দেশনায়ক – ২২

মান্দালয় জেল থেকে লেখা প্রথম চিঠিতেই সুভাষচন্দ্র কোনও এক চাকরিপ্রার্থী এন্তাজ আলির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র কর্পোরেশনে তাঁর অফিস থেকে উদ্ধার করে তাকে ফেরত দেবার জন্যে শরৎচন্দ্রকে অনুরোধ করেছিলেন। যাতে না তার অন্যত্র কাজ পেতে অসুবিধা হয়। দীর্ঘ কারাবাসের পর ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়ে কলকাতায় ফিরেই সুভাষচন্দ্র যান শিলং-এ স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্যে। শিলং থেকে ক’দিন পরেই তিনি একটি চিঠি লেখেন। ওই চিঠির দু’টি মুখ্য বক্তব্য ছিল। প্রথমটি তাঁর নিজের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সম্বন্ধে। দ্বিতীয়টি, একটি সিল্কের লুঙ্গি। এটি তিনি মান্দালয় জেলে পরতেন। লুঙ্গির এই গুরুত্বের ব্যাপারটি তাঁর চিঠি থেকেই জানা ভাল। তিনি লিখছেন, “কলকাতায় থাকার সময় মান্দালয় থেকে পাঠানো আমার সিল্কের লুঙ্গিটা পেয়েছি। এটা আমার পাওয়ার কথা নয়। কারণ লুঙ্গিটা আমি কয়েদি মউ টিনের জন্যে রেখে এসেছিলাম। এই কয়েদিটি আমার গা-হাত-পা টিপে দিত। আমি এ-বিষয়ে সুপারিন্টেডেন্টের সঙ্গে কথা বলে জানিয়ে এসেছিলাম যে কয়েদিটি ছাড়া পাওয়ার পরে ওই লুঙ্গিটা যেন পায়। না পেলে গরিব মানুষটি বেশ হতাশ হবে। মান্দালয় ছাড়ার সময় আমি কি আপনাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম যে লুঙ্গিটি আমি মউ টিনের জন্যে রেখে যাচ্ছি? কথা রাখার জন্যে মউ টিনের প্রাপ্য লুঙ্গিটা আমি আবার মান্দালয়ে পাঠিয়ে দেব।” এক কয়েদিকে নিজের ব্যবহার করা লুঙ্গি দেব বলে, কথার খেলাপ যাতে না হয় তার জন্যে ওই লুঙ্গি আবার কলকাতা থেকে মান্দালয়ে ফেরত পাঠাবার ব্যবস্থা করা সুভাষচন্দ্রের মতো মানুষের পক্ষেই সম্ভব। এই মানবিকতা, কথার মূল্য সম্পর্কে সচেতনতার দুর্লভ গুণ সুভাষচন্দ্রের চরিত্রকে মহিমময় করে তুলেছিল।

১৯২৭ থেকে ১৯৩৩ সালে ইউরোপ যাত্রা করা পর্যন্ত সময়টি সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই সময়েই তিনি সর্বভারতীয় নেতার স্বীকৃতি ও মর্যাদা অর্জন করেন। গান্ধীজির সঙ্গে তাঁর মতাদর্শ, নীতি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্য সম্পর্কে মতপার্থক্য তীব্রতর হয়। যুব আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন, নারীমুক্তি ও নারী-পুরুষের সমমর্যাদা, গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা ও তার সমাধানের উপায় প্রভৃতি বিষয়ে সুভাষচন্দ্র বলিষ্ঠভাবে তাঁর বক্তব্য প্রকাশ করেন এবং সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তাঁর ওই সময়ের চিন্তাধারা ও কর্মতৎপরতার বিশ্লেষণের জন্যে শিলং-এ কেমনভাবে তাঁর মানসিক প্রস্তুতি হচ্ছিল তা জানা প্রয়োজন। প্রকাশ্য বিবৃতি বা ভাষণের থেকেও এই সময়ে লেখা তাঁর ব্যক্তিগত চিঠিগুলির মূল্য এই প্রসঙ্গে আরোও বেশি। দেশবন্ধুর মৃত্যুর পর থেকেই স্বরাজ্য দলে ও বাংলা প্রদেশ কংগ্রেসের মধ্যে মতানৈক্য ও বিরোধ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। সুভাষচন্দ্র ও যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের মধ্যে বিতর্ক ও বিরোধ প্রদেশ কংগ্রেসকে কার্যত দু’টি শিবিরে বিভক্ত করে তুলছিল। যতীন্দ্রমোহন গান্ধীজির সমর্থন লাভ করেছিলেন। মান্দালয় জেলে থাকাকালেই সুভাষচন্দ্র এই বিরোধ নিয়ে উদ্বিগ্ন বোধ করছিলেন।

জেল থেকে মুক্তিলাভ করে শিলং-এ বিশ্রাম নেবার সময়ে প্রদেশ কংগ্রেসের এই অন্তর্বিরোধ যাতে মিটে যায় তার জন্যে তিনি অধীর হয়েছিলেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, এই বিরোধ ও দলাদলি কংগ্রেসের ও দেশের পক্ষে ক্ষতিকর। শিলং থেকে তিনি লিখেছিলেন, “বৈষম্য দূর করে বিভিন্ন দলকে একতাবদ্ধ করার কাজে আমি সব রকম উদ্যোগ নেব।” ১৩ সেপ্টেম্বর (১৯২৭) শিলং থেকে প্রচারিত এক আবেদনে তিনি বলেন, ‘ক্ষমা করুন ও ভুলে যান’ (‘Forgive and Forget’)। তিনি ‘ঘরে শৃঙ্খলা’ প্রতিষ্ঠা ও কংগ্রেসের বাইরের সব দলের সঙ্গে ঐক্য গড়ে তোলার আবেদন জানিয়ে বলেন যে, দেশ এক ‘নবজাগরণের দ্বারপ্রান্তে’। এখন ‘ক্ষমা করুন এবং ভুলে যান’ —এই নীতি অনুসরণ করে সব দলাদলি, সব সাম্প্রদায়িক বিবাদের ঊর্ধে সবাইকে উঠতে হবে। কিন্তু সুভাষচন্দ্রের আন্তরিক ইচ্ছা ও প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কংগ্রেসের অন্তর্দ্বন্দ্ব মেটেনি। যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তও শ্রদ্ধেয় ও জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। তবুও তাঁদের মধ্যে মতবিরোধ কেন মেটেনি তার দীর্ঘ আলোচনার অবকাশ এখানে নেই। কোনও কোনও সমসাময়িক রাজনৈতিক কর্মী এবং আধুনিক ঐতিহাসিক এর জন্যে সুভাষচন্দ্রের অনমনীয় মনোভাবকে (চলিত কথায় ‘একগুঁয়েমি’ বা ‘জিদ’) দায়ী করেছেন। গান্ধী-সুভাষ বিরোধ সম্পর্কেও একই সমালোচনা হয়েছে সুভাষচন্দ্রের। কিন্তু সুভাষচন্দ্রের মনোভাব ও ‘অনমনীয়তা’ বুঝতে হলে তাঁর মানসিক গঠনটি ভালভাবে জানা প্রয়োজন। সুভাষচন্দ্র যা সত্য, কল্যাণকর, দেশ এবং সমাজের হিতার্থে প্রয়োজন বোধ করতেন তার জন্যে কোনও আপস বা নীতিহীন বোঝাপড়া পছন্দ করতেন না। তার জন্যে চরম মূল্য দিতেও তিনি এতটুকু দ্বিধা করতেন না। আর চরম মূল্য তিনি দিয়েও ছিলেন। গান্ধীজির নেতৃত্ব ও সিদ্ধান্ত তিনি যদি বিনা প্রতিবাদে মেনে নিতেন, তাঁর সম্মোহনী ব্যক্তিত্বের প্রভাবমুক্ত না হতেন তাহলে তাঁকে কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত হতে হত না। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভের সংগ্রামের জন্যে দেশত্যাগ করতে হত না। সম্ভবত স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির পদ তাঁর জন্যেই নির্দিষ্ট হত। কিন্তু কী হলে কী হতে পারত সেটা বড় কথা নয়। মূল কথা হল তাঁর বিশ্বাসের দৃঢ়তা, কারোর জন্যে, কোনও কিছুর জন্যেই নিজের বিবেকের নির্দেশ অমান্য না করা। বিবেককে বাঁধা না দেওয়া। এই সঙ্কল্পের দৃঢ়তা যদি অনমনীয়তা বা জিদের নামান্তর হয় তাহলে অবশ্যই তিনি ওই অভিযোগে অভিযুক্ত হতে পারেন। এই প্রসঙ্গে দেশবন্ধু-পত্নী বাসন্তী দেবীর সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের সম্পর্কের কথা উল্লেখ করি।

সুভাষচন্দ্রের একান্ত ইচ্ছা ছিল দেশবন্ধুর মৃত্যুর পর বাসন্তী দেবী বাংলার রাজনৈতিক নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন যে অন্য কারোর পক্ষেই দেশবন্ধুর মৃত্যুর পরের শূন্যতা পূরণ করা সম্ভব নয়। বারবার তিনি এই অনুরোধ বাসন্তী দেবীকে জানিয়েছিলেন। বাসন্তী দেবী সুভাষচন্দ্রের কাছে ছিলেন মাতৃবিগ্রহের মতো। গভীর আবেগে তিনি লিখেছিলেন যে, নিজের আত্মবিশ্বাসের অভাবের জন্যে তিনি ওই আবেদন করছেন না। “আত্মবিশ্বাস আমাদের বোধহয় একটু বেশিই আছে।” কিন্তু, “আমাদের অন্তরের সর্বশ্রেষ্ঠ যাহা কিছু পাইয়াছি তাহা লইয়াই মাতৃমূর্তি রচনা করিয়াছি। ‘বন্দে মাতরম’ গান লইয়া আমাদের জাতীয় অভিযান শুরু হইয়াছে। তাই আজ মাকে ডাকিতেছি।” বাসন্ত দেবী এর পরেও কোনও সাড়া না দেওয়ায় সুভাষচন্দ্র ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত হয়েছিলেন। তিনি বাসন্তী দেবীকে জানান যে, দেশের কথা ভেবেই তাঁর অনুরোধ। Big Five—নলিনীরঞ্জন সরকার, তুলসীচন্দ্র গোস্বামী, নির্মলচন্দ্র চন্দ্র, শরৎচন্দ্র বসু ও ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়—সকলেই (তুলসীচন্দ্র গোস্বামী ছাড়া) Professional লোক। নিজের কাজে ব্যস্ত। নেতৃত্ব দেবার মতো লোকের অভাব। কংগ্রেসের ভাণ্ডার শূন্য, এই সঙ্কটের সময় দেশবন্ধু পত্নীর এগিয়ে আসা গভীর দুঃখের কথা। তারপর সুভাষচন্দ্র যা লেখেন তাতে তাঁর চরিত্রের অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি বলেন, “জীবনে কাহারও কখনও খোসামুদি করি নাই—অপরের মন যুগিয়ে কথা বলার রীতি আমার জানা নাই। আমাদের Leader-এর (দেশবন্ধু) জীবদ্দশায় যখন সকলেই তাঁহাকে সন্তুষ্ট করবার জন্য তাঁহার মনের মতো কথা বলেছেন, আমি তখন অপ্রিয় সত্য বলে তাঁহার সহিত ঝগড়া করেছি, আপনাকে সন্তুষ্ট করবার জন্য কোনও কথা বলি নাই বলব না। দেশবাসী আপনাকে চায়…সকল দল আপনাকে মানবে, আপনাকে খাতির করবে, আপনার কথা রাখবে। এ কথা সত্য বলে বিশ্বাস করি বলে আপনাকে জানিয়েছি।”

বাসন্তী দেবীকে এইভাবে চিঠি লেখা সুভাষচন্দ্রের পক্ষেই সম্ভব ছিল। যে চিঠিতে তিনি কার্যত বাসন্তী দেবীকে দেশের সঙ্কটমুহূর্তে নেতৃত্ব দিতে অস্বীকার করার জন্যে তীব্র সমালোচনা করেছেন সেই চিঠিতেই আবার লিখেছেন, “সেদিন মা-এর (প্রভাবতী) কাছে শুনিলাম আপনি স্বপ্নে একটা ঔষধ পেয়েছিলেন—আমার অসুখের জন্য—অথচ আপনি আমাকে সেই ঔষধ দেন নাই বা সে সম্বন্ধে কিছু বলেন নাই। শুনে আমার খুব রাগ হয়েছে…আপনি জানেন যে, যে কোনও ঔষধ আপনি দিলে আমি সাগ্রহে এবং ভক্তির সহিত তাহা গ্রহণ করিতাম।” বাসন্তী দেবী সম্ভবত মনে করেছিলেন যে, সুভাষ ‘স্বপ্নলব্ধ ঔষধ’-এ বিশ্বাস করবেন না। তাই ওই ওষুধ পাঠাতে তাঁর সঙ্কোচবোধ হয়েছিল। কিন্তু সুভাষচন্দ্রের কাছে তিনি স্বপ্নলব্ধ ওষুধে বিশ্বাস করতেন কি না করতেন তা বড় কথা ছিল না। মা পাঠিয়েছেন পুত্রের আরোগ্যের জন্যে—এটাই সবচেয়ে বড় ছিল। এখানে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কোনও ঠাঁই ছিল না।

শিলং-এর নির্জন ও মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে কয়েক মাস বিশ্রাম নেবার সময় সুভাষচন্দ্রের মনে বিচিত্র অনুভূতি ও উপলব্ধির আনাগোনা চলছিল। ১৬ জুন ‘দরিদ্র নারায়ণে’র সেবায় দেশবন্ধুর আত্মনিবেদনের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে তিনি বলেছিলেন যে, চিত্তরঞ্জন বিরাট ঋণের চাপে জর্জরিত হয়েও নিজের প্র্যাকটিস আবার শুরু করার কথায় কান দেননি। কারণ, তিনি বুঝেছিলেন টাকার চেয়েও আদর্শ বড়। তিনি অসহযোগিতার আদর্শ বর্জন করেননি। দেশবন্ধু বিশ্বাস করতেন যে টাকার অভাব মানুষ মেটাতে পারে, কিন্তু মানুষের অভাব টাকায় কখনও মেটানো যায় না। দু’মাস পরে মেজবৌদি বিভাবতী দেবীকে এক চিঠিতে সুভাষচন্দ্র লেখেন, ‘টাকা মাটি, মাটি টাকা’, শ্রীরামকৃষ্ণের এই ভাবটি হৃদয়ে রাখা ভাল। এই ভাবটি থাকলে মানুষ স্বার্থপর বা কৃপণ হয় না। কিন্তু তাঁর নিজের (সুভাষের) দিক থেকে ওই কথাটি বলা খাটে না। তাঁর কাছে প্রতিটি টাকার মূল্য খুব বেশি। “যে টাকাটি আমার নিজের জন্যে ব্যয় করি, প্রতি মুহূর্তে মনে হয় যে ঐ টাকা অপরের জন্যে ব্যয় করতে পারলে আমি বেশী সুখী হতুম।” সুভাষচন্দ্র একদিকে যেমন শ্রীরামকৃষ্ণের শিক্ষা অন্তরে গ্রহণ করেছিলেন, তেমনি অন্যদিকে সৎ কাজ ও সৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যেও যে টাকার প্রয়োজন আছে তাও নিজের অভিজ্ঞতায় বুঝেছিলেন। এই রকম মানসিক দ্বন্দ্ব তাঁর জীবনে প্রায়ই দেখা দিয়েছিল। সুভাষচন্দ্রের অন্তর্জীবনে কী রকম পরিবর্তন দেখা দিত তার আর একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরি।

সুভাষচন্দ্র শিলং-এ থাকাকালে মেজবৌদি বিভাবতী দেবী ও বাড়ির আরও কয়েকজন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তাঁরা চলে যাবার পর সুভাষ মেজবৌদিকে লেখেন, “আপনারা সকলে হঠাৎ চলে যাওয়াতে একটু মুস্কিলে পড়েছিলাম। খালি বাড়ীটা খাঁ খাঁ করতে লাগল—মনটা কেমন করে উঠল। দৈনন্দিন জীবনের খেইগুলো যেন কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গেল…আমি মনে করতুম যে আমি মায়া-মমতার বাহিরে। তাই একটু ঘা দিয়ে প্রকৃতি আমাকে বুঝিয়ে দিলেন যে এখনও একেবারে মমতাহীন হতে পারিনি।” পাঁচ বছর পরে সুভাষচন্দ্র যখন একলা অসুস্থ শরীরে মাদ্রাজে ইউরোপে যাবার জন্যে অপেক্ষা করছেন তখন তাঁর সঙ্গে এক নিকট বন্ধু দেখা করতে আসছেন শুনে তিনি লিখেছিলেন, “আমার সঙ্গে কেহ দেখা করিতে আসিবে শুনিলে মনটা যেন চঞ্চল হইয়া উঠে, মোট কথা কাহারও আসাটা আমি পছন্দ করি না।” এমনকি তাঁর নিজের বড়দা সতীশচন্দ্র মাদ্রাজে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে সুভাষচন্দ্র তাঁকেও আসতে বারণ করেছিলেন। আসলে, সুভাষচন্দ্রের মনের মধ্যে সবসময়ই একটা অস্থিরতা ছিল। এর মূলে ছিল তাঁর উদগ্র স্বদেশপ্রেম, স্বাধীন ভারতের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার অস্থিরতা। তিনি নিজেও তাঁর এই অস্থিরতা বা মেজাজ সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন। একটি চিঠিতে বিভাবতী দেবীকে লিখেছিলেন, “অনেক বাজে বকলুম, কিছু মনে করবেন না, পাগল আমি নই, তবে যদি মনে করেন তাতে আমার আপত্তি নাই। একটু আধটু ছিট না থাকলে চলবে কেন? একেবারে স্থির মস্তিষ্ক হওয়াটা কি ভাল!” এই রকমই ‘পাগল’ ছিলেন দেশবন্ধু। তিনি মাঝে মাঝে বলতেন যে, তাঁর জন্যে কোনও স্মৃতিমন্দির না করে একটি পাথরের ওপর লিখে দিতে : ‘বাংলার একজন পাগল এখানে বিশ্রাম করছে।’ দেশবন্ধুর ওই কথাটি স্মরণ করিয়ে দিয়ে সুভাষচন্দ্র ১৯২৭ সালে বলেছিলেন, ‘অনেক সময়ে পাগল লক্ষণ না থাকলে মানুষ বড় হতে পারে না। পুরো মাত্রায় sanity পাওয়া যায় সেখানে—যেখানে আছে শুধু dull mediocrity (অনুজ্জ্বল মাঝারিয়ানা)।” দেশবন্ধুর মন্ত্রশিষ্য, রাজনৈতিক আদর্শ ও ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী সুভাষচন্দ্র তাঁরই গুরুর উন্মাদনা নিয়ে শিলং থেকে ফিরে স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল স্রোতে পুনঃপ্রবেশ করেন।

১৯২৭ সালের নভেম্বর মাসে সুভাষচন্দ্র প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। সম্পাদক হন কিরণশঙ্কর রায়। সভাপতি পদে সুভাষচন্দ্রের আসার ফলে কংগ্রেস কর্মীদের মধ্যে নতুন উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা দেয়। দেশের সামনে প্রধান সমস্যাগুলির অন্যতম ছিল সাম্প্রদায়িক ঐক্য ও সম্প্রীতি। মানসিক হতাশার কারণে গান্ধীজি ও স্বাস্থ্যের কারণে মতিলাল নেহরু সর্বভারতীয় রাজনীতি থেকে দূরে সরে থাকায় মূল দায়িত্ব পড়েছিল শ্রীনিবাস আয়েঙ্গারের ওপর। তিনি যথাসাধ্য এ দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বাংলাদেশে ১৯২৬ সালে সাম্প্রদায়িক সমস্যা তীব্রতর হওয়ায় সুভাষচন্দ্র খুবই উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন। তিনি মুসলমানদের আস্থা ফিরিয়ে এনে হিন্দু-মুসলমান ঐক্য সুদৃঢ় করার জন্যে সচেষ্ট হন। বেঙ্গল প্যাক্টের জন্যে দেশবন্ধুর এবং কলকাতা কর্পোরেশনের চিফ এক্সিকিউটিভ রূপে চাকরির ক্ষেত্রে মুসলমানদের অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রশ্নে দেশবন্ধু ও সুভাষচন্দ্র উভয়ের প্রচুর সমালোচনা হয়েছিল। কিন্তু দেশবন্ধু ও সুভাষচন্দ্র তাতে বিচলিত হননি। নতুন পরিস্থিতিতেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ঐক্যরক্ষার সমস্যা সম্বন্ধে সুভাষচন্দ্রের দৃষ্টিভঙ্গির কোনও পরিবর্তন হয়নি। তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের প্রতি আবেদন করেন যে, স্বাধীনতা সংগ্রামই মূল প্রশ্ন। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের বেশি নমনীয় ও উদার হতে হবে যাতে মুক্তি সংগ্রামের অগ্রগতি বিঘ্নিত না হয়। তিনি নির্ভীকভাবে বলেন, “মুসলমানরা গরুর শত্রু নয়। মুসলমানদের বাড়িতে গরুর যথেষ্ট যত্ন হয়, কোনও কোনও ক্ষেত্রে হিন্দুর বাড়ির থেকেও। বাংলার মুসলমান কৃষক হিন্দু কৃষকের মতই গরুকে ভালবাসে, কারণ সে জানে দুধ ও চাষবাস তা ছাড়া সম্ভব নয়।” এই ভাষণ তিনি দিয়েছিলেন প্রাদেশিক হিন্দুসভা আয়োজিত জন সমাবেশে। উদ্যোক্তাদের মনোভাবের সমালোচনা করেছিলেন। একই সঙ্গে নিন্দা করেছিলেন মুসলিম লীগের। তিনি হিন্দুসভাকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন গো হত্যার বিরুদ্ধে কোনও প্রস্তাব গ্রহণ না করতে। তিনি খোলাখুলি বলেন যে, ‘আমি জানি এই কথা বলার ফলে আমার বর্তমান জনপ্রিয়তার সম্ভবত ক্ষতি হবে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি আমার জনপ্রিয়তার এতটা মূল্য দিই না যার জন্য সত্যকে বিসর্জন দিতে হবে।” হিন্দু-মুসলমান ঐক্য সম্পর্কে এক সভায় তিনি বলেছিলেন (১২ নভেম্বর, ১৯২৭), “আপনারা হিন্দুর অধিকার মুসলিমদের অধিকারের কথা বলেন। আমি আপনাদের জিজ্ঞাসা করি পরাধীন জাতির কোনো মানুষের কি কোনো অধিকার আছে?”

খুব স্বাভাবিকভাবেই সুভাষচন্দ্রের এই দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিমত অনেকেরই পছন্দ হয়নি। হিন্দু জাতীয়তাবাদ ও হিন্দু সংগঠনগুলি তখন ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠছিল। মুসলিম লীগ ও অনেক মুসলমান নেতাদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদ ও সাম্প্রদায়িক মনোভাব প্রকট হতে থাকায় হিন্দুদের মধ্যেও প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে থাকে। হিন্দু মহাসভার সভাপতি ডাঃ বি. এস. মুঞ্জে সুভাষচন্দ্রের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। কিন্তু সুভাষচন্দ্র তাঁর বিশ্বাসে অবিচল ছিলেন। তিনি মুঞ্জের সমালোচনার উত্তরে বলেন যে, জাতীয় জীবনে, সমাজ কল্যাণে, হিন্দু মহাসভার করণীয় অনেক কিছু আছে। ওইসব ক্ষেত্রে তাঁদের কাজের তিনি প্রশংসা করেন। কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষেত্রে হিন্দু মহাসভার প্রবেশ না করাই কাম্য।

হিন্দু-মুসলমান ঐক্য ও ধর্মনিরপেক্ষ মনোভাব গঠনের প্রচেষ্টা সুভাষচন্দ্রের জীবনের এক প্রধান লক্ষ্য ছিল। পুণাতে এক ভাষণে (৩ মে, ১৯২৮) তিনি ধর্মোন্মত্ততার প্রতিকারের জন্যে সাংস্কৃতিক সৌহার্দ ও বৈজ্ঞানিক শিক্ষার ওপর বিশেষ জোর দিয়েছিলেন। আর গুরুত্ব দিয়েছিলেন ‘অর্থনৈতিক চেতনা’ জাগ্রত করার ওপর। সাম্প্রদায়িকতা দূর করে সুস্থ জাতীয়তাবাদের বিকাশের জন্যে জরুরি প্রয়োজন অর্থনৈতিক চেতনার। তিনি বলেন, ‘একজন মুসলমান কৃষক এবং একজন মুসলমান জমিদারের মধ্যে যতটা মিল তার চেয়ে ঢের বেশি মিল একজন মুসলমান কৃষক এবং একজন হিন্দু কৃষকের মধ্যে। তাঁদের অর্থনৈতিক স্বার্থ কোথায় নিহিত আছে জনসাধারণকে শুধু সেই শিক্ষা দিতে হবে এবং একবার এই কথাটা বুঝতে পারলে তারা আর সাম্প্রদায়িক বিবাদে নিজেদের ঘুঁটি হিসাবে ব্যবহার করতে দিতে রাজি হবে না।”

পূর্বেই উল্লেখ করেছি, হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক ও সাম্প্রদায়িক ঐক্য-সংহতির সমাধান প্রসঙ্গে সুভাষচন্দ্রের মধ্যে অতি সরলীকরণের প্রবণতা ছিল। পরে এটা আরোও বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু সুভাষচন্দ্র যেভাবে গভীর আন্তরিকতা ও বিশ্বাসের দৃঢ়তা নিয়ে এক বিষবৃক্ষের শিকড় উৎপাটনের চেষ্টা করেছিলেন তা তাঁর জীবন ও দর্শনের এক উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য। যে সমাধানের কথা তিনি ভেবেছিলেন তার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি অত্যন্ত সুদৃঢ়। মুসলমান কৃষকের গরুর প্রতি ভালবাসা সম্বন্ধে তাঁর সাহসী উক্তি স্মরণ করিয়ে দেয় শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’-এর গফুরকে। পরবর্তীকালে আজাদ হিন্দ ফৌজের সংগঠন ও কীর্তি সুভাষচন্দ্রের বিশ্বাসকে রূপ দিয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাঁর সুসংহত ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ অবিভক্ত স্বাধীন ভারতবর্ষের স্বপ্ন সার্থক হবার মতো পরিবেশ ও পরিস্থিতি আর সৃষ্টি হয়নি। ঘটনা প্রবাহ নিয়ন্ত্রিত করার ক্ষমতা সুভাষচন্দ্রের ছিল না। সে সুযোগও তিনি পাননি।

সকল অধ্যায়

১. দেশনায়ক – ১
২. দেশনায়ক – ২
৩. দেশনায়ক – ৩
৪. দেশনায়ক – ৪
৫. দেশনায়ক – ৫
৬. দেশনায়ক – ৬
৭. দেশনায়ক – ৭
৮. দেশনায়ক – ৮
৯. দেশনায়ক – ৯
১০. দেশনায়ক – ১০
১১. দেশনায়ক – ১১
১২. দেশনায়ক – ১২
১৩. দেশনায়ক – ১৩
১৪. দেশনায়ক – ১৪
১৫. দেশনায়ক – ১৫
১৬. দেশনায়ক – ১৬
১৭. দেশনায়ক – ১৭
১৮. দেশনায়ক – ১৮
১৯. দেশনায়ক – ১৯
২০. দেশনায়ক – ২০
২১. দেশনায়ক – ২১
২২. দেশনায়ক – ২২
২৩. দেশনায়ক – ২৩
২৪. দেশনায়ক – ২৪
২৫. দেশনায়ক – ২৫
২৬. দেশনায়ক – ২৬
২৭. দেশনায়ক – ২৭
২৮. দেশনায়ক – ২৮
২৯. দেশনায়ক – ২৯
৩০. দেশনায়ক – ৩০
৩১. দেশনায়ক – ৩১
৩২. দেশনায়ক – ৩২
৩৩. দেশনায়ক – ৩৩
৩৪. দেশনায়ক – ৩৪
৩৫. দেশনায়ক – ৩৫
৩৬. দেশনায়ক – ৩৬
৩৭. দেশনায়ক – ৩৭
৩৮. দেশনায়ক – ৩৮
৩৯. দেশনায়ক – ৩৯
৪০. দেশনায়ক – ৪০
৪১. দেশনায়ক – ৪১
৪২. দেশনায়ক – ৪২
৪৩. দেশনায়ক – ৪৩
৪৪. দেশনায়ক – ৪৪
৪৫. দেশনায়ক – ৪৫
৪৬. দেশনায়ক – ৪৬
৪৭. দেশনায়ক – ৪৭
৪৮. দেশনায়ক – ৪৮
৪৯. দেশনায়ক – ৪৯
৫০. দেশনায়ক – ৫০

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন