কংগ্রেস সভাপতিত্ব ত্যাগের পর সুভাষচন্দ্র উদ্যোগ নিলেন সব বামপন্থী দল ও বাম মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিদের নিয়ে কংগ্রেসের ভেতরেই একটি দল গঠন করতে। এই উদ্দেশ্য নিয়ে গঠন করলেন ফরওয়ার্ড ব্লক (৩ মে, ১৯৩৯)। সুভাষচন্দ্র হলেন সভাপতি। সহ-সভাপতি শার্দূল সিং কবিশের ও লালা শঙ্কর লাল। সাধারণ সম্পাদক হলেন পণ্ডিত বিশ্বম্ভর দয়াল ত্রিপাঠী, কে. এফ. নরিম্যান ও সত্যরঞ্জন বক্সী। অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন অন্নপূর্ণাইয়া, সেনাপতি বাপাত, এইচ. ভি. কামাথ প্রমুখ। লক্ষণীয় ছিল যে, ফরওয়ার্ড ব্লকের শীর্ষে শুধু বাঙালিরা ছিলেন না। নতুন দল বাংলার ও বাঙালির দল ছিল না। সুভাষচন্দ্রের চিন্তা ও ফরওয়ার্ড ব্লক সংগঠনে সর্বভারতীয় চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গিই প্রতিফলিত হয়েছিল। বাংলার অভিমান বা বাঙালি গর্বের প্রতীক ফরওয়ার্ড ব্লক ছিল না। নতুন দল গঠনের পিছনে সুভাষচন্দ্রের দু’টি প্রধান প্রত্যাশা ছিল। গান্ধীবাদীদের সঙ্গে ভবিষ্যতে মতবিরোধ ও সংঘাত দেখা দিলে ফরওয়ার্ড ব্লকের সংগ্রাম কার্যকর হবে। এ ছাড়া ভবিষ্যতে কোনও বড় সঙ্কটকালে ‘গান্ধী-দল’ যদি সময়োপযোগী তৎপরতা দেখাতে না পারে তাহলে ফরওয়ার্ড ব্লক প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে সক্ষম হবে। বোম্বাইয়ে নিখিল ভারত ফরওয়ার্ড ব্লকের অধিবেশনে (২১ জুন, ১৯৩৯) তিনি তাঁর দলের তিনটি মুখ্য উদ্দেশ্য ব্যক্ত করেন: (১) বামপন্থীদের সংহতি সাধন, (২) বামপন্থী সংহতির মাধ্যমে কংগ্রেসের প্রকৃত ঐক্যসৃষ্টি এবং (৩) কংগ্রেসে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত এবং অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে পূর্ণ স্বরাজের জন্যে আন্দোলন শুরু করা। ফরওয়ার্ড ব্লকে শুধুমাত্র কংগ্রেসের প্রাথমিক সদস্যরাই যোগ দিতে পারবে এবং ফরওয়ার্ড ব্লক কংগ্রেসের বর্তমান সংবিধান এবং কর্মসূচী অপরিবর্তিতভাবে মেনে নেবে। কিন্তু কংগ্রেসের মধ্যে ‘সাংবিধানিকতা’ এবং ‘সংস্কারবাদ’-এর প্রতি যে প্রবণতা দেখা দিয়েছে তা দূর করে জনগণের মধ্যে এক বৈপ্লবিক মনোবৃত্তি জাগিয়ে ভোলার জন্যে ফরওয়ার্ড ব্লক সচেষ্ট হবে। ফরওয়ার্ড ব্লকের লক্ষ্য হবে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করে ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদের জন্যে সংগ্রাম শুরু করা এবং ভারতকে একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করা।
সকল বামপন্থী দলের পক্ষে ফরওয়ার্ড ব্লকে যোগদান করা সম্ভব হবে না জেনে ২১ জুন তিনি একটি বামপন্থী সংহতি কমিটি (Left Co-ordination Committee) গঠন করেন। কমিটির আহ্বায়ক হন সুভাষচন্দ্র। কংগ্রেস সোস্যালিস্ট পার্টির জয়প্রকাশ নারায়ণ, আচার্য নরেন্দ্র দেব, ইউসুফ মেহের আলি, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক পি. সি. যোশী, ভরদ্বাজ ও সোমনাথ লাহিড়ী, কিষাণ সভার স্বামী সহজানন্দ ও এন. জি. রঙ্গ, মানবেন্দ্রনাথ রায়গোষ্ঠীর মানবেন্দ্রনাথ ও কার্নিক, ফরওয়ার্ড ব্লকের সত্যরঞ্জন বক্সী ও বিশ্বম্ভর দয়াল ত্রিপাঠী প্রমুখ এই সমন্বয় কমিটির সদস্য হন। ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ শুরু হয় (৫ আগস্ট, ১৯৩৯)। এই পত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সত্যরঞ্জন বক্সী, গোপাল হালদার, বিনয় ঘোষ ও শ্রীপ্রসাদ উপাধ্যায়। সুধী প্রধান ওই সাপ্তাহিকে লিখেছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টির সোমনাথ লাহিড়ী ও পাঁচুগোপাল ভাদুড়ি সহযোগিতা করতেন। তাঁরা বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সদস্য ছিলেন। ওই সময়ে কমিউনিস্টরা সুভাষচন্দ্রের সমর্থক ছিলেন। একক দল হিসেবে কমিউনিস্ট পার্টির নিজস্ব কোনও শক্তিশালী সংগঠন ও গণ-সমর্থন না থাকায় ওই সময়ে কমিউনিস্টরা কংগ্রেসের ও কংগ্রেস সোস্যালিস্ট পার্টির মধ্যেই প্রচ্ছন্নভাবে কাজ করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর, বিশেষ করে হিটলারের আক্রমণের পর, সোভিয়েত রাশিয়া মিত্রপক্ষে যোগদান করলে কমিউনিস্টদের নীতি সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি উগ্র সুভাষ-বিরোধীতে পরিণত হয়। তাঁর বিরুদ্ধে কোনও কুৎসা রটনা করতে কমিউনিস্টরা বাকি রাখেননি। সোভিয়েত রাশিয়ার প্রতি আনুগত্য ও অন্ধভক্তি কমিউনিস্টদের রাজনৈতিক দৃষ্টি ও বিচারবুদ্ধিকে লুপ্ত করে।
ফরওয়ার্ড ব্লকের ভবিষ্যতের সম্ভাবনা ও সাফল্য সম্বন্ধে সুভাষচন্দ্রের প্রত্যাশা বাস্তবধর্মী ছিল না। তাঁর রাজনৈতিক বিশ্লেষণও নির্ভুল ছিল না। তিনি আশা করেছিলেন গান্ধীপন্থীদের পরিচালিত কংগ্রেস ফরওয়ার্ড ব্লকের নীতি গ্রহণ করবে। বামপন্থীদের সমর্থন ও সংহতির ওপর তিনি খুব ভরসা করেছিলেন। কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের ওপর তাঁর বেশি নির্ভরতা ছিল। কিন্তু ত্রিপুরীর অভিজ্ঞতার পর তাঁর এরকম আশা পোষণ করার কোনও কারণ ছিল না। জয়প্রকাশ নারায়ণ যতই সমাজতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন হন না কেন, তিনি যে একটি নির্দিষ্ট সীমানার বাইরে গান্ধী-বিরোধিতা করবেন না, সুভাষচন্দ্রের প্রতি যতই শুভেচ্ছা ও সহমর্মিতা থাকুক না কেন গান্ধীজির নেতৃত্ববিহীন কোনও জাতীয় আন্দোলন শুরু করা যে অসম্ভব এ বিষয়ে তিনি স্থির নিশ্চিত ছিলেন, এটা সুভাষচন্দ্রের উপলব্ধি না করার কোনও কারণ ছিল না। অন্যান্য বামপন্থী দল ও বামপন্থী মনোভাবাপন্নরা কতটা দুর্বল ও বিচ্ছিন্ন তা তিনি জানতেন। কংগ্রেসের মধ্যে গান্ধীপন্থীদের নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব কতখানি তার পরিচয় তিনি পেয়েছিলেন। গান্ধীজির যতই সমালোচনা হোক না কেন, তাঁর নেতৃত্বের দুর্বল দিকগুলি সম্বন্ধে অসন্তোষ যতই বৃদ্ধি পাক না কেন, তাঁর কোনও বিকল্প ভারতের লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে যে অচিন্তনীয় ছিল তাও উপলব্ধি করা কঠিন ছিল না। সর্বোপরি তিনি আশা করেছিলেন যে, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের নেতৃত্বে স্বরাজ্য দল বিশের দশকে যেভাবে কংগ্রেসের মধ্যে কার্যকর ও সফল হয়েছিল তা ফরওয়ার্ড ব্লকের পক্ষেও সম্ভব হবে। কিন্তু ১৯৩৮-১৯৩৯ সালে পরিস্থিতির ও রাজনৈতিক আবহাওয়ার সম্পূর্ণ পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল। গান্ধীজি ও দেশবন্ধুর মতপার্থক্য এবং বিরোধের সঙ্গে গান্ধীজি ও তাঁর মতভেদ ও বিরোধের চরিত্র ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। গান্ধী-দেশবন্ধু-মতিলাল আর গান্ধী-নেহরু-সুভাষের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ও মনোভাবের স্তর ছিল প্রকৃতিগতভাবে ভিন্ন। এ ছাড়া, ছিলেন গান্ধীভক্ত দক্ষিণপন্থী নেতারা। ‘রাজার থেকে পার্ষদদে’র সহনশীলতার অভাব এবং উগ্রতা ছিল অনেক বেশি। যাঁরা তাঁর পুনর্নির্বাচনের ঘোর বিরোধিতা করেছিলেন, তাঁকে নিষ্ক্রিয় সভাপতি করে শেষপর্যন্ত পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছিলেন, রাজনৈতিকভাবে তাঁকে শেষ করতে চেয়েছিলেন এবং আত্মসমর্পণ ছাড়া অন্য কোনও শর্তেই মিটমাট চাননি, তাঁরাই তাঁকে ও তাঁর দলকে কংগ্রেসের ভিতরে কাজ করতে দেবেন, কংগ্রেসের নীতি ও কর্মসূচী পরিবর্তিত করতে দেবেন, এরকম আশা সুভাষচন্দ্রের মনে এসেছিল এটাই বিস্ময়কর।
সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক ভুলের কয়েকটি ব্যাখ্যা করা সম্ভব। প্রথমত, ত্রিপুরীর অভিজ্ঞতার পরেও কংগ্রেসের মধ্যে ঐক্যস্থাপনের আশা তিনি ত্যাগ করেননি। ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ কংগ্রেসের জরুরি প্রয়োজন তাঁর মনে সর্বাগ্রে ছিল। তিনি আশা করেছিলেন সভাপতি পদে ইস্তফা দেবার পর গান্ধীপন্থীরা অতীতকে পিছনে ফেলে সহযোগিতার হাত বাড়াবেন। দ্বিতীয়ত, নিজের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা, পদত্যাগের পর তাঁর প্রতি সমর্থন ও সহানুভূতির দেশব্যাপী স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ দেখে অভিভূত হয়েছিলেন। তাঁর অসুখের সময় দূর দূরান্তর থেকে সাধারণ মানুষ যেভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল, পরম আত্মীয়ের মতো তাঁর আরোগ্য কামনার জন্যে ব্যাকুল হয়েছিল তা তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাকেও প্রভাবিত করেছিল। ফরওয়ার্ড ব্লকের জন্মের পর কয়েকমাস তিনি সারা ভারত পরিক্রমা করেছিলেন। প্রায় এক হাজার সভায় বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সর্বত্র বিপুল সংবর্ধনা পেয়েছিলেন। প্রতিটি সভায় বিশাল জনসমাবেশ হয়েছিল। এর ফলে তাঁর বিশ্বাস জন্মেছিল যে তিনি যদি গান্ধীজির ইচ্ছার বিরুদ্ধে এবং তাঁকে অমান্য করে কোনও কর্মসূচী গ্রহণ করেন এবং আন্দোলন শুরু করেন তাহলে জনসমর্থন তাঁর পক্ষেই থাকবে। তৃতীয়ত, মনে হয়েছিল জনগণের ওপর ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রচণ্ড প্রভাব পড়েছে, দলের জনপ্রিয়তা দ্রুত বাড়ছে। সুভাষচন্দ্রের পদত্যাগের কয়েক মাস পরে গান্ধীজি মন্তব্য করেছিলেন যে, সুভাষচন্দ্রের জনপ্রিয়তা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। গান্ধীজির ওই মন্তব্য তাঁর বিশ্বাসকে আরও সুদৃঢ় করেছিল। তিনি ফরওয়ার্ড ব্লকের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আরও আশাবাদী হয়ে ওঠেন। গান্ধীজির সঙ্গে যতই মতপার্থক্য ও বিরোধ হয়ে থাকুক না কেন গান্ধীজির কথা ও মন্তব্যের গুরুত্ব তাঁর কাছে হ্রাস পায়নি। ১৯৪০ সালের জুন মাসেও (যার অনেক পূর্বেই তিনি কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন) তিনি গান্ধীজি ও তাঁর প্রধান প্রধান সহচরদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ‘নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ আন্দোলন’ শুরু করার জন্যে ‘আবেগপূর্ণ’ আবেদন করেন। তাতে কোনও সাড়া পাননি। গান্ধীজি ‘দীর্ঘ ও সৌহার্দপূর্ণ’ (সম্পূর্ণ নিষ্ফল) আলোচনার শেষে বলেন যে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অর্জনের জন্যে সুভাষচন্দ্রের প্রচেষ্টা যদি সফল হয় তাহলে তাঁর (গান্ধীজির) অভিনন্দন বার্তাটি তিনি প্রথম লাভ করবেন। গান্ধীজির এই মন্তব্যে সুভাষচন্দ্র খুব খুশি হয়েছিলেন।
ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্যে অবিলম্বে কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন শুরু করতে সুভাষচন্দ্র জিন্নার কাছে প্রস্তাব করেন। মুসলিম লীগ তখন ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ গ্রহণ করেছে। কিন্তু সুভাষচন্দ্র হিন্দু-মুসলমানের মিলন ও ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম শুরু করার জন্যে এতই উদগ্রীব ছিলেন যে, তিনি এমন প্রস্তাবও করেছিলেন যে ওই রকম সংগ্রাম হলে জিন্নাই ভারতবর্ষের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হবেন। জিন্না ওই প্রস্তাবও গ্রাহ্য করেননি। আর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ইতিপূর্বেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। সুভাষচন্দ্ৰ অধীর হয়ে উঠেছিলেন আর এতটুকু কালক্ষেপ না করে ওই সুবর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদের জন্যে মরণ সংগ্রাম শুরু করতে। উদগ্র ও অদম্য স্বাধীনতাস্পৃহা সুভাষচন্দ্রের চিন্তা ও সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেছিল। স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন রূপায়িত করার জন্যে সুভাষচন্দ্রের প্রবল বাসনার আবেগের গভীরতা এবং তীব্রতা উপলব্ধি না করলে তাঁর তৎকালীন রাজনৈতিক বিচার-বুদ্ধি ও সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা এবং সাফল্য-ব্যর্থতার বিচার করা সম্ভব নয়।
ফরওয়ার্ড ব্লকের জন্ম ও সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক তৎপরতা গান্ধীজি ও কংগ্রেস কর্তৃপক্ষের একেবারেই পছন্দ হয়নি। তাঁরা ক্রমেই উদ্বিগ্ন ও রুষ্ট হচ্ছিলেন এবং প্রত্যাঘাতের চিন্তা করছিলেন। বোম্বাইয়ে জুন মাসের (১৯৩৯) শেষে AICC-র অধিবেশনে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, প্রদেশ কংগ্রেসের সম্মতি ছাড়া কোনও প্রদেশের কংগ্রেস কর্মীরা কোনও সত্যাগ্রহে অংশ নিতে পারবে না। কংগ্রেস মন্ত্রিসভাগুলির কাজকর্মের কোনও প্রকাশ্য সমালোচনাও নিষিদ্ধ করা হয়। এই সিদ্ধান্তের লক্ষ্য ছিলেন সুভাষচন্দ্র ও তাঁর সমর্থকরা। বামপন্থী সমন্বয় কমিটি এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে ৯ জুলাই সারা দেশে বিক্ষোভ জানাবে স্থির করে। কংগ্রেস সভাপতি ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ সতর্ক করে ঘোষণা করেন যে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নির্দেশ অমান্য করে বিক্ষোভ প্রদর্শিত হলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি সুভাষচন্দ্রকে এক বার্তায় (৬ জুলাই, ১৯৩৯) জানান যে প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতিরূপে তাঁর কর্তব্য হল দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষা করা। এই হুমকিতে সুভাষচন্দ্র অবিচল থাকলেও অনেকেই বামপন্থী সমন্বয় কমিটি থেকে সরে যান। প্রদেশ কংগ্রেসেও যাঁরা তাঁর সমর্থক ছিলেন তাঁদের অনেকেও শেষপর্যন্ত তাঁর পাশে থাকেননি। যেমন, অতুল্য ঘোষ হাওড়ার কংগ্রেস নেতা কৃষ্ণকুমার চট্টোপাধ্যায়কে একটি চিঠি লিখে জানান (৯ জুন, ১৯৩৯), “আমি ঘোষণা করিতেছি যে বর্তমানে বাংলা দেশে সুভাষবাবুর কাজকর্ম সমর্থন না করা অন্যায় এবং আমি সর্বান্তকরণে সুভাষবাবুর কাজকর্ম সমর্থন করিতেছি এবং করিয়া থাকি।” কিন্তু তিনি প্রকৃতপক্ষে তা করেননি।
১৬ জুলাই কংগ্রেস সভাপতি কার্যত সুভাষচন্দ্রকে ‘Show Cause’ নোটিশ জারি করেন এবং ওয়ার্কিং কমিটিতে বিষয়টি উত্থাপন করে প্রয়োজনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সম্ভাবনার কথা জানান। উত্তরে সুভাষচন্দ্র লেখেন (৭ আগস্ট) যে, বাক্-স্বাধীনতার জন্যে কংগ্রেস ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে লড়াই করে এসেছে, কিন্তু বাক্-স্বাধীনতা কী শুধু কংগ্রেসের বাইরে প্রয়োগ করা হবে, ভেতরে নয়? তিনি স্মরণ করিয়ে দেন গান্ধীজি ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’তে সংখ্যালঘুদের বিদ্রোহের অধিকার স্বীকার করেছিলেন। এখন পর্যন্ত তাঁদের কাজকর্ম বিদ্রোহের পর্যায়ে যায়নি। তাঁরা শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠদের গৃহীত প্রস্তাবের সমালোচনা করেছেন মাত্র। তিনি জানিয়ে দেন ৯ জুলাই-এর ঘটনার জন্যে যদি কোনও কংগ্রেসকর্মীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় তাহলে তাঁর বিরুদ্ধেও যেন অনুরূপ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। পরিশেষে তিনি লেখেন, “যদি ৯ জুলাই সর্বভারতীয় দিবসরূপে উদ্যাপন করা অপরাধ হয় তাহলে আমি স্বীকার করি যে আমি চরম অপরাধী।” সুভাষচন্দ্রের ওই উক্তি একদিন তাঁর গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন যে কথা বলেছিলেন তারই প্রতিধ্বনি।
কংগ্রেস ‘হাইকম্যান্ড’ তাঁদের মনস্থির পূর্বেই করেছিলেন। ওয়ার্কিং কমিটি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপরাধে সুভাষচন্দ্রকে বাংলা প্রদেশ কমিটির সভাপতি পদ থেকে বরখাস্ত করা হচ্ছে এবং আগামী তিন বছর তিনি কংগ্রেসের কোনও কমিটিতে নির্বাচিত হতে পারবেন না। কিছু পরে তিনি কংগ্রেস থেকেই বহিষ্কৃত হন। ওয়ার্কিং কমিটির এই সিদ্ধান্ত ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করে। বাংলা কংগ্রেসে চরম প্রতিক্রিয়া ও অন্তর্দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। কিন্তু শেষপর্যন্ত সুভাষচন্দ্রের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা প্রত্যাহার করা হয়নি। যাঁরা দীর্ঘকাল সুভাষপন্থী ও তাঁর নিকট বন্ধু বলে পরিচিত ছিলেন তাঁদেরও অনেকে ‘দলত্যাগ’ করে গান্ধীপন্থী হয়ে যান। বাম সংহতিতে ভাঙন ধরে। অক্টোবরে কংগ্রেস সোস্যালিস্টরা ও পরের মাসে কমিউনিস্টরা বামপন্থী সংহতি কমিটি ত্যাগ করেন।
সুভাষচন্দ্রকে কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত করার সিদ্ধান্তে রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত বিচলিত বোধ করেন। তিনি ওই উদ্যোগের মধ্যে ‘শক্তিস্পর্ধা’র প্রভাব ও ‘শক্তিপ্রিয়তা’র লক্ষণ দেখেছিলেন। জওহরলালও যেন ওই স্রোতে ভেসে যাচ্ছেন বলে তাঁর মনে হচ্ছিল। পরম স্নেহভাজন জওহরলালের এই প্রবণতা দেখে তিনি অমিয় চক্রবর্তীকে এক চিঠিতে লেখেন, “আমি তাঁকে প্রশ্ন করি, কংগ্রেসের দুর্গদ্বারের দ্বারীদের মনে কোথাও কি এই ব্যক্তিগত মদমত্ততার সাংঘাতিক লক্ষণ দেখা দিতে আরম্ভ করেনি?” সুভাষচন্দ্রকে বহিষ্কৃত করার ব্যাপারে কবি কতখানি মনোবেদনা বোধ করেছিলেন ও গান্ধীজিকে এরকম যেন না ঘটে তার জন্যে সানুনয় অনুরোধ করেছিলেন এই প্রসঙ্গটির সুন্দর সংক্ষিপ্ত বিবরণ সমর গুহের ‘রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে সুভাষচন্দ্র’ বইটিতে আছে। গান্ধীজি ও ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের কাছে এক বার্তায় তিনি জাতীয় ঐক্যের বিশেষ স্বার্থে বহিষ্কার-আদেশ তুলে নেবার অনুরোধ জানান। দু’দিনের মধ্যেই গান্ধীজি উত্তরে জানালেন ওই আদেশ তুলে নেওয়া সম্ভব নয়। যদি তা করতে হয় তাহলে কবি যেন সুভাষচন্দ্রকে নিয়মশৃঙ্খলা মেনে চলার পরামর্শ দেন। গান্ধীজি কতখানি সুভাষচন্দ্রের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন তা রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করলেন আরও কিছুদিন পরে। সম্ভবত রবীন্দ্রনাথকে না জানিয়েই তাঁর ঘনিষ্ঠবন্ধু ও সহকর্মী দীনবন্ধু এ্যান্ড্রুজ গান্ধীজিকে চিঠি দিয়েছিলেন ওই একই অনুরোধ করে। এর উত্তরে গান্ধীজি লিখলেন (১৫ জানুয়ারি, ১৯৪০), “…সুভাষ পরিবারের ‘আদুরে ছেলের’ মতো আচরণ করছে। ওর সঙ্গে বোঝাপড়া করার একমাত্র উপায় হল ওর চোখ খুলে দেওয়া…আমি সুনিশ্চিত যে বিষয়টির মীমাংসা করা গুরুদেবের পক্ষে অত্যন্ত জটিল। তিনি এ কথা বিশ্বাস করুন যে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিতে সুভাষের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত কিছু নেই। আমার কাছে সে পুত্রের মতো।” (“I feel Subhas is behaving like a spoilt child of a family. The only way to make up with him is to open his eyes…I am quite clear the matter is too complicated for Gurudev to handle.”)
সহজ কথায়, গান্ধীজি রবীন্দ্রনাথকে জানিয়ে দিলেন ওই ব্যাপরে তিনি যেন মাথা না ঘামান। সুভাষচন্দ্রকে উপযুক্ত “শিক্ষা” দিতেই হবে। কবির পক্ষে জটিল রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। এটি তাঁর বিষয়ও নয়! গান্ধীজির কাছে থেকে এরকম রুঢ় চিঠি পেয়ে রবীন্দ্রনাথের কী মনে হয়েছিল তা অনুমান করা কঠিন নয়। গান্ধীজিকে তিনি অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করতেন। অন্যদিকে সুভাষচন্দ্রের প্রতি তাঁর অন্তহীন স্নেহ ছিল। সুভাষের মধ্যে তিনি আগামী দিনের এক মহান নেতাকে দেখেছিলেন। মাত্র কয়েক মাস পূর্বেই তিনি তাঁর ‘তাসের দেশ’ সুভাষচন্দ্রকে উৎসর্গ করেছিলেন (মাঘ, ১৩৪৫)। উৎসর্গপত্রে লিখেছিলেন, “কল্যাণীয় শ্রীমান সুভাষচন্দ্র, স্বদেশের চিত্তে নৃতন প্রাণ সঞ্চার করবার পুণ্যব্রত তুমি গ্রহণ করেছ, সেই কথা স্মরণ করে তোমার নামে ‘তাসের দেশ’ নাটিকা উৎসর্গ করলুম।”।
কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত সুভাষচন্দ্রের আহ্বানে তিনি সুভাষচন্দ্রের পরিকল্পিত ‘কংগ্রেস ভবন’-এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে সম্মত হয়েছিলেন। তিনি নিজেই এই ভবনের নামকরণ করেছিলেন ‘মহাজাতি সদন’। অনুষ্ঠানে কবিকে ভিত্তি স্থাপনের অনুরোধ জানিয়ে সুভাষচন্দ্র বলেন (১৯ আগস্ট ১৯৩৯) যে, ওই ভবন ভারতের স্বাধীনতার জন্যে যাঁরা সর্বপ্রকার ত্যাগ ও নির্যাতন সহ্য করেছেন তাঁদের “আশা-আকাঙ্ক্ষা স্বপ্ন ও আদর্শের এক বাহ্য প্রতীকস্বরূপ হবে।” পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক সঙ্কটের উল্লেখ করে তিনি বলেন, “নবজাগ্রত ভারতীয় মহাজাতি স্বাবলম্বন, গণ-আন্দোলন এবং গণ-সংগ্রামের পন্থা কিছুতেই পরিত্যাগ করবে না…বৈদেশিক সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে একটা তুচ্ছ আপস করে তারা কিছুতেই তাদের জন্মগত অধিকার—স্বাধীনতা—হেলায় ছেড়ে দেবে না।” রবীন্দ্রনাথের ভাষণে ছিল বাংলার নবজাগরণের কথা যা একদিন জীবনের সর্বক্ষেত্র আলোকিত করে রাষ্ট্রযুক্তি সাধনার সর্বপ্রথম কেন্দ্রস্থল করে তুলেছিল বাংলাকে। আত্মগৌরবে সমগ্র ভারতবর্ষের সঙ্গে বাংলার সম্পর্ক ‘অচ্ছেদ্য থাকুক, আত্মাভিমানের সর্বনাশা ভেদবুদ্ধি তাকে পৃথক না করুক’ এই কামনা তিনি করেছিলেন। “বাঙালির বাহু ভারতের বাহুকে বল দিক, বাঙালির বাণী ভারতের বাণীকে সত্য করুক, ভারতের মুক্তি সাধনায় বাঙালি স্বৈরবুদ্ধিতে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোনও কারণেই নিজেকে অকৃতার্থ যেন না করে”, এই প্রার্থনা তিনি জানিয়েছিলেন। রাষ্ট্রীয় সঙ্কটের ঘনীভূত ছায়া কবির মনে যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছিল তার ইঙ্গিত ছিল ওই ভাষণে।
১৯৩৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর মাদ্রাজে এক বিশাল জনসভায় ভাষণদানের মাঝখানেই সুভাষচন্দ্র ব্রিটেন জার্মানীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে এই সংবাদটি পান। তখনই তাঁর মনে হল যে, “সেই বহু প্রতীক্ষিত সঙ্কট সমাগত— ভারতের এই সুবর্ণ সুযোগ।” কিন্তু মহাত্মা গান্ধী ও জওহরলাল নেহরুর দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাব ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। বড়লাট লর্ড লিনলিথগোর সঙ্গে সাক্ষাতের পর গান্ধীজি ঘোষণা করলেন যে ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নে ব্রিটেনের সঙ্গে মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও ব্রিটেনের এই বিপদের সময় ভারতের উচিত তার সঙ্গে সহায়তা করা। তাঁর ‘হরিজন’ পত্রিকায় গান্ধীজি লিখলেন, “সম্পূর্ণ মানবিক কারণে তাঁর সহানুভূতি ইংলন্ড ও ফ্রান্সের দিকে।” জওহরলালও যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে কোনও সংগ্রাম শুরু করার পক্ষে ছিলেন না, কেননা তাঁর দৃষ্টিতে এই যুদ্ধ ছিল ফ্যাসিবাদ ও গণতন্ত্রের মধ্যে সংগ্রাম। যুদ্ধ সম্পর্কে মনোভাব কী হওয়া উচিত তা স্থির করার জন্যে ওয়ার্ধায় কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির জরুরি সভা বসে। কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত হলেও বিশেষ আমন্ত্রিত হয়ে তিনি ওই সভায় যোগ দেন। এর কারণ, গান্ধীজি ও কংগ্রেস নেতারা সুভাষচন্দ্রের জনপ্রিয়তা ও জনগণের ওপর তাঁর বিপুল প্রভাবের কথা উপলব্ধি করেছিলেন। প্রত্যাশিতভাবে সুভাষচন্দ্র অবিলম্বে স্বাধীনতা সংগ্রাম পুনরায় পূর্ণোদ্যমে শুরু করার প্রস্তাব করেন। তাঁর প্রস্তাব পুরোপুরি গৃহীত না হলেও কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি ঘোষণা করে যে (১৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৯) ব্রিটিশ সরকারকে ভারতকে এক স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে ঘোষণা করতে হবে এবং এখনই, যতদূর সম্ভব, ওই মর্যাদার স্বীকৃতি দিতে হবে। ব্রিটেনকে গণতন্ত্র, সাম্রাজ্যবাদ ও যুদ্ধোত্তর নীতি সম্পর্কে তার লক্ষ্য ঘোষণা করতে হবে। তবেই কংগ্রেস সহযোগিতা করবে। সুভাষচন্দ্র এই নীতির বিরোধী ছিলেন। তাঁর দৃঢ় প্রত্যয় ছিল যে, যুদ্ধে ব্রিটেনের পরাজয় ঘটে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতনের পরই ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অর্জিত হওয়া সম্ভব। ব্রিটিশ সরকার কংগ্রেসের প্রস্তাবে কার্যত কর্ণপাত করেনি। ভারত শাসন আইন (১৯৩৫) স্থগিত রেখে সমস্ত ক্ষমতা বড়লাটের হাতে কেন্দ্রীভূত করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। সঙ্গে সঙ্গে জনসভা, শোভাযাত্রা, বিক্ষোভ প্রদর্শন, বিনা বিচারে আটক ও বাক্-স্বাধীনতা হ্রাস ইত্যাদি দমনমূলক ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়। ভারতীয়দের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনও মূল্য না দিয়েই, কোনও বক্তব্য না শুনেই ভারতকে যুদ্ধে যোগদানে বাধ্য করা হয়। এর প্রতিবাদে আটটি প্রদেশে কংগ্রেস মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করে। কিন্তু তা ব্রিটিশ সরকারের মনোভাব ও নীতি পরিবর্তন করতে কার্যকর হয়নি। কংগ্রেসের নীতি সুভাষচন্দ্রকে সম্পূর্ণ হতাশ করে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন