গান্ধীপন্থী কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের মতভেদ ও বিরোধের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল ১৯৩৫ সালে প্রবর্তিত আইন অনুসারে ব্রিটিশ ভারতীয় প্রদেশসমূহ ও দেশীয় রাজ্যগুলিকে নিয়ে কেন্দ্রে একটি ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র (Federation of India) গঠনের প্রশ্নটি। ফেডারেশন গঠনের প্রবল বিরোধী ছিলেন সুভাষচন্দ্র। তাঁর তীব্র বিরোধিতার কারণ ছিল: এই নতুন শাসন ব্যবস্থায় ভারতে প্রকৃত স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তিত হয়নি। ভাইসরয়ের হাতে অত্যধিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। অনুরূপভাবে প্রাদেশিক গভর্নরদের হাতেও বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। ভারতের সৈন্যবাহিনী নৌ-বাহিনী ও বিমান বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ছিল ভাইসরয়ের। তাঁর তিনজন উপদেষ্টাকে তিনিই নিয়োগ করবেন। প্রাদেশিক গভর্নর তাঁর ইচ্ছানুসারে প্রাদেশিক আইনসভায় গৃহীত কোনও বিলে সম্মতি বা অসম্মতি জানাতে পারবেন। মন্ত্রিসভা গঠনের বা ভেঙ্গে দেবার ক্ষমতা তাঁর থাকবে। দেশীয় রাজ্যগুলির প্রজাদের রাজনৈতিক অধিকার স্বীকৃত হয়নি। ওই রাজ্যগুলির নৃপতিরা ইচ্ছা করলে যুক্তরাষ্ট্রে যোগদান করতে পারবেন। ‘যুক্তরাষ্ট্র’-এর আর এক অত্যন্ত আপত্তিকর ও ক্ষতিকর দিক ছিল সাম্প্রদায়িক নির্বাচন ব্যবস্থা অক্ষুণ্ণ রেখে দেশের ঐক্য ও সংহতি বিঘ্নিত করা। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থায় ব্রিটিশ বণিক সম্প্রদায়ের কায়েমী স্বার্থকে অক্ষুণ্ণ রাখার শর্ত যুক্ত করা হয়। প্রধান প্রধান চাকরিগুলি লন্ডনে ভারত-সচিবের নিয়ন্ত্রণাধীন রাখা হয়।
দেশীয় রাজন্যবর্গও ‘ফেডারেল’ প্রস্তাবে আপত্তি জানান। তাঁরা ‘গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা’ (democratic freedom) প্রবর্তনের দাবি সম্পর্কে ভীত হয়ে পড়ছিলেন। কংগ্রেসের গান্ধীপন্থী নেতারাও ‘ফেডারেল’ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। তাঁরা দাবি করেন যে, প্রকৃত জনপ্রতিনিধিমূলক একটি গণ পরিষদ (Constituent Assembly) ভারতবর্ষের জন্যে একটি সংবিধান রচনা করুক। মুসলিম লীগ ফেডারেশন-এর কেন্দ্রীয় শাসন ক্ষমতার বিন্যাসে আপত্তি জানালেও প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থার অংশটুকু মেনে নিতে সম্মত হয়। এর ফলে ‘ফেডারেশন’ গঠন বা Federal Scheme পুরোপুরি কার্যকর করা স্থগিত রাখতে হয়েছিল।
সুভাষচন্দ্রের আশঙ্কা ছিল যে, ক্রমে ক্রমে ব্রিটিশ সরকার ওই ফেডারেল ব্যবস্থা প্রবর্তন করবে। স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল লক্ষ্য থেকে সরে গিয়ে কংগ্রেস আপস করার দিকে ঝুঁকবে। প্রথমে প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা গঠনে কংগ্রেস উৎসাহ প্রকাশ না করলেও, শেষপর্যন্ত কংগ্রেস প্রাদেশিক আইনসভাগুলির নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে। মোট এগারোটির মধ্যে সাতটি প্রদেশে কংগ্রেস মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। এ ছাড়া সিন্ধু ও আসামে কংগ্রেস একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং এ দু’টি প্রদেশেও কংগ্রেস মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। বাংলা ও পঞ্জাবে মুসলমানদের জন্যে নির্ধারিত আসনগুলির মধ্যে মুসলিম লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। বাংলায় মুসলিম লীগের সঙ্গে কংগ্রেস কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠনে রাজি হয়নি। ফলে ‘কৃষক প্রজা পার্টি’র ফজলুল হক মুসলিম লীগের সঙ্গে যুক্তভাবে মন্ত্রিসভা গঠন করেন। পঞ্জাবে ইউনিয়নিস্ট পার্টির সিকান্দার হায়াৎ খানের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠন করে। মুসলিম লীগ কংগ্রেসের সঙ্গে কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠনের প্রস্তাব দিলে কংগ্রেস তা প্রত্যাখ্যান করে। কংগ্রেসের বক্তব্য ছিল যে, যাদের সঙ্গে কংগ্রেসের নীতি ও আদর্শের কোনও মিল নেই তাদের সঙ্গে যৌথভাবে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয় এবং সমীচীন নয়। এর ফলে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের সম্পর্ক আরও তিক্ত হয়। হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কেরও অবনতি হয়।
সুভাষচন্দ্রের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, কোনও মতেই ‘ফেডারেল’ প্রস্তাব মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। অবিলম্বে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের উচ্ছেদের জন্যে পূর্ণ শক্তিতে প্রবল মুক্তি আন্দোলন শুরু করা প্রয়োজন। মন্ত্রিসভা গঠন করে ও কিছু সীমিত ক্ষমতা পেয়েই রক্ষণশীল কংগ্রেস নেতারা আরও বেশি আপসের মনোভাব দেখাচ্ছেন। প্রকৃত স্বাধীনতার জন্যে সংগ্রামে অবিচল না থেকে কংগ্রেসের ক্ষমতাশালী নেতারা ইংরাজদের প্রতিশ্রুতিতে আস্থাশীল হয়ে পড়ছেন। ব্রিটিশ শক্তির উচ্ছেদের জন্যে সর্বাত্মক আন্দোলনের মানসিকতা হারিয়ে ফেলার লক্ষণ দেখা দিয়েছে। এই মনোভাব ও নীতি কোনওমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। আর একটি বিরাট আন্তর্জাতিক যুদ্ধ আসন্ন। ব্রিটিশ শক্তি ওই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে। ভারতের মুক্তি আন্দোলনকে জয়যুক্ত করার জন্যে এই সুবর্ণ সুযোগ গ্রহণ করতে হবে। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ভারতবর্ষের পক্ষে অত্যন্ত অনুকূল। তার জন্যে প্রস্তুতি শুরু করতে হবে। কংগ্রেসকে আরও শক্তিশালী ও সঙ্ঘবদ্ধ করে তোলার জন্যে সুভাষচন্দ্র দেশের বিভিন্ন স্থানে সফর করে বক্তৃতা দেন। কৃষিজীবী, কারখানার শ্রমিক ও কৃষিকর্মীরা যাতে কংগ্রেসে অধিকতর সংখ্যায় যোগ দেন তার জন্যে তিনি আবেদন করেন। তিনি বলেন, কংগ্রেস ‘দরিদ্রদের মধ্যে দরিদ্রতম ব্যক্তির গৃহেও প্রবেশ করেছে’। তিনি মুসলমানদের কংগ্রেস সম্বন্ধে সন্দেহ মুক্ত হয়ে কংগ্রেসে যোগ দিয়ে এই জাতীয় দলটির পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের আহ্বান জানান। শিলং-এ এক ভাষণে (২৯ অক্টোবর, ১৯৩৮) তিনি খাসিয়া জনগণের কাছে একই আবেদন জানান। তিনি সতর্ক করে দেন যে, ব্রিটিশ সরকার ফেডারেশন চাপাবার চেষ্টা করছে, কিন্তু বিদেশীদের রচিত সংবিধান ভারতবাসী মেনে নেবে না। কংগ্রেস স্বাধীনতার জন্যে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম করে যাবে। দু’দিন পরে গৌহাটি কটন কলেজে তিনি ছাত্রদের উদ্দেশে বলেন যে, ছাত্রছাত্রীদের সভায় উপস্থিত হতে পারলে তিনি বেশি উৎসাহিত বোধ করেন। তার কারণের সরস ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন যে, এরকম সুযোগ “নিজেকে তরুণ ভাবতে সহায়তা করে—অবশ্য এমন নয় যে আমি নিজেকে বৃদ্ধ মনে করি। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি যে আমাদের এই দেশে আমাদের মাঝে মাঝেই যৌবনের ইনজেকসন দেওয়া উচিত···প্রথমেই যে কথাটি আপনাদের বলতে চাই তা হল এই যে আমরা যুগ-পরিবর্তনের এক সন্ধিক্ষণে বাস করছি—এ শুধু সন্ধিক্ষণের সময় নয়, সংগ্রামেরও সময়।”
সুভাষচন্দ্রের এই ভাষণের অন্তর্নিহিত মর্ম ছিল অত্যন্ত ইঙ্গিতপূর্ণ। তিনি অনুভব করছিলেন যে, কংগ্রেসের ক্ষমতাসীন প্রবীণ নেতারা সংগ্রামবিমুখ হয়ে উঠছেন। পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের জন্যে আর বড় কোনও আন্দোলনের পরিবর্তে শাসনতান্ত্রিক বিবর্তনের মাধ্যমে অধিকতর রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভই তাঁদের লক্ষ্য। ঘনীভূত আন্তর্জাতিক সঙ্কট ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির মধ্যে আসন্ন যুদ্ধ সম্বন্ধে তাঁরা যথেষ্ট সচেতন নন, বরং উদাসীন। এই মনোভাব ও নীতি থেকে কংগ্রেসকে মুক্ত করতে হবে। কংগ্রেসের সভাপতি পদে পুননির্বাচিত হওয়ার সিদ্ধোন্তের পিছনে এটি এক বড় কারণ ছিল। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, কংগ্রেস সভাপতি পদে তিনি বা সম-মনোভাবাপন্ন কেউ নিবাচিত না হলে কংগ্রেসের নীতি ও কর্মসূচীর বৈপ্লবিক পরিবর্তন অসম্ভব। স্বভাবতই গান্ধীজি ও তাঁর অনুগত নেতৃবৃন্দের কাছে সভাপতি রূপে সুভাষচন্দ্র আর গ্রহণযোগ্য ছিলেন না। তাঁরা মনস্থির করেন যে, ত্রিপুরীতে কংগ্রেস অধিবেশনে সুভাষচন্দ্রকে সভাপতি পদে পুননির্বাচিত করার প্রস্তাবের বিরোধিতা করবেন।
ত্রিপুরী কংগ্রেস ও তার পরবর্তী নাটকীয় ঘটনাপ্রবাহ আলোচনার পূর্বে অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ উল্লেখ করা প্রয়োজন। হরিপুরা কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার (১৯৩৮) প্রায় এক দশক পূর্ব থেকেই সুভাষচন্দ্র জাতীয় কংগ্রেস ও সর্বভারতীয় রাজনীতিতে খুব দ্রুত একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতারূপে স্বীকৃতি এবং মর্যাদা অর্জন করেছিলেন। ১৯৩৩ সালে ইউরোপে প্রবাস জীবনের সূচনা থেকেই সুভাষচন্দ্র ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক নিরলস, আপসহীন ও জনপ্রিয় নেতারূপে আন্তর্জাতিক (বিশেষ করে ইউরোপে) পরিচিতি অর্জন করেছিলেন। ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রধান শত্রুরূপে তিনি ইংরাজ সরকার, প্রশাসন ও পুলিশের কাছে চিহ্নিত হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর কর্মক্ষেত্র সর্বভারতীয় হলেও সুভাষচন্দ্রের প্রধান পরিচিতি ছিল তিনি একজন ‘বাঙালি’ ও ‘বাংলার নেতা’। বাংলার ছাত্র-যুবসমাজের কাছে তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয়। গান্ধীজি ও অন্যান্য কংগ্রেসী নেতারাও সাধারণত সুভাষচন্দ্রকে বাংলার নেতারূপে উল্লেখ করতেন। সুভাষচন্দ্রের নিজের কথাবার্তায়, ভাষণে ও লেখায় বাংলার কথা, বাংলার সমস্যা ও বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষার উল্লেখ অনেক বেশি থাকত। বাংলার রাজনীতির সঙ্গে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। কংগ্রেস সভাপতি হওয়ার পরেও সুভাষচন্দ্র বাংলার রাজনীতি থেকে নির্লিপ্ত থাকার চেষ্টা করেননি বা দূরত্ব রাখেননি। কংগ্রেস সভাপতি—‘রাষ্ট্রপতি’ সুভাষচন্দ্রের কর্মক্ষমতা, শক্তি এবং অমূল্য সময়ের অনেকখানি ব্যয়িত হয়েছিল কলকাতা এবং বাংলার সমস্যা এবং রাজনীতিতে।
কংগ্রেস সভাপতি হওয়ার পরেও সুভাষচন্দ্র বাংলা প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি পদে ছিলেন। এ ছাড়াও তিনি কলকাতা কর্পোরেশনের অলডারম্যান এবং কলকাতা মিউনিসিপাল অ্যাসোসিয়েশনের নেতারূপে পৌরশাসন ব্যবস্থার সংস্কার ও উন্নতির জন্যে সক্রিয় ছিলেন। কিন্তু এই কাজে তাঁর অভিজ্ঞতা সুখকর হয়নি। কর্পোরেশনের শিক্ষাধিকারিককে কেন্দ্র করে এক অপ্রীতিকর বিতর্কে তিনি জড়িত হয়ে পড়েন। কংগ্রেস মিউনিসিপ্যাল অ্যাসোসিয়েশন থেকে তিনি পদত্যাগ করেন। কর্পোরেশনের পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর বিবৃতি (৫ জুলাই, ১৯৩৮) থেকে বোঝা যায় যে, তিনি কতখানি হতাশ ও বিক্ষুব্ধ হয়েছিলেন কংগ্রেস মিউনিসিপ্যাল অ্যাসোসিয়েশনের অভ্যন্তরীণ পরিবেশে। তাঁর পক্ষে কলকাতা পৌরসভার আবিল রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকা সমীচীন হয়নি। বাংলায় মুসলিম লীগের সঙ্গে কংগ্রেস কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠন করতে সম্মত না হওয়ায় কৃষক প্রজা পার্টির ফজলুল হক মুসলিম লীগের সঙ্গে যুক্তভাবে মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন। বাংলার ‘পঞ্চ প্রধান’-এর অন্যতম, নলিনীরঞ্জন সরকার ফজলুল হক মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রী হন। কংগ্রেসের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছেদ হলেও তিনি গান্ধীজির বিশ্বস্ত কাছের মানুষ এবং সুভাষচন্দ্রের ঘোর বিরোধী ছিলেন। ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় গান্ধীজি ও নেহরু পরিবারের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বাংলার রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে গান্ধী-সমর্থক রূপে চিহ্নিত হন। ফজলুল হক মন্ত্রিসভার নীতি ও কার্যকলাপ সুভাষচন্দ্রের দৃষ্টিতে ক্রমেই সাম্প্রদায়িক দোষদুষ্ট বলে মনে হচ্ছিল। ফজলুল হক মুসলিম লীগের ক্রীড়নকে পরিণত হচ্ছিলেন। হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, এমনকি কৃষক প্রজা পার্টির অনেকে অভিযোগ করেন যে, ফজলুল হক মন্ত্রিসভা নিজেদের স্বার্থে সাম্প্রদায়িকতার বৃদ্ধিতে ইন্ধন যোগাচ্ছে। মুসলমান মন্ত্রিসভা বলেই কংগ্রেস ওই সরকারের উচ্ছেদ চায়, এই অভিযোগের উত্তরে সুভাষচন্দ্র বলেন যে, এই ধারণা সম্পূর্ণ মিথ্যা। “আমি বাংলার মন্ত্রীসভাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছি···তাঁরা এগারোজন মুসলমান মন্ত্রী নিয়ে মন্ত্রীসভা পুনর্গঠন করুন। তাঁরা যদি যোগ্য ও দেশপ্রেমী ভদ্রলোক হন, তবে কংগ্রেস তাঁদের বিরুদ্ধে একটি কথাও বলবে না। যে বিষয়ে আপত্তি তা হল এই যে, মন্ত্রীসভায় যোগ্যতা ও দেশপ্রেমের অভাব। আমি আরও অগ্রসর হয়ে বলব যে, যদি এগারো জন অযোগ্য হিন্দুকেও মন্ত্রী করা হয় তাহলেও কংগ্রেসের বিরোধিতা কিছুমাত্র কমবে না। কংগ্রেস হিন্দু ও মুসলমানকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখে না!” লিওনার্ড গর্ডন লিখেছেন, শরশ্চন্দ্র ও সুভাষচন্দ্র মুসলিম লীগ ও কৃষক প্রজা পার্টির মন্ত্রিসভার পতন ঘটিয়ে কংগ্রেস-কৃষক প্রজা পার্টি-তপশীল সম্প্রদায়ের সংযুক্ত মন্ত্রিসভা গঠনের কথা চিন্তা করেছিলেন। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা ও অন্যান্য প্রশ্নে তা কার্যকর হয়নি। বিশেষ করে গান্ধীজি এই প্রস্তাব সমর্থন করেননি। তাঁর সিদ্ধান্ত নলিনীরঞ্জন সরকার এবং ঘনশ্যাম দাস বিড়লার সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের দ্বারা অনেকটা প্রভাবিত হয়েছিল। তা ছাড়া মৌলানা আজাদও ওই প্রস্তাবের বিরোধী। ছিলেন। অমলেশ ত্রিপাঠী কিন্তু লিখেছেন যে, গান্ধীজির কংগ্রেস-ফজলুল হক দলের কোয়ালিশনে আপত্তি ছিল না। সুভাষচন্দ্র যে গান্ধীজির মনোভাবে খুবই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। লিওনার্ড গর্ডন বিশ্লেষণ করেছেন যে রক্ষণশীল গান্ধীপন্থীরা খুব সঙ্কীর্ণতার পরিচয় দিয়ে সুভাষচন্দ্রের বিরোধিতা করেছিলেন। একাধারে কংগ্রেস সভাপতি ও বাংলা প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি হলেও গান্ধীপন্থীদের কাছে তিনি প্রায় একজন বহিরাগতদের মতো ব্যবহার পাচ্ছিলেন।
দক্ষিণপন্থী গান্ধী-অনুগত কংগ্রেসী নেতাদের ওপর সুভাষচন্দ্র কতখানি ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন তা প্রকাশ পায় কলকাতায় এক জনসভায় (১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৮)। তিনি বলেন যে, বাংলার বর্তমান পরিস্থিতির একটি ‘কলঙ্কজনক’ ঘটনা হল কংগ্রেসের মধ্যে এমন লোক আছেন যাঁরা বর্তমান মন্ত্রিসভার পতন চান না। তিনি ওই মনোভাবাপন্নদের সতর্ক করে বলেন, “বর্তমানে জাতীয় আন্দোলন এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছেছে যখন কংগ্রেসসেবীদের আর শুধু অতীতের সেবা ও লাঞ্ছনা-ভোগের রেকর্ড নিয়ে অহংকার করলে চলবে না···যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে না চলতে পারলে দেশ তাঁদের সহ্য করবে না।” সুভাষচন্দ্রের মনে কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ অবস্থা সম্পর্কে যে অসহিষ্ণুতা দেখা দিচ্ছিল তা তিনি ব্যক্ত না করে পারেননি। তিনি বলেন যে, রাজনীতির প্রাথমিক নীতি ‘যিনি আমাদের সঙ্গে নন তিনি আমাদের বিরোধী’—এটা ভোলা সম্ভব নয়। যাঁরা প্রগতিশীল হতে পারবেন না এবং প্রতিক্রিয়াশীলদের সঙ্গে সমঝোতা রেখে চলবেন তাঁদের জনগণ কোনও প্রকারে সহ্য করবেন না। যতই বেদনাদায়ক হোক না কেন তাঁদের পরিত্যাগ করতে হবে। পরিশেষে তিনি বাংলার স্বার্থ-বিরোধীদের লক্ষ্য করে সরাসরি বলেন, “নিজেদের এখানকার কুকীর্তির পাপ ক্ষালনের জন্যে কিছু লোকের ওয়ার্ধার নিকটবর্তী একটি স্থানে রাজনৈতিক তীর্থযাত্রায় যাওয়া একটা রেওয়াজ হয়ে উঠেছে। আমি এই ধরনের লোকদের নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে, তাঁরা যদি ভেবে থাকেন যে অন্যত্র অন্যায় ভিক্ষে করে তাঁরা তাঁদের কুকীর্তির দরুন নিন্দা এড়াতে পারবেন তাহলে তাঁরা ভুল করবেন। আমি যতদিন কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটিতে থাকব ততদিন অন্তত এই সব কলা-কৌশলে কোনও কাজ হবে না।”
সুভাষচন্দ্রের কংগ্রেস সভাপতি পদে পুনর্নির্বাচন যে প্রাচীন দক্ষিণপন্থীর কোনওক্রমেই সমর্থন করবেন না তা বুঝতে অসুবিধা ছিল না। ১৯৩৮ সালের শেষ দিক থেকে ত্রিপুরী কংগ্রেসের অধিবেশন এবং তার অব্যবহিত পরের ঘটনায় প্রকাশ পেয়েছিল গান্ধী-সুভাষ বিরোধ কতটা গভীরে পৌঁছেছিল। অমলেশ ত্রিপাঠী লিখেছেন, “অবশ্যই ১৯৩৯-এর জানুয়ারিতে সুভাষ গান্ধীর ওপর রেগেছিলেন।···গান্ধীর খুশি হবার কথা নয়।” কেন গান্ধীজি সুভাষচন্দ্রের ওপর অখুশি হয়েছিলেন তার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অমলেশ ত্রিপাঠী কার্যত সুভাষচন্দ্রকেই মূলত দায়ী করেছেন। কারণ: ফেডারেশনের ব্যাপারে দক্ষিণপন্থীদের বিরুদ্ধে সুভাষচন্দ্রের সন্দেহ ও অভিযোগ ছিল ‘অমূলক’। গান্ধীজিকে সুভাষচন্দ্র বৃদ্ধ, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে অজ্ঞ, গণ-আন্দোলনের নেতৃত্ব দেবার অনুপযুক্ত (অনিচ্ছুক তো বটেই) মনে করেছিলেন। এই দু’টিই সুভাষচন্দ্রের ‘অমার্জনীয়’ ভুল বলে ত্রিপাঠী মনে করেন। ১৯৩৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সুভাষচন্দ্র ওয়ার্ধায় গান্ধীজির আশ্রমে তাঁর সঙ্গে দেখা করে সমস্যা ও মতভেদ মিটিয়ে নেবার চেষ্টা করেন। কিন্তু ওই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এই ব্যাপারটা ‘ভদ্রভাবে মিটিয়ে না নেওয়ার’ জন্যেও তিনি সুভাষচন্দ্রের সমালোচনা করেছেন। সুভাষচন্দ্রের আর একটি ভূলের উল্লেখ করেছেন অধ্যাপক ত্রিপাঠী। সেটি হল বামপন্থীদের সাহায্যের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা। সুভাষচন্দ্রের নিজের কোনও সংগঠন ছিল না এবং তা গড়ার চেষ্টাও তিনি তেমন করেননি। ত্রিপাঠীর মতে “আপন Charisma সম্বন্ধে এমন উচ্চ ধারণা পোষণ করা উচিত হয়নি।”
অমলেশ ত্রিপাঠীর গান্ধী-সুভাষ বিরোধ সম্বন্ধে বিশ্লেষণে গান্ধীজির প্রতি পক্ষপাত সুস্পষ্ট। গান্ধীজি আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে অজ্ঞ না হলেও তাঁর ধ্যানধারণা যে অস্পষ্ট ও অবান্তর ছিল তা মনে করা ভুল নয়। তা না হলে নাৎসী জার্মানীর সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর গান্ধীজি ব্রিটেনের সব মানুষের কাছে খোলা চিঠিতে উপদেশ দিতেন না: “আমি চাই নাৎসীদের সঙ্গে আপনারা বিনা অস্ত্রে লড়ন···অহিংস অস্ত্র নিয়ে লড়ন। আমি চাই—যে অস্ত্র আপনাদের হাতে আছে তা আপনারা ত্যাগ করুন; কারণ ঐ অস্ত্র দিয়ে তো আপনারা নিজেদের বা মনুষ্যজাতিকে রক্ষা করতে পারছেন না। আপনারা হের হিটলার ও সিনর মুসোলিনীকে আমন্ত্রণ করুন; যে-সব দেশ আপনারা বলেন আপনাদের অধিকারে সে-সব দেশ থেকে ওরা যা নিতে চায় তা ওদের নিতে দিন। সুন্দর সুন্দর সব ঘর-বাড়ি সমেত আপনাদের সুন্দর দ্বীপটির দখলও ওদের নিতে দিন। আপনারা এ-সব কিছুই দেবেন, কিন্তু যা দেবেন না তা হল আপনাদের আত্মা, আপনাদের মন···।” হিটলারের সঙ্গে মরণ-পণ যুদ্ধের মাঝখানে মহাত্মা গান্ধীর এই চিঠি ব্রিটিশ জনগণের মনে কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায়। গান্ধীজি যে, ১৯৩৮-১৯৩৯ সালে নতুন উদ্যমে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে কোনও গণ-আন্দোলন শুরু করতেই একেবারে ইচ্ছুক ছিলেন না, আসন্ন বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধাচারণ করা তো দূরের কথা—সহানুভূতি এবং সহযোগিতা করতে প্রস্তুত ছিলেন এটা অনস্বীকার্য, তাঁর এই মনোভাব ও নীতির পরিবর্তন এসেছিল পরে। সুভাষচন্দ্র তখন কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত। স্বদেশ ত্যাগ করে বিদেশে চলে গিয়েছেন তাঁর পরিকল্পনা মতো ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অর্জনের জন্যে চূড়ান্ত আঘাত হানতে। এই পটভূমি ও পরিপ্রেক্ষিতে সুভাষচন্দ্রের পক্ষে গান্ধীজির সঙ্গে মৌলিক প্রশ্নগুলিতে কোনও ঐকমত্যে পৌঁছন অসম্ভব ছিল। আর একটি কথাও স্মরণ রাখা প্রয়োজন। গান্ধীজি আপাতদৃষ্টিতে নরম, নমনীয় এবং আলোচনার ভিত্তিতে সব সমস্যার মীমাংসা করতে সদাপ্রস্তুত বলে মনে হলেও তিনি নিজের বক্তব্য ও বিশ্বাস সম্বন্ধে অনমনীয় ছিলেন। সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করায় তাঁর আগ্রহ থাকলেও নিজের মূল নীতি ও বিশ্বাস থেকে তিনি এতটুকু সরে যেতে প্রস্তুত ছিলেন না। অন্যদিকে, সুভাষচন্দ্রও ছিলেন নিজের মত ও পথ সম্বন্ধে আত্মবিশ্বাসী ও অটল। পারস্পরিক ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা ও প্রীতি যতই থাকুক কেন (যা সুভাষচন্দ্রের প্রথমে কংগ্রেস ও পরে দেশত্যাগের পরও অটুট ছিল), গান্ধী-সুভাষ মতানৈক্য ও বিরোধের অবসানের প্রকৃত কোনও সম্ভাবনা প্রথম থেকেই ছিল না। হয়তো একে ইতিহাসের অপ্রতিরোধ্য ধারা বা নিয়তি বলা যায়।
অনেকের এমন ধারণাও হয়েছিল (যা এখনও কেউ কেউ ব্যক্ত করেছেন) যে, সুভাষচন্দ্র চেষ্টা করেছিলেন গান্ধীজি ও ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের সঙ্গে হৃদ্যতা ও সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তুলতে। এই বক্তব্য ভুল নয়। কিন্তু সুভাষচন্দ্র চেয়েছিলেন সহযোগিতা করতে, সহমত গড়ে তুলতে। কিন্তু আত্মসমর্পণ করতে নয়। যদি তাই করতেন তাহলে তিনি সহজেই সভাপতি পদে পুনর্নির্বাচিত হতেন।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন