শিলং থেকে একটি চিঠিতে (১৬ জুন, ১৯২৯) বাসন্তী দেবীকে সুভাষচন্দ্র লিখেছিলেন, “ঝড়ের মতো চলেছি—কোথায় চলেছি, শুভের দিকে না অশুভের পশ্চাতে—তা বোঝা দরকার। তা ছাড়া আত্মপরীক্ষাও করা দরকার এবং বেশি অবসর না পেলে আত্মপরীক্ষা করা যায় না।” কিছুদিন পর আর একটি চিঠিতে আত্মসমীক্ষার সুরে তিনি লেখেন, “আমি শৈশব হতেই স্বভাবত বড় লাজুক—এখনও তাই—সভা-সমিতিতে বক্তৃতা করা সত্ত্বেও। লোকে মনে করে আমি অহঙ্কারী। আমি যাই হই না কেন অহঙ্কারী নই—কারণ আমি জানি যে অহঙ্কার করার মতো আমার কিছুই নেই। আমি যেখানে নিজেকে ধরা দিই—সেখানে ভাল করেই ধরা দিই।” সত্যিই সুভাষচন্দ্রের জীবনে ঝড়ের গতি আসছিল। সেই ঝড়ের গতি ক্রমেই বাড়ছিল। তাঁকে ‘অহঙ্কারী’ বলে কিছু মানুষ সমালোচনা করা শুরু করছিলেন। তাঁর আদর্শনিষ্ঠা, স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামে একাগ্রতা ও অনমনীয়তাকে ভুল বোঝা শুরু হয়েছিল। কিন্তু সত্যিই তাঁকে বোঝার কোনও অসুবিধা ছিল না। তাঁর বক্তব্য ও রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল খুবই স্বচ্ছ! এতটা স্বচ্ছতা রাজনীতিতে হয়তো কাম্য ছিল না। তাঁর ব্যক্তিস্বার্থের পক্ষে ক্ষতিকরই হয়েছিল। কিন্তু এই বৈশিষ্ট্য না থাকলে সুভাষচন্দ্র বসু ‘নেতাজি সুভাষচন্দ্র’ হয়ে উঠতেন না। আরও একজন বড় নেতা হয়ে উঠতেন মাত্র!
সুভাষচন্দ্র ও কংগ্রেসের মধ্যে বামপন্থীদের মনে হচ্ছিল গান্ধীজি যেন আন্দোলনের রাশ টেনে ধরার চেষ্টা করছেন। বাংলার আইনসভায় কংগ্রেস দলের সদস্যদের ভোটে বারবার মন্ত্রিসভার পতন হওয়ায় পরিষদ ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচনের আদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু নির্বাচনে কংগ্রেস দল আরও বেশি সংখ্যক সদস্য নিয়ে আইনসভায় নির্বাচিত হল। জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের আসন সংখ্যাও বৃদ্ধি পেল। নতুন পরিস্থিতিতে আইন-পরিষদে কংগ্রেস দল সরকারকে আরও বিব্রত, বিপর্যস্ত করার সুযোগ পেল। কিন্তু গান্ধীজির নির্দেশে কংগ্রেস কার্যনিবাহক সমিতি হঠাৎ কোনও যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা না দিয়ে কংগ্রেস সদস্যদের আইনসভা থেকে পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিল। এর প্রতিবাদ করে সুভাষচন্দ্র ও যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত কার্যনির্বাহক সমিতি থেকে পদত্যাগ করেন। জওহরলালও পদত্যাগ করেন। সুভাষচন্দ্রের বোধগম্য হয়নি হঠাৎ কী এমন ঘটল যার জন্যে গান্ধীজি এমন একটি সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি আরও ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন মতিলাল নেহরুর আচরণে। মতিলালই বাংলার কংগ্রেসীদের সবচেয়ে বেশি উৎসাহ দিয়েছিলেন নির্বাচনে লড়াই করার। কিন্তু গান্ধীজির প্রভাবে তিনি তাঁর পূর্ব মত সম্পূর্ণ পাল্টে ফেললেন। যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তও অল্পদিনের মধ্যেই গান্ধীজির পক্ষে চলে যান। এর ফলে বাংলা কংগ্রেসের মধ্যে বিভেদ দেখা দেয়। কংগ্রেস রাজনীতিতে এই অভিজ্ঞতা সুভাষচন্দ্রের পরেও একাধিকবার ঘটেছিল। প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পুনরাবৃত্তি হয় ডিসেম্বরের শেষে লাহোরের কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে।
সুভাষচন্দ্র তা সত্ত্বেও গান্ধীজি ও প্রবীণ কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে বিরোধিতা চাননি। মতিলাল নেহরু প্রমুখ নেতাদের অনুরোধে ও আশ্বাসে তিনি তাঁর পদত্যাগ প্রত্যাহার করে নেন। এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি এক বিবৃতিতে (২২ নভেম্বর, ১৯২৯) জানান, শ্রীনিবাস আয়েঙ্গার, জওহরলাল নেহরু ও সুভাষচন্দ্র নিজে যখন ওয়ার্কিং কমিটিতে নির্বাচিত হন তখন তাঁরা “স্বাধীনতাওয়ালা” নামে পরিচিত হন। তাঁদের স্বাধীনভাবে নিজেদের বক্তব্য বলার অধিকার দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু গান্ধীজি যখন বললেন যে, মন্ত্রিসভার মতো কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া উচিত তখন তাঁদের পক্ষে পদত্যাগ করাই সঙ্গত মনে হয়েছিল। কিন্তু এখন যেহেতু বলা হয়েছে যে ওয়ার্কিং কমিটিতে ভিন্নমত ব্যক্ত করার স্বাধীনতা আছে তাই পদত্যাগী সদস্যরা পদত্যাগ প্রত্যাহার করছেন। যতদিন বাক্যে ও কর্মে তাঁকে (সুভাষকে) স্বাধীনতা দেওয়া হবে ততদিন তিনি ওয়ার্কিং কমিটিতে থাকবেন। এই ঘটনাটি প্রায় এক দশক পরে কংগ্রেস সংগঠনে গান্ধী-সুভাষ বিরোধ ও তার পরিণতির পূর্বাভাস দিয়েছিল।
১৯২৯ সালে আর এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল কলকাতার কাছে একটি ট্রেন দুর্ঘটনা সম্পর্কিত সংবাদে ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ের পক্ষে ‘আপত্তিকর সংবাদ প্রচারের’ অভিযোগে ‘ফরোয়ার্ড’-এর বিরুদ্ধে মানহানির মামলায় ওই পত্রিকাকে দেড়লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেবার নির্দেশ। এই মামলা ও বিপুল পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দেবার নির্দেশের পিছনে উদ্দেশ্য ছিল জনপ্রিয় জাতীয়তাবাদী কাগজটির প্রকাশ বন্ধ করে দেওয়া। কিন্তু ওই উদ্দেশ্য সফল হয়নি। ক্ষতিপূরণ এড়াবার জন্যে রাতারাতি ‘ফরোয়ার্ড’-এর পরিবর্তে দৈনিক ‘লিবার্টি’ (Liberty) পত্রিকা প্রকাশের ব্যবস্থা করা হয়। ‘লিবার্টি’-র সম্পাদনার দায়িত্ব নেন সত্যরঞ্জন বক্সী।
স্বাধীনতা সংগ্রামে সর্বস্বপণ করে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে ছাত্রদের সুভাষচন্দ্র যেভাবে আহ্বান জানাচ্ছিলেন তা লক্ষণীয় ছিল। তিনি মনে মনে উপলব্ধি করছিলেন যে ছাত্র-যুবকরাই তাঁর পাশে এসে দাঁড়াবে। কংগ্রেস তথা জাতীয় আন্দোলনের প্রবীণ প্রতিষ্ঠিত নেতাদের ওপর তাঁর আস্থা ক্রমেই কমে যাচ্ছিল। তাঁর বিভিন্ন বক্তৃতার মূল সুর ছিল দীর্ঘদিনের পুরনো প্রচলিত ধ্যানধারণার বিরুদ্ধে। ছাত্রসমাজ কিছু ভ্রান্ত আদর্শের দ্বারা প্রভাবিত এবং তার ফলে উন্নতির পথে বাধা সৃষ্টি হয়েছে, এই বক্তব্যের সমর্থনে তিনি যেসব দৃষ্টান্ত তুলে ধরছিলেন তা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। যেমন, তিনি বলেন, “আমরা প্রায়ই শুনে থাকি—‘ছাত্রানাং অধ্যয়নং তপঃ’—অধ্যয়নই ছাত্র জীবনের তপস্যা। এই বচনের দোহাই দিয়ে ছাত্রদের দেশসেবার কার্য হতে নিরস্ত রাখবার চেষ্টা অনেকেই করে থাকেন। অধ্যয়ন কখনই তপস্যা হতে পারে না।” সুভাষচন্দ্র বলেন, এর ফলে স্বর্ণপদক পাওয়া যেতে পারে, বড় চাকরি পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু মানুষ হওয়া যায় না। ‘গ্রন্থকীট’দের পুঁথির বাইরে কোনও অস্তিত্ব নেই, পরীক্ষার প্রাঙ্গণেই তাদের জীবন কাটে। এইসব ‘ভাল ছেলে’দের সঙ্গে “বকাটে রবার্ট ক্লাইভ”-এর তুলনা করলেই বোঝা যাবে এইসব ‘বাপে তাড়ানো মায়ে খেদানো’ ছেলেরা কেমন করে সাত-সমুদ্র তের-নদী পার হয়ে ইংরেজ-সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল। ‘বকাটে ক্লাইভ’ শেষ জীবনে রবার্ট ক্লাইভ হয়েছিলেন। যে অত্যাচার ও মনুষ্যত্বের অপমানের প্রতিরোধ করতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বিপন্ন হয়, কারারুদ্ধ হয়, লাঞ্ছিত হয় সে-ই মনুষ্যত্বের গৌরবে প্রতিষ্ঠিত হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতি বছর যেসব Gold medalist ছাত্র বেরচ্ছে, সেরকম হাজার ছাত্র একত্র করলেও একজন খড়্গ বাহাদুর তৈরি হবে না। ভারতবর্ষ স্বাধীন হবেই, এখন সংঘবদ্ধ স্বাধীনতার সৈনিক শ্রেণী গড়ে তোলার সময় এসেছে। সুভাষচন্দ্রের এই অগ্নিগর্ভ আহ্বানের উৎসে যে স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ছিল তা তাঁর পাবনা যুব-সম্মিলনীতে প্রদত্ত ভাষণেই (১৩৩৫ বঙ্গাব্দ) প্রকাশ পেয়েছিল। যুবশক্তির সাধনার স্বরূপ ব্যক্ত করে তাঁর ভাষণের সমাপ্তিতে তিনি স্বামীজির বিখ্যাত কবিতা উদ্ধৃত করেন:
“পূজা তাঁর সংগ্রাম অপার,
সদা পরাজয়,
তাহা না ডরাক তোমা,
হৃদয় শ্মশান, নাচুক তাহাতে শ্যামা।”
‘নেতাজি’ ভারতের মুক্তির জন্যে তাঁর চূড়ান্ত সংগ্রামে যোগ দেবার আহ্বান করে বলেছিলেন, “Give me blood, I will give you freedom.” এই ডাক ও প্রতিশ্রুতি কিন্তু সুভাষচন্দ্র বসু বহু পূর্বেই দিয়েছিলেন।
ভারতীয় রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চের পটপরিবর্তন, বিপ্লবী তৎপরতা, ব্যাপক বিক্ষোভ, অসন্তোষ, জাতীয় কংগ্রেসের মাদ্রাজ অধিবেশনে (১৯২৭) ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’ অর্জনকে চূড়ান্ত লক্ষ্য রূপে ঘোষণা, ব্রিটিশ সরকারকে চিন্তিত করে তুলেছিল। স্যার জন সাইমন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী র্যামসে ম্যাকডোনাল্ডকে (Ramsay Macdonald) পরামর্শ দেন যে, ভারতীয় সমস্যাগুলির সমাধানের পথ ও শাসনতান্ত্রিক সংস্কার সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্যে প্রতিনিধি-স্থানীয় ভারতীয় নেতাদের একটি আলোচনা সভায় আহ্বান করা উচিত। ব্রিটিশ সরকার এই পরামর্শ গ্রহণ করে। ভাইসরয় লর্ড আরউইন (Lord Irwin) ঘোষণা করেন (৩১ অক্টোবর, ১৯২৯) যে, শীঘ্রই এই উদ্দেশ্যে ইংলন্ডে একটি গোলটেবিল বৈঠক (Round Table Conference) আহুত হবে। গোলটেবিল বৈঠক আহ্বানের ঘোষণায় ভারতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সুভাষচন্দ্র, জওহরলাল প্রমুখ তরুণ নেতারা ব্রিটিশ সরকারের আসল উদ্দেশ্য ও আন্তরিকতা সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করেন। কংগ্রেস ও ইংরাজ কর্তৃপক্ষের মধ্যে সন্দেহ, ভুল বোঝাবুঝি দূর করে, প্রাথমিক কথাবার্তার জন্যে ভাইসরয় আরউইন গান্ধীজির সঙ্গে এক সাক্ষাৎ আলোচনার প্রস্তাব করেন। গান্ধীজি ওই প্রস্তাবে সম্মত হন। ১৯২৯ সালের ডিসেম্বর মাসে, আসন্ন কংগ্রেস অধিবেশনের অল্প কয়েকদিন আগেই, গান্ধী-আরউইন সাক্ষাৎকার হয়। এই বৈঠকে গান্ধীজি দাবি করেন যে অবিলম্বে স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তন করে ভারতবর্ষকে অধিরাজ্যের মর্যাদা (Dominion Status) দিতে হবে। কিন্তু ওই রকম কোনও সুনিশ্চিত প্রতিশ্রুতি দিতে আরউইন অসম্মত হলে গান্ধী-আরউইন বৈঠক বিফল হয়। কংগ্রেস নেতারা হতাশা বোধ করেন। কিন্তু এই প্রথম ভারতবর্ষের একজন ভাইসরয় কংগ্রেসের নেতা গান্ধীজির সঙ্গে সম-মর্যাদার ভিত্তিতে সামনা-সামনি কথা বলতে সম্মত হয়েছেন, এর জন্যে তাঁরা আত্মপ্রসাদ বোধ করেন। কিন্তু কংগ্রেসের নবীন বামপন্থী নেতাদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এর প্রকাশ ঘটে কংগ্রেসের লাহোর অধিবেশনে।
ভাইসরয় আরউইন গোলটেবিল বৈঠকের প্রস্তাব করে প্রথম যে ঘোষণা করেন তাকে সুভাষচন্দ্র প্রথম থেকেই খুব সন্দেহের চোখে দেখেছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল আসলে এটি ব্রিটিশ সরকারের একটি ফাঁদ মাত্র। প্রথমে মতিলাল নেহরু, মদনমোহন মালব্য, সর্দার প্যাটেল প্রমুখ নেতারা ও গান্ধীজি নিজে আরউইনের প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়ে একটি বিবৃতিতে সই দেন। সুভাষচন্দ্র, জওহরলাল ও আরও কয়েকজন এর বিরোধিতা করে পৃথক এক ইস্তাহার প্রচার করার মনস্থ করেন। কিন্তু জওহরলালকে গান্ধীজি বোঝান যে, তাঁর পক্ষে এরকম একটা পৃথক বিবৃতিতে সই দেওয়া সমীচীন হবে না। কেননা জওহরলাল আগামী লাহোর কংগ্রেসের নির্বাচিত সভাপতি। জওহরলাল গান্ধীজির কথায় তাঁর মত পরিবর্তন করেন। এইরকম ঘটনা ইতিপূর্বে ও পরে একাধিকবার ঘটেছিল। জওহরলাল নিজেই তাঁর ‘আত্মজীবনী’তে (An Autobiography) স্বীকার করেছেন যে, নিজের বিবেক ও যুক্তির বিরোধী হলেও, তিনি শেষপর্যন্ত কখনও গান্ধীজির সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করতে পারেননি। এটা গান্ধীজির ব্যক্তিত্ব, সম্মোহনী শক্তির প্রভাব, না অন্য কিছু তা তিনি নিজেই সঠিক ব্যাখ্যা করতে অক্ষম ছিলেন। জওহরলাল এইভাবে হঠাৎ তাঁর মত পরিবর্তন করায় সুভাষচন্দ্র অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তিনি তাঁর গভীর ক্ষোভ প্রকাশ করে বাসন্তী দেবীকে এক চিঠিতে (৫ নভেম্বর, ১৯২৯) লেখেন, “জওহরলাল এবার মহাত্মার পাল্লায় পড়ে Independence ত্যাগ করলেন।” মাসখানেক পরে (৯ ডিসেম্বর, ১৯২৯) বাসন্তী দেবীকে আর একটি চিঠিতে তিনি জানান যে, বাংলা প্রদেশ কংগ্রেসের মধ্যেও তাঁকে অপদস্থ, বিধ্বস্ত করার চেষ্টা চলছে। এর পিছনে মতিলাল নেহরুর সমর্থন আছে বলে তাঁর ধারণা। তিনি আরও জানান, “আমাদের এই বিপদের সময় ডাঃ রায়ের (বিধানচন্দ্র রায়) কাছে আশানুরূপ সহায়তা পাচ্ছি না। নির্মলবাবু (নির্মলচন্দ্র চন্দ্র) অনেকটা করছেন।”
ভারতের মুক্তিসংগ্রামে নির্মলচন্দ্র চন্দ্রের অবদান আজও যথাযথ স্বীকৃতি পায়নি। Big Five বা ‘পঞ্চ প্রধানে’র অন্যতম নির্মলচন্দ্র চন্দ্র কোনও প্রচার ও পদের প্রত্যাশা না করে যেভাবে নিজের বিপুল পসার ও পারিবারিক বিত্ত সত্ত্বেও সব কিছু স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্যে দান করে নিজে প্রায় দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিলেন তার দৃষ্টান্ত বিরল। দেশবন্ধু ও সুভাষচন্দ্রের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী গোপাললাল সান্যাল নির্মলচন্দ্র চন্দ্রের হৃদয়বত্তা ও দেশপ্রেমের একটি চিত্তস্পর্শী ঘটনার কথা লিখেছেন। ১৯২০ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় গান্ধীজি এসেছিলেন কলকাতায়। তখনও বাংলাদেশে অসহযোগ আন্দোলনে তেমন উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়নি। গান্ধীজি এসেছিলেন বাংলার মানুষকে উদ্দীপ্ত করতে এবং তিলক স্বরাজ্য ভাণ্ডারের জন্যে টাকা তুলতে। কলকাতায় জনসভা ডাকা হয়েছে ওয়েলিংটন স্কোয়ারে। সভাপতি নির্মলচন্দ্র চন্দ্র। স্বেচ্ছাসেবকরা সভায় বাক্স হাতে ঘুরে ঘুরে চাঁদা সংগ্রহ করছে। কিন্তু সামান্য কিছু পয়সা আর কয়েকটি মাত্র টাকা ছাড়া তেমন কিছু ওঠেনি। গান্ধীজির ভাষণের পর নির্মলচন্দ্র উঠলেন বক্তৃতা দিতে। তিনি সম্ভবত ইতিমধ্যে জানতে পেরেছিলেন যে নামমাত্র অর্থ সংগৃহীত হয়েছে। লজ্জায় রাঙা হয়ে (নির্মলচন্দ্র খুবই ফরসা ছিলেন) তিনি প্রথমে গান্ধীজির প্রতি তাঁর অবিচল আনুগত্য ও শ্রদ্ধা জানালেন। তারপর ঘোষণা করলেন তিলক স্বরাজ্য ভাণ্ডারের জন্যে তাঁর ‘সামান্য দান—পঞ্চাশ হাজার টাকা!’ এখনকার মূল্যে ৫০০০০ কত তা অনুমান করাও দুঃসাধ্য। নির্মলচন্দ্রের সঙ্গে গান্ধীজি, মতিলাল, মৌলানা আজাদ, রাজেন্দ্র প্রসাদ, জওহরলাল থেকে শুরু করে সারা ভারতবর্ষের সব বড় বড় নেতাদের নিকট সম্পর্ক ছিল। প্রায় সকলেই তাঁর বাড়িতে আসতেন, আতিথ্য গ্রহণ করতেন। সুভাষচন্দ্রকে তিনি গভীর স্নেহ করতেন। তাঁর সাহস ও অদম্য স্বাধীনতাস্পৃহাকে শ্রদ্ধা করতেন। নির্মলচন্দ্র তিরিশের দশকে প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে সরে যান, যদিও কেন্দ্রীয় আইনসভার সদস্য ছিলেন। কিন্তু সুভাষচন্দ্রের প্রতি তাঁর সমর্থন অটুট ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নেতাজি সুভাষ যখন জার্মানী ও দূর প্রাচ্য থেকে ভাষণ দিতেন নির্মলচন্দ্র তা রেডিও কানের কাছে নিয়ে এসে শুনতেন। সব কথা যাতে ভালভাবে শোনা যায় তার জন্যে কানে ‘স্টেথিসকোপ’ লাগাতেন। নির্মলচন্দ্রের পুত্র প্রতাপচন্দ্র চন্দ্র তখন যুবক, ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয়। তাঁর কাছে নির্মলচন্দ্রের সুভাষ-প্রীতির এই গল্প শুনেছি।
তিলক স্বরাজ্য ভাণ্ডারের জন্যে অর্থ সংগ্রহ সম্পর্কে একটি কৌতুকপূর্ণ কিন্তু হৃদয়গ্রাহী গল্পের উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক হবে না। এটি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের কন্যা অপর্ণা দেবীর কাছে শুনে হেনা চৌধুরী তাঁর ‘আপন মনের মাধুরী মিশায়ে’ গ্রন্থে লিখেছেন। দেশবন্ধু ও সুভাষচন্দ্র তখন একসঙ্গে কারাগারে। অপর্ণা দেবী ও তাঁর ছোট বোন কল্যাণী তিলক স্বরাজ্য ভাণ্ডারের জন্যে অর্থ সংগ্রহ করে বেড়াচ্ছেন। কলকাতার নিষিদ্ধপল্লীর মেয়েরাও দেশের সেবায় তাঁদের ভারী ভারী সোনার গয়না দান করছিলেন। পিতা দেশবন্ধুকে দেখানোর জন্যে দুই বোন যতখানি সম্ভব ওই গয়নাগুলি পরে জেলে দেখা করতে যেতেন। জেলের মধ্যে দুই সালঙ্করা বোনকে দেখে সুভাষচন্দ্র খুব কৌতুক বোধ করতেন। শেষপর্যন্ত একদিন বলেই ফেললেন, “কি ব্যাপার, আপনারা দুই বোন গায়ে যে একেবারে ব্যাঙ্ক চাপিয়ে এসেছেন?” অপর্ণা দেবী সঙ্গে সঙ্গে সরস জবাব দিলেন, “কি করি, এ ছাড়া তো ব্যাঙ্ককে আর ভেতরে আনবার উপায় ছিল না।”
গান্ধীজির রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও পরিস্থিতি বোঝার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। লাহোরে কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন শুরু হওয়ার পূর্বেই তিনি আঁচ করেছিলেন যে, সুভাষচন্দ্র ও তাঁর বামপন্থী সহযোগীরা পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে অবিচল থাকবেন। তাঁরা ‘Dominion Status’-এর লক্ষ্যকে কিছুতেই মেনে নেবেন না। তা ছাড়া ভাইসরয় আরউইনের সঙ্গে কথাবার্তাতে বুঝেছিলেন যে, ওইটুকু প্রতিশ্রুতিও ব্রিটিশ সরকার দিতে প্রস্তুত নয়। যতীন দাসের অনশনে মৃত্যু, ভগৎ সিং, বটুকেশ্বর দত্ত ও অন্যান্য বিপ্লবীদের বিচার ও সম্ভাব্য চরম দণ্ডের আশঙ্কা, যুব-ছাত্র সমাজে বিক্ষোভ এবং চাঞ্চল্য, শ্রমিক অসন্তোষ—সব কিছু মিলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, পরিবেশ উত্তপ্ত করে তুলেছে। সুতরাং একটা কিছু পদক্ষেপ না নিলে লাহোর কংগ্রেসে গভীর সঙ্কটের সৃষ্টি হবে। তিনি কলকাতা কংগ্রেসে (১৯২৮) ঘোষণা করেছিলেন যে, এক বছরের মধ্যে ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন না পেলে তিনি নিজে একজন ‘ইন্ডিপেনডেন্সওয়ালা’ হয়ে যাবেন! সেই সময়সীমা পার হতে আর কয়েকদিন মাত্র বাকি ছিল। সম্ভাব্য জটিল পরিস্থিতি সামলাবার জন্যে গান্ধীজি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তুতি নেন।
সকলে প্রত্যাশা করেছিল যে, বল্লভভাই প্যাটেল লাহোর কংগ্রেসের জন্যে সভাপতি নির্বাচিত হবেন। বারদৌলিতে কৃষক আন্দোলনের সার্থক নেতৃত্ব দিয়ে তিনি সারা দেশের দৃষ্টি ও শ্রদ্ধা আকর্ষণ করে ‘সর্দার’ নামে ভূষিত হয়েছিলেন। কিন্তু গান্ধীজি কংগ্রেস সভাপতি পদে জওহরলাল নেহরুকে পছন্দ করলেন। তাঁর দৃষ্টিতে জওহরলাল ছিলেন যুবশক্তির প্রতীক। মৌলানা আবুল কালাম আজাদও জওহরলালকে চেয়েছিলেন কেননা, তাঁর মতে, মুসলমানদের কাছে জওহরলালের বেশি গ্রহণযোগ্যতা আছে। অনেকে মনে করেছিলেন, জওহরলালের নির্বাচন বামপন্থীদের শক্তিবৃদ্ধির স্বীকৃতি। জওহরলাল ও সুভাষচন্দ্রকে এই মতবাদ ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রধান মুখপাত্র মনে করা হত।
লাহোর কংগ্রেসের মূল সিদ্ধান্ত সুভাষচন্দ্রকে সম্পূর্ণ হতাশ করেছিল। গৃহীত কর্মসূচীর মধ্যে ছিল, ব্যবস্থাপক সভাগুলি থেকে কংগ্রেস সদস্যদের পদত্যাগ, অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ, মাদক দ্রব্য বর্জন ইত্যাদি। এছাড়া সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচী অনুসরণের ওপরেও গুরুত্ব দেওয়া হয়। আর একটি প্রস্তাবে ভাইসরয় আরউইনের ট্রেনে বোমা নিক্ষেপের ঘটনার (কিছুদিন আগে ঘটেছিল) নিন্দা ও তিনি দৈবক্রমে বেঁচে যাওয়ায় আনন্দ প্রকাশ করা হয়। ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’ সম্পর্কে আন্দোলন শুরু করার (৩১ ডিসেম্বর, ১৯২৯-এর পর) পূর্ব সিদ্ধান্ত স্মরণ রেখে লাহোর কংগ্রেসে প্রস্তাব গৃহীত হয় যে, ওই লক্ষ্যে পৌঁছবার উদ্দেশ্যে কংগ্রেস সংগ্রাম শুরু করবে। নির্ধারিত স্থানে ও নির্ধারিত কর্মসূচী অনুসারে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করা হবে। এই প্রস্তাবটি গান্ধীজি নিজে উত্থাপন করেন। গান্ধীজির এই প্রস্তাবের ওপর সুভাষচন্দ্র একটি সংশোধনী প্রস্তাব আনেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, কংগ্রেস যেসব সামাজিক কর্মসূচী গ্রহণ করেছে, তা কার্যকর করতেই যদি কংগ্রেসীরা সচেষ্ট হন তাহলে তাঁদের আর কী করণীয় থাকবে? সুভাষচন্দ্র প্রস্তাব করেন যে, জাতীয় কংগ্রেসকে একদিকে স্বাধীনতা লাভের পক্ষে নিরন্তর প্রচার এবং দেশে একটি ‘প্রতি-সরকার’ বা parallel government গঠন করতে হবে এবং তারই সঙ্গে দেশব্যাপী আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করতে হবে। এই আন্দোলনে যুবক, শ্রমিক, কৃষক ও অন্য সব নিপীড়িত মানুষকে সংগঠিত করতে হবে। যখন যেখানে সম্ভব হরতাল ও ধর্মঘট করতে হবে। গভীর আবেগে সুভাষচন্দ্র বলেন, “এই দেশের মানুষের খাঁটি শুভেচ্ছার ওপর ভিত্তি করে একটি প্রতি-সরকার প্রতিষ্ঠা ছাড়া স্বাধীনতার লক্ষ্যে আমরা কীভাবে পৌঁছাব তা আমি বুঝছি না⋯আমি চরমপন্থী, আমার নীতি হল: ‘হয় সবটা চাই, নয়তো কিছুই চাই না।’ আমি যদি দখল করার নীতি অনুসরণ করতে বলি, তবে আমি সবই দখল করতে চাইব। এখন আমরা বয়কটের কথা বলছি, তাই সম্পূর্ণ বয়কট চাই।” গোলটেবিল বৈঠক সম্বন্ধে সুভাষ বলেন, গান্ধীজির মতে বর্তমান পরিস্থিতিতে গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিয়ে কোনও লাভ হবে না। কিন্তু ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে’ কথাটির অর্থ কী? দু’টি যুদ্ধরত বা দু’টি প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষের প্রতিনিধিদের মধ্যেই ‘গোলটেবিল’ বৈঠক হতে পারে। কিন্তু যে বৈঠকে ইউরোপীয়ান চেম্বার্স অফ কমার্স, দেশীয় রাজন্যবর্গ; ব্রিটিশ অনুগত বন্ধুরাও বসবে, তা আবার ‘গোলটেবিল’ হয় কী করে? কোনও অবস্থাতেই কংগ্রেসের ওই রকম বৈঠকে যোগ দেওয়া উচিত নয়। পরিশেষে সুভাষচন্দ্র বলেন, “মহাত্মা গান্ধী আপনাদের সামনে যে লক্ষ্য (পূর্ণ স্বাধীনতা) উপস্থিত করেছেন তার জন্যে আমি আবার তাঁকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। সংশোধনী উপস্থাপনের আমার একমাত্র উদ্দেশ্য হল যত দ্রুত সম্ভব লক্ষ্যবস্তু লাভ করা।”
গান্ধীজি সংশোধনী প্রস্তাবটির বিরোধিতা করে সুভাষচন্দ্রকে বাংলার এক বড় বা মহান কর্মী (great worker in Bengal) বলে উল্লেখ করেন। তাঁর প্রস্তাবটিও ভাল (a good one) বলেন। কিন্তু যেখানে এক হাজারটি গ্রামেও এখনও কংগ্রেস পতাকা ওড়ে না সেখানে প্রতি-সরকার গঠনের সম্ভাবনা কোথায় বলে তিনি প্রশ্ন করেন। “এটা সাহস বা বিজ্ঞতার পরিচায়ক নয় এবং আপনারা শুধু প্রস্তাব পাস করে স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন না। মনে রাখবেন আমরা স্বাধীনতা ঘোষণা করছি না⋯।” গান্ধীজি বাগ্মী ছিলেন না। কিন্তু তাঁর শব্দ চয়ন, শ্রোতাদের অভিভূত করার ক্ষমতা এবং ব্যক্তিত্ব ছিল অসাধারণ। সাত ঘণ্টা বিতর্কের পর সুভাষচন্দ্রের সংশোধনী প্রস্তাবটি অগ্রাহ্য হয়।
গান্ধী-সুভাষের মধ্যে এই প্রথম প্রকাশ্য বিরোধে কার যুক্তি ও বক্তব্য অধিকতর বাস্তবোচিত ছিল এই বিশ্লেষণ আরও পরে করা হবে। কিন্তু লাহোর কংগ্রেসে সভাপতি রূপে জওহরলালের ভূমিকায় সুভাষচন্দ্র ক্ষুব্ধ, হতাশ ও মর্মাহত হয়েছিলেন। সুভাষ বলেছেন, “স্পষ্ট বোঝা গিয়েছিল কংগ্রেসে মহাত্মারই প্রধান্য ঘটবে এবং সভাপতি শুধু সাক্ষিগোপাল থাকবেন।” কিছুটা বিদ্রূপের সুরেই সুভাষ তাঁর ‘ভারতের মুক্তি সংগ্রাম’ গ্রন্থে লিখেছে, “লাহোর কংগ্রেসে মহাত্মার সত্যিই বিরাট একটা সাফল্য হল। বামপন্থীদের মধ্যে সবচেয়ে বিশিষ্ট মুখপাত্রদের অন্যতম পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুকে তিনি তাঁর দলে টেনে নিলেন এবং অন্যান্য সবাইকে ওয়ার্কিং কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হল। ⋯যখনই কোনও বিরোধিতা দেখা গেছে তিনি সর্বদাই কংগ্রেস থেকে অবসর গ্রহণ অথবা আমৃত্যু অনশনের ভয় দেখিয়ে জনসাধারণকে নিবৃত্ত করতে সমর্থ হয়েছেন।” গান্ধীজি সম্বন্ধে এই মন্তব্য অবশ্য রূঢ় মনে হতে পারে। কিন্তু রাজনীতির এই হল ধর্ম। মহাত্মাজীও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। পরের বছর কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি থেকে গান্ধীজি তাঁর সব বিরোধীদের বাদ দিয়েছিলেন। এ নামের তালিকায় সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন তা বলা বাহুল্য।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন