার থাকে, ভারতীয়রাও সেই অধিকার দাবি করতে পারে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, লাহোরে সাইমন কমিশন-বিরোধী বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশের আক্রমণের ফলে লালা লাজপত রায় গুরুতরভাবে আহত হন। কয়েকদিন পরে তাঁর মৃত্যু হয়। লক্ষ্ণৌতে অনুরূপ আক্রমণের ফলে গোবিন্দবল্লভ পন্থ মারাত্মকভাবে আহত হন। ঐ আঘাতের ফলে তিনি চিরকালের জন্যে আংশিক পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। মৃত্যুর আগে লাজপত রায় তাঁর সকল সম্পত্তি জাতিকে দান করে যান। তাঁর মৃত্যুকে সুভাষচন্দ্র ‘সুখের মৃত্যু’ বলে অভিহিত করেছিলেন, কেননা ওই ছিল ‘মহাপুরুষদের জীবনধারণ ও মৃত্যুবরণের রীতির এক দৃষ্টান্ত’। যেমন করেছিলেন দেশবন্ধু। কিন্তু সুভাষচন্দ্রের ক্ষোভ ও অভিযোগ ছিল কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতাদের বিরুদ্ধে। পরবর্তী কংগ্রেস অধিবেশনে (১৯২৮) এই ক্ষোভের কথা ব্যক্ত করে তিনি লাজপত রায়ের মৃত্যু এবং লক্ষ্ণৌ ও কানপুরের ওই ঘটনার পর জাতির আত্মসম্মান রক্ষার উপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যে নেতাদের কাছে আবেদন করেছিলেন। কিন্তু তাঁরা তাতে সাড়া দেননি। গভীর বেদনার সঙ্গে সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন, “কংগ্রেসের জয়-পরাজয় নিয়ে তরুণ ভারত মাথা ঘামায় না। তারা চায় দেশকে মুক্ত করতে এবং তার সকল দায়িত্ব তারা গ্রহণ করেছে। আমরা আমাদের প্রবীণ নেতাদের চাই, আমরা তাঁদের শ্রদ্ধা করি, আমরা তাঁদের ভালোবাসি— কিন্তু আমরা এগিয়েও যেতে চাই।” সুভাষচন্দ্রের অভিযোগের প্রধান লক্ষ্য ছিলেন গান্ধীজি। এ কথা তিনি খোলাখুলি লিখেছিলেন তাঁর The Indian Struggle গ্রন্থে। সুভাষের মতে, যে আইন অমান্য আন্দোলন গান্ধীজি ১৯৩০ সালে শুরু করেছিলেন তা দু’ বছর আগে শুরু করলে আরও ভাল হত। ১৯২৮ সালের মে মাসে সুভাষচন্দ্র নিজে সবরমতী আশ্রমে গিয়ে গান্ধীজির সঙ্গে দেখা করে তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন। গান্ধীজি তাঁকে বলেছিলেন, জনগণ যে সংগ্রামের জন্যে প্রস্তুত এরকম কোনও আলো তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। তবে শুধুমাত্র গান্ধীজিকে নয়, সুভাষচন্দ্র স্বরাজ্যপন্থী নেতাদেরও সমালোচনা করেছিলেন ১৯২৮ সালের গণ-বিক্ষোভের চরিত্র বুঝতে ব্যর্থ হওয়ার জন্যে।

সাইমন কমিশন-বিরোধী আন্দোলনের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য ছিল। এর পিছনেও ছিল সুভাষচন্দ্রের চিন্তার গভীরতা ও দূরদৃষ্টি। বিলাতী বস্ত্র ও লবণ বয়কট আন্দোলন স্বরাজ অর্জনের সংগ্রামকে শক্তিশালী করবে, এই বিশ্বাস জনমানসে বদ্ধমূল করার জন্যে সুভাষ নিরন্তর প্রচার শুরু করেন। বাঙালি নারীদের কাছে তিনি বিশেষ আবেদন জানান যাতে তাঁরা ‘শৌখিন বস্ত্রের ফাঁদ’-এ না পড়েন। সংসারে তাঁরা যদি স্বদেশীর শপথে অবিচল থাকেন তাহলে ব্রিটিশ বস্ত্র কেনার সাহস পুরুষদের হবে না। ‘দাসত্বের চিহ্নস্বরূপ’ শৌখিন বস্ত্রের প্রলোভন ত্যাগ করে তাঁরা যেন স্বদেশের তৈরি মোটা কাপড় পরিধান করেন। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় যে ‘স্বদেশী’ মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছিল তার পুনরুজ্জীবন সুভাষচন্দ্র চেয়েছিলেন। এই বিষয়ে গভীর পড়াশোনা ও তথ্য সংগ্রহ করে সুভাষচন্দ্র তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘ব্রিটিশ পণ্য বর্জন’ (Boycott of British Goods) প্রকাশ করেন (১৯২৯)। বইটি লেখা তিনি শুরু করেছিলেন আগের বছরের ডিসেম্বর মাসে।

স্বাধীনতা সংগ্রামে সামাজিক অন্যায়, বৈষম্য ও লোকাচারভিত্তিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে জনমত গঠনও প্রয়োজন বলে সুভাষচন্দ্র মনে করেছিলেন। লোকাচারের দোহাই দিয়ে শাস্ত্রকে উপেক্ষা করে সামাজিক কুসংস্কারকে সমর্থন করার বিরুদ্ধে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর একদিন সোচ্চার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। সুভাষচন্দ্র সেই সুরে বলেছিলেন, “বহু ক্ষেত্রে শাস্ত্রের ওপরও লোকাচারকে স্থান দেওয়া হয়। শাস্ত্র শাশ্বত, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লোকাচার ও প্রথা বদলায়।” প্রগতিশীল সমাজের স্বার্থে পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে সঙ্গে লোকাচার ও প্রথার সামঞ্জস্য করতে হবে। তিনি বলেছিলেন, “আমি বুঝতে পারি না যে-দেশের লোক বিশ্বাস করে ঈশ্বর সর্বভূতে আছেন সে দেশের লোক অস্পৃশ্যতার মতো একটি প্রথা কেমন করে সহ্য করে। বর্ণপ্রথার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। যত শীঘ্র তা বর্জন করা যায় ততই মঙ্গল।” তাঁর মতে “সামাজিক গণতন্ত্র ভিন্ন রাজনৈতিক গণতন্ত্র অর্থহীন। যদি আমরা রাজনৈতিক গণতন্ত্র চাই তবে সামাজিক গণতন্ত্রের মূল্যেই তা কিনতে হবে।”

ধূমপান বিরোধী মনোভাব সৃষ্টির ওপর তিনি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। যুবকদের মধ্যে ধূমপানের বিপজ্জনক প্রবণতা এখনি বন্ধ করা প্রয়োজন বলে তিনি যুবকদের কাছে আবেদন করেন। বয়কট আন্দোলনের সঙ্গে ধূমপানের সম্পর্কের প্রসঙ্গে তিনি রাজশাহীতে এক ছাত্র সমাবেশে (১০ এপ্রিল, ১৯২৮) বলেন, “তোমরা ধূমপানের মতো ক্ষতিকর অভ্যাস ত্যাগ করো। ধূমপান করে ধূমপানকারীর কোনো উপকার হয় না। বরং দেশের কোটি কোটি টাকা ধূমপান খাতে বাইরে চলে যাচ্ছে।” বিদেশী ছায়াছবি আমদানি ও দেখার বিরুদ্ধ আন্দোলনও তিনি বয়কট ও বিদেশী বর্জনের অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিলেন। কলকাতার মনোমোহন থিয়েটারে ইস্টার্ন ফিল্ম সিন্ডিকেটের নির্মিত ‘দেবদাস’ ছবিটি দেখতে গিয়ে তাঁর ভাষণে (১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৮) সুভাষচন্দ্র বলেন যে, আমেরিকায় এবং ইংলন্ডে বিদেশী ফিল্ম আমদানীর বিরুদ্ধে এক আন্দোলন শুরু হয়েছে। এ দেশেও অনুরূপ আন্দোলন হওয়া প্রয়োজন। বাঙালিরা যদি স্থির করে যে তারা কোনও বিদেশী ছবি দেখবে না তাহলে সিনেমা কোম্পানিগুলি দেশী ফিল্ম করতে বাধ্য হবে। বিদেশীদের পকেটে প্রচুর অর্থ যাওয়া বন্ধ হবে। ওই অর্থ দেশেই থাকবে। ছায়াছবি যাতে নৈতিক শৈথিল্য প্রশ্রয় না দেয় তার জন্যে তিনি সেন্সর বোের্ডকে নজর রাখতে বলেন। ভারতীয় ফিল্ম কোম্পানি গঠিত হলে জাতীয় সাহিত্য থেকে ছায়াছবির কাহিনী নিবাচিত হবে, জনসাধারণ জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হবে এই আশা তিনি ব্যক্ত করেন। শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের ছায়াছবি দেখে তিনি অনুরূপ আশা প্রকাশ করেছিলেন। কলকাতার ‘চিত্রা’ সিনেমা হলের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে (১৯ ডিসেম্বর, ১৯৩০) তিনি বলেন, “আমি কদাচিৎ সিনেমা দেখতে যাই। গত কয়েক বছরে আমি কয়েকবার মাত্র ছবি দেখতে গিয়েছি এবং তাও দেশী ছবি… আমাদের দেশবাসীর কর্তব্য জাতীয় শিল্প রূপে আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পের বিকাশে সাহায্য করা।” ইতিপূর্বে কোনও রাজনৈতিক নেতা বয়কট ও বিদেশী বর্জন আন্দোলনকে এত ব্যাপক রূপ দেবার চিন্তা করেননি। সাফল্য-ব্যর্থতার নিরিখে নয়, চিন্তার ব্যাপ্তি ও মৌলিকতা দিয়েই সুভাষচন্দ্রের অবদানের মূল্যায়ন করতে হবে।

সাইমন কমিশন নিয়োগের প্রবল সমালোচনা প্রসঙ্গে ভারত-সচিব লর্ড বার্কেহেড ভারতীয় রাজনৈতিক নেতাদের ভারতের জন্যে সর্বসম্মত একটি শাসনতন্ত্রের খসড়া রচনা করতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। কার্যত এটি ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলির প্রতি একটি প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ ছিল। তিনি ইঙ্গিত করেছিলেন, ভারতীয় নেতাদের মধ্যে এতই মতপার্থক্য আছে যে তাঁরা সর্বসম্মত কোনও শাসনতন্ত্রের খসড়া করতে ব্যর্থ হবেন। ভারত-সচিবের এই উদ্ধত চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে মতিলাল নেহরুর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠিত হয়। কমিটির সদস্যদের অন্যতম ছিলেন সুভাষচন্দ্র। এই কমিটি একটি সংবিধানের খসড়া প্রস্তুত করেন। এটি ‘নেহরু রিপোর্ট’ বা ‘নেহরু সংবিধান’ (Nehru Constitution) নামে পরিচিত হয়। এই রিপোর্টে প্রস্তাব করা হয় যে, অনতিবিলম্বে ভারতবর্ষকে ‘অধিরাজ্যের মর্যাদা’ (Dominion Status) দেওয়া প্রয়োজন। এই ভারতীয় অধিরাজ্যে সব নাগরিকদের সমান মর্যাদা ও অধিকার থাকবে। ভারতবর্ষ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হবে। ১৯২৮ সালের নভেম্বর মাসে এক সর্বদলীয় সম্মেলনে খসড়া সংবিধানটি গৃহীত হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে রাজনৈতিক দলগুলির এই মতৈক্য ছিল ক্ষণস্থায়ী। কিছুকাল পরেই মহম্মদ আলি জিন্নার নেতৃত্বে মুসলিম লীগ পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর ও বিশেষ সুযোগ-সুবিধার দাবি পুনরুজ্জীবিত করে ‘নেহরু সংবিধান’ নাকচ করে। সাম্প্রদায়িক মনোভাব এক ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলার পথে আবার বিরাট অন্তরায় রূপে দেখা দেয়।

নেহরু কমিটিতে সুভাষচন্ত্রের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। তিনি ‘পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী’র (Separate Electorate) পরিবর্তে ‘যৌথ নির্বাচকমণ্ডলী’র (Joint Electorate) পক্ষে ছিলেন। তিনি তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে মূল্যবান তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। ওই তথ্য রিপোর্টের পরিশিষ্টের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সুভাষচন্দ্র তাঁর The Indian Struggle গ্রন্থে আইনসভাগুলিতে হিন্দু, মুসলমান ও শিখদের প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নের মীমাংসাকে নেহরু কমিটির ‘বিরাটতম সাফল্য’ বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এই দাবি কার্যত অর্থহীন। কেননা সমগ্র প্রচেষ্টাই অল্পদিনের মধ্যে নিষ্ফল প্রমাণিত হয়েছিল।

একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে সুভাষচন্দ্র কমিটির রিপোর্টের সঙ্গে সহমত হতে পারেননি। মাদ্রাজ কংগ্রেস (১৯২৭) ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’কে রাজনৈতিক আন্দোলনের লক্ষ্যরূপে ঘোষণা করেছিল। কিন্তু ‘নেহরু রিপোর্ট’ ‘অধিরাজ্যের মর্যাদা’ (Dominion Status) প্রাপ্তিকে লক্ষ্য বলে স্থির করে। এটি সুস্পষ্টভাবে রাজনৈতিক আপস বা পশ্চাদপসরণ ছিল। সুভাষচন্দ্র এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন ও লিখিতভাবে তা জানিয়েছিলেন। কিন্তু রিপোর্টে তিনি সই করেছিলেন। কমিটির রিপোর্টের ভূমিকায় তাই লেখা হয়েছিল যে, কমিটির অল্প কয়েকজন সদস্য ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন মেনে নেননি। তাঁরা শাসনতন্ত্রের ভিত রূপে পূর্ণ স্বাধীনতার জন্যে চাপ দিয়েছেন। এত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে মতভেদ থাকা সত্ত্বেও কেন তিনি রিপোর্টে সই করেছেন, এই প্রশ্নের উত্তরে সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন, “আমি যদি প্রতিবাদী মন্তব্যলিপি পেশ করতাম, তাহলে নানা প্রশ্নে আরও কয়েকটি প্রতিবাদী মন্তব্যলিপি আসত। সেক্ষেত্রে কমিটির সদস্যরা একযোগে একটি মাত্র রিপোর্ট প্রস্তুত করতে পারতেন না। এর ফল হত মারাত্মক।” সুভাষচন্দ্রের এই বক্তব্যে সুস্পষ্ট যে, তিনি ঐক্যের স্বার্থে নমনীয় হতে প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু মূল নীতি ও লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হতে সম্মত ছিলেন না। তাঁর সঙ্গে জাতীয় কংগ্রেসের নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য তিরিশের দশকের পূর্বেই দেখা দিতে শুরু করেছিল। ক্রমে ক্রমে তা বাড়তে থাকে। গান্ধীজি ও কংগ্রেসের সর্বভারতীয় নেতারা এর জন্যে সুভাষচন্দ্রের ওপর খুব সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি তাঁদের অধিকাংশেরই আস্থাভাজন হয়ে উঠতে পারেননি। তাঁর শক্তির উৎস ছিল যুব ও ছাত্র সমাজ, অপেক্ষাকৃত তরুণ প্রগতিশীল নেতারা।

কংগ্রেসের মধ্যে ‘ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন’ ও ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’র প্রশ্নে প্রবীণ ও নবীনদের মধ্যে মতপার্থক্য কত গভীর হয়ে উঠছিল তার সুস্পষ্ট লক্ষণ ‘ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগ অফ ইন্ডিয়া’র (Independence League of India) প্রতিষ্ঠায় (নভেম্বর ১৯২৮) দেখা দিয়েছিল। এর উদ্যোক্তা ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু ও জওহরলাল নেহরু। এই দুই প্রগতিশীল তরুণ তখন অনেক কাছাকাছি হয়েছিলেন। জাতীয় কংগ্রেসের আসন্ন কলকাতা অধিবেশনের আগে কোনও রকম বিভেদ সৃষ্টি না করে নিজেদের বক্তব্য প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করা ছিল সুভাষ ও জওহরলালের উদ্দেশ্য। ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগের বাংলা শাখা’র ইস্তাহারে অদূর ভবিষ্যতে অশনিপাতের ইঙ্গিত ছিল। ইস্তাহারের সূচনাতেই বলা হয় : “ভারতের জাতীয় আন্দোলনে নূতন নেতৃত্বের প্রয়োজন। আমাদের জাতীয় জীবনে আমরা এমন একটি স্তরে পৌঁছিয়াছি যখন পুরানো নীতি ও কর্মসূচী আর যথেষ্ট নয়…যাহারা পূর্ণ ও অবাধ স্বাধীনতা চায় তাহাদের এখন দ্বিধাগ্রস্ত ব্যক্তিদের নিকট হইতে বিদায় লইতে হবে। আমাদের জাতীয় আন্দোলনের অগ্রগামীদের একটি দলে সংঘবদ্ধ হইয়া জাতির সেবার জন্য প্রস্তুত হইতে হইবে।”

‘দ্বিধাগ্রস্ত ব্যক্তিদের’ মধ্যে সর্বাগ্রে কে ছিলেন তা অনুমান করা কঠিন ছিল না। ‘রক্ষণশীল’ প্রবীণ ও ‘প্রগতিশীল” নবীনের মধ্যে বিরোধ ক্রমেই প্রকাশ্য এবং তীব্রতর হয়ে উঠছিল। কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে তা আরও প্রকট হয়ে ওঠে।

সকল অধ্যায়

১. দেশনায়ক – ১
২. দেশনায়ক – ২
৩. দেশনায়ক – ৩
৪. দেশনায়ক – ৪
৫. দেশনায়ক – ৫
৬. দেশনায়ক – ৬
৭. দেশনায়ক – ৭
৮. দেশনায়ক – ৮
৯. দেশনায়ক – ৯
১০. দেশনায়ক – ১০
১১. দেশনায়ক – ১১
১২. দেশনায়ক – ১২
১৩. দেশনায়ক – ১৩
১৪. দেশনায়ক – ১৪
১৫. দেশনায়ক – ১৫
১৬. দেশনায়ক – ১৬
১৭. দেশনায়ক – ১৭
১৮. দেশনায়ক – ১৮
১৯. দেশনায়ক – ১৯
২০. দেশনায়ক – ২০
২১. দেশনায়ক – ২১
২২. দেশনায়ক – ২২
২৩. দেশনায়ক – ২৩
২৪. দেশনায়ক – ২৪
২৫. দেশনায়ক – ২৫
২৬. দেশনায়ক – ২৬
২৭. দেশনায়ক – ২৭
২৮. দেশনায়ক – ২৮
২৯. দেশনায়ক – ২৯
৩০. দেশনায়ক – ৩০
৩১. দেশনায়ক – ৩১
৩২. দেশনায়ক – ৩২
৩৩. দেশনায়ক – ৩৩
৩৪. দেশনায়ক – ৩৪
৩৫. দেশনায়ক – ৩৫
৩৬. দেশনায়ক – ৩৬
৩৭. দেশনায়ক – ৩৭
৩৮. দেশনায়ক – ৩৮
৩৯. দেশনায়ক – ৩৯
৪০. দেশনায়ক – ৪০
৪১. দেশনায়ক – ৪১
৪২. দেশনায়ক – ৪২
৪৩. দেশনায়ক – ৪৩
৪৪. দেশনায়ক – ৪৪
৪৫. দেশনায়ক – ৪৫
৪৬. দেশনায়ক – ৪৬
৪৭. দেশনায়ক – ৪৭
৪৮. দেশনায়ক – ৪৮
৪৯. দেশনায়ক – ৪৯
৫০. দেশনায়ক – ৫০

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন