দেশনায়ক – ৩৬

পোল্যান্ড ভ্রমণের সময় (১৯৩৩) সুভাষচন্দ্র ভারতের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি সহানুভূতিশীল বেশ কিছু মানুষের সন্ধান পেয়েছিলেন। একটি গ্রামীণ কৃষি-বিদ্যালয় তিনি দেখতে গিয়েছিলেন, বিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধায়ক সবকিছু ঘুরিয়ে দেখাবার পর সুভাষচন্দ্রের কাছে খোঁজ করেন, মহাত্মা গান্ধী কেমন আছেন, তিনি বর্তমানে কী করছেন। পোল্যান্ডের সুদূর গ্রামাঞ্চলের এক বৃদ্ধা মহাত্মা গান্ধী সম্পর্কে এইভাবে জানতে চাইছেন, এটি সুভাষচন্দ্রের কাছে খুবই মর্মস্পর্শী ঘটনা বলে মনে হয়েছিল। পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারস’র ‘প্রাচ্য বিদ্যা সমিতি’ সুভাষচন্দ্রকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ভারত-পোল্যান্ড সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্যে সুভাষচন্দ্র একটি পোল-ভারত সমিতি গঠনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। প্রখ্যাত ভারতপ্রেমিক, সংস্কৃত ও ভারতীয় সাহিত্যের সুপণ্ডিত অধ্যাপক স্ট্যানিম্ন মিকালস্কির (Stanislaw Michalski) সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল। মিকালস্কি পোল ভাষায় যেসব গ্রন্থ অনুবাদ করেছিলেন তার মধ্যে ছিল ‘ভগবদগীতা’, ‘উপনিষদ’ (নিবাচিত অংশ), ঋগ্বেদের চল্লিশটি শ্লোক, ভূমিকা ও মন্তব্যসহ মূল সংস্কৃতে ভগবদগীতা ইত্যাদি। সুভাষচন্দ্র পোল-ভারত সমিতি গঠনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিলেন।

রুমানিয়া ভ্রমণকালে বুখারেস্টে ডাঃ নরসিং মূলগুণ্ড নামে এক চিত্তাকর্ষক ব্যক্তির সঙ্গে তিনি পরিচিত হন। জন্মসূত্রে মহারাষ্ট্রীয় ডাঃ মূলগুণ্ড রুমানিয়ার সেনাবাহিনীর চিকিৎসা বিভাগের একজন উচ্চপদস্থ ডাক্তার ছিলেন। তাঁর বিচিত্র জীবন কাহিনী, রুমানিয়াতে খ্যাতি ও সম্মান, দীর্ঘকাল বিদেশবাসী হওয়া সত্ত্বেও মাতৃভাষা মারাঠীর প্রতি গভীর অনুরাগ এবং তাঁর সাদর আতিথেয়তায় সুভাষচন্দ্র মুগ্ধ হয়েছিলেন।

লীগ অব নেশনস্‌ সম্পর্কে সুভাষচন্দ্রের হতাশা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। ব্রিটেন ও ফ্রান্সের কুক্ষিগত এই আন্তজাতিক সংস্থাটি যে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের অনুকূলে কিছুই করবে না তা সুভাষচন্দ্র নিশ্চিতভাবে বুঝেছিলেন। তাই তিনি মনে  করেছিলেন অবিলম্বে ভারতের এই সংস্থা বর্জন করা উচিত। জেনিভায় অবস্থিত ‘ইন্টারন্যাশনাল কমিটি ফর ইন্ডিয়া’ নামক একটি সংগঠনের সহযোগিতায় ইংরাজি, ফরাসি ও জার্মান ভাষায় পুস্তিকা প্রকাশ করে ভারতবর্ষ ও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অনুকূলে জনমত গড়ে তুলতে সুভাষচন্দ্র সচেষ্ট হয়েছিলেন। মাদাম ই. হোরাপ (Madame E. Horup) নামে এক ড্যানিস মহিলা এই সংগঠনের নেতৃত্বে ছিলেন।

আয়ারল্যান্ডের স্বনামধন্য নেতা ও প্রেসিডেন্ট ডি. ভ্যালেরা (Eamon De Vlera), তাঁর মন্ত্রিসভার কয়েকজন সদস্য এবং বিশিষ্ট আইরিশ নেতাদের সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের সাক্ষাৎকার এবং গুরুত্বপূর্ণ কথাবার্তা হয়েছিল। আইরিশ স্বাধীনতা সংগ্রামের বৈপ্লবিক কর্মকৌশল সুভাষচন্দ্রকে বহু পূর্ব থেকেই আকৃষ্ট এবং প্রভাবিত করেছিল। তাঁর The Indian Struggle গ্রন্থে তিনি আইরিশ বিপ্লবী দল সিনফিন-এর বারবার উল্লেখ করেছেন। এই দলের সংগঠন, পরিচালনা ও বিদেশে প্রচারের ক্ষেত্রে দলের সভাপতি ডি. ভ্যালেরার ভূমিকার তিনি উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। হরিপুরা কংগ্রেসে (১৯৩৮) সভাপতির ভাষণে সুভাষচন্দ্র ব্রিটিশ সরকার ও জনগণের প্রতি তাঁর নিজের মনোভাবের ক্ষেত্রে ডি. ভ্যালেরার প্রভাবের উল্লেখ করেছিলেন। আয়ারল্যান্ডে যাওয়ার ও ডি. ভ্যালেরার সঙ্গে সাক্ষাৎকারের প্রবল ইচ্ছার কথা, তিনি ইন্ডিয়ান-আইরিশ ইন্ডিপেডেন্স লীগ-এর সম্পাদিকা এফ. এম. উডস্‌-কে কয়েক বছর পূর্বেই একটি চিঠিতে (৭ ডিসেম্বর, ১৯৩৩) জানিয়েছিলেন। কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের অনুমতি না পেলে তাঁর পক্ষে আয়ারল্যান্ড ভ্রমণ করা প্রায় অসম্ভব ছিল। শেষপর্যন্ত বহু চেষ্টার পর তাঁর ইচ্ছা পূর্ণ হয়েছিল (জানুয়ারি, ১৯৩৬)।

আয়ারল্যান্ড ভ্রমণ করে, ভারতবর্ষের প্রতি আইরিশ জনগণ ও প্রেসিডেন্ট ডি. ভ্যালেরার সহানুভূতির প্রত্যক্ষ পরিচয় পেয়ে সুভাষচন্দ্র অভিভূত হয়েছিলেন। আয়ারল্যান্ডের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ‘ইউনাইটেড প্রেস’-এর প্রতিনিধির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে (২৩ মার্চ, ১৯৩৬) তিনি বলেন যে, আয়ারল্যান্ডে তিনি যা দেখেছেন ও শিখেছেন তা ভারতের উপযোগী ও আকর্ষণীয় হবে। তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন যে, ভারতীয়রা ইংলন্ডে যান, বছরের পর বছর ইংলন্ডে কাটান, কিন্তু তাঁদের অধিকাংশই কখনও আয়ারল্যান্ডে যান না। অথচ, আয়ারল্যান্ড এক সম্পূর্ণ ভিন্ন জগৎ। আয়ারল্যান্ডের সব রাজনৈতিক দলই ভারতবর্ষ ও ভারতের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার প্রতি সমান সহানুভূতিসম্পন্ন। আয়ারল্যান্ডের মানুষের মনে সর্বাপেক্ষা বেশি আগ্রহ সৃষ্টি করে দু’টি দেশ—ভারতবর্ষ ও মিশর।

ইউরোপে অবস্থানকালে তাঁর প্রচেষ্টার ফলাফল সম্বন্ধে সুভাষচন্দ্র লিখেছিলেন যে, ইউরোপের বহু দেশে ভারতবর্ষ সম্বন্ধে তিনি আগ্রহ সৃষ্টি করেছেন। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্যে সংগঠন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনি সহায়তা করেছেন। যদিও ব্রিটিশ সরকার ও তাঁর সমালোচকরা সুবিধামত তাঁকে কখনও ‘কমিউনিস্ট’ আবার কখনও ‘ফ্যাসিস্ট’ বলে প্রচার করেছিলেন, তবুও তিনি ইউরোপের কিছু দেশে ভারতের স্বাধীনতা স্পৃহার প্রতি সহানুভূতির মনোভাব জাগাতে পেরেছিলেন। ভারতের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে পেরেছিলেন। নিজের সাফল্য সম্বন্ধে কিছু লেখার ব্যাপারে তিনি সতর্ক ছিলেন। সঙ্কোচ বোধ করতেন। The Indian Struggle যখন ১৯৩৫ সালে লন্ডনে প্রথম প্রকশিত হয় তখন ‘ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় মন্তব্য করা হয়েছিল যে, বইটি পড়ে বোঝা যায় যে সুভাষচন্দ্র ‘আত্মম্ভরী’ ও ‘অসহিষ্ণু’, এই অভিযোগ ভ্রান্ত। বইটি পড়লে তাঁর সম্বন্ধে বরং সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারণা সৃষ্টি হবে। ইউরোপে থাকাকালে তাঁর সাফল্যের যে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত উল্লেখ তিনি ওই গ্রন্থে করেছেন তা ‘ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান’-এর অভিমতের যথার্থতার এক প্রমাণ। প্রকৃতপক্ষে ইউরোপে থাকাকালে সুভাষচন্দ্রের বিস্ময়কর, বৈচিত্র্যময় বিভিন্ন প্রচেষ্টার তাৎপর্য এখনও যথাযথ স্বীকৃতি পায়নি।

স্বাধীন ভারতবর্ষের পররাষ্ট্রনীতির রূপকার রূপে জওহরলাল নেহরু দেশে বিদেশে স্বীকৃতি পেয়েছেন। ভারতবর্ষের পররাষ্ট্রনীতির মূল স্রষ্টা রূপে তিনি উচ্চ প্রশংসিত। কিছুটা সমালোচিতও হয়েছেন। সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত, সমস্যাজর্জরিত, ভারতবর্ষের মতো একটি ‘উন্নতিশীল’ (Developing) দেশকে (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী দুই দশকে ‘অনুন্নত’ বা ‘Under-Developed’ কথাটির বেশি প্রচলন ছিল) জওহরলাল নেহরু বিশ্বরাজনীতিতে এক মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। স্বাধীনতা লাভের পূর্বেই জাতীয় কংগ্রেস বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ভারতবর্ষের সম্পর্ক, আন্তর্জাতিক সমস্যাগুলির প্রতি মনোভাব এবং স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষের পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য কী হওয়া উচিত, সে বিষয়ে বহু প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল। কংগ্রেসের পররাষ্ট্রনীতিরও প্রধান রূপকার রূপে জওহরলাল পরিচিত। তাঁর এই পরিচিতি ও স্বীকৃতি যুক্তিযুক্ত। কিন্তু সুভাষচন্দ্র বসুর এই ক্ষেত্রে যে অবদান ছিল, গভীর ভাবনা-চিন্তা ও নিরলস প্রচেষ্টা ছিল তা আশ্চর্যজনকভাবে উপেক্ষিত ও প্রায় অজানা হয়ে আছে। ভারতবর্ষের যে সুচিন্তিত, সুনির্দিষ্ট বৈদেশিক নীতি ও আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকা অত্যন্ত জরুরি প্রয়োজন তা সুভাষচন্দ্রও বহুপূর্বেই উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তিরিশের দশকে ইউরোপে অবস্থানকালে তাঁর অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম, ভারতের সভ্যতা, সংস্কৃতি, অন্তর্নিহিত সম্পদ ও ঐতিহ্য সম্পর্কে প্রচার করে ভারত সম্বন্ধে আগ্রহ ও শ্রদ্ধার মনোভাব সৃষ্টি করা। তারই সঙ্গে তিনি চেয়েছিলেন ভারতীয়রাও বিশ্বের অন্যান্য দেশ সম্বন্ধে জানুক, আত্মশ্লাঘা ও কূপমণ্ডূকতা থেকে মুক্ত হোক। তাঁর লেখায়, কথায়, ভাষণে ও কাজে বারবার এটি ফুটে উঠেছিল।

সুভাষচন্দ্র ইউরোপে ভারত-বিরোধী অপপ্রচারের প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। নিরলসভাবে চেষ্টা করেছিলেন তা মিথ্যা প্রমাণ করতে। এই প্রসঙ্গে বেলগ্রেড থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে (৩ জুন, ১৯৩৪) তিনি জানান, নানা দেশে একটি প্রচার চালান হচ্ছে যে গান্ধীজি নাকি ‘অচ্ছুতদের’ বিরুদ্ধে। তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধেই তিনি অনশন করেছিলেন। শুধু তাই নয়, গান্ধীজি কমিউনিস্ট হয়ে গেছেন। এই অপপ্রচারের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপে গান্ধীজির, এবং একই সঙ্গে, কংগ্রেসের ভাবমূর্তিটি নষ্ট করা। সুভাষচন্দ্র এই জঘন্য প্রচারের প্রতিবাদ করেন, কিন্তু তিনি দেশবাসীকে জানান, তাঁর মতো একক ব্যক্তির পক্ষে এইরকম সুপরিকল্পিত মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করা সম্ভব নয়। প্রয়োজন হল সুসংগঠিত কাৰ্যসূচী।

‘ইন্ডিয়া স্পীকস’ (India Speaks) নামে একটি ভারত-বিরোধী অশালীন চলচ্চিত্র আমেরিকায় প্রদর্শিত হচ্ছিল। রোমে এক ঘরোয়া প্রদর্শনীতে ছবিটি দেখে সুভাষচন্দ্র অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন। ছবিটিকে মিস মেয়োর ‘মাদার ইন্ডিয়া’র চিত্রভাষ্য আখ্যা দিয়ে তিনি মন্তব্য করেন যে ছবিটির মূল সুর হল, “একমাত্র ভারতেই পাপকে পুণ্য বলে গণ্য করা হয়।” এই রকমের চলচ্চিত্র সারা ইউরোপে তৈরি করা হচ্ছে, বহু মানুষ তা দেখছে। এর কি প্রতিকার করা যায় না? সারা দেশ জুড়ে এর বিরুদ্ধে জনমত গঠন করা উচিত। ভারতীয় চিত্র নির্মাতাদের ভারত-বিষয়ক উচ্চমানের চলচ্চিত্র তৈরি করা উচিত। বিদেশ ওইসব ছবি দেখাবার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। উচ্চমানের ভারতীয় ছবির বিদেশে সমাদর হবে বলে তিনি মনে করেন। প্রযোজকরা একটি জাতীয় কর্তব্য পালন করার সঙ্গে সঙ্গে আর্থিক লাভবানও হবেন। উদ্দেশ্যমূলকভাবে ভারত-বিরোধী প্রচারের প্রতিবাদ জানিয়ে ভারতীয় আইন পরিষদে প্রশ্ন তোলা উচিত। ‘এভরিবডি লাভ্‌স মিউজিক’ (Everybody Loves Music) নামে আর একটি ছবির দৃষ্টান্ত দিয়ে তিনি বলেন, এইসব ছবি কতটা ক্ষতি করছে তা ভারতীয়রা জানে না। ছবিটির একটি দৃশ্যে দেখান হয়েছিল নিজের পোশাকে গান্ধীজি এক ইউরোপীয় মহিলার সঙ্গে নৃত্য করছেন।

আর একটি ভারত-বিরোধী ছবি ভিয়েনায় দেখান হচ্ছিল। ছবিটির নাম “বাঙালি”। ‘রহস্যময় ভারতবর্ষের চাঞ্চল্যকর একটি চলচ্চিত্র’ বলে ছবিটি বিজ্ঞাপিত হচ্ছিল। ছবিটিতে দেখান হয় যে, ভারতীয়রা ‘ভীরু কাপুরুষ জাতি’। ইংরেজরা তাদের ত্রাণকর্তা। ভারতীয়রা স্বাধীনতা লাভের অযোগ্য। ছবিটি দেখে ভিয়েনার ভারতীয়রা প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন। সুভাষচন্দ্র ভিয়েনার আর্চবিশপকে একটি দীর্ঘ চিঠি লিখে (১৭ এপ্রিল, ১৯৩৫) অনুরোধ করেন ছবিটির প্রদর্শনী নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নিতে। এই আর্চবিশপ চলচ্চিত্র শিল্পের বিশুদ্ধির জন্যে একটি আন্দোলন শুরু করেছিলেন। চিঠিতে যে বিশেষ কোনও কাজ হবে না তা সুভাষচন্দ্র জানতেন। কেননা, ব্রিটিশদের প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল খুব বেশি। তাদের অখুশি করার মতো কাজ আর্চবিশপ করবেন সে আশা সুভাষচন্দ্র করেননি। তবু এই প্রতিবাদপত্রের প্রয়োজন ছিল। সুভাষচন্দ্র বলেন যে, প্রয়োজন হল বিক্ষোভের। কিন্তু ইউরোপের শহরগুলিতে ভারতীয় ছাত্রদের সংখ্যা তেমন ছিল না। সুতরাং সবচেয়ে জরুরি প্রয়োজন হল, ব্রিটিশ সরকারের ওপর এমন চাপ সৃষ্টি করা যাতে তারা কূটনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। আর একটি যে প্রস্তাব তিনি করেছিলেন তা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, “আমি জোর দিতে চাই যে পূর্ণ স্বরাজের জন্যে আর অপেক্ষা না করে পৃথিবীর বড় বড় দেশের রাজধানীগুলিতে ভারতীয় দূত নিয়োগের জন্যে আমাদের আন্দোলন শুরু করা দরকার।”

১৯৩৪ সালে ভিয়েনায় ‘ইন্ডিয়ান-সেন্ট্রাল ইউরোপীয়ান সোসাইটি’ গঠিত হয়েছিল। সুভাষচন্দ্র এই উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এর প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অতীতে ভারতবর্ষের সঙ্গে বহির্বিশ্বের বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগে ছিল। কিন্তু ঘটনাচক্রে ভারতের সঙ্গে এশিয়া ও পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সম্পর্ক বহুলাংশে ছিন্ন হয়ে যায়। নিজের এলাকা-বহির্ভূত কোনও কিছু জানবার আগ্রহ কমে যায়। কিন্তু ওই মানসিকতার পরিবর্তন ঘটছে। ভারতীয়দের আগ্রহ এখন আর শুধুমাত্র ইংলন্ডেই কেন্দ্রীভূত নয়। বিশ্বের নানান ঘটনায় ভারতকে উপযুক্ত ভূমিকা পালন করতে হবে। পৃথিবীতে শুধুমাত্র কাঁচামালের সরবরাহকারী দেশরূপে। ভারত পরিচিত থাকতে পারে না। ভারতে দ্রুত শিল্পায়ন ঘটছে। বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকেও বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের প্রশ্নটি দেখতে হবে।

কংগ্রেস নেতাদের একটি বক্তব্য ছিল যে, আমেরিকা এবং অন্যান্য দেশে ভারত সম্পর্কে প্রচারের প্রয়োজনীয়তা আছে ঠিকই, কিন্তু তার জন্যে প্রয়োজন হল: (১) উপযুক্ত ক্ষমতাপ্রাপ্ত বা স্বীকৃত প্রতিনিধিবর্গ। (২) ব্যয় নির্বাহের জন্যে প্রয়োজনীয় তহবিল। এই মর্মে কংগ্রেস সভাপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ এবং অন্যতম শীর্ষনেতা ভুলাভাই দেশাই-এর প্রকাশিত একটি বিবৃতির উল্লেখ করে সুভাষচন্দ্র বলেন (২১ জুলাই, ১৯৩৫) এই যুক্তি ঠিকই। কিন্তু, সত্যিই যদি কাজ করার ইচ্ছা থাকে তাহলে প্রচুর টাকাকড়ি না থাকলেও কংগ্রেসের পক্ষে অনেক জরুরি কাজ করা সম্ভব। ইউরোপ ও আমেরিকায় এমন বহু যোগ্য, অভিজ্ঞ ভারতীয় আছেন, সংগঠন আছে, যারা কোনও টাকা-পয়সার প্রত্যাশা না করে দেশের হয়ে কাজ করে যেতে পারেন। প্রয়োজন হল, তাঁদের কংগ্রেস প্রতিনিধিরূপে স্বীকৃতি দেওয়া। তিনি দৃষ্টান্তরূপে বিঠলভাই প্যাটেলের নাম উল্লেখ করেন। প্রয়াত বিঠলভাই প্রায়ই বলতেন যে, কংগ্রেস প্রতিনিধিরূপে যদি তিনি বিদেশে কথা বলতে পারতেন তাহলে তিনি অনেক বেশি সফল হতে পারতেন। সুভাষচন্দ্র সবিনয়ে বলেন, “আমার মতো গৌণ ব্যক্তিদের অভিজ্ঞতাও ওই একই ধরনের। টাকা-পয়সার অভাবই যদি কংগ্রেসের একমাত্র সমস্যা হয় তবে কংগ্রেস কি অন্ততপক্ষে আমাকে (এবং আমার মতো অন্যান্য কর্মীদেরও) কংগ্রেস প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করবার ও কথাবার্তা বলবার অধিকার দেবেন?…আমি কংগ্রেস প্রেসিডেন্টের কাছে খুব সোজাসুজি এই প্রশ্নটি রাখলাম, এবং তাঁর কাছ থেকে অনুরূপ সোজাসুজি একটি উত্তরেরও প্রত্যাশা জানাই।”

কোনও উত্তর সুভাষচন্দ্র পাননি। সহজ সোজা উত্তরটি ছিল, তৎকালীন কংগ্রেস কর্তৃপক্ষ বা ‘হাইকমান্ড’-এর কাছে বিঠলভাই প্যাটেল বা সুভাষচন্দ্র বসু গ্রহণযোগ্য ও আস্থাভাজন ছিলেন না। প্রশ্নাতীত আনুগত্যই তাঁদের কাছে বিচার্য ছিল। সুভাষচন্দ্র কিন্তু স্পষ্টই বলেছিলেন, অভ্যন্তরীণ নানা প্রশ্নে নিজেদের মধ্যে যতই মতবিরোধ থাকুক কেন, বৈদেশিক প্রচারের ক্ষেত্রে তো কোনওরকম বাধা হয়ে পড়া উচিত নয়। গান্ধীজি সম্বন্ধে যে কোনও নিন্দা সমালোচনা বা কংগ্রেস সম্বন্ধে কোনও বিরূপ কথাবার্তার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে একাধিকবার তিনি তাঁর কথা ও কাজের মিল প্রমাণ করেছিলেন। রাজেন্দ্র প্রসাদের বিবৃতি প্রসঙ্গে তিনি দুঃখের সঙ্গে উল্লেখ করেছিলেন যে, প্রায় এক বছর হয়ে গেলেও তিনি প্রয়াত বিঠলভাই প্যাটেলের উইলের প্রবেট পাননি। অথচ প্রয়াত প্যাটেল বিদেশে ভারতবর্ষ সম্বন্ধে প্রচারের জন্যেই ওই টাকা রেখে গিয়েছিলেন।

বিদেশে প্রচার সম্পর্কে কিছু কিছু মহলে আপত্তি ও বিরূপ মনোভাবের একটি কারণ ছিল যে, এই ধরনের প্রচার আসলে কোনও গোপন, বৈপ্লবিক এবং ব্রিটিশ-বিরোধী ব্যাপার। এইসব কাজ করলে ব্রিটিশ সরকার ক্ষুব্ধ হবে এবং তা দেশের রাজনৈতিক অগ্রগতির পক্ষে ক্ষতিকর হবে। এইরকম আশঙ্কা রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদী নেতাদের আপসমূলক মনোভাবের প্রকাশ ছিল। সুভাষচন্দ্র দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন যে এই আশঙ্কা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। বিদেশে ভারত সম্বন্ধে প্রচারের মূল লক্ষ্য হল ভারত-বিরোধী প্রচারের প্রতিবাদ করা, ভারত সম্বন্ধে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে মৈত্রীর সম্পর্ক গড়ে তোলা। ভারতের স্বার্থের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিই হল এই প্রচারের উদ্দেশ্য।

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আন্দোলন ও আন্তজাতিক সংগঠন সম্পর্কে সুভাষচন্দ্রের গভীর ঔৎসুক্য ছিল। ভারতবর্যে অনুরূপ সচেতনতা সৃষ্টি করা, সংগঠন গড়ে তোলার ব্যাপারে তিনি খুবই আগ্রহী ছিলেন। জেনিভাতে থিওসফিক্যাল সোসাইটি, বাহাই সমিতি, সুফীদের একটি ছোট কেন্দ্র, রুশ গির্জা দেখে তিনি আনন্দিত হয়েছিলেন। কিন্তু হিন্দুদের কোনও কেন্দ্র নেই বলে তাঁর দুঃখবোধ হয়েছিল। নারীর অধিকার ও স্বাধীনতার প্রতিষ্ঠার জন্যে ‘নারী আন্তজাতিক লীগ’ দেখে তাঁর মনে হয়েছিল শিক্ষিতা ভারতীয় মহিলারা এই সংস্থায় যোগ দিয়ে ভারতের অনেক উপকার করতে পারেন। অহিফেন-বিরোধী তথ্য ব্যুরোর কাজকর্মের কথা জেনে তাঁর মনে হয়েছিল এরকম একটি অহিফেন ও মাদক ভেষজ-বিরোধী (বর্তমান পরিভাষায় ‘ড্রাগস’) সংস্থার বিশেষ প্রয়োজন ভারতবর্ষেও আছে। দণ্ডবিধির সংস্কার, বন্দীদের প্রতি মানবিক আচরণ ও মানব অধিকার রক্ষার জন্যে ভারতবর্ষে উদ্যোগ নেওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেছিলেন। এই বিষয়ে দায়িত্ব নিয়ে কিছু করার জন্যে তিনি মানবেন্দ্রনাথ রায়কে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। ভারতীয় লেখক ও সম্পাদকরা পি. ই. এন. (Poets Editors Novelists) ক্লাবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতর ভাবে যুক্ত হন, প্রতি বছর পি. ই. এন. কংগ্রেসে প্রতিনিধি পাঠান, ভারতীয় সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে পরিচিত করাতে উদ্যোগী হন—এটা তিনি চেয়েছিলেন। খ্যাতনামা সাহিত্যিক আঁদ্রে জিদ, আঁদ্রে মার্লরো প্রমুখের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ও কথাবার্তা হয়েছিল। ভারতবর্ষের শিল্পোন্নয়নের জন্যে কেবলমাত্র মূলধন ও রাষ্ট্রীয় সহায়তা নয়, প্রযুক্তিবিদ বিশেষজ্ঞও চাই—এই কথাটি তিনি বিশেষ জোর দিয়ে বলেছিলেন। তার জন্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যচুক্তির দিকে মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু ‘অসহায়ের মতো বিদেশী বিশেষজ্ঞদের কাছে আত্মসমর্পণ’ যাতে না করতে হয় সে সম্পর্কে সতর্ক থাকার কথাও তিনি বলেছিলেন। অর্থাৎ নৈতিক পুনরুজ্জীবন ও বাণিজ্যিক ভারসাম্য সুরক্ষিত করার চিন্তা মাথায় রেখে বাণিজ্যিক চুক্তি করা প্রয়োজন বলে তিনি বিশ্বাস করতেন।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, পররাষ্ট্র নীতি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সাংস্কৃতিক বিনিয়ম ও ভৌগোলিক সীমানার বাইরে প্রকৃত মানবিক সমস্যা এবং তার প্রতিকার সম্বন্ধে সুভাষচন্দ্রের ভাবনা-চিন্তায় এবং উদ্যোগে এক অভিজ্ঞ, পরিণত, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাষ্ট্রনায়কের পরিচয় ফুটে উঠেছিল।

সকল অধ্যায়

১. দেশনায়ক – ১
২. দেশনায়ক – ২
৩. দেশনায়ক – ৩
৪. দেশনায়ক – ৪
৫. দেশনায়ক – ৫
৬. দেশনায়ক – ৬
৭. দেশনায়ক – ৭
৮. দেশনায়ক – ৮
৯. দেশনায়ক – ৯
১০. দেশনায়ক – ১০
১১. দেশনায়ক – ১১
১২. দেশনায়ক – ১২
১৩. দেশনায়ক – ১৩
১৪. দেশনায়ক – ১৪
১৫. দেশনায়ক – ১৫
১৬. দেশনায়ক – ১৬
১৭. দেশনায়ক – ১৭
১৮. দেশনায়ক – ১৮
১৯. দেশনায়ক – ১৯
২০. দেশনায়ক – ২০
২১. দেশনায়ক – ২১
২২. দেশনায়ক – ২২
২৩. দেশনায়ক – ২৩
২৪. দেশনায়ক – ২৪
২৫. দেশনায়ক – ২৫
২৬. দেশনায়ক – ২৬
২৭. দেশনায়ক – ২৭
২৮. দেশনায়ক – ২৮
২৯. দেশনায়ক – ২৯
৩০. দেশনায়ক – ৩০
৩১. দেশনায়ক – ৩১
৩২. দেশনায়ক – ৩২
৩৩. দেশনায়ক – ৩৩
৩৪. দেশনায়ক – ৩৪
৩৫. দেশনায়ক – ৩৫
৩৬. দেশনায়ক – ৩৬
৩৭. দেশনায়ক – ৩৭
৩৮. দেশনায়ক – ৩৮
৩৯. দেশনায়ক – ৩৯
৪০. দেশনায়ক – ৪০
৪১. দেশনায়ক – ৪১
৪২. দেশনায়ক – ৪২
৪৩. দেশনায়ক – ৪৩
৪৪. দেশনায়ক – ৪৪
৪৫. দেশনায়ক – ৪৫
৪৬. দেশনায়ক – ৪৬
৪৭. দেশনায়ক – ৪৭
৪৮. দেশনায়ক – ৪৮
৪৯. দেশনায়ক – ৪৯
৫০. দেশনায়ক – ৫০

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন