দেশনায়ক – ২৯

সুভাষচন্দ্রের সংশোধনী প্রস্তাব অগ্রাহ্য করলেও গান্ধীজি দেশের আবহাওয়া বুঝতে ভুল করেননি। প্রত্যক্ষ সংগ্রামে বিশ্বাসীদের সাংগঠনিক ও প্রবল ইচ্ছাশক্তিকে উপেক্ষা করা আর সম্ভব নয়। একমাত্র বিকল্প, এক অহিংস আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করা। ১৯২৯ সালের মধ্যরাত্রে কংগ্রেস সভাপতি জওহরলাল নেহরু ভারতবর্ষের ত্রি-রঙ্গা জাতীয় পতাকা উত্তোলন করলেন। শুরু হল, সুভাষচন্দ্রের ভাষায় ‘ঝটিকাক্ষুব্ধ ১৯৩০’। স্থির হল আগামী ২৬ জানুয়ারি সারা দেশে স্বাধীনতা দিবস রূপে পালিত হবে। গান্ধীজি রচিত নির্দেশ গেল সব কংগ্রেস কর্মীদের কাছে—ওই দিনটিতে স্বাধীনতার ঘোষণা এবং ভারতের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি আনুগত্যের শপথ নিতে হবে প্রত্যেককে। ব্রিটিশ শাসনের ফলে সবদিক থেকে দেশের যে অবক্ষয় ও বিপর্যয় ঘটেছে তা আর মেনে চলা “ঈশ্বর ও মানুষের বিরুদ্ধে অপরাধ”। সম্পূর্ণ অহিংস নীতিতে বিশ্বাস রেখে এই আন্দোলন করতে হবে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হল সুভাষচন্দ্রের প্রস্তাবিত মত ও পথই তিনি কার্যত মেনে নিচ্ছেন। কিন্তু তা যে নয় সেটি তিনি বুঝিয়ে দিলেন তাঁর রক্ষণশীল বিত্তশালী সমর্থকদের, যাঁরা পূর্ণ স্বাধীনতা বলতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ আশঙ্কা করে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। গান্ধীজি ব্যাখ্যা করলেন যে, স্বাধীনতার যা মর্ম তাতেই তিনি সন্তুষ্ট হবেন। ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’র অর্থ দাঁড়াল গান্ধীজির ভাষায় ‘পূর্ণ স্বরাজ’ বা ‘স্বাধীনতার মর্ম’ (substance of independence)। ভারতীয় পুঁজিপতিদের ও তাঁর অন্য সব রক্ষণশীল (দক্ষিণপন্থী) অনুগামীদের আশ্বস্ত করার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি ইংরাজ সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পথ খোলা রাখলেন। স্বাধীনতার মর্ম বলে তিনি যে ‘এগার দফা দাবি’র কথা তুললেন সেগুলি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ হলেও তার কোনওটিতে পূর্ণ স্বাধীনতার কথা ছিল না। এ সত্ত্বেও নতুন বছর শুরু হল প্রবল প্রত্যাশা, উত্তেজনা এবং অধীর আগ্রহের মধ্য দিয়ে। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি আসন্ন আইন অমান্য আন্দোলনের কর্মসূচী নির্ধারণ ও নেতৃত্বের সম্পূর্ণ দায়িত্ব দিলেন গান্ধীজির ওপর।

১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি ‘পূর্ণ স্বরাজ’ বা ‘স্বাধীনতা দিবস’ রূপে উদ্‌যাপিত হয়। ওই দিন লক্ষ লক্ষ স্বদেশপ্রেমিক ভারতবাসী স্বাধীনতার শপথ গ্রহণ করে। ‘শপথ’ বা প্রতিজ্ঞাপত্রে স্বাধীনতাকে ভারতবাসীর অবিচ্ছেদ্য অধিকার (inalienable right) রূপে ঘোষণা করা হয়। আসন্ন সংগ্রামের জন্যে উন্মাদনা ও রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা নিয়ে সারা দেশ অপেক্ষা করে রইল গান্ধীজির সিদ্ধান্ত ও নির্দেশের।

কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি থেকে গান্ধী-বিরোধী বলে চিহ্নিত সব নেতাদের বিশেষ করে শ্রীনিবাস আয়েঙ্গার ও তাঁকে বাদ দেওয়ায় সুভাষচন্দ্র খুবই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি খোলাখুলি বলেন, ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য নির্বাচনে প্রচলিত প্রথা ভঙ্গ করা হয়েছে। কংগ্রেস সভাপতি জওহরলাল সঠিকভাবে তাঁর দায়িত্ব পালন করেননি। প্রথম থেকেই তিনি তাঁদের প্রতি ‘যথেচ্ছ ব্যবহার করেছেন’। অধিবেশনে গান্ধীজিকে দিয়ে নতুন ওয়ার্কিং কমিটির প্রস্তাবিত নামের তালিকা পেশ করিয়ে অন্যায়ভাবে তাঁর প্রভাবের সুযোগ নেওয়া হয়েছিল। জওহরলাল একটি বিবৃতিতে বলেছিলেন যে, সুভাষচন্দ্র ও তাঁর সমর্থকরা তাঁর (জওহরলালের) রুলিং-এর অপেক্ষা না করেই সভা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। জওহরলালের এই বক্তব্যের তিনি তীব্র প্রতিবাদ করে বলেন যে, এই অভিযোগ ঠিক নয়। সুভাষচন্দ্র কিছুটা ক্ষোভ ও তিক্ততার সঙ্গে ওই প্রসঙ্গে বলেন, “যখন আমরা দেখলাম যে ওয়ার্কিং কমিটি বা নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি থেকে ন্যায় বিচার পাওয়ার কোনও আশা নেই, তখন আমাদের বেরিয়ে হয়ে আসা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না।” লাহোর কংগ্রেসের ওই ঘটনার পর স্বভাবতই আশঙ্কা হয়েছিল যে, গান্ধীপন্থী ও সুভাষপন্থীদের মতভেদ জাতীয় আন্দোলনের ঐক্য বিঘ্নিত করবে। সুভাষচন্দ্র ও তাঁর সহযোগীরা একটি পৃথক দল গঠন করবেন। কিন্তু ওই আশঙ্কা অমূলক ছিল। সুভাষচন্দ্র সুস্পষ্টভাবে জানান, “মতভেদ হয়েছে সত্য, কিন্তু সেই মতভেদ কার্যক্ষেত্রে নয়।” গান্ধীজির প্রস্তাবের প্রতিবাদ করলেও স্বাধীনতার জন্যে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। সেখানে দলাদলির স্থান নেই।

গান্ধীজি তখনও কোথায়, কীভাবে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করবেন সে বিষয়ে মনস্থির করেননি। সুভাষচন্দ্র কিন্তু তখনই বাংলা দেশে আইন অমান্যের কর্মসূচী সম্বন্ধে প্রস্তাব করেন। এর অন্যতম ছিল পূর্ববঙ্গে যশোহর জেলার বন্দবিলাতে ইউনিয়ন বোর্ড স্থাপনের চেষ্টার বিরুদ্ধে গত ছ’মাস ধরে যে আইন অমান্য আন্দোলন চলছিল তাকে সক্রিয়ভাবে প্রদেশ কংগ্রেসের সমর্থন করা। এক সাধারণ কংগ্রেস কর্মী বিজয়চন্দ্র রায় ইউনিয়ন বোর্ড গড়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এই বিরোধিতার অনেকগুলি কারণের মধ্যে প্রধান ছিল সাধারণ দরিদ্র গ্রামবাসীর ওপর করের বোঝা চাপাননা। সুভাষচন্দ্র নিজে ইতিপূর্বেই বন্দবিলায় গিয়ে তদন্ত করে বুঝেছিলেন যে ওই সংগ্রাম ন্যায়সঙ্গত। তিনি সারা দেশের মানুষকে অর্থ ও কর্মী পাঠিয়ে বন্দবিলার আইন অমান্য আন্দোলনকে সমর্থন জানাতে আবেদন করেন। তিনি বলেন, মেদিনীপুরে ইতিপূর্বেই অনুরূপ আন্দোলন সফল হয়েছে। এখন বন্দবিলার গ্রামবাসীর নির্ভীক দৃষ্টান্ত অন্যান্য জেলায় অনুসৃত হোক। গ্রামে গ্রামে স্বাধীনতার আন্দোলন জোরদার করতে তিনি আরও কিছু কর্মসূচী প্রস্তাব করেন। যেমন, প্রতিটি গ্রামের কংগ্রেস কমিটি একটি করে জাতীয় সেনাবাহিনী গঠন করবে। এই বাহিনীর কাজ হবে পুলিশ ও চৌকিদারদের ওপর গ্রামবাসীকে যেন নির্ভর না করতে হয়; আদালতে না গিয়ে গ্রামের বিরোধ কংগ্রেস কমিটির মাধ্যমে সালিসীর দ্বারা মীমাংসা করা; ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের আন্দোলন অব্যাহত রাখার সঙ্গে সঙ্গে স্বদেশী শিল্পদ্যোগ এবং গ্রামীণ অর্থনীতির আত্মনির্ভরশীলতাকে সাহায্য করা। আর একটি কর্মসূচী গ্রহণের জন্যে তিনি হাওড়ার ক্ষীরেরতলা ময়দানে এক জনসভায় (১১ জানুয়ারি ১৯৩০) আবেদন জানান। সেটি ছিল: “গভর্নমেন্ট যদি কোনও বাড়িতে লবণ তৈরি করতে না দেয়, তা আইন অমান্য করবার একটা ভাল সুযোগ করে দেবে।” তিনি বলেন, “বাড়িতে লবণ তৈরির যে নিষেধাত্মক আইন এদেশে প্রচলিত আছে, পৃথিবীর কোথাও তার তুলনা নেই। যত শীঘ্র সম্ভব এর বিলোপ-সাধন করবার অধিকার প্রত্যেকের আছে।”

গান্ধীজি ঐতিহাসিক আইন অমান্য আন্দোলন (লবণ আইন অমান্য আন্দোলন নামেও খ্যাত) শুরু করার ঘোষণার (২ মার্চ, ১৯৩০) প্রায় দু’ মাস আগে সুভাষচন্দ্র লবণ আইন ভঙ্গের গুরুত্বের কথা বলেছিলেন। লবণ আইনের বিরুদ্ধে ইতিপূর্বে কোনও কথা বলা হয়নি তা নয়, কিন্তু সুভাষচন্দ্রের মতো এত স্পষ্টভাবে এই আন্দোলনের রাজনৈতিক তাৎপর্যের সম্ভাবনার কথা কেউ বলেননি। বিস্ময় ও দুঃখের কারণ হল, অসহযোগ আন্দোলন বা স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের বৃহদায়তন গ্রন্থগুলিতেও সুভাষচন্দ্রের এই চিন্তাধারা ও কর্মসূচীর প্রায় কোনও উল্লেখই নেই। আর একটি কথা এই প্রসঙ্গে স্মরণ রাখা প্রয়োজন। সুভাষচন্দ্রও গান্ধীজির সিদ্ধান্তের জন্যে সাগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। কোনও বিকল্প কর্মসূচী বা পরোক্ষভাবেও গান্ধীজির নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করা তাঁর চিন্তায় ছিল না। যেখানে পরিস্থিতি অনুকূল সেখানেই আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করার কর্মসূচী কংগ্রেস অধিবেশনেই গৃহীত হয়েছিল। সুভাষচন্দ্রের অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত প্রস্তাব ছিল, যেখানে এই আন্দোলন ইতিপূর্বেই শুরু হয়ে গেছে সেখানে কালক্ষেপ না করে সর্বতোভাবে সাহায্য করা উচিত। দু’ মাস পরে গান্ধীজি যখন তাঁর কর্মসূচী ঘোষণা করেন তখন সুভাষচন্দ্র তাকে উচ্ছ্বসিত ভাবে স্বাগত জানিয়েছিলেন। সেই প্রসঙ্গে পরে আসব।

ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সরকারের পক্ষে ক্রমেই উদ্বেগজনক হয়ে উঠছিল। তৎকালীন কংগ্রেস নেতারা সুভাষচন্দ্রের জনপ্রিয়তা, কর্মক্ষমতা এবং প্রভাব সম্পর্কে যাই মূল্যায়ন করুন না কেন, বাংলার প্রশাসন এবং পুলিশ কর্তৃপক্ষ বুঝেছিল যে, সুভাষচন্দ্রকে কারারুদ্ধ করা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। ১৯২৯ সালের আগস্ট মাসে বে-আইনী সমাবেশ ও দেশদ্রোহের (sedition) অভিযোগে সুভাষচন্দ্র ও আরও কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এই মামলা চলাকালেই সুভাষচন্দ্রের আশঙ্কা ছিল, যে কোনও সময় তাঁর কারাদণ্ড হতে পারে। তিনি এর জন্যে মানসিক ভাবে প্রস্তুত ছিলেন। ওই মামলার রায় বেরল ২৩ জানুয়ারি, ১৯২০। সুভাষচন্দ্র ও আরও কয়েকজনের এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হল। জন্মদিনের একটি চমৎকার ‘উপহার’ তিনি সরকারের কাছ থেকে পেলেন! ‘মহামান্য’ ভারতীয় বিচারপতি তাঁর রায়ে বললেন, “এরকম উঁচু সংস্কৃতিবান্ (highly cultured) ব্যক্তিরা এই আইনের এক্তিয়ারে পড়েছেন তা খুব দুঃখজনক। কিন্তু যেহেতু তাঁরা দেশের সরকারের সম্পর্কে বিদ্বেষ ও শত্রুতার মনোভাব সৃষ্টি করছেন, তাঁদের এক বছরের কারাদণ্ড হল যোগ্য শাস্তি।” কারারুদ্ধ হবার পূর্বেই সুভাষচন্দ্র জনসাধারণকে আহ্বান জানান সর্বতোভাবে কংগ্রেসের পিছনে দাঁড়াতে। শ্রমিকদের প্রতি তিনি ‘জাতীয় ইতিহাসের এক বিঘ্নসঙ্কুল’ সময়ে ইউনিয়নের মধ্যে দলাদলি ভুলে সঙ্ঘবদ্ধ হতে অনুরোধ জানান। কলকাতা কর্পোরেশনের কাউন্সিলার রূপেও তিনি পদত্যাগ করেন। অনেক বিশিষ্টজনের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে তিনি বলেন, এক বছর কারাবাসের সময় তাঁর পক্ষে কর্পোরেশনের কোনও কাজে সহায়তা করা সম্ভব হবে না। সুতরাং পদত্যাগ না করলে নির্বাচকমণ্ডলীর প্রতি অবিচার করা হবে। সুভাষচন্দ্রের কারাদণ্ডের সংবাদ পেয়ে গান্ধীজি এক বার্তা পাঠান। সুভাষচন্দ্র ও তাঁর সঙ্গীদের নির্ভীকভাবে দেশসেবার অপরাধে সশ্রম কারাদণ্ড প্রাপ্তির জন্যে তিনি অভিনন্দন জানান। তিনি বলেন, বাংলা বহু দল ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত হতে পারে, কিন্তু বাংলার সাহসিকতা ও আত্মত্যাগ কখনও ক্ষয় হয় না! অভিনন্দনসূচক বার্তায় গান্ধীজি কেন বাংলার দলাদলির উল্লেখ করেছিলেন তা বোধগম্য নয়। আর একটি উল্লেখ প্রাসঙ্গিক হবে। গান্ধীজি যখন কোনও প্রসঙ্গে সুভাষচন্দ্রের উল্লেখ করতেন, তাঁর প্রশংসা বা সমালোচনা করতেন, অধিকাংশ সময়েই সুভাষচন্দ্রকে ‘বাংলার নেতা’ বলে অভিহিত করতেন। এখনও পাশ্চাত্য ঐতিহাসিকদের লেখায় সুভাষচন্দ্রকে ‘বাঙালি’ বা ‘বাংলার নেতা’ বলে উল্লেখ করার প্রবণতা লক্ষণীয়। তিরিশের দশকের সূচনাতেই কিন্তু সুভাষচন্দ্র সর্বভারতীয় নেতার স্বীকৃতি অর্জন করেছিলেন। গান্ধীজি ওই স্বীকৃতি দিতে কার্পণ্য করছিলেন কি না এই প্রশ্ন উঠতেই পারে।

১৯৩০ সালের ২ মার্চ গান্ধীজি ভাইসরয় আরউইনকে এক পত্র মারফৎ জানালেন যে, লবণ উৎপাদনের ওপর যে সরকারি নিষেধাজ্ঞা আছে তা প্রত্যাহৃত না হলে তিনি গুজরাটের সমুদ্রতীরের ডাণ্ডি নামে একটি ছোট গ্রামে লবণ আইন অমান্য করবেন। আরউইন গান্ধীজির প্রস্তাব অগ্রাহ্য এবং তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে অসম্মত হলে আসন্ন সংঘর্ষের মীমাংসার আশা দূর হয়। ১২ মার্চ (১৯৩০) গান্ধীজি ডান্ডি অভিমুখে তাঁর ঐতিহাসিক পদযাত্রা শুরু করেন। সবরমতী আশ্রম থেকে ডাণ্ডির দূরত্ব প্রায় দু’শ মাইল। এই দীর্ঘপথ প্রায় পঁচিশ দিন ধরে যখন গান্ধীজি ও তাঁর শত শত অনুগামী সত্যাগ্রহীরা ধীরে ধীরে অতিক্রম করেন সেই সময় দেশে অভূতপূর্ব চাঞ্চল্য ও উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এরকম দৃশ্য এর আগে দেশবাসী কখনও প্রত্যক্ষ করেনি। ৬ এপ্রিল গান্ধীজি ডাণ্ডিতে লবণ আইন ভঙ্গ করলে সারা দেশ জুড়ে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হয়। বিদেশী দ্রব্য বর্জন, করদান বন্ধ করা, ধর্মঘট, গণ-বিক্ষোভ প্রভৃতি আন্দোলনের কর্মসূচীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। উত্তরপ্রদেশে করদান বন্ধের আন্দোলন বিশেষ সাফল্য লাভ করে। হাজার হাজার নারী আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দেন। ইতিপূর্বে কোনও আন্দোলনে এত বেশি সংখ্যায় মেয়েরা যোগ দেননি। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে আইন অমান্য আন্দোলন গণ-সমর্থন লাভ করে। এর মূলে ছিলেন খান আবদুল গফ্ফর খান। গান্ধীজি-প্রদর্শিত পথ ও অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী এই মহান নেতা ‘সীমান্ত গান্ধী’ (Frontier Gandhi) রূপে খ্যাত হয়ে সমগ্র দেশের শ্রদ্ধা অর্জন করেন। তিনি খোদা-ই-খিদমৎগার (ঈশ্বরের সেবক) নামে এক স্বাধীনতা সংগ্রামী দল গঠন করেন। এই বাহিনীর সদস্যরা সীমান্ত অঞ্চলের প্রাচীন লাল রঙের কুর্তা পরত বলে সংগঠনটি ‘লাল কুর্তা’ (Red Shirts) নামে পরিচিত হয়। ১৯৩১ সালে এই দলটি আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় কংগ্রেসের অন্তর্ভুক্ত হয়।

আইন অমান্য আন্দোলন যখন শুরু হল সুভাষচন্দ্র তখন কারাগারে। তাঁর মানসিক অবস্থা তখন পিঞ্জরাবদ্ধ সিংহের মতো। আইন অমান্য আন্দোলন ও তার কর্মসূচীকে তিনি গান্ধীজির নেতৃত্বের “শ্রেষ্ঠতম কীর্তি হিসেবে চিরকাল গণ্য হবে” বলে অভিনন্দিত করেছেন। সুভাষচন্দ্র মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেন যে, গান্ধীজির কর্মসূচী থেকে এই সত্যই প্রতীয়মান হয়েছিল, “সঙ্কটমুহূর্তে তিনি কী রকম উচ্চস্তরের রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে পারেন।” গান্ধীজির আবেদন দেশে ‘জাদুর মতো’ কাজ করেছিল। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে গোঁড়া ও অভিজাত পরিবারের মেয়েরাও আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। হাজার হাজার মেয়েরা কংগ্রেসের নির্দেশ পালন করতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন। গান্ধীজির অবদানের এই অকুণ্ঠ স্বীকৃতি জানাবার সময় সুভাষচন্দ্র নিজের ভূমিকা সম্বন্ধে একটি কথাও বলেননি। স্বাধীনতা সংগ্রামে দলে দলে সাধারণ ও মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের আকৃষ্ট করার মূলে তাঁর অবদানও কম ছিল না। কলকাতা কংগ্রেসেই তা দেখা গিয়েছিল। লবণ আইন অমান্যের কথাও তিনি দু’ মাস আগেই বলেছিলেন, যদিও যেভাবে এই কর্মসূচীকে রূপায়িত করার কথা ভেবেছিলেন তার তুলনা নেই। কিন্তু নিজের কৃতিত্বের সামান্যতম উল্লেখ না করে তিনি সব কিছুর কৃতিত্ব দিয়েছিলেন গান্ধীজিকে। সুভাষচন্দ্রের এই আত্মপ্রচার বিমুখতা ও রাজনৈতিক বিরোধীদের অবদান স্বীকৃতিতে উদার মনোভাব তাঁর ‘The Indian Struggle’ গ্রন্থের বিদেশী সমলোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।

আইন অমান্য আন্দোলনের ব্যাপ্তি ও গণ-সমর্থন ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে উদ্বিগ্ন করে তোলে। অভূতপূর্ব নির্যাতন, দমনমূলক নীতি, হাজার হাজার সত্যাগ্রহীকে বন্দী করেও স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মনোবল ভাঙ্গা সম্ভব হয়নি। ৫ মে গান্ধীজিকে বন্দী করেও নয়! এরই সঙ্গে বিপ্লবীদের তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন (১৮ এপ্রিল, ১৯৩০), বিনয়-বাদল-দীনেশের রাইটার্স আক্রমণ প্রভৃতি ঘটনা পরিস্থিতিকে আরও সঙ্কটজনক করে তোলে। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ উপলব্ধি করেন, শুধুমাত্র নিপীড়ন ও দমনমূলক ব্যবস্থা ফলপ্রসূ হবে না। চৌরিচৌরার ঘটনার পরে গান্ধীজি অসহযোগ আন্দোলন বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এর জন্যে তাঁর প্রচুর সমালোচনা হয়েছিল। গান্ধীজি তা বিস্মৃত হননি। তাই এবার আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করবার পূর্বেই তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আশ্বস্ত করে ঘোষণা করেছিলেন যে, হিংসাত্মক শক্তিগুলিকে সংযত রাখার জন্যে সবরকম চেষ্টা করা হবে। কিন্তু একবার আন্দোলন শুরু হলে একজন আইন অমান্যকারী সুস্থ ও জীবিত থাকতে এই আন্দোলন আর বন্ধ হবে না। সরকার উপলব্ধি করেছিলেন, আইন অমান্য আন্দোলনকে তথা স্বাধীনতা আন্দোলনকে ব্যর্থ করতে কূট কৌশলের চিন্তাও জরুরি হয়ে পড়েছে।

১৯৩০ সালের ৭ জুন সাইমন কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। রিপোর্টের সুপারিশগুলি এতই প্রতিক্রিয়াশীল ছিল যে, কোনও ভারতীয় রাজনৈতিক দলের কাছেই তা গ্রহণযোগ্য ছিল না। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সুকৌশলে পুণার যারবেদা জেলে বন্দী গান্ধীজি এবং অন্যান্য কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে মীমাংসার সূত্রের জন্যে কথাবার্তা শুরু করল। কিন্তু ঐকমত্যে পৌঁছনো সম্ভব হল না। তখন ব্রিটিশ সরকার কংগ্রেসের কোনও প্রতিনিধি ছাড়াই লন্ডনে একটি গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করে (১২ নভেম্বর ১৯৩০-১৯ জানুয়ারি ১৯৩১)। দীর্ঘ আলোচনার পর বৈঠকে স্থির হয় যে, ব্রিটিশ-শাসিত অঞ্চল ও ভারতীয় রাজন্যবর্গ-শাসিত (Princely States) রাজ্যগুলির সমন্বয়ে একটি যুক্তরাষ্ট্র (Federal Union) গঠন করা হবে। কিন্তু প্রস্তাবিত ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ সংবিধান সম্বন্ধে কোনও মতৈক্য হয়নি। অনুন্নত সম্প্রদায়ের নেতা ডঃ বি. আর. আমবেদকার এবং মুসলিম লীগের নেতা মহম্মদ আলি জিন্না নিজ নিজ সম্প্রদায়ের জন্যে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দাবি করেন। শেষপর্যন্ত এই বৈঠক অনির্দিষ্ট কালের জন্যে মুলতুবি রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী র‍্যামসে ম্যাকডোনাল্ড তার সমাপ্তি ভাষণে ভারতীয় জনগণকে আইন অমান্য আন্দোলন বন্ধ করে শাসনতান্ত্রিক সংস্কার প্রবর্তনে সহযোগিতা করতে অনুরোধ জানান। তাঁরা বুঝেছিলেন, কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে ভারতীয় সমস্যার কোনও সমাধান সম্ভব হবে না।

শুরু হয় পরবর্তী গোলটেবিল বৈঠকে কংগ্রেসকে যোগদানে সম্মত করানোর প্রচেষ্টা। ইতিমধ্যে আইন অমান্য আন্দোলনের গতি কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়েছিল। স্বয়ং গান্ধীজি ও কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠিত নেতারাও পরিস্থিতি বিচার করে নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গির কিছুটা পরিবর্তনের কথা ভাবতে শুরু করেছিলেন। ব্রিটিশ সরকার ও ভাইসরয় আরউইন সুযোগ বুঝে গান্ধীজির সঙ্গে আলাপ-আলোচনার জন্যে উদ্যোগী হন। অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির জন্যে ১৯৩১ সালের জানুয়ারি মাসে গান্ধীজি ও কংগ্রেস নেতাদের মুক্তি দেওয়া হয়। এর পরিণতি রূপে গান্ধীজির সঙ্গে ভাইসরয় আরউইনের মধ্যে মুখখামুখি বৈঠক ও আলাপ-আলোচনা হয় এবং ১৯৩১ সালের ৫ মার্চ গান্ধী-আরউইন চুক্তি (Gandhi-Irwin Pact) স্বাক্ষরিত হয়। স্থির হয়, কংগ্রেস আইন অমান্য আন্দোলন প্রত্যাহার করবে এবং দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দেবে। বৈঠকে সৌহার্দ্যপূর্ণ আলোচনার স্বার্থে ব্রিটিশ দ্রব্য বর্জন কার্যসূচী স্থগিত রাখা হবে। ব্রিটিশ সরকার অর্থনীতি ও শিল্পের উন্নয়নে ভারতীয় শিল্পদ্যোগে উৎসাহদান করবে। করাচিতে কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে (মার্চ, ১৯৩১) গান্ধী-আরউইন চুক্তি অনুমোদিত হয়। কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ, ব্রিটিশ রাজনৈতিক ভাষ্যকাররা ও সরকারি মহল গান্ধী-আরউইন চুক্তিকে উচ্ছ্বসিতভাবে স্বাগত জানান। এই চুক্তিকে কংগ্রেসের এক বিরাট সাফল্য রূপে প্রচার করা হয়। এই প্রথম একজন ভাইসরয় সব আড়ম্বর, পদমর্যাদার আত্মম্ভরিতা বর্জন করে সমানে-সমান মনোভাব নিয়ে এক ভারতীয় নেতার সঙ্গে মুখোমুখি আলোচনায় বসেছেন, এটাকে একটা বিরাট ঘটনা রূপে দেখানো হয়। পরবর্তীকালের ও আধুনিক অনেক ঐতিহাসিকও ওই ঘটনা প্রবাহকে মূলত এই দৃষ্টিতেই দেখেছেন। কিন্তু সুভাষচন্দ্র ও শত শত স্বাধীনতা সংগ্রামী আইন অমান্য আন্দোলনের এই পরিণতি ও গান্ধীজির আপস নীতিতে কতখানি ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন তা যথাযথভাবে উপস্থাপন এবং বিশ্লেষণ করা হয়নি।

সকল অধ্যায়

১. দেশনায়ক – ১
২. দেশনায়ক – ২
৩. দেশনায়ক – ৩
৪. দেশনায়ক – ৪
৫. দেশনায়ক – ৫
৬. দেশনায়ক – ৬
৭. দেশনায়ক – ৭
৮. দেশনায়ক – ৮
৯. দেশনায়ক – ৯
১০. দেশনায়ক – ১০
১১. দেশনায়ক – ১১
১২. দেশনায়ক – ১২
১৩. দেশনায়ক – ১৩
১৪. দেশনায়ক – ১৪
১৫. দেশনায়ক – ১৫
১৬. দেশনায়ক – ১৬
১৭. দেশনায়ক – ১৭
১৮. দেশনায়ক – ১৮
১৯. দেশনায়ক – ১৯
২০. দেশনায়ক – ২০
২১. দেশনায়ক – ২১
২২. দেশনায়ক – ২২
২৩. দেশনায়ক – ২৩
২৪. দেশনায়ক – ২৪
২৫. দেশনায়ক – ২৫
২৬. দেশনায়ক – ২৬
২৭. দেশনায়ক – ২৭
২৮. দেশনায়ক – ২৮
২৯. দেশনায়ক – ২৯
৩০. দেশনায়ক – ৩০
৩১. দেশনায়ক – ৩১
৩২. দেশনায়ক – ৩২
৩৩. দেশনায়ক – ৩৩
৩৪. দেশনায়ক – ৩৪
৩৫. দেশনায়ক – ৩৫
৩৬. দেশনায়ক – ৩৬
৩৭. দেশনায়ক – ৩৭
৩৮. দেশনায়ক – ৩৮
৩৯. দেশনায়ক – ৩৯
৪০. দেশনায়ক – ৪০
৪১. দেশনায়ক – ৪১
৪২. দেশনায়ক – ৪২
৪৩. দেশনায়ক – ৪৩
৪৪. দেশনায়ক – ৪৪
৪৫. দেশনায়ক – ৪৫
৪৬. দেশনায়ক – ৪৬
৪৭. দেশনায়ক – ৪৭
৪৮. দেশনায়ক – ৪৮
৪৯. দেশনায়ক – ৪৯
৫০. দেশনায়ক – ৫০

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন