হরিপুরা অধিবেশনের পর থেকেই সুভাষচন্দ্র জাতীয় পরিকল্পনার কার্যকর রূপ দিতে উদ্যোগ নেন। পর পর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের পর ১৯৩৮ সালের ডিসেম্বর মাসে বোম্বাইয়ে একটি প্ল্যানিং কমিটি গঠিত হয়। ১৭ ডিসেম্বর প্ল্যানিং কমিটির প্রথম অধিবেশনের উদ্বোধন করেন সুভাষচন্দ্র। সভাপতিত্ব করেন জওহরলাল নেহরু। তিনিই এই কমিটির সভাপতি হন। অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন স্যার এম. বিশ্বেশ্বরায়া, স্যার পুরুষোত্তমদাস ঠাকুরদাস, অম্বালাল সারাভাই, এ. ডি. স্রফ, কে. টি. শাহ ও ডঃ ভি. এস. দুবে। আহ্বায়ক ছিলেন ভি. ভি. গিরি। বিশেষ আমন্ত্রিতদের মধ্যে ছিলেন বল্লভভাই প্যাটেল, ভুলাভাই দেশাই, জে. বি. কৃপালনী, যমনদাস বাজাজ প্রমুখ। সুভাষচন্দ্রের অনুরোধে জওহরলাল প্ল্যানিং কমিটির সভাপতি হতে সম্মত হয়েছিলেন। সুভাষচন্দ্র জওহরলালকে সভাপতিরূপে চেয়েছিলেন তার কারণ: জওহরলাল নিজেও প্ল্যানিং সম্বন্ধে খুব উৎসাহী ছিলেন, এই বিষয়ে চিন্তাভাবনা করেছিলেন, তিনি সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় প্রভাবিত ছিলেন এবং কংগ্রেসের ভেতরকার বামপন্থী মনোভাবাপন্নদের মধ্যে তিনি ও সুভাষচন্দ্র শীর্ষস্থানীয় ছিলেন। জওহরলালের ব্যাপক পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা ছিল। এ ছাড়া, জওহরলাল মহাত্মা গান্ধীর সর্বাপেক্ষা স্নেহভাজন ছিলেন। সুভাষচন্দ্রের বিশ্বাস ছিল যে, প্ল্যানিং কমিটির নীতি ও লক্ষ্য এবং তাঁর (সুভাষচন্দ্রের) শিল্পোন্নয়ন এবং অন্যান্য আর্থ-সামাজিক পরিকল্পনা সম্পর্কে গান্ধীপন্থীদের সংশয় বা আপত্তি থাকলেও জওহরলাল ওই কমিটির সভাপতি পদে থাকায় গান্ধীজির সঙ্গে মতবিরোধ দূর করা সহজ হবে।
কংগ্রেস ও ন্যাশনাল প্ল্যানিং প্রসঙ্গে আর একটি কথা বলা প্রয়োজন। জাতীয় কংগ্রেসে এবং মুক্তি আন্দোলনে সুভাষচন্দ্রের অবদান সম্পর্কে সমসাময়িক ও বর্তমান ঐতিহাসিকেরা সুবিচার করেননি বললে যথেষ্ট হবে না। সুভাষচন্দ্র বহু ক্ষেত্রে প্রায় উপেক্ষিত হয়েছেন। জাতীয় কংগ্রেস তথা স্বাধীন ভারতবর্ষের পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তির স্থপতি এবং জাতীয় পরিকল্পনার (National Planning) উদ্যোক্তারূপে প্রায় সবটুকু কৃতিত্ব এবং প্রশংসা পেয়েছেন জওহরলাল নেহরু। জওহরলালের অবদান অবশ্যই অনস্বীকার্য। কিন্তু পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে সুভাষচন্দ্রের অসামান্য দূরদৃষ্টি, জ্ঞান, তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ শক্তি এবং তাঁর অবদানের কথা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। তেমনি, জাতীয় পরিকল্পনা কমিটি গঠনের প্রয়োজনীয়তা, ওই কমিটির লক্ষ্য এবং কর্মসূচী নির্ণয়ে সুভাষচন্দ্রের ভূমিকাও ছিল অনন্য। গান্ধীজির সঙ্গে তাঁর আদর্শগত বিরোধের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল এই প্ল্যানিং কমিশন গঠন ও তার কার্যধারা। কিন্তু সুভাষচন্দ্রের এই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা প্রায় অস্বীকৃত থেকে গেছে। শঙ্করীপ্রসাদ বসু তাঁর তথ্যবহুল, ‘সুভাষচন্দ্র ও ন্যাশন্যাল প্ল্যানিং’ গ্রন্থে এই বিষয়টি বিশদ আলোচনা করেছেন। তিনি সঙ্গত ক্ষোভের সঙ্গে দেখিয়েছেন যে, নেহরুর গুণমুগ্ধ এক বিদগ্ধ লেখকও ‘ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটি’ গঠনের সব কৃতিত্বটুকু জওহরলালকে দিয়েছেন। তিনি শুধুমাত্র লিখেছেন, ওই কমিটি ১৯৩৮ সালে ‘কংগ্রেস সভাপতি গঠন করেছিলেন’। আসলে, উক্ত সভাপতি যে ‘সুভাষচন্দ্র বসু’, এই কথাটুকু পর্যন্ত তিনি উল্লেখ করেননি।
১৯৩৮ সালে ন্যাশনাল প্ল্যানিং ও প্ল্যানিং কমিটি সম্পর্কে সুভাষচন্দ্র একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিয়েছিলেন। প্রখ্যাত বৈজ্ঞানিক মেঘনাদ সাহার সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের এই বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছিল। ১৯১৩ সালে উভয়েই প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র ছিলেন। সুভাষচন্দ্রের দুই অগ্রজ মেঘনাদ সাহার সহপাঠী ছিলেন। মেঘনাদ সাহা গভীর আগ্রহের সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক জীবন লক্ষ্য করতেন। তাঁর প্রতি অধ্যাপক সাহার শ্রদ্ধা ছিল। ১৯২২ সালে নিখিল বঙ্গ যুবক সম্মেলনের অধিবেশনে মূল সভাপতি ছিলেন মেঘনাদ সাহা। এই সম্মেলনে মেঘনাদ সাহা ও সুভাষচন্দ্র উভয়েরই বক্তব্যের মূল বিষয় ছিল জাতীয় পুনর্গঠন। পরবর্তী কয়েক বছরে দু’জনের মধ্যে যোগাযোগ তেমন না হলেও ১৯৩৫ সালে পত্রালাপ হয়েছিল। সুভাষচন্দ্র মেঘনাদ সাহার বিভিন্ন উদ্যোগ, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সাফল্যের সংবাদে ভীষণ খুশি হতেন। সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস সভাপতি হলে, মেঘনাদ সাহা তাঁকে অভিনন্দন জানাতে যান, দু’জনের মধ্যে প্ল্যানিং কমিটি ও পরিকল্পনার লক্ষ্য নিয়ে আলোচনা হয়। সুভাষচন্দ্রের উদ্যোগ দেখে তিনি অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন। তিনি সুভাষচন্দ্র সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধে লেখেন, “কংগ্রেস সভাপতি দেশকে অপ্রত্যাশিত নেতৃত্ব দিয়েছেন।” তাঁর স্বভাবসিদ্ধ তীক্ষ্ণ ভাষায় তিনি বলেন, “জনপ্রিয় নেতারা এবং জনপ্রিয় সরকারগুলি (প্রাদেশিক কংগ্রেস সরকার) যদি শ্রীযুক্ত বসুর তুল্য বুদ্ধিমান এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হন, যদি ব্যবসায়ীরা আরো স্বার্থবোধহীন হন, সকলে যদি সামাজিক উন্নতি ও ন্যায়বিচারের জন্য কাজ করেন, তাহলে আমরা বিজ্ঞানের সাহায্যে প্রাচুর্য ও সমৃদ্ধির যুগে প্রবেশ করতে পারব, যেখানে ভারতের প্রতিটি নরনারী এমন স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে বাঁচতে পারবেন যা সম্রাট শাজাহানের পক্ষেও ঈর্ষার যোগ্য।”
সুভাষচন্দ্র মেঘনাদ সাহার মতো বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী ও মননশীল মানুষের সমর্থন ও উৎসাহ পেয়ে খুবই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান কলেজে অনুষ্ঠিত জাতীয় পুনর্গঠন পরিকল্পনা সম্পর্কিত এক আলোচনা সভায় (২৩ আগস্ট, ১৯৩৮) তিনি বলেন, “যখন আমরা সমগ্র দেশের জন্যে জাতীয় সরকার গঠন করব তখন আমাদের অন্যতম প্রধান কাজ হবে সমগ্র দেশের জন্যে জাতীয় পরিকল্পনা কমিশন নিয়োগ করা।” গান্ধীজি ও কংগ্রেসের রক্ষণশীল নেতাদের শিল্পায়ন সম্বন্ধে আশঙ্কা এবং শিল্পায়নকে ‘অভিশাপ’ বলে মনে করার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “শিল্পায়ন অভিশাপ হতে পারে···কিন্তু এই অভিশাপের হাত এড়াবার উপায় নেই।”
মেঘনাদ সাহা সুভাষচন্দ্রের প্রগতিশীল চিন্তাধারার এত বড় সমর্থক ছিলেন যে যখন সুভাষচন্দ্রকে ত্রিপুরী কংগ্রেসের সভাপতি করার প্রশ্নে তুমুল বিতর্ক-বিরোধ দেখা দেয় তখন তিনি রবীন্দ্রনাথকে অনুরোধ জানান সুভাষচন্দ্রের পুনর্বিাচন সমর্থন করতে এবং গান্ধীজিকে তার জন্যে প্রভাবিত করতে। ১৯৩৮ সালের নভেম্বর মাসে এই উদ্দেশ্যে মেঘনাদ সাহা শান্তিনিকেতনেও গিয়েছিলেন।
সুভাষচন্দ্র অতি অল্প সময়ের মধ্যে অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত ও দক্ষ ব্যক্তিদের শ্রদ্ধা ও আস্থা অর্জন করেছিলেন। তাঁদের আকৃষ্ট করেছিলেন। এরকম এক দৃষ্টান্ত ছিলেন হরিবিষ্ণু কামাথ। কলেজে ছাত্রজীবনেই কামাথ সুভাষচন্দ্রের নামে ও তাঁর অসাধারণ আত্মত্যাগের কথা পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন। এরপর মান্দালয় জেল থেকে লেখা সুভাষচন্দ্রের কয়েকটি চিঠি পড়ে কামাথ তাঁর সম্বন্ধে আরও জানার জন্যে অধীর হয়ে পড়েন। সংবাদপত্রে সুভাষচন্দ্রের একটি ছবি দেখে তিনি বিস্মিত মনে চিন্তা করতে থাকেন যে ওই রকম সুন্দর, নিষ্পাপ যার মুখ, সেই মানুষটির মনের ভেতরে এত শক্তি কী করে থাকতে পারে। এর পর কামাথ আই সি এস হয়ে উচ্চ পদমর্যাদার রাজকর্মচারী হন। বেশ কয়েক বছর চাকরি করার পর কামাথের মনে হতে থাকে যে তিনি তাঁর যৌবনের আদর্শ ও লক্ষ্য থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছেন। সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস সভাপতি হলে কামাথ তাঁকে চিঠি লেখেন, “আমি কি আপনার কাজে যোগ দিতে পারি?” এইরকম চিঠি সুভাষচন্দ্র একদিন দেশবন্ধুকে লিখেছিলেন। সুভাষচন্দ্র উত্তর দেন, “আমি সর্বান্তকরণে তোমাকে স্বাগত জানাই।” এরপর কামাথ ‘রাষ্ট্রপতি’ সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করেন। ১৯৩৮ সালের মার্চ মাসের এক মধ্যাহ্নে নাগপুরে এক কংগ্রেস। মন্ত্রীর ঘরে কামাথ সুভাষচন্দ্রের মুখোমুখি হন। সুভাষচন্দ্র কামাথকে উষ্ণ আলিঙ্গন করে স্বাগত জানান। মুখে তাঁর উজ্জ্বল হাসি। বিমুগ্ধ কামাথ অন্তরের গভীরে উপলব্ধি করলেন যে তিনি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এক মাসের মধ্যে আই সি এস-এর মোহ ও বন্ধনমুক্ত কামাথ সুভাষচন্দ্রের পাশে এসে দাঁড়ালেন। তিনি ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটির যুগ্মসচিব হন ও সুভাষচন্দ্রের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হয়ে ওঠেন।
ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটির নীতি নিয়ে পরে যখন কংগ্রেসের মধ্যে বিতর্ক দেখা দেয়, গান্ধীজি স্বয়ং ক্ষোভ প্রকাশ করেন যে, খাদি ও কুটির শিল্পকে উপেক্ষা করে শিল্পায়নের ওপর মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে এবং এটা কংগ্রেসের সাংবিধানিক নির্দেশ-বিরোধী, তখন জওহরলাল এক উভয় সঙ্কটের মধ্যে পড়েন। শিল্পায়ন ও নতুন অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় নেহরু বিশ্বাস করতেন, তিনিই ছিলেন কমিটির সভাপতি। কিন্তু গান্ধীজির সঙ্গে কোনও প্রকাশ্য বিরোধে যেতে তিনি অনিচ্ছুক ছিলেন। গান্ধীজির ইচ্ছা ও নির্দেশ-বিরোধী কাজ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। এই নিয়ে কামাথের সঙ্গে নেহরুর দীর্ঘ পত্র-বিনিময় হয়েছিল। কামাথ পদত্যাগ করেছিলেন কমিটির সচিবের পদ থেকে। কংগ্রেসের সভাপতি পদে সুভাষের পুনর্নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয়। ত্রিপুরী অধিবেশনের পর যখন তা গভীর সঙ্কটের রূপ নেয় তখন নেহরুর ভূমিকা নিয়ে বহু প্রশ্ন ওঠে। নেহরু-সুভাষের মতান্তর ও মনান্তর তীব্রতর এবং কিছুটা তিক্তকরও হয়ে ওঠে। প্রভাবশালী শিল্পপতি ও রক্ষণশীল গান্ধীপন্থীদের নিয়ন্ত্রিত কিছু বড় বড় সংবাদপত্র-পত্রিকায় সুভাষচন্দ্রের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের নীতি সমালোচিত হলেও জনমত ছিল সুভাষচন্দ্রের পক্ষে। এমনকি জেরার্ড কর-এর মতো (Gerard Corr) সুভাষচন্দ্রের নিরবচ্ছিন্ন ব্রিটিশ সমালোচকও স্বীকার করেন (সুবোধ মার্কণ্ডেয়র Subhas Chandra Bose গ্রন্থে উদ্ধৃত): “Bose was ahead of his time, for the people were not ready for this sort of direct to-the-point bluntness about the Indian condition. It was an engaging characteristic of Bose that—unlike so many Indian politicians—he never attempted to dissemble. He spoke what was on his mind, not always with due regard to the consequences. He could never be a fellow traveller.”
সত্যিই সুভাষচন্দ্র তাঁর যুগের পুরোবর্তী ছিলেন। যা সত্যি বলে মনে করতেন তা খোলাখুলি স্পষ্ট করে বলতেন। অন্য অনেক ভারতীয় রাজনৈতিক নেতাদের মতো ছদ্মবেশ ধারণ বা মনোভাব গোপন করার স্বভাব তাঁর ছিল না। এর ফল কী হতে পারে তা নিয়ে তিনি ভাবতেন না।
নিজের রাজনৈতিক স্বার্থের পক্ষে কংগ্রেস সভাপতিরূপে সুভাষচন্দ্রের নির্ভীক, বলিষ্ঠ, সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ শুভ হয়নি। ক্রমেই কংগ্রেসের গান্ধীপন্থী নেতারা সুভাষ-বিরোধী হয়ে উঠতে থাকেন। তাঁরা চাননি সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস সভাপতি পদে পুনর্নির্বাচিত হন। অন্তরালে গান্ধীজিরও প্রচ্ছন্নভাবে এই মনোভাবের প্রতি সমর্থন ছিল। সুভাষচন্দ্র কিন্তু তখনও গান্ধীজি ও তাঁর অনুগামীদের সঙ্গে বোঝাপড়ার সম্পর্ক অব্যাহত রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। হরিপুরা কংগ্রেসের কিছু কাল পরেই মধ্যপ্রদেশের (Central Province) কংগ্রেস দলে এক সঙ্কট দেখা দেয়। ক্রমেই এই সঙ্কট মুখ্যমন্ত্রী এন. বি. খারের সঙ্গে কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের মধ্যে এক তিক্ত বিরোধের রূপ নেয়। মধ্যপ্রদেশের মন্ত্রিসভায় মহারাষ্ট্রীয় (মারাঠা-ভাষী) ও মহা কোশলীয় (হিন্দী-ভাষী) দু’টি দলের সৃষ্টি হয়। এই দুই দলের মধ্যে মন্ত্রী নির্বাচন ও দপ্তর বিভাগ নিয়ে রাজনৈতিক জটিলতা দেখা দেয়। মুখ্যমন্ত্রী (তখন প্রধানমন্ত্রী বলা হত) খারে ছিলেন মহারাষ্ট্রীয়। কংগ্রেস পার্লামেন্টারী কমিটির সভাপতি বল্লভভাই প্যাটেলের মধ্যস্থতায় সাময়িক মীমাংসা হলেও, আবার বিরোধ আরও জটিল ও তিক্ত হয়ে ওঠে। খারের বিরুদ্ধে কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের অভিযোগ ছিল যে, তিনি ব্রিটিশ প্রশাসকদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দলীয় নির্দেশ অমান্য করছেন। দলের স্বার্থ-বিরোধী কাজ করছেন। শেষপর্যন্ত অবস্থা চরমে পৌঁছয়। সুভাষচন্দ্রের সভাপতিত্বে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি খারেকে র্ভৎসনা করে তাঁর বিরুদ্ধে দলীয় নির্দেশ ও শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত করেন। ক্ষুব্ধ খারে অভিযোগ করেন যে, সুভাষচন্দ্র গান্ধীজির নির্দেশে কাজ করেছেন। তিনি এরপর বলে বেড়ান যে, তিনি সুভাষচন্দ্রকে নাকি সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, ‘গান্ধী রাজনৈতিক চক্রে’র হাতে একদিন সুভাষচন্দ্রের একই অভিজ্ঞতা হবে।
মধ্যপ্রদেশে সঙ্কটের কারণ, ঘটনাবলী ও কেন খারের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে ওয়ার্কিং কমিটি কঠোর অপ্রিয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে তার সব বেতথ্য ও ব্যাখ্যা দিয়ে সুভাষচন্দ্র এক দীর্ঘ বিবৃতি দেন (১৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৮)। এই বিবৃতিতে সুস্পষ্ট হয় যে, মুখ্যমন্ত্রীর পদ ও ক্ষমতার লোভে খারে সর্বপ্রকার অর্থনৈতিক, দলীয় স্বার্থ-বিরোধী কাজকর্মে লিপ্ত হন, কোনও উপদেশ ও আদেশ তিনি কর্ণপাত করেননি। মধ্যপ্রদেশের গভর্নরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন। গান্ধীজির বিরুদ্ধে তাঁর কটুক্তি, মিথ্যা সন্দেহ ও অযৌক্তিক অভিযোগও রুচিবিরুদ্ধ ছিল। ঘটনাচক্রে কয়েক মাসের মধ্যেই গান্ধীজির সঙ্গে বিরোধের ফলে সুভাষচন্দ্রকেও শেষপর্যন্ত কংগ্রেস ত্যাগ করতে হলেও তার সঙ্গে খারের ঘটনার কোনও মিল ছিল না। খারের লক্ষ্য ছিল মুখ্যমন্ত্রীর পদ না হারানো। সুভাষচন্দ্রের লক্ষ্য ছিল কোনওরকম ক্ষমতার প্রলোভনে বা কায়েমী স্বার্থের চাপে দেশের মুক্তি আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে লক্ষচ্যুত না হওয়া।
মুসলিম লীগ, মহম্মদ আলি জিন্নার সাম্প্রদায়িক দাবি ও কংগ্রেস-লীগ রাজনৈতিক মতভেদের প্রশ্নে গান্ধীজি এবং কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের ঐকমত্য ছিল। ভারতবর্ষের মধ্যে একটি স্বতন্ত্র মুসলিম রাষ্ট্রের দাবি প্রথম উত্থাপন করেন (১৯৩০) প্রখ্যাত কবি মহম্মদ ইকবাল। একটি স্বাধীন ও পৃথক মুসলমান রাষ্ট্রের পরিকল্পনাকে আরও বিশদ ও নতুন রূপ দেন ইংলভ প্রবাসী কয়েকজন তরুণ মুসলমান ছাত্র। এঁদের মধ্যে প্রধান ছিলেন রহমত আলি। লন্ডনে গোলটেবিল বৈঠকের সময় তিনি মুসলিম লীগের প্রতিনিধিদের কাছে এই পরিকল্পনা পেশ করেন। গোলটেবিল বৈঠকে তাঁর মুসলিম রাষ্ট্র, পাকিস্তান গঠনের প্রস্তাব তেমন গুরুত্ব না পেলেও, ১৯৩৩ সালে রহমত আলি পাকিস্তান জাতীয় আন্দোলন শুরু করেন। প্রথমে ছাত্রসুলভ ‘উদ্ভট ও অবান্তর’ বলে অভিহিত হলেও অল্পকালের মধ্যেই ‘পাকিস্তান’-এর দাবি মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে জনসমর্থন লাভ করে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। জিন্না একসময় কংগ্রেস দলের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু তিনি কংগ্রেস ও উগ্র গান্ধী-বিরোধী হয়ে উঠে মুসলিম লীগে যোগ দেন। তাঁরই নেতৃত্বে মুসলিম লীগ পাকিস্তান প্রস্তাব গ্রহণ করে ওই দাবিকে জোরদার করে তোলে। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ একটি শক্তিশালী দল রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। মুসলিম জনগণের কাছে জিন্নার সাম্প্রদায়িক আবেদন ক্রমেই হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ককে প্রভাবিত করে। এর প্রতিক্রিয়া হিন্দু জনমতেও দেখা দেয়। মুসলিম লীগ দাবি করতে শুরু করে যে মুসলমানদের একমাত্র রাজনৈতিক দল হল মুসলিম লীগ। মুসলমানদের মুখপাত্র হওয়ার অধিকার শুধু মাত্র মুসলিম লীগের। কংগ্রেস হল হিন্দুদের দল। মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করার অধিকার কংগ্রেসের নেই। কংগ্রেস এই দাবি সম্পূর্ণ নস্যাৎ করে বলে যে, কংগ্রেস হিন্দু, মুসলমান ও সর্বধর্ম এবং সম্প্রদায়ের মানুষের একমাত্র জাতীয় প্রতিষ্ঠান। ভারতবর্ষের সকল মানুষের মুখপাত্র হল জাতীয় কংগ্রেস। জিন্না অভিযোগ করেন গান্ধীজি কংগ্রেসকে হিন্দু পুনর্জাগরণের অস্ত্ররূপে ব্যবহার করছেন। ‘হিন্দুরাজ’ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন। মুসলমান সম্প্রদায়ের কাছে জিন্নার দু’টি প্রধান বক্তব্য ছিল। প্রথমত, প্রাদেশিক কংগ্রেসী মন্ত্রিসভাগুলি নির্মমভাবে মুসলমানদের স্বার্থ ও অধিকার দলিত করছে। দ্বিতীয়ত, ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানরা প্রকৃত অর্থে সংখ্যালঘু নয়। এই উপমহাদেশে তারা এক পৃথক জাতি (Nation)। হিন্দু ও মুসলমান দুটি পৃথক জাতি (Two Nations) হওয়ায় ভারতবর্ষে গণতন্ত্রের সংখ্যাগরিষ্ঠদের শাসন প্রতিষ্ঠার নীতি গ্রহণযোগ্য নয়। বলা বাহুল্য, কংগ্রেসের কাছে এই দ্বি-জাতি তত্ত্বের ব্যাখ্যা ও দাবি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য ছিল।
সুভাষচন্দ্রের কাছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, জাতীয় ঐক্য ও সংহতি রক্ষা ও সুদৃঢ় করা ছিল প্রধান লক্ষ্য। এই প্রশ্নে তিনি এতই আবেগপ্রবণ ছিলেন যে, মাঝে মাঝেই রূঢ় বাস্তবকে প্রায় উপেক্ষা করে তিনি আশাবাদী হয়ে উঠতেন। হরিপুরা ভাষণে ব্রিটিশ বিভেদনীতির ফলে দেশ বিভক্ত হয়ে যাওয়ার যে আশঙ্কা তিনি ব্যক্ত করেছিলেন তা তাঁর দূরদৃষ্টির পরিচায়ক ছিল। কিন্তু মাত্র দু’ মাস পরে স্কটিশ চার্চ কলেজে এক ভাষণে (১০ এপ্রিল, ১৯৩৮) তিনি বলেন যে, দেশের মুক্তি আন্দোলন সকলপ্রকার সাম্প্রদায়িক বিভেদকে ভেঙে ফেলছে। তিনি নিশ্চিত, “ভারতে সাম্প্রদায়িকতা তার শেষ ধাপে এসে পৌঁছেছে।” কিছুদিন পরে পূর্ববাংলায় সফরকালে মুসলমান জনসাধারণের কাছে অভূতপূর্ব সংবর্ধনা পেয়ে অভিভূত সুভাষচন্দ্র বলেন যে, বাংলার মুসলমানরা সকলেই শীঘ্রই কংগ্রেসে যোগ দেবেন। পূর্ববাংলায় তাঁর বিরুদ্ধে কোথাও কোথাও যে বিক্ষোভ এবং ‘কালো পতাকা’ দেখান হয়েছিল তাকে তিনি কোনও গুরুত্ব দেননি। গান্ধীজিও হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি গড়ে ওঠা, সাম্প্রদায়িকতার অবসান এবং ভারত-বিভাগের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়া সম্পর্কে খুবই আশাবাদী ছিলেন। তিনি সর্বতোভাবে চেষ্টা করেছিলেন জিন্নার মন থেকে হিন্দু প্রাধান্যের আশঙ্কা দূর করতে। কিন্তু তিনি সফল হননি। কংগ্রেস সভাপতিরূপে সুভাষচন্দ্রও সেই প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন।
মীমাংসার সূত্র খুঁজে বার করার জন্যে তিনি জিন্নার সঙ্গে পত্রালাপ করেছিলেন (মে-আগস্ট, ১৯৩৮)। তিনি জিন্নাকে লিখেছিলেন যে, এটা অনস্বীকার্য যে কংগ্রেসের বৃহত্তম সংখ্যক সদস্যরা হলেন হিন্দু। কিন্তু ধর্মের ভিত্তিতে কেউ কংগ্রেসের সদস্য হন না। কংগ্রেসে বহু মুসলমান ও অন্যান্য বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ আছেন। “ভারতবর্ষ যাঁদের স্বদেশ সেই সব সম্প্রদায়ের, সব জাতির এবং সকল শ্রেণীর মানুষের প্রতিনিধিত্ব করা কংগ্রেসের অবিচ্ছিন্ন ঐতিহ্য হয়ে আছে।” কিন্তু তাঁর কোনও যুক্তি বা আবেদনে কাজ হয়নি। জিন্না তাঁর দাবিতে অনড় থাকেন। মুসলিম লীগই একমাত্র মুসলিম জনসাধারণের প্রতিনিধিত্ব করবে এতেই তিনি সন্তুষ্ট হননি। তিনি জিদ ধরেছিলেন যে মীমাংসার সূত্র খোঁজার জন্যে কোনও কমিটি গঠিত হলে তাতে কংগ্রেসের প্রতিনিধি দলে একজনও মুসলমান থাকলে চলবে না। এর ফলে সুভাষ-জিন্না আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি। কিন্তু তবুও সুভাষচন্দ্র জিন্নাকে আলোচনার মাধ্যমে পাকিস্তান প্রস্তাব ত্যাগ করে স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর সহযোগিতার পাওয়ার আশা ত্যাগ করেননি।
ভারতবর্ষের অখণ্ডতা ও হিন্দু-মুসলমান ঐক্য বিপন্ন হলেও সুভাষচন্দ্র আশাহত হননি। কংগ্রেস সভাপতিপদ ত্যাগ (এপ্রিল, ১৯৩৯) ও ফরোয়ার্ড ব্লক গঠনের (মে, ১৯৩৯) পর ঢাকায় এক বক্তৃতায় (৫ জুন, ১৯৩৯) তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, বামপন্থীরা যদি তাঁদের কর্মপদ্ধতি কার্যকর করতে পারেন তাহলে মুসলমানদের অভিযোগ দূর হবে। বামপন্থীদের সঙ্গে তাঁদের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠার বৃহত্তর সম্ভাবনা দেখা দেবে। মুসলিম লীগে অভিজাত বিত্তশালী মুসলমানদের কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে ‘হাজারে হাজারে’ এমন সদস্য হচ্ছেন যাঁরা পুরনো নেতাদের ক্ষমতাচ্যুত করে নিজেরা নেতৃত্বে আসছেন। এই পরিস্থিতিতে মুসলমানদের দলে টানতে না পারলে ‘ভয়ঙ্কর কর্তব্যচ্যুতির দায়ে’ পড়তে হবে। আসল সমস্যা হল—খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা ও বেকারত্ব। স্বাধীনতার পর এর সমাধান হলে মুসলমানদের অভিযোগ এবং সমস্যা দূর হবে। সুভাষচন্দ্রের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, ইংরাজদের চক্রান্ত, বিভেদ নীতি ও অপপ্রচারই মুসলমান বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্যে দায়ী। মুসলমানদের মধ্যে একটি শ্রেণীর অল্পসংখ্যক কিছু লোক ভারত বিভাগ চান।
১৯৪২ সালেও সুভাষচন্দ্রের বিশ্বাস অটুট ছিল যে, পাকিস্তান একটি ‘আজগুবী পরিকল্পনা’ ও ‘অকার্যকর প্রস্তাব’। তাঁর এই বিশ্বাস কতখানি অবাস্তব ছিল তা মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই দেখা গিয়েছিল। সুভাষচন্দ্র ঐক্যবদ্ধ স্বাধীনতা আন্দোলন ও অখণ্ড স্বাধীন ভারতের আদর্শ ও লক্ষ্যে এত অবিচল ছিলেন যে, তিনি তাঁর স্বপ্নভঙ্গের চিন্তা করতে পারেননি। জিন্নাকে কংগ্রেসের সঙ্গে একযোগে সংগ্রাম করতে সম্মত করানোর জন্যে তিনি তাঁকে (জিন্নাকে) স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব পর্যন্ত দিয়েছিলেন। হিন্দু মহাসভার নেতা বীর সাভারকরের সঙ্গেও তিনি কথা বলেছিলেন। তাঁকেও ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের প্রয়োজন বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর প্রচেষ্টা সফল হয়নি।
অল্পকালের মধ্যেই তিনি গোপনে দেশত্যাগ করেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আজাদ হিন্দ ফৌজ সংগঠনে ও পরিচালনায় তিনি কীভাবে সঙ্ঘবদ্ধ মুক্তি সংগ্রামের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন তা আজ আর অজানা নয়। কিন্তু ভারতবর্ষে ক্ষমতা হস্তান্তরের সন্ধিক্ষণে সুভাষচন্দ্র ছিলেন না। দেশত্যাগের পূর্বে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে এক বিরাট ব্যক্তিত্ব হলেও ঘটনার গতি নিয়ন্ত্রণের একক ক্ষমতা তাঁর ছিল না। স্বভাবতই একটি প্রশ্ন মনে জাগে। গান্ধীজিও দেশ-বিভাগের আপসহীন বিরোধী ছিলেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে তাঁর মৃতদেহের ওপর দেশ-বিভাগ করতে হবে। কিন্তু শেষপর্যন্ত তাঁকেও দেশ-বিভাগ মেনে নিতে হয়েছিল। হতাশ, বেদনাহত গান্ধীজির নিজেকে অসহায় ও একাকী মনে হয়েছিল। ওই মুহূর্তে তাঁর পাশে যদি সুভাষচন্দ্র থাকতেন তাহলে কি ভারত-বিভাগ রোধ করা সম্ভব হত?
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন