সুভাষচন্দ্র কলকাতা কর্পোরেশনের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার রূপে কার্যত ছিলেন মাত্র ছ’মাস। ওই অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন দক্ষতা ও আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলে কতখানি নাগরিক চেতনা আনা, নাগরিক কল্যাণ ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করা সম্ভব। নগর উন্নয়নের ক্ষেত্রে কলকাতা ভারতের অন্যান্য শহরের কাছে নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়েছিল। মেয়র দেশবন্ধু ও পরিচালন ব্যবস্থার প্রধান সুভাষ অভূতপূর্ব নতুন নির্দেশ ও পরিকল্পনা চালু করেছিলেন। নব-নির্বাচিত স্বরাজ্য কাউন্সিলার, অল্ডারম্যান ও মেয়র স্বয়ং সকলেই ঘরে প্রস্তুত খদ্দরের পোশাক পরে আসতেন। কর্মচারীদের সরকারি পোশাকও হল খদ্দর। শহরের বহু রাস্তা ও পার্কের নামকরণ হল শ্রেষ্ঠ ভারত সন্তানদের নামে। এই প্রথম একটি শিক্ষা-বিভাগ খোলা হল। এই বিভাগের প্রধান নিযুক্ত হলেন কেমব্রিজের স্নাতক ক্ষিতীশপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। সারা শহরে কর্পোরেশনের পরিচালনায় অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপিত হল। জনস্বাস্থ্যের জন্যে প্রত্যেকটি ওয়ার্ডে সমাজসেবী নাগরিকদের নিয়ে স্বাস্থ্য-সমিতি গড়া হল। দরিদ্র মানুষদের জন্যে পৌরসভা দাতব্য চিকিৎসালয় খুলল। পৌরসভার সব জিনিসপত্র কেনাকাটার ব্যাপারে স্বদেশী পণ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। এই নির্দেশ ইউরোপীয় বণিক-শিল্পপতি গোষ্ঠীকে খুবই ক্ষুব্ধ ও চিন্তিত করে তোলে। এতদিন কর্পোরেশনে যেসব সাহেব আমলা কর্তৃত্ব করছিল তারা খুবই অসন্তুষ্ট ও উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। অন্যান্য জনকল্যাণমূলক কর্মসূচীর মধ্যে ছিল মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় শিশু চিকিৎসা কেন্দ্র খোলা, দরিদ্র পরিবারের শিশুদের জন্যে বিনামূল্যে দুধ সরবরাহ ইত্যাদি। আর একটি বৈশিষ্ট্য ছিল মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। এর আগে পর্যন্ত ভাইসরয়, গভর্নর এবং উচ্চপদস্থ সরকারি আমলাদেরই নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হত। এখন সেই রীতি রদ করে দেশবরেণ্য জাতীয়তাবাদী নেতাদের নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়ার নীতি গৃহীত হল। নতুন নীতি অনুসারে মহাত্মা গান্ধী, পণ্ডিত মতিলাল নেহরু, বিঠলভাই প্যাটেল প্রমুখ ব্যক্তিদের সংবর্ধিত করা হয়েছিল। ‘ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল গেজেট’-এর প্রকাশ ও কলকাতা কর্পোরেশনে কর্মাসিয়াল মিউজিয়ম-এর প্রতিষ্ঠাও এই সময় হয়।
কলকাতা কর্পোরেশনে দেশবন্ধু ও সুভাষচন্দ্রের পরিচালনায় যে চমকপ্রদ কাৰ্যসূচী নেওয়া হয়েছিল, তার ফলে স্বরাজ্য দলের মর্যাদা ও জনপ্রিয়তা স্বভাবতই খুবই বৃদ্ধি পেয়েছিল। বিদেশী আমলা ও সরকারি মহল এতে খুবই বিচলিত বোধ করতে শুরু করে। পৌরশাসন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ও তার সাফল্যের সঙ্গে বৃহত্তর রাজনীতির একটা সুস্পষ্ট সম্পর্ক ছিল। কলকাতা কর্পোরেশনের পরিচালন ক্ষমতাকে স্বরাজ্য দল যে জাতীয় আন্দোলনের অগ্রগতির একটি অস্ত্ররূপে ব্যবহার করছেন তা বুঝতে সরকারের ভুল হয়নি। জনমানসে প্রতিক্রিয়ার পিছনে দেশবন্ধুর ভাবমূর্তি ও সুভাষচন্দ্রের উদ্দীপ্ত কর্মদক্ষতার অবদানই ছিল সর্বাধিক। তাই সরকারি প্রত্যাঘাত প্রায় অনিবার্য হয়ে উঠছিল। নানান কারণে সরকারি রোষের প্রধান লক্ষ্য হয়ে উঠছিলেন সুভাষচন্দ্র।
কলকাতা পৌরসভাকে কেন্দ্র করে কিছু কিছু জটিলতা দেশবন্ধু-সুভাষচন্দ্রের সময় থেকেই শুরু হয়। সুভাষচন্দ্র কর্পোরেশনের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার পদের দায়িত্ব চাননি তা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি সোজাসুজি চিত্তরঞ্জনকে বলেছিলেন, “আমি কি এই কাজ করার জন্যে আই সি এস ছেড়েছি?” দেশবন্ধু শুধু বলেছিলেন, “তোমাকে এই দায়িত্ব নিতেই হবে।” কিন্তু তা সত্ত্বেও সুভাষচন্দ্রের নিয়োগ নিয়ে বেশ জল ঘোলা হয়েছিল। আসলে, স্বরাজ্য দল কর্পোরেশনের নির্বাচনে জেতার আগেই ক্ষমতা পেলে কে কোন পদ পাবে সেই নিয়ে জল্পনা-কল্পনা মন কষাকষি শুরু হয়ে গিয়েছিল। মেদিনীপুরের বীরেন্দ্রনাথ শাসমল অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেবার জন্যে ব্যারিস্টারি ছেড়ে দিয়েছিলেন। নিজের জেলায় কাঁথিতে চৌকিদারি খাজনার বিরুদ্ধে সফল আন্দোলন করে তিনি বিশেষ খ্যাতি ও শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন। তাঁর অনুগত অনেকের আশা ছিল তিনিই ওই পদটি পাবেন। কিন্তু সেই আশা পূর্ণ না হওয়ায় তাঁরা খুব হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। প্রকাশ্যে, আকারে-ইঙ্গিতে সমালোচনা, তির্যক মন্তব্য থেকে স্বয়ং দেশবন্ধুও অব্যাহতি পাননি। এক আধুনিক ঐতিহাসিক তো লিখেছেন যে, শুধু কলকাতার কায়স্থ গোষ্ঠীকে খুশি করতে পূর্বে প্রতিশ্রুতি দিয়েও মাহিষ্য বংশীয় বীরেন্দ্রনাথ শাসমলকে দেশবন্ধু কর্পোরেশনের ওই পদে বসাতে পারেননি। সুভাষচন্দ্রের প্রতি বিপ্লবীদের, মুসলমান সম্প্রদায়ের এবং সর্বোপরি দেশবন্ধুর কেন অত শ্রদ্ধা ও আস্থা ছিল তা উপলব্ধি করলে এরকম ভাবার কোনও অবকাশই থাকত না।
দুঃখের বিষয় হল জাত-পাত, সাম্প্রদায়িকতার ছায়া স্বরাজ্য দলে এবং জাতীয় আন্দোলনেও পড়ছিল তখন থেকেই। তারই সঙ্গে বাড়ছিল দলাদলি। গোষ্ঠী ও ব্যক্তি স্বার্থের লড়াই। পড়লে ও জানলে মন খারাপ হলেও স্বরাজ্য দলের কর্পোরেশনে ও বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভায় ক্ষমতা লাভের সম্ভাবনায় বাংলার রাজনীতির যে দুঃখজনক দিকটি ফুটে উঠতে শুরু করে তার একটি সমকালীন বর্ণনা তুলে না ধরলেই নয়। এই চিত্রটি আমাদের একান্ত পরিচিত। কে কোন পদ পাবে, লোভের প্রকাশ, নানান গুজবের ফলে রাজনৈতিক পঙ্কিলতা দেশবন্ধুর জীবনকে দুঃসহ করে তুলতে শুরু করে। গোপাললাল সান্যাল ওই সময়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে লিখেছেন, “কোথায় স্বরাজ-সংগ্রাম, আর কোথায় চাকরি নিয়ে কাড়াকাড়ি। মানুষের মনোগজতের এক বিচিত্র ও বিকৃত রূপ দেখে তরুণ দেশসেবকগণ যেমন নেতৃবর্গের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে উঠতে লাগলেন, সঙ্গে সঙ্গে দেশবন্ধুর মনেও নানা সংশয় উপস্থিত হতে থাকলে—এত হৈ চৈ, হাততালি, বক্তৃতা, আন্দোলন, অত্যাচার, স্বার্থত্যাগ, কারাবরণ—কিন্তু কী লাভ হল, আমরা কতদূর এগোলাম, স্বরাজের পথে?” কী কর্পোরেশন, কী বৃহত্তর ক্ষেত্রে ধর্ম, জাতি, গোষ্ঠীর মধ্যে পার্থক্য পাকাপাকি করার ব্যবস্থা হয়েছে, বিভিন্ন স্বার্থের এমনই সংঘাত যে জাতীয়তার ভাবে উদ্বুদ্ধ করে স্বরাজ্য দলের আসল লক্ষ্য (ভিতর থেকে নিরন্তর চেষ্টা করে নতুন শাসন ব্যবস্থাকে বানচাল করা) কার্যকর করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে বলে দেশবন্ধু ও সুভাষচন্দ্রের মতো আদর্শনিষ্ঠ নেতারা গভীরভাবে মর্মাহত। দলের নীতি অমান্য করে সরকারি পক্ষে ভোট দিলে “হাতে হাতে ফললাভের আশা প্রবল। কোনও সদস্যের ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী অর্জন করেও চাকরি পাচ্ছে না। কারো জামাতা বাবাজী সরকারি চাকরিতে আছেন বটে, কিন্তু মফঃস্বলের দূর-দূরান্তের শহরগুলিতেই তার নিয়ত বদলাবদলি চলছে। কারো বা ওপরওয়ালার অবসরগ্রহণের কাল আসন্ন—সে স্থলে নিজের পুত্রটিকে কোনোরকম যোগসাজশের সাহায্যে ওই পদে বসানো যায়, ইত্যাদি। নানারূপ স্বার্থক্লিষ্ট ব্যক্তি সরকারি দলে থাকাই লাভজনক মনে করেন। সমগ্র দেশের স্বরাজ যে কী বস্তু, তা আহরণ করতে একটি ভোটের মূল্যই বা কত, তা উপলব্ধি করবার আগ্রহ অপেক্ষা ছেলে বা জামাতার চাকরি বা পদোন্নতি হাতে হাতে অর্জন করা—কোনটা লোভনীয়?”
স্বরাজ্য দল এবং কংগ্রেসের মধ্যে ক্রমবর্ধমান গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সুভাষচন্দ্রকে গভীরভাবে মর্মাহত করেছিল। দেশবন্ধুর মৃত্যুর পর দলীয় অন্তর্বিরোধ আরও বৃদ্ধি পায়। গান্ধীজির সমর্থনে যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত বাংলা প্রদেশ কংগ্রেসের নেতৃত্বের দায়িত্ব পান। কিন্তু বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের সমর্থকরা এর বিরোধিতা শুরু করেন। ১৯২৭ সাল পর্যন্ত এই লড়াই চলে। এমনকি, কিছুদিনের জন্যে দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটিও গঠিত হয়। ১৯২৭ সালের কলকাতা পৌরসভার নির্বাচনে কংগ্রেসের দুটি গোষ্ঠীর প্রার্থীই নিবার্চন যুদ্ধে নামেন। সুভাষচন্দ্র এই সময় বর্মার মান্দালয় জেলে বন্দী ছিলেন। নিজের মানসিক প্রতিক্রিয়া ও যন্ত্রণা ব্যক্ত করে তিনি একটি চিঠিতে লেখেন যে, খাঁটি কর্মীর অভাব বড় বেশি। কিন্তু এরই মধ্যে কাজ করে যেতে হবে। যেমন ভালবাসা না দিলে ভালবাসা পাওয়া যায় না, তেমনি নিজে মানুষ হলে মানুষ তৈরিও করা যায় না। “রাজনীতির স্রোত ক্রমশ যেরূপ পঙ্কিল হইয়া আসিতেছে তাহাতে মনে হয় যে, অন্তত কিছুকালের জন্য রাজনীতির ভিতর দিয়া দেশের কোনও বিশেষ উপকার হইবে না। সত্য ও ত্যাগ—এই দুটি আদর্শ রাজনীতির ক্ষেত্রে যতই লোপ পাইতে থাকে, রাজনীতির কার্যকারিতা ততই হ্রাস পাইতে থাকে।” আর একটি চিঠিতে সুভাষচন্দ্র লেখেন যে, রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে সংযম ও শৃঙ্খলার অভাবের জন্যে দায়ী কর্মীরা নয়, নেতারা। সবাই ‘স্ব স্ব প্রধান’ হয়ে পড়েছে। তাই কেউ কোনও নেতাকে মানতে চায় না। Sincerity এবং tenacity-র খুব অভাব কর্মীদের মধ্যে। Congress Politics এখন এত unreal হয়ে পড়েছে যে, কোনও খাঁটি লোক ওই কাজে সন্তুষ্ট হতে পারে না। এই অবস্থা দেখে যারা কিছু কাজ করতে চায় তারা বোধহয় কাউন্সিলের সঙ্গে কোনও সংস্রব রাখবে না। “দেশবন্ধুর মৃত্যুর পর অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়েছে। কর্মীদের মধ্যে ‘ব্যবসায়ী ও পাটোয়ারি বুদ্ধি’ জমে উঠেছে। এখন তারা বলছে, আমায় ক্ষমতা দাও—নয়তো আমি কাজ করব না। বাংলার সর্বত্র শুধু ঝগড়া আর দলাদলি। যেখানে কাজকর্ম যত কম, সেখানে ঝগড়া তত বেশি।” সুভাষচন্ত্রের এই সময়ের চিঠিপত্র, ভাষণ পড়লে মনে হবে তিনি যেন বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতির এক বাস্তব ছবি তুলে ধরে নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। জেল থেকে মুক্তিলাভ করে রাজনৈতিক জগতে ফিরে এসে তিনি নিজেও কিন্তু এই রোগ নির্মূল করতে পারেননি। রাজনৈতিক দলাদলি থেকে দূরে থাকা তাঁর পক্ষেও সম্ভব হয়নি। রাজনীতিতে এই সমস্যা চিরকালীন। যত বড় মাপেরই হোন না কেন, সব রাষ্ট্রনেতারই এই অভিজ্ঞতা হয়েছে। সুভাষচন্দ্রের দিক থেকে আন্তরিক প্রচেষ্টার কোনও ত্রুটি ছিল না। ১৯২৭ সালে শিলং থেকে এক গভীর আবেগপূর্ণ আবেদনে তিনি শুধুমাত্র কংগ্রেসের ভেতরে যে দুঃখজনক বিরোধ, অনৈক্য চলছিল তার অবসানের জন্যেই নয়, যাঁরা কংগ্রেস ছেড়ে চলে গেছেন তাঁদেরও ফিরে আসার জন্যে অনুরোধ জানান। অনুরূপ আবেদন তিনি বহুবার করেছিলেন। কিন্তু ১৯২৫ থেকে ১৯২৮ সাল পর্যন্ত নানান কারণে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও পরিবেশ ঐক্যবদ্ধ ফলপ্রসূ আন্দোলনের অনুকূল ছিল না। পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে নতুন প্রাণচাঞ্চল্য ও উদ্যম এলেও অন্তর্বিরোধ, মনান্তর ও গোষ্ঠীতন্ত্রের অবসান হয়নি।
অসহযোগ আন্দোলনের ব্যর্থতার পর থেকেই সাম্প্রদায়িক সমস্যাটি মাথা চাড়া দিচ্ছিল। হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের শুধু অবনতিই নয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়ছিল। উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও অনাস্থার মনোভাব প্রকট হয়ে উঠছিল। স্বাধীনতা সংগ্রাম, দেশের ঐক্য, সংহতি ও ভবিষ্যতের পক্ষে এর পরিণতির চিন্তা গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে পড়েছিল। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন হিন্দু-মুসলমান ঐক্য ও সম্প্রীতি, পারস্পরিক বিশ্বাসের সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দিতেন। সংখ্যালঘুদের জাতীয় আন্দোলনের অন্তর্ভুক্ত করা তাঁর প্রধান লক্ষ্য ছিল। মুসলমান সম্প্রদায়ের অভাব, অভিযোগ ও তাদের প্রতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে অন্যায় বৈষম্যমূলক আচরণের ক্ষোভ দূর করতে না পারলে মুসলমানদের জাতীয় আন্দোলনের মূল স্রোতে আনা সম্ভব হবে না বলে তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। এই লক্ষ্য নিয়ে ১৯২৩ সালে তিনি বাংলার মুসলমান নেতাদের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছিলেন। এই চুক্তি ‘দি বেঙ্গল প্যাক্ট’ নামে পরিচিত হয়। চুক্তিতে স্থির হয় যে, স্বরাজ্য দল ক্ষমতাসীন হলে সমস্ত সরকারি চাকরির ৬০% মুসলমান প্রার্থীদের দেওয়া হবে। যতদিন না মুসলমানরা দেশের জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে সরকারি চাকরি পাচ্ছে ততদিন এই নীতি চালু থাকবে। অন্যান্য ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নানা সমস্যাও এই চুক্তিতে বিবেচিত হয়েছিল। কিন্তু চাকরির ক্ষেত্রে মুসলমানদের জন্যে সংরক্ষণের প্রশ্নটিই প্রধান ও বিতর্কিত হয়ে ওঠে। প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও দেশবন্ধু বাংলা, কংগ্রেসের সিরাজগঞ্জ সম্মেলনে এই চুক্তিটি অনুমোদন করিয়ে নিতে পেরেছিলেন। কিন্তু জাতীয় কংগ্রেসের কোকনদ অধিবেশনে (ডিসেম্বর, ১৯২৩) চুক্তিটি অনুমোদিত হয়নি। অনেকের কাছে মনে হয়েছিল সাম্প্রদায়িক দাবির প্রতি দেশবন্ধু তোষোমোদমূলক না হলেও আপসমূলক নীতি গ্রহণ করেছেন। তাঁর ওই সিদ্ধান্তের মূলে রয়েছে স্বরাজ্য দলের রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি। অনেকে তা মনে না করলেও ওই চুক্তি সামগ্রিকভাবে ক্ষতিকর, এতে হিন্দু-মুসলমান সমস্যার কোনও স্থায়ী সমাধান হবে না বলে মনে করেছিলেন। বাংলাদেশে দেশবন্ধুর এমন এক উজ্জ্বল ভাবমূর্তি ছিল, তাঁর প্রতি সকলের, এমনকি তাঁর বিরোধীদেরও, এত গভীর শ্রদ্ধা ছিল যে সিরাজগঞ্জে ওই চুক্তি অনুমোদন করিয়ে নিতে পেরেছিলেন। কিন্তু সর্বভারতীয় চিত্র তা ছিল না। তাঁর একক প্রভাবে কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে এ সাফল্য সম্ভব হয়নি। ইতিমধ্যেই কংগ্রেসের বিরুদ্ধে এক প্রভাবশালী হিন্দু জনমত গড়ে উঠেছিল। তাঁরা অভিযোগ করছিলেন, হিন্দু স্বার্থ রক্ষা করতে কংগ্রেস ব্যর্থ হচ্ছে। সাম্প্রদায়িক দাবির যথাযথ প্রতিরোধ করতে পারছে না।
‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ সম্পর্কে আপত্তি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ছিল না। শুধুমাত্র চাকরির সংরক্ষণ ব্যবস্থা করে দীর্ঘদিনের জটিল আর্থ-সামাজিক ও ধর্মীয় সমস্যাব প্রকৃত স্থায়ী সমাধান যে সম্ভব নয় তা ভারতবর্ষের পরবর্তী কয়েক দশকের ঘটনাপ্রবাহে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন যেভাবে সাম্প্রদায়িকতা দূর করে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি ও ঐক্যের জন্যে উদ্গ্রীব হয়েছিলেন তা অতুলনীয়। মনুষটি প্রকৃতই সকল ক্ষুদ্রতা, সাম্প্রদায়িকতা ও সন্দেহ-বিদ্বেষের ঊর্ধ্বে ছিলেন। জাতীয় ঐক্যের জন্যে সংখ্যাগরিষ্ঠদের অধিকতর ঔদার্য দেখাতে হবে, সহনশীল হতে হবে এই নীতি তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু বাস্তব রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাঁর পরিকল্পনার সার্থক রূপায়ণের পক্ষে অনুকূল ছিল না।
সাম্প্রদায়িকতা সম্পূর্ণ নির্মূল করে হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ় করার প্রশ্নে সুভাষচন্দ্র সর্বতোভাবে দেশবন্ধুর অনুগামী ছিলেন। তাঁর সবচেয়ে বেশি প্রত্যাশা ছিল বাংলার তরুণদের কাছে। নিখিলবঙ্গ যুব সম্মিলনীর অধিবেশনের ভাষণে তিনি এই কথাটির ওপর বিশেষ জোর দিয়েছিলেন। তাঁর কথা ও কাজের মধ্যে কোনও পার্থক্য ছিল না। কর্পোরেশনের দায়িত্বশীল পদে বসেই তিনি ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’-এ গৃহীত নীতি কার্যকর করতে উদ্যোগী হন। ফলে, বেশ কিছু কাউন্সিলার খুবই ক্ষুব্ধ হন। তাঁদের অভিযোগের উত্তরে সুভাষচন্দ্র জানান যে, এক সপ্তাহের মধ্যে ৩৩টি পদে ২৫ জন মুসলমান প্রার্থী নিযুক্ত হয়েছেন। আবেদনকারীর সংখ্যা ছিল ১০০০-এর বেশি। তাঁদের মধ্যে কিছু বি এ, এম এ পাসও ছিলেন। কিন্তু শুধুমাত্র শিক্ষাগত যোগ্যতা দেখে কোনও প্রার্থীকে বিচার করা যায় না। কর্পোরেশনের স্বার্থের পক্ষে ক্ষতিকর কোনও নিয়োগ করা হয়নি। সুভাষচন্দ্র বলেন, তিনি মুসলমানদের যে দাবি ন্যায্য বলে মনে করেন তা মনে রেখেই কাজ করেছেন। ভবিষ্যতেও তাই করবেন। নিজের সিদ্ধান্তের সব দায়িত্ব নিয়ে তিনি আরও বলেন যে, শিক্ষাগত যোগ্যতা ছাড়াও, প্রার্থীদের চরিত্র, উৎসাহ, আন্তরিকতা ও সততাও বিচার্য হওয়া উচিত। উচ্চপদে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রার্থীর বিদ্যাবুদ্ধির প্রশ্নের কথা স্বতন্ত্র। কিন্তু সাধারণ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে চিন্তার কোনও কারণ নেই। যদি সব পদেই মুসলমান, খ্রিস্টান, অনুন্নত শ্রেণীর প্রার্থীরা নিযুক্ত হন তাহলেও নয়। যাঁদের নিয়োগ করা হয়েছে তাঁদের যদি ওই পদের অযোগ্য মনে হয়, তাহলে তিনি তাঁদের বরখাস্ত করতেও ইতস্তত করবেন না। হিন্দুরা অতীতে চাকরির ব্যাপারে প্রায় একচেটিয়া সুযোগ পেয়েছে। এখন এক নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। কর্পোরেশনে সেই যুগোপযোগী হতে হবে।
সুভাষচন্দ্রের ওই বলিষ্ঠ নির্ভীক সিদ্ধান্তকে দেশবন্ধু তো বটেই, গান্ধীজিও স্বাগত জানিয়েছিলেন। ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’তে তিনি লেখেন (৩১ জুলাই, ১৯২৪), “সুভাষের সিদ্ধান্ত খুবই প্রশংসনীয়, পক্ষপাতশূন্য। হিন্দুরা যদি সত্যিই ভারতকে স্বাধীন দেখতে চায় তাহলে তাদের মুসলমান এবং অন্যান্যদের জন্যে ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকতে হবে।” সুভাষচন্দ্রের সিদ্ধান্ত ও বক্তব্যের উচ্চ আদর্শ ও লক্ষ্য ছিল প্রশ্নাতীত। কিন্তু তিনি সমস্যাটির সরলীকরণ করেছিলেন, একাধারে মুসলমানদের আস্থা, স্বরাজ্য দলের প্রতি সমর্থন লাভ ও সাম্প্রদায়িক মনোভাব দূর করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু চাকরি সংরক্ষণের প্রশ্নটি খুবই জটিল ও স্পর্শকাতর ছিল। তা ছাড়া, একবার সরকারি বা আধা-সরকারি সংস্থায় নিযুক্ত করে তারপর অযোগ্যতার অভিযোগে বরখাস্ত করা যে কত কঠিন হতে পারে সে বিষয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা ছিল না। বিশেষ করে যদি নিযুক্তির পিছনে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রশ্নটি বিশেষ বিচার্য হয় তাহলে সেইরকম কোনও প্রার্থীকে বরখাস্তের প্রশ্নে কত গভীর সমস্যা দেখা দিতে পারে সেটা বিশেষ চিন্তার কারণ ছিল। সাম্প্রদায়িক সমস্যার শিকড়টি এত গভীরে ছিল যে তার তাৎক্ষণিক সমাধান সহজলভ্য ছিল না।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন