দেশনায়ক – ২০

দিলীপকুমার রায়কে একটি চিঠিতে সুভাষচন্দ্র লিখেছিলেন, “যেসব জটিল প্রশ্নের উত্তর এতদিন খুঁজে পাইনি সেগুলোর সমাধান দেখা যাচ্ছে। আমাদের জীবনের নানা সমস্যার সমাধানের জন্যে যে নিরাসক্ত মনোভাব গড়ে তোলা প্রয়োজন, এই নির্জনতা ও প্রবাসজীবনের ফলে তা আমি পেয়েছি। এজন্য কৃতজ্ঞ বোধ না করে পারছি না। যদি আমার শরীর সুস্থ থাকত তাহলে যে নির্বাসন আমাকে বাধ্য হয়ে ভোগ করতে হচ্ছে তার দ্বারা আরও অনেক কিছু লাভ হত।” জওহরলাল নেহরু তাঁর ‘আত্মজীবনী’, ‘ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া’ প্রভৃতি বহুল পঠিত বিখ্যাত গ্রন্থগুলি লিখেছিলেন কারাগারে। ইন্দিরা গান্ধী একবার বলেছিলেন, “আমার বাবা দীর্ঘকাল জেলে থাকায় এত লেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। আমি সেই সুযোগ পাইনি।” জওহরলালের স্বাস্থ্য কারাবাসের ফলে ভেঙ্গে যায়নি। জেলের পরিবেশও অপেক্ষাকৃত ভাল ছিল। প্রয়োজনীয় বইপত্র পেতে তাঁর অসুবিধা হয়নি। মননশীল নেহরুর পক্ষে তাই এসব গ্রন্থ লেখা সম্ভব হয়েছিল। সুভাষচন্দ্রের সে পরিবেশ ও সুযোগ ছিল না। মান্দালয় জেলে থাকাকালে তাঁর স্বাস্থ্যের ক্রমেই অবনতি হয়। ভগ্নস্বাস্থ্য পরে আর ভাল হয়নি। তা না হলে সুভাষচন্দ্রের কাছ থেকেও অনুরূপ মূল্যবান গ্রন্থ আমরা পেতাম। তাঁর চিঠিপত্রগুলি পড়লেই তা বোঝা যায়। শিল্প, শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, দর্শন, ইতিহাস ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর ভাবনা-চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্লেষণ কত মৌলিক ও তীক্ষ্ম ছিল সে পরিচয় ছড়িয়ে রয়েছে চিঠিপত্রে, ভাষণে ও সাক্ষাৎকারে।

শিল্পকলা, সঙ্গীত, লোকসংস্কৃতি ও প্রাথমিক শিক্ষা সম্বন্ধে সুভাষচন্দ্রের দৃষ্টিকোণ ও অভিমত আজও খুবই প্রাসঙ্গিক, বিশেষ মূল্যবান। তিনি মনে করতেন কারুকলা বা ওই সংক্রান্ত কোনও প্রচেষ্টাই নিষ্ফল নয়। তিনি বলেছিলেন, “এ জন্মে যে আর্টিস্ট হলুন না তার কারণ, হতে পারলুম না, আর আমার বিশ্বাস শিল্পী জন্মায়, তৈরি করা যায় না। একথা অনেকটা সত্য।” কিন্তু নিজে আর্টিস্ট না হলে আর্ট উপভোগ করা যায় না, এটা ঠিক নয়। যে কোনও শিক্ষিত ব্যক্তির পক্ষেই কলার সমজদার হওয়া কঠিন নয়। জীবনকে আনন্দময় ও পরিপূর্ণ করার জন্যে তিনি সঙ্গীত ও শিল্পকে অপরিহার্য বলে মনে করতেন। দিলীপকুমার রায়কে লিখেছিলেন, “বন্ধু, সারা দেশকে সঙ্গীতের বন্যায় প্লাবিত করে দাও, আর যে সহজ আনন্দ আমরা প্রায় হারিয়ে বসেছি, তা আবার জীবনে ফিরিয়ে আনো। যার হৃদয়ে আনন্দ নেই, সঙ্গীতে যার চিত্ত সাড়া দেয় না, তার পক্ষে জগতে বৃহৎ কি মহৎ কিছু সম্পাদন করা কি কখনও সম্ভব?” সুভাষচন্দ্র চেয়েছিলেন শিল্প ও সঙ্গীতের আনন্দকে অতি দরিদ্রের কাছেও সহজলভ্য করে তুলতে। বিশেষ জ্ঞান অর্জনের জন্যে ছোট ছোট গণ্ডীর মধ্যে তাকে আবদ্ধ করে রাখার প্রয়োজন থাকতে পারে। কিন্তু সঙ্গীতকে সর্বসাধারণের উপযোগীও করে তুলতে হবে। বিশিষ্ট সাধনার অভাবে আর্টের উচ্চ আদর্শ ক্ষুণ্ণ হয়। তেমনি সাধারণ মানুষের কাছে সুগম না হলে শিল্প ও জীবনের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে। তাতে আর্ট বা শিল্প ‘নির্জীব ও খর্ব’ হয়। এই যোগাযোগ রাখার জন্যে লোকসঙ্গীত ও নৃত্যের বিশেষ ভূমিকা আছে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন যে, এই যোগসূত্রটি ভারতবর্ষে প্রায় ছিন্ন হওয়ার মূলে আছে পাশ্চাত্য সভ্যতা। কিন্তু তার জায়গায় নতুন কোনও যোগসূত্র গড়ে ওঠেনি। এর দুঃখজনক পরিণতি কী হতে পারে সে সম্বন্ধে সতর্ক করে তিনি বলেছিলেন, “আমাদের যাত্রা, কথকতা, কীর্তন প্রভৃতি যেন কোন অতীত যুগের স্মৃতিচিহ্ন মাত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। বস্তুত, যদি আমাদের গুণী শিল্পীরা অচিরে আর্টকে পুনরায় জীবনের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত না করতে পারেন তাহলে আমাদের চিত্তের যে কী দৈন্যদশা ঘটবে, তা ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়।” মালদার ‘গম্ভীরা’ গানের মৃত্যুর সম্ভাবনায় তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন। বাংলার নিজস্ব লোকসঙ্গীত ও লোকনৃত্য একমাত্র মালদাতেই বেঁচে আছে। তাকে বাঁচাবার দায়িত্ব নিতে হবে। দিলীপকুমার রায়কে অনুরোধ করেছিলেন মালদায় যেতে, বাংলার লোকসঙ্গীতকে বাঁচাবার, উন্নত করার জন্যে উদ্যোগ নিতে। ভারতীয় সঙ্গীতে আবার প্রাণ সঞ্চার ও তার প্রচারের জন্যে একটি বই ইংরাজিতে লেখার জন্যেও তিনি তাঁকে বলেছিলেন। ইংরাজিতে লিখলে অন্য ভাষাভাষীদেরও বইটি পড়ার সুবিধা হবে তাই ইংরাজিতে লেখার কথা বলেছিলেন। সব বিষয়েই সুভাষচন্দ্রের একটি সর্বভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও লক্ষ্য ছিল। তাঁর নিজের বিশেষ পরিচিত বইগুলিও তিনি ইংরাজিতে লিখেছিলেন।

ছোটবেলা থেকেই ছেলেমেয়েদের গান ও ছবি আঁকা শেখানো উচিত বলে সুভাষচন্দ্র মনে করতেন। প্রাথমিক শিক্ষারও উপযুক্ত ব্যবস্থা, প্রসার, পাঠ্যপুস্তক রচনা ও উপযুক্ত শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তাকে অগ্রাধিকার দেবার ওপর জোর দিয়েছিলেন। কর্পোরেশনের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার রূপে তিনি সকল শ্রেণীর ছেলেমেয়েকে, বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারের, প্রাথমিক শিক্ষাদান এবং তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। মান্দালয় থেকে তিনি কর্পোরেশনের জনপ্রিয় উদ্যমী কাউন্সিলার সন্তোষকুমার বসুকে একাধিক চিঠিতে কর্পোরেশনের কর্মসূচী ও জনকল্যাণমূলক পরিকল্পনা সম্বন্ধে তাঁর অভিমত ও বিভিন্ন প্রস্তাব জানিয়েছিলেন। সন্তোষকুমার বসু পরে কর্পোরেশনের মেয়র ও বিশিষ্ট জননেতা হয়েছিলেন। একটি চিঠিতে তিনি জানান, এটা লজ্জার কথা যে, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তনে বোম্বাই, দিল্লি ও চট্টগ্রাম কলকাতার চাইতে এগিয়ে গেছে। তাঁর নিজের ইচ্ছা ছিল ১৯২৬ সালে কয়েকটি অঞ্চলে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন করার। কিন্তু আইনে সেরকম কোনও ক্ষমতা কর্পোরেশনকে দেওয়া হয়নি। ঐ ক্ষমতা লাভের জন্যে চেষ্টা করা উচিত। সন্তোষকুমার বসু তাঁর অভিমত ও প্রস্তাবগুলিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন ও তাঁকে তা জানাতেন বলে সুভাষচন্দ্র খুব খুশি হয়েছিলেন। পৌরসভার এডুকেশন অফিসার-এর বিশেষ দায়িত্ব হওয়া উচিত বাধ্যতামূলক শিক্ষার প্রবর্তনের দিকে লক্ষ্য রাখা। কিন্ডারগার্টেন প্রথা, শিশু মনস্তত্ত্বের সঙ্গে পরিচয়, শিশুদের জন্যে আদর্শ পাঠ্যপুস্তক যোগ্য ব্যক্তিদের দিয়ে লেখানো, শিক্ষকদের ট্রেনিং দেওয়ার জন্যে একটি Training School স্থাপন করা তাঁর দায়িত্ব হওয়া উচিত। এর জন্যে কর্পোরেশনের শিক্ষা বিভাগকে একটি পৃথক বিভাগে পরিণত করা দরকার। এটা করতে সময় লাগবে, অর্থের প্রয়োজন হবে ঠিকই। কিন্তু সুভাষচন্দ্র দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করতেন, “কলকাতার অল্পবয়স্ক গরিব ছেলেমেয়েদের শিক্ষাদানের দায়িত্ব যে বিভাগের উপর, গুরুত্বের বিচারে তা অন্য কোনও বিভাগ থেকে কোনও মতেই কম নয়।” আজ সাতদশক পরেও সুভাষের ঐ পরিকল্পনা কার্যকর হয়নি।

প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা ও তার গুরুত্বের বিষয়টি সম্পর্কে সুভাষচন্দ্র কী গভীর পড়াশোনা ও চিন্তাভাবনা করেছিলেন তা বিস্ময়কর। প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে উচ্চ শিক্ষার বড় পার্থক্যের সুন্দর ব্যাখ্যা করে তিনি লিখেছিলেন, “প্রাথমিক শিক্ষায় নূতন facts শেখাবার চেষ্টাই বেশি প্রয়োজন। উচ্চশিক্ষায় নূতন facts যেরূপ শেখাতে হয় তার সঙ্গে reasoning faculty-র অনুশীলনও সেইরূপ করতে হয়।” প্রাথমিক শিক্ষায় ইন্দ্রিয়-শক্তির ওপর নির্ভর করতে হয়, কারণ তখন চিন্তার বা মনে রাখার শক্তি ভালরকম জাগে। উচ্চ শিক্ষায় চিন্তাশক্তির আধিক্য বেশি হয়। প্রাথমিক শিক্ষায়, মানসিক শিক্ষার সঙ্গে শিল্প শিক্ষারও ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। প্রথম থেকেই ‘manual training’-এর ওপর জোর না দিলে শিক্ষার গোড়ায় গলদ থেকে যায়। নিজের হাতে গাছের সৃষ্টি, পুতুল তৈরি ইত্যাদি শেখালে শিশুরা সৃষ্টির আনন্দ অনুভব করতে শেখে। সুভাষচন্দ্র বিশ্বাস করতেন প্রথম দিকে Text Book-এর আদৌ কোনও প্রয়োজন নেই। যাই শেখানো হোক না কেন তা যেন ইন্দ্রিয়ের সামনে উপস্থিত থাকে। “খুব গরিব চালে” হলেও গান, ছবি আঁকা, বাগান তৈরি করা শেখানো খুবই প্রয়োজন। ভাল শিক্ষক না থাকলে প্রাথমিক শিক্ষা সার্থক হতে পারে না। শিক্ষকের মনে থাকা চাই শিশুদের প্রতি ভালবাসা ও সহানুভূতি। শিক্ষার তিনটি উপাদান দরকার : শিক্ষকের ব্যক্তিত্ব ; শিক্ষার প্রণালী ; শিক্ষার বিষয় ও পাঠ্যপুস্তক। ব্যক্তিত্ব ও চরিত্রবান শিক্ষক না পাওয়া গেলে শিক্ষা ব্যবস্থা সফল হয় না।

সুভাষচন্দ্রের চিন্তা-ভাবনা কত বহুমুখী ছিল তা তাঁর মান্দালয় থেকে লেখা চিঠিগুলিতে যেমনভাবে প্রকাশ পেয়েছিল তা আর কোথাও হয়নি। কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যেতে পারে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ম্যাট্রিক ক্লাস পর্যন্ত বাংলা ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম করেছে জেনে তিনি খুব আনন্দিত হয়েছিলেন। বাংলা সাহিত্যে ছাত্রদের আরও গভীর মনোনিবেশ করা উচিত ছিল বলে তিনি মনে করতেন। তিনি লিখেছিলেন, “আমার শিক্ষায় যাকে আমি খুঁত বলে মনে করি তা হল বাংলা সাহিত্যে আমার বিশাল অজ্ঞতা এবং কেবলমাত্র এখনই আমি সেই অভাব পূরণের চেষ্টা করছি।” মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে রত্নভাণ্ডার অনেক দিক থেকে আধুনিক কালের চেয়েও বেশি বলে তিনি মনে করতেন।

সমাজসেবা, কল্যাণ ও উন্নয়ন সুভাষচন্দ্রের স্বদেশ চিন্তা ও জাতীয়তাবোধের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিল। দক্ষিণ কলিকাতায় তিনি ‘দক্ষিণ কলিকাতা সেবাসমিতি’ ও ‘দক্ষিণ কলিকাতা সেবাশ্রম’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, সংবাদপত্র পত্রিকার পরিচালনা এবং জাতীয় শিক্ষার কাজে দিবারাত্র ব্যস্ত থাকার মধ্যেও তিনি সেবামূলক কাজে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। মান্দালয়ে কারাজীবনেও তিনি সমাজকল্যাণমূলক প্রচেষ্টা সম্বন্ধে গভীর আগ্রহের সঙ্গে খোঁজখবর নিতেন, পরামর্শ দিতেন। এই বিষয়েও তার দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিমত ছিল অত্যন্ত সুচিন্তিত। সমাজসেবামূলক কাজের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র লোককে অর্থ সাহায্য করা নয়। গরিবকে সাহায্য করে তাকে দিয়ে কাজ করানো হল ‘organized charity’-র লক্ষ্য। তিনি এই বিষয়ে সমাজসেবী হরিচরণ বাগচীকে উপদেশ দিয়েছিলেন, “প্রতিদান না দিলে দান গ্রহণ করা আত্মসম্মানের পক্ষে হানিকর—এই ভাবটা গরিব সাহায্যপ্রার্থীদের মনে জাগানো উচিত। সুতরাং যদি কেহ সাহায্য গ্রহণ করিয়া কাজ করিতে প্রস্তুত না হয় তবে তাহার সাহায্য বন্ধ করা ভাল।” তবে তারই সঙ্গে বিচার্য হল সাহায্য গ্রহণকারীর কাজ করার মতো সময়, শারীরিক সামর্থ্য ও তার উপযুক্ত কোনও কাজ করার সুযোগ আছে কি না। তাছাড়া, কাজ শেখাবার ব্যবস্থা করাও প্রয়োজন। তিনি লেখেন, “আমরা ভিক্ষুকের জাতে পরিণত হইয়াছি। সুতরাং ভিক্ষুকের মনোভাব একদিনে পরিবর্তিত হইবে না।” যদি আশা করা যায় যে তা সম্ভব, তাহলে হতাশ হতে হবে। সমাজসেবী প্রতিষ্ঠানের চিরকাল জনসাধারণের দানের (Public Charity) ওপর নির্ভর করা ঠিক নয়। ঐ সমিতির নিজস্ব আয়ের ব্যবস্থা করা উচিত। তবে এটি সময়সাপেক্ষ ও আয়াস-সাধ্য। দক্ষিণ কলিকাতা সেবাশ্রমের কাজে উৎসাহী কর্মীর অভাব সম্পর্কে তাঁকে জানালে সুভাষচন্দ্র লিখেছিলেন ঐ নিয়ে নিরাশ ও চিন্তিত না হতে। অধিকাংশ সমিতিরই একই সমস্যা। নিজেদের সেবা ও আগ্রহের মাধ্যমে অপরের সেবা প্রবৃত্তি জাগাতে হবে। গ্রামের মানুষের মনেও অপরের দুঃখবেদনার প্রতি সহানুভূতি না জাগলে সেবার কাজ করা, বিস্তৃত করা সম্ভব হবে না। সেবাশ্রমের বিস্তৃত বিবরণ তিনি পাঠাতে বলেছিলেন। তা পড়ে তিনি পরামর্শ দিতে আগ্রহী ছিলেন। তিনি আর একটি কাজের দায়িত্ব নেবার কথা ভাবতে বলেছিলেন। কলকাতার জেলের হাসপাতালে কোনও হিন্দু কয়েদি মারা গেলে, তার যদি আত্মীয়স্বজন কলকাতায় না থাকে, তাহলে তার সৎকারের কোনও উচিত মতো ব্যবস্থা হয় না। কিন্তু মুসলমানদের Burial Association আছে। মুসলমান কয়েদি মারা গেলে তারা খবর পাওয়া মাত্র সৎকারের ব্যবস্থা করে। হিন্দু কয়েদিদের জন্যে অনুরূপ একটা ব্যবস্থা থাকা উচিত। তিনি তারপর যা বলেন, তাতে তাঁর বিশাল হৃদয় ও চরিত্রের মাহাত্ম্য উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। সুভাষচন্দ্র লেখেন, “আপনারা যদি এখন ব্যবস্থা না-ও করিতে পারেন তবে আমি বাইরে গেলে নিজে এ বিষয়ে চেষ্টা করিব। আমি নিজে লোকাভাব ঘটিলে অনেক সৎকার করিয়াছি। সুতরাং এরূপ কাজে আমি স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করিতে স্বয়ং প্রস্তুত।”

মুক্তিলাভের পর দেশে ফিরে তিনি বৃহত্তর রাজনৈতিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ায় নিজে সক্রিয় ভূমিকা না নিতে পারলেও ১৯৩২ সালে হিন্দু মহাসভার উদ্যোগে হিন্দু-সৎকার সমিতি স্থাপিত হয়।

সুভাষচন্দ্র নানান দিক থেকেই এক বিরাট মাপের মানুষ ছিলেন। কিন্তু তাঁর জীবনের যে দিকটি বোধহয় সবচেয়ে বেশি মনকে স্পর্শ করে তা হল তাঁর মানবিকতা। হাজার কাজের মাঝে দারুণ সঙ্কট ও মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যেও অতি সাধারণ মানুষের আপাত তুচ্ছ সুবিধা-অসুবিধার কথা চিন্তা করা। মান্দালয় জেলে তখন সবেমাত্র এসেছেন। জেলের পরিবেশ ও পরিস্থিতি কত খারাপ তা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথম দিন থেকেই শরীর খারাপ। দেহ ও মনে অবসাদ। তা সত্ত্বেও শরৎচন্দ্র বসুকে সম্ভবত প্রথম চিঠিতেই লিখছেন, “কর্পোরেশনের পাম্পিং স্টেশনে অথবা জল সরবরাহের যে কোনও কেন্দ্রে ইঞ্জিন ড্রাইভারের কাজের জন্য এন্তাজ আলি নামে একটি লোক দরখাস্ত করেছিল। বাঁশের মতো গোলাকৃতি একটি টিন কেসের মধ্যে পুরে সে তার দরখাস্তের সঙ্গে প্রশংসাপত্রগুলি আমাকে দিয়েছিল সেটি আমার অফিসে হয় টেবিলের ওপর নতুবা আমার চেয়ারের বাঁদিকে what-not-এর মধ্যে আছে। টিন কেসটি দেখতে এত অদ্ভুত যে, ভুল হবার নয়। লোকটি আমাকে ওই প্রশংসাপত্রগুলির কথা লিখেছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, এটি তাকে ফেরৎ পাঠাবার ব্যবস্থা করবেন। কারণ এটি না পেলে সে অন্য কোথাও চাকরির জন্য দরখাস্ত করতে পারছে না।” ভাবা যায়? কোথাকার কে এক চাকরিপ্রার্থী এন্তাজ আলির প্রশংসাপত্রগুলি ফেরৎ না পেলে অসুবিধা হবে, এই চিন্তায় উদ্বিগ্ন সুভাষচন্দ্র লিখছেন জেল থেকে প্রথম চিঠিতেই।

মানুষের প্রতি এই গভীর মমতাই তাঁকে বিচলিত করেছিল দেশবন্ধুর স্নেহধন্য দাগী আসামী মাথুরের আশ্রয় সম্বন্ধে। মেজদাকে আবেদন করেছিলেন তার আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে। তিনি চিন্তায় পড়েছিলেন তাঁর সাহায্যে যে ছেলেটি পড়াশোনা করছিল, তার এখন কী হবে। গ্রাম্য জমিদার মলয়-এর যে কাহিনী তিনি মেজবৌদি বিভাবতী দেবীকে চিঠিতে জানিয়েছিলেন তা খুব কঠিন হৃদয়কে স্পর্শ করে, চক্ষু সজল করে। শুধু মাত্র একটি করুণ কাহিনী বলেই নয়, কাহিনীর বর্ণনায় সুভাষচন্দ্রের হৃদয়ের উত্তাপ ও এক ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষের প্রতি তাঁর সহমর্মিতায়। সুভাষচন্দ্রের ওয়ার্ডে মলয় নামে এক কয়েদি মেথরের কাজ করত। কোনও এক অপরাধে তার সাত বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে একদিন তার নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই মুক্তির আদেশ এল। কিন্তু মলয়ের মুখে কোনও আনন্দের ছাপ না দেখে সবাই বিস্মিত হল। অত্যন্ত বিহ্বল অবস্থায় সে শুধু বলছে ‘কাউন্ডে কাউন্ডে’ অথাৎ ‘ভাল ভাল’। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার আগের দিন তাকে কাছে বসিয়ে জানা গেল যে চার বছর হয়ে গেল সে স্ত্রী, পুত্র-কন্যাদের কোনও খবর পায়নি। তারা ভাল আছে, এমনকি বেঁচে আছে কি না তাও সে জানে না। তাই তার মন ভয়ে আকুল হচ্ছে। সে একজন গ্রাম্য জমিদার বা রাজা। তারা পূর্বে স্বাধীন ছিল। প্রথমে বর্মী রাজাদের ও পরে ইংরেজদের সঙ্গে স্বাধীনতা ফিরে পেতে লড়াই করে তারা হেরে গিয়ে আত্মগোপন করে থাকে। তিন বছর লুকিয়ে থাকার পর তাকে ও তার ভাইকে তাদের বৈমাত্রেয় ভাই ধরিয়ে দেয়। তার ভাই-এর যাবজ্জীবন দীপান্তর ও তার সাত বছরের কারাদণ্ড হয়।

মলয় তার শরীরে অনেকগুলি আঘাতের চিহ্ন দেখায়। সবগুলিই যুদ্ধের সময়ে পাওয়া। অবিশ্বাস্য কাহিনী। পরে সুভাষচন্দ্র খোঁজ নিয়ে জেনেছিলেন যে ‘গ্রাম্য রাজা’ মলয়ের কাহিনীর প্রতিটি বর্ণ সত্য। এরকম একজন মানুষকে মেথর করে রাখা হয়েছিল। সুভাষচন্দ্র তাকে জিজ্ঞাসা করেন, কেন সে মেথরের কাজ করতে রাজি হয়েছিল। ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষটি দুঃখের সঙ্গে বলে, “কি করব, জেলের হুকুম! এখানে কি আর মানুষ আছি—এখানে কুকুর হয়ে গেছি। আবার বাইরে গেলে তখন মানুষ হব।” তার করুণ কাহিনী শুনে সুভাষচন্দ্র জিজ্ঞাসা করেন, ভবিষ্যতে সে কী করবে? মলয় বলে, সে জানে না। এখন তাদের জমিদারি সেই বৈমাত্রেয় ভাই ভোগ-দখল করছে। ভয় হয়, কপালে এখনও অনেক দুঃখ আছে। যাবার সময় সুভাষচন্দ্র প্রশ্ন করেন, তাঁদের কথা বাড়িতে ফিরে গিয়ে মনে থাকবে কি না। গদগদ কণ্ঠে মলয় বলে, “বেঁচে থাকতে আপনাদের স্নেহের কথা ভুলব না—এবং আমার ছেলে ও নাতিদের কাছে আপনাদের গল্প করব।” গল্পটি লেখার পর সুভাষচন্দ্র বিভাবতী দেবীকে প্রশ্ন করেন, “এখন আপনারা বলুন তো যে এ ঘটনা সত্য বলে মনে হয়, না উপন্যাসের গল্প বলে মনে হয়?” নিজেই এই উত্তর দিয়ে সুভাষচন্দ্র লেখেন, অনেক সময় সত্য ঘটনা গল্পের চেয়েও অলৌকিক হয়। এও তাই।

সকল অধ্যায়

১. দেশনায়ক – ১
২. দেশনায়ক – ২
৩. দেশনায়ক – ৩
৪. দেশনায়ক – ৪
৫. দেশনায়ক – ৫
৬. দেশনায়ক – ৬
৭. দেশনায়ক – ৭
৮. দেশনায়ক – ৮
৯. দেশনায়ক – ৯
১০. দেশনায়ক – ১০
১১. দেশনায়ক – ১১
১২. দেশনায়ক – ১২
১৩. দেশনায়ক – ১৩
১৪. দেশনায়ক – ১৪
১৫. দেশনায়ক – ১৫
১৬. দেশনায়ক – ১৬
১৭. দেশনায়ক – ১৭
১৮. দেশনায়ক – ১৮
১৯. দেশনায়ক – ১৯
২০. দেশনায়ক – ২০
২১. দেশনায়ক – ২১
২২. দেশনায়ক – ২২
২৩. দেশনায়ক – ২৩
২৪. দেশনায়ক – ২৪
২৫. দেশনায়ক – ২৫
২৬. দেশনায়ক – ২৬
২৭. দেশনায়ক – ২৭
২৮. দেশনায়ক – ২৮
২৯. দেশনায়ক – ২৯
৩০. দেশনায়ক – ৩০
৩১. দেশনায়ক – ৩১
৩২. দেশনায়ক – ৩২
৩৩. দেশনায়ক – ৩৩
৩৪. দেশনায়ক – ৩৪
৩৫. দেশনায়ক – ৩৫
৩৬. দেশনায়ক – ৩৬
৩৭. দেশনায়ক – ৩৭
৩৮. দেশনায়ক – ৩৮
৩৯. দেশনায়ক – ৩৯
৪০. দেশনায়ক – ৪০
৪১. দেশনায়ক – ৪১
৪২. দেশনায়ক – ৪২
৪৩. দেশনায়ক – ৪৩
৪৪. দেশনায়ক – ৪৪
৪৫. দেশনায়ক – ৪৫
৪৬. দেশনায়ক – ৪৬
৪৭. দেশনায়ক – ৪৭
৪৮. দেশনায়ক – ৪৮
৪৯. দেশনায়ক – ৪৯
৫০. দেশনায়ক – ৫০

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন