দেশনায়ক – ৫০

সুভাষচন্দ্র ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিদেশী শক্তির সহযোগিতা ও সাহায্য গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলে অনেকেই তাঁর সমালোচনা করেছিলেন। কংগ্রেসের একাধিক বিশিষ্ট নেতা ও কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যরা শুধু তাঁর নীতি ও সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনাই নয়, সুভাষচন্দ্র সম্বন্ধে কটু মন্তব্য করতে দ্বিধা করেননি। এঁদের মধ্যে ছিলেন জওহরলাল নেহরু। গান্ধীজি ও জওহরলাল দু’জনেই মিত্রশক্তির জয় কামনা করেছিলেন কেননা তাঁরা ফ্যাসিস্ট ইতালী ও নাৎসী জার্মানীর বিরোধী ছিলেন। তাঁদের সহানুভূতি ছিল মিত্রশক্তির দিকে। তাঁদের সুস্পষ্ট অভিমত ছিল যে ব্রিটেনের ওই সঙ্কটকালে কোনও গণ-আন্দোলন করা সমীচীন হবে না। সুভাষচন্দ্রের মনোভাব ও নীতি এর সম্পূর্ণ বিরোধী ছিল। তা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথমে জার্মানী এবং পরে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে বেতার ভাষণে ও বক্তৃতায় সুভাষচন্দ্র নিরন্তর কংগ্রেসের আপস নীতি গ্রহণের আশঙ্কা ও তার ক্ষতিকর ফলাফলের কথা বলায় কংগ্রেস নেতারা আরও রুষ্ট হয়েছিলেন। সুভাষচন্দ্র এই সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন ছিলেন। কেন তিনি জার্মানী ও জাপানের সহযোগিতা নেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, কেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ভারতবর্ষের সামনে এক সুবর্ণ সুযোগ এনে দিয়েছে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন তা তিনি বহুবার ব্যাখ্যা করেছিলেন। নাৎসী জার্মানীর কঠোর সমালোচনা এবং চীন ও অন্যান্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির প্রতি জাপানের আগ্রাসী নীতির নিন্দা তিনি খোলাখুলিভাবে করেছিলেন।

যখন জাপানের পরাজয় সুনিশ্চিত এবং ভারতবর্ষে জাতীয় কংগ্রেস আন্দোলনের পথ সম্পূর্ণ বর্জন করে ইংরাজদের সঙ্গে আপস-মীমাংসার পথ বেছে নিতে প্রায় মনস্থ করেছে তখন সিঙ্গাপুর থেকে প্রচারিত একটি ভাষণে (২৬ জুন, ১৯৪৫) তিনি জাপানের সহযোগিতা কেন নিয়েছেন তা ব্যাখ্যা করেছিলেন। সুভাষচন্দ্র ওই ভাষণে বলেন যে, জাপানের সহযোগিতা নেবার জন্যে তিনি লজ্জিত নন। জাপান ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা মেনে নেবে এই শর্তেই জাপানের সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তাঁর অস্থায়ী সরকারকে জাপান ইতিমধ্যেই স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু ব্রিটেন ভারতের স্বাধীনতা স্বীকার করবে এমন কোনও প্রতিশ্রুতি দেয়নি। তবু কংগ্রেস নেতারা সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের সঙ্গে আপস করতে প্রস্তুত। তিনি সগর্বে বলেন, “আজাদ হিন্দ ফৌজ নামে অভিহিত এই বাহিনী ভারতীয় শিক্ষকদের দ্বারা ভারতীয় ভাষায় শিক্ষাপ্রাপ্ত। এই বাহিনী ভারতীয় জাতীয় পতাকা বহন করে এবং এর ধ্বনিগুলিও ভারতের জাতীয় ধ্বনি। এই বাহিনীর নিজস্ব ভারতীয় সেনাধিনায়কগণ রয়েছেন এবং সম্পূর্ণরূপে ভারতীয়দের পরিচালিত নিজস্ব অফিসার প্রশিক্ষণ বিদ্যালয়ও আছে।” যদি এই বাহিনীকে কেউ ‘পুতুল বাহিনী’ বলেন তাহলে তাঁর ওই আখ্যা ব্রিটিশ-ভারতীয় বাহিনীকেই দেওয়া উচিত। কেননা ওই বাহিনী ব্রিটিশ অফিসারদের অধীনে ব্রিটেনের সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ করছে। তিনি বলেন যে, ভারতের স্বার্থে যদি বাঞ্ছনীয় হয় তাহলে অন্য যে কোনও শক্তির সাহায্য তিনি নিতে কুণ্ঠিত হবেন না। “আমরা যদি কোনওপ্রকার বৈদেশিক সাহায্য ছাড়াই ভারতের স্বাধীনতা অর্জন করতে পারতাম তা হলে আমার অপেক্ষা অধিকতর সুখী কেউ হত না। কিন্তু আমার এখনো আধুনিক ইতিহাসে এরূপ একটি দৃষ্টান্ত পাওয়া বাকি আছে যেখানে একটি দাসত্ব-শৃঙ্খলিত জাতি কোনও প্রকার বৈদেশিক সাহায্য না নিয়ে মুক্তি অর্জন করেছে।”

সুভাষচন্দ্র গভীর ক্ষোভ ও দুঃখের সঙ্গে সংবাদ পাচ্ছিলেন ও লক্ষ্য করছিলেন কীভাবে শীর্ষস্থানীয় কংগ্রেস নেতারা এবং অন্যান্য কিছু রাজনৈতিক নেতারা তাঁর এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ অপপ্রচার ও কুৎসার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাঁদের নিন্দা করছিলেন। ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে স্বাধীনতার দাবির প্রশ্নে তাঁরা আপস করতে উদ্যোগী হচ্ছিলেন। তাঁর স্বভাব-বিরুদ্ধ ক্ষোভ ও তিক্ততার সঙ্গে সুভাষচন্দ্র বলেন, “আমি যদি এখানে আরাম কেদারায় বসে রাজনীতি করতাম তাহলে আমি মুখ খুলতাম না এবং আপনাদের একটি কথাও বলতাম না। এখানে আমার কমরেডরা ও আমি কঠিন সংগ্রামে নিযুক্ত। রণাঙ্গনে আমাদের কমরেডদের মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে হয়…শত্রুর নিষ্ঠুর বোমাবর্ষণ ও মেশিনগানের গুলিবর্ষণের ফলে আমার বহু কমরেডকে আমি নিহত, বিকলাঙ্গ ও আহত হতে দেখেছি। রেঙ্গুনে আজাদ হিন্দ হাসপাতালকে আমি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে দেখেছি…যেহেতু আমরা বেঁচে আছি, কাজ করছি ও মৃত্যুর মুখে সংগ্রাম করছি সেই হেতু আপনাদের কাছে কথা বলবার ও আপনাদের উপদেশ দেবার অধিকার আমার আছে। বোমাবর্ষণ কী বস্তু তা আপনাদের অধিকাংশই জানেন না। নীচে উড়ন্ত বোমারু বিমান ও ফাইটার থেকে মেশিনগানের গুলিবিদ্ধ হওয়া কী বস্তু তা আপনাদের অধিকাংশ জানেন না। আপনাদের দক্ষিণে ও বামে শিস দিয়ে বুলেট চলে যাওয়া কী বস্তু তার অভিজ্ঞতা আপনাদের অধিকাংশের নেই।” পরিশেষে তিনি তাঁর গভীর আশা ও বিশ্বাস পুনরায় ঘোষণা করে বলেন, “ব্যর্থতায় যিনি বিষণ্ণ হয়ে ওঠেন তিনি বিপ্লবী নন। বিপ্লবীর মন্ত্র সর্বোত্তমের আশা করা কিন্তু চরম দুর্যোগের জন্যে প্রস্তুত থাকা…আমরা যদি যুদ্ধ করে চলি ও আন্তজাতিক ক্ষেত্রে কূটনৈতিক চাল ভাল করে প্রয়োগ করতে পারি, আমরা এই যুদ্ধের শেষে স্বাধীনতা অর্জন করব।”

সুভাষচন্দ্রের ক্ষোভ ও তিক্ততার সঙ্গে অভিমান মিশ্রিত ছিল। গান্ধীজি, জওহরলাল ও অন্যান্য কংগ্রেস নেতারা তাঁকে কংগ্রেস সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য করেছিলেন এবং শেষপর্যন্ত বহিস্কৃত করেছিলেন। তাঁদের সঙ্গে মতবিরোধ তীব্রতর ও তিক্ত হলেও সুভাষচন্দ্র তাঁদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তিরিশের দশকে এবং পরবর্তীকালে গান্ধীজি ও অন্য কংগ্রেস নেতাদের বিরুদ্ধে অসৌজন্যমূলক কোনও মন্তব্য ইউরোপে শুনলে বা পড়লে তিনি তাঁর প্রতিবাদ করতেন। আজাদ হিন্দ ফৌজের চারটি ব্রিগেডের তিনটির তিনি নামকরণ করেছিলেন গান্ধী, নেহরু ও মৌলানা আজাদের নামে। নিজের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও সেনাবাহিনীর ইচ্ছানুসারে অপরটির নামকরণ হয়েছিল সুভাষ ব্রিগেড। কিন্তু কংগ্রেস নেতারা তাঁর বিরুদ্ধে অত্যন্ত আপত্তিকর মন্তব্য প্রকাশ্যে করতে দ্বিধা করেননি। ব্রিটিশ অপপ্রচারে তাঁরা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করেছিলেন। ভারতের কমিউনিস্টদের মতো অতটা কুৎসা না করলেও তাঁদের নেতাজি-বিরোধিতার তীব্রতা কম ছিল না। দিল্লিতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে (১২ এপ্রিল, ১৯৪২) জওহরলাল বলেছিলেন যে, সুভাষচন্দ্র যদি কখনও তাঁর মুক্তি বাহিনী নিয়ে ভারতের দিকে অগ্রসর হন তাহলে তিনি তাঁর বিরোধিতা করবেন। কেননা তাঁর মতে সুভাষচন্দ্রের বাহিনী বস্তুত জাপানের হাতের ‘পুতুল’ ছাড়া কিছু নয় (‘a dummy force under Japanese control’)। গান্ধীজিও বলেছিলেন, “ঘটনা হল, আমি বিশ্বাস করি যে আমাদের সুভাষ বসু’কে ঠেকাতেই হবে (In fact, I believe that Subhas Bose will have to be resisted by us)।”

স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে ১৯৩৯ সালে ত্রিপুরী কংগ্রেসের সময় ও তার অব্যবহিত পরে গান্ধীজি, জওহরলাল ও প্রবীণ কংগ্রেস নেতারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জনিত পরিস্থিতিতে কোনও ব্রিটিশ শাসন-বিরোধী আন্দোলন (অহিংস সত্যাগ্রহ পর্যন্ত) করতে অসম্মত হলেও সুভাষচন্দ্রের দেশ ছাড়ার (জানুয়ারি ১৯৪১) মাত্র দেড় বছরের মধ্যে ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আন্দোলনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় গান্ধীজিই বলেছিলেন যে, ইংরেজরা ভারত ছেড়ে গেলেই জাপানীরা ভারত আক্রমণ করবে তা বলা যায় না। কেননা জাপানের সঙ্গে আমাদের কোনও বিরোধ নেই। উল্লেখ্য যে, ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ও তৎকালীন বাংলার গভর্নর জন হার্বাটকে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক সমস্যা প্রসঙ্গে লিখেছিলেন (১৬ নভেম্বর, ১৯৪২) যে, অবিলম্বে ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা দেওয়া উচিত, কেননা, “স্বাধীনতার জন্যে মানুষের মৃত্যু বরণের আগেই স্বাধীনতা পেয়ে যাওয়া উচিত মানুষের। স্বাধীনতাকামী এবং বিদেশী শাসনের অবসানকামী মানুষকে অপরাধী হিসাবে গণ্য করাটাই অপরাধ।” এরপর শ্যামাপ্রসাদ যা বলেন তার সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের বক্তব্য ও দাবির খুব বেশি মৌলিক পার্থক্য ছিল না। “কেন ভারতবাসীরা জাপানকে নিজের দেশে আমন্ত্রণ জানাতে উদগ্রীব হবে? আমরা চাইছি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিরাপদে আপনারা দেশে ফিরে যান। সেক্ষেত্রে আবার নতুন একটা শক্তিকে স্বাগত জানাবার প্রশ্ন আসে কোথা থেকে? আমরা বিদেশী শাসন থেকে পুরোপুরি মুক্তি চাই। আমরা চাই এদেশ আমাদের হোক, এদেশ আমাদের দ্বারা শাসিত হোক।… যদি আপনারা সত্যিই চান যে বিশ্ব-ব্যবস্থার মধ্যে একটা পরিবর্তন আসুক, মানুষের স্বাধীনতা পদদলিত না হোক তাহলে আপনারা কেন ভারত পরিত্যাগে দ্বিধা বোধ করে শয়তান হিসাবে অভিযুক্ত হওয়া থেকে বাঁচাচ্ছেন না নিজেদের? যা উচিত এবং স্বাভাবিক তা না করে গত তিন মাস ধরে আপনারা অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছেন। আপনাদের এই অত্যাচার স্বৈরাচারী শাসনের নিদর্শন…একটা ভয়ানক ইঙ্গিত হচ্ছে। আজ মানুষ এতটা হতাশ যে তারা এই অপশাসন থেকে মুক্তি পেতে যে কোনও রকম পরিবর্তনকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত।”

১৯৪২ সালের মাঝামাঝি গান্ধীজি ও কংগ্রেস নেতারা যা বুঝেছিলেন ও দাবি করেছিলেন, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও হিন্দু মহাসভা যা বুঝেছিলেন এবং চেয়েছিলেন তা সুভাষচন্দ্র উপলব্ধি ও দাবি করেছিলেন তিন বছর পূর্বে। তিনি নাৎসীদের ‘দানব’ বলেছিলেন। জাপানের আগ্রাসী নীতির তীব্র সমালোচনা করেছিলেন বহু পূর্বেই। কিন্তু গান্ধীজি ও কংগ্রেস যখন কোনওমতেই দেশব্যাপী সত্যাগ্রহ আন্দোলন করতেও অসম্মত হন তখন গত্যন্তর না দেখে তিনি দেশের বাইরে থেকে সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নেন। জার্মানী ও জাপানের “ক্রীড়নক” তিনি ছিলেন না। বার্লিন ও টোকিওতে বসে হিটলার ও তোজোকে তিনি খুব স্পষ্টভাবে জানিয়েছিলেন যে তিনি তাঁদের সহযোগিতা এবং সাহায্য চান সম-মর্যাদার ভিত্তিতে। ব্রিটিশ শাসনের পরিবর্তে অন্য কোনও বিদেশী শাসন বা নিয়ন্ত্রণ তিনি চান না। সে রকম কোনও পরোক্ষ প্রচেষ্টারও তিনি বিরোধিতা করবেন। আশ্চর্যের ও দুঃখের বিষয় হল যে, গান্ধীজি ও জওহরলাল, যাঁরা সুভাষচন্দ্রের স্বদেশপ্রেম, ভারতের স্বাধীনতার জন্যে তাঁর সর্বপ্রকার নিপীড়ন সহ্য করা এবং আত্মত্যাগের কথা খুব ভালভাবে জেনেও তাঁরা ব্রিটিশ প্রচারে বিভ্রান্ত হয়েছিলেন।

গান্ধীজি, নেহরু ও অন্যান্য কংগ্রেসী এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা তাঁদের বিরাট ভুল উপলব্ধি করেছিলেন যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর বিভিন্ন সূত্রে নেতাজি সুভাষচন্দ্র ও আজাদ হিন্দ বাহিনীর প্রকৃত কার্যকলাপ, গৌরবোজ্জ্বল বীরত্ব ও আত্মত্যাগের কাহিনী ভারতবর্ষের মানুষ জানতে শুরু করে। কমিউনিস্টদের ভুল ভাঙতে ও তা স্বীকার করতে আরও দীর্ঘ সময় লেগেছিল। নেতাজী ও INA-র কাহিনী সমগ্র দেশকে বিস্মিত, চমৎকৃত ও শ্রদ্ধায় এবং গর্বে অভিভূত করে। INA-র তিনজন অফিসার— শাহ নওয়াজ, প্রেম সেগল ও গুরুবক্স সিং ধীলন-এর দিল্লির লাল কেল্লায় রাজদ্রোহের অভিযোগে বিচার (Trial) বা কোর্ট মাশাল (Court Martial) শুরু হওয়ার পর (নভেম্বর, ১৯৪৫)। এই তিন INA সেনাপ্রধানের প্রকাশ্য-বিচারের সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্রিটিশ সরকার এক বিরাট রাজনৈতিক ভুল করেছিল। বিদেশে আজাদ হিন্দ ফৌজের কীর্তিকাহিনী এতদিন পর্যন্ত ক্ষীণ স্রোতের মতো মানুষের মধ্যে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছিল। শাহ নওয়াজ, সেগল ও ধীলনের বিচারের সিদ্ধান্ত ঘোষিত হওয়ার পর এবং বিচার শুরু হলে তা প্লাবনের রূপ ধারণ করে, জনগণের মনে এর প্রতিক্রিয়া হয় এক বিরাট বিস্ফোরণের মতো। ওই তিনজনের বিচারের এক অন্য দিক ছিল। ব্রিটিশ সরকার ও সামরিক কর্তৃপক্ষ সেটা চিন্তা করেনি। এঁদের একজন ছিলেন মুসলমান, একজন হিন্দু ও অন্যজন শিখ। এর ফলে ভারতবর্ষের তিনটি প্রধান ধর্মাবলম্বী মানুষই এই বিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে কিছুটা ধর্মীয় আবেগের দ্বারা তাড়িত হয়েছিলেন। কিন্তু অবশ্যই দেশব্যাপী যে ক্ষোভ ও স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের ঝড় উঠেছিল তার চরিত্র ছিল রাজনৈতিক। মাতৃভূমির মুক্তির জন্যে যে বীর সেনানীরা নিজেদের রক্ত দিয়ে সংগ্রাম করেছেন তাঁদের বিচার করছে বিদেশী ইংরাজ শাসকরা। এই চিন্তা ও দৃশ্য অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। নেতাজি সুভাষের নাম আসমুদ্রহিমাচল ভারতবর্ষের মানুষের কাছে দেশপ্রেম, শৌর্য ও আত্মত্যাগের শ্রেষ্ঠ প্রতীকে পরিণত হয়। ‘নেতাজি জিন্দাবাদ’, ‘চলো দিল্লী’, ‘জয় হিন্দ’ প্রভৃতি ধ্বনিতে সারা দেশ মুখরিত হয়। তৎকালীন অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি সম্পর্কে ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকার সম্পাদক আয়ান স্টিফেন্স (Ian Stephens) মন্তব্য করেছিলেন, “আজ যদি কলকাতার ময়দানে সুভাষ অবতরণ করেন তা হলে সমগ্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এখনি ভেঙে পড়বে (If Subhas is dropped on the Calcutta Maidan today, whole British Empire wil collapse immediately.)।” অনুমানটি যে ভুল ছিল না তা অল্পদিনের মধ্যেই প্রমাণিত হয়েছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ সরকারের ভারত-নীতির গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হয়। ১৯৪৫-এর ব্রিটিশ সাধারণ নির্বাচনে শ্রমিক দলের (Labour Party) জয় হয়। উইন্সটন চার্চিলের রক্ষণশীল মন্ত্রিসভার পরিবর্তে ক্লেমেন্ট এ্যাটলি-র (Clement Attlee) শ্রমিক মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। শ্রমিক দল সাধারণভাবে ভারতীয়দের রাজনৈতিক দাবির প্রতি তুলনামূলকভাবে বেশি সহানুভূতিশীল ছিল। এর পিছনে অনেকগুলি কারণ ছিল যা পরে আরও পরিস্ফুট হয়েছিল। ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার সঙ্গে পরামর্শের পর ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেল ঘোষণা করেন (১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৫) যে শীঘ্রই কেন্দ্র ও প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। একটি নতুন ভারতীয় সংবিধান রচনার জন্যে ভারতীয় রাজনৈতিক দলসমূহ ও দেশীয় রাজন্যবর্গের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি গণ-পরিষদ (Constituent Assembly) গঠন করা হবে। এই উদ্দেশ্য কার্যকর করার জন্যে ওয়াভেল সব ভারতীয় রাজনৈতিক দলের সহযোগিতা কামনা করেন। উল্লেখ্য হল, যখন ‘ওয়াভেল প্রস্তাব’ প্রথম করা হয়েছিল (১৫ জুন, ১৯৪৫) সুভাষচন্দ্র তার তীব্র সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছিলেন কেন ওই প্রস্তাব একেবারেই গ্রহণযোগ্য ছিল না। সুভাষচন্দ্রের বিশ্লেষণ কতখানি সঠিক ছিল তার এক নিদর্শন হল তাঁর ১৯ জুনের সিঙ্গাপুর থেকে প্রচারিত ভাষণ। ‘ওয়াভেল প্রস্তাব’ বর্জন করার পক্ষে যুক্তিগুলির মধ্যে তিনি বলেছিলেন যে, জুলাই মাসের আসন্ন ব্রিটিশ নির্বাচনের পূর্বে কোনওমতেই রক্ষণশীল ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে আপস করা ঠিক হবে না। সাধারণ নির্বাচনে শ্রমিক দল যদি ক্ষমতায় নাও আসে, পালামেন্টে তাদের শক্তি বৃদ্ধি নিশ্চিত। যে নতুন মন্ত্রিসভা ব্রিটেনে ক্ষমতাসীন হবে তারা ভারতের সমস্যা সমাধানে অধিকতর উদ্যোগ নেবে। ভারতবর্ষের সমস্যার সমাধান করা এক কর্তব্য ও প্রয়োজন বলে স্বীকৃত হবে। তিনি কংগ্রেস নেতাদের উদ্দেশ্য করে বলেন, “শ্রমিক মন্ত্রীসভার সঙ্গে আপনারা এমন আপস করতে পারবেন যা রক্ষণশীলদের দ্বারা নির্দেশিত লর্ড ওয়াভেলের প্রস্তাব অপেক্ষা ভারতের পক্ষে অনেক বেশি সুবিধাজনক হবে।” সুভাষচন্দ্রের ওই রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ও ভবিষ্যদ্বাণী নির্ভুল ছিল।

নেতাজির আজাদ হিন্দ ফৌজের কীর্তি কাহিনী দেশজুড়ে যে আবেগ-উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল তার প্রভাব কংগ্রেস সহ সব কটি রাজনৈতিক দলের ওপর পড়ে। কংগ্রেসের নেতাজী-INA বিরোধী মনোভাবের পরিবর্তন হয়। শাহ নওয়াজ-সেগল-ধীলনকে আদালতে সমর্থন করার জন্যে কংগ্রেস একটি আইনজ্ঞের বিশেষ দল গঠন করে। এঁদের মধ্যে ছিলেন জওহরলাল নেহরু, তেজ বাহাদুর সপ্রু, ভুলাভাই দেশাই প্রমুখ। জওহরলালকে ব্যবহারজীবীর ভূমিকা গ্রহণ করার চমকপ্রদ দৃশ্যের একটি রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ছিল। ‘আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচার (INA Trial)’ নামে অভিহিত এই ঐতিহাসিক ঘটনার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। বিচারে তিন অভিযুক্তের শাস্তি হলেও প্রবল গণ-বিক্ষোভের ফলে প্রথমে তা মকুব করতে ও অনতিকাল পরে তাঁদের মুক্তি দিতে সরকার বাধ্য হয়। অন্যান্য অভিযুক্ত আই. এন. এ. অফিসারদের যেন দেশদ্রোহের অভিযোগ আর বিচার না করে মুক্তিদান করতে সরকার বাধ্য হয় তার জন্যে তীব্রতর আন্দোলন শুরু হয়। কলকাতা ও দেশের অন্যত্র প্রচণ্ড বিক্ষোভের মুখে পুলিশের গুলিচালনার ঘটনা পর্যন্ত ঘটে। কলকাতার রাজপথে তরুণ ছাত্র রামেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় শহীদ হন। জনবিক্ষোভ ও প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তোলায় ছাত্র-যুব সম্প্রদায়ের এক বড় ভূমিকা ছিল। ট্রামওয়ে কর্মচারী ও শিল্প শ্রমিকরাও ধর্মঘট করে। শরৎচন্দ্র বসুও উদ্যোগ নিয়েছিলন জনমত সংগঠিত করতে। বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে আজাদ হিন্দ সরকার গঠনের দিনটি (২১ অক্টোবর) পালিত হয়।

১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আজাদ হিন্দ বাহিনীর ক্যাপ্টেন আব্দুল রশীদকে বিচারের নামে সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এর ফলে ১১-১৩ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় আবার প্রচণ্ড বিক্ষোভ দেখা দেয়। নভেম্বর মাসের মতো এবারও ছাত্র-মিছিলের মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ ভুলে ছাত্র, যুবক, শ্রমিক, কর্মচারি এবং হিন্দু ও মুসলমান প্রভৃতি সব সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে এক স্বতঃস্ফূর্ত ঐক্য গড়ে ওঠে। ১২ ফেব্রুয়ারি এক ধর্মঘটে কলকাতা মহানগরী অচল হয়ে যায়। বিকেলে এক বিরাট মিছিল বের হয় ও ওয়েলিংটনে স্কোয়ারে এক বিশাল জনসভা হয়। সমস্ত শহর ক্যাপ্টেন রশীদ তথা আজাদ হিন্দ বাহিনীর বিচারের প্রতিবাদে বিক্ষোভে ও ধমর্ঘটে উত্তাল হয়ে ওঠে। এই গণ-বিক্ষোভ দমন করতে সরকার পুলিশ ও সামরিক বাহিনী নিয়োগ করে। বহু বিক্ষোভকারী ও সাধারণ মানুষ হতাহত হয়। স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসতে দু’দিন সময় লাগে।

গণ-বিক্ষোভ ক্রমেই বিভিন্নস্থানে নানান রূপ নিতে থাকে। শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিতে থাকে। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত তীব্র ক্ষোভ ক্রমেই প্রকাশ পেতে থাকে। সারা দেশে রাজনৈতিক সচেতনতা এক নতুন মাত্রা পায়।

জাতীয় কংগ্রেসের মনোভাব ও নীতি পরিবর্তনের কারণ সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন ও সংশয় রয়ে গেছে। লাডলি মোহন রায়চৌধুরী তাঁর ‘আজাদহিন্দ ফৌজের কোর্ট মার্শাল ও গণ বিক্ষোভ গ্রন্থে এই প্রসঙ্গে লিখেছেন যে, ভারঘর্ষকে অবিলম্বে স্বাধীনতা দেওয়া হবে এবং তার প্রস্তুতি হিসেবে কেন্দ্রে ও প্রদেশগুলিতে শীঘ্রই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এই ঘোষণার (২১ আগস্ট, ১৯৪৫) কথা মাথায় রেখেই কংগ্রেস INA-র প্রতি তাদের পূর্বনীতির পরিবর্তন করেছিল। নেতাজি ও আজাদ হিন্দ ফৌজের জনপ্রিয়তাকে তারা নির্বাচনে জয়ী হবার কাজে লাগাতে চেয়েছিল। নেহরু, প্যাটেল, পন্থ প্রমুখ নেতারা INA-র পক্ষে ব্যাপক প্রচারে নেমেছিল। তৎকালীন ভারত-সচিব মন্তব্য করেছিলেন (১৪ নভেম্বর, ১৯৪৫) যে, ওইসব কংগ্রেস নেতারা যা কিছু বলেছেন তার বেশির ভাগই নির্বাচনী প্রচারের চমক উচ্ছ্বাস বলা যেতে পারে (‘Much of what these leaders had said could be regarded as electioneering exuberence’.)। আর একটি গোপনীয় সূত্রে জানা যায় যে, আজাদ হিন্দ ফৌজ সম্পর্কে নেহরু প্রমুখ কংগ্রেস নেতাদের গোড়ার দিকে কোনও সহানুভূতিই ছিল না। INA বন্দীদের মুক্তি দাবি করলেও নেহরু তাঁদের সম্পর্কে বিপথচালিত মানুষ (‘misguided men’) বলে মন্তব্য করতেন। প্রায়ই তিনি INA-র সম্বন্ধে কিছু বলার সময় ‘তাঁদের ভুল ভ্রান্তি সত্ত্বেও (Whatever errors and mistakes they had committed) মন্তব্যটি জুড়ে দিতেন। অথাৎ প্রকারান্তরে বুঝিয়ে দিতেন যে, আজাদ হিন্দ বাহিনী এবং ওই আন্দোলনে বহু ভুল-ভ্রান্তি ছিল যা তিনি সমর্থন করেন না। কিন্তু কংগ্রেস আজাদ হিন্দ আন্দোলনের জনপ্রিয়তাকে ব্রিটিশ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্যে ব্যবহার করছিল।

এই বিশ্লেষণের যুক্তি অনস্বীকার্য। কিন্তু শুধু রাজনৈতিক স্বার্থে ও রাজনৈতিক কৌশলগত কারণেই কংগ্রেস আজাদ হিন্দ আন্দোলন সম্বন্ধে মনোভাব পরিবর্তন করেছিল এটা মনে করা ঠিক হবে না। জওহরলাল যে, প্রথমে নেতাজি সুভাষের মত ও পথের বিরোধিতা করেছিলেন তা তিনি প্রকাশ্য জনসভায় স্বীকার করেছিলেন। নতুন তথ্য জানার পর তাঁর মনোভাবের পরিবর্তন হয়েছে, তা তিনি নিজেই স্বীকার করেছিলেন। সুভাষচন্দ্রের দেশপ্রেম, বীরত্ব ও অসাধারণ আত্মত্যাগ সম্পর্কে জওহরলালের যে আন্তরিক শ্রদ্ধা ছিল তা সন্দেহ করা সমীচীন হবে না। তবে এও অনস্বীকার্য যে, জওহরলালের মনে সুভাষচন্দ্র ও INA আন্দোলন সম্বন্ধে এক ধরণের মানসিক বাধা (inhibition) ও দ্বৈতভাব (ambivalence) ছিল। জওহরলাল ব্রিটিশ শাসনের অবসান ও স্বাধীন ভারতের জন্যে আজীবন সংগ্রাম করেছিলেন। কিন্তু তিনি ব্রিটিশদের গুণগ্রাহী ছিলেন। সশস্ত্র সংগ্রামে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি মিত্রশক্তির (Allies) জয় ও অক্ষশক্তির (Axis) পরাজয় চেয়েছিলেন। তাঁর কাছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিল নাৎসীবাদ ও ফ্যাসিবাদের সঙ্গে গণতান্ত্রিক শক্তির লড়াই। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতে ব্রিটিশ শাসনের নিপীড়ন এবং স্বৈরাচার সম্বন্ধে সচেতন হলেও বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ওই প্রশ্নটিকে সাময়িকভাবে গৌণ করে দেখতে প্রস্তুত ছিলেন। যুদ্ধের সময় ভারতের স্বাধীনতা, অন্তত ভারতীয়দের নিয়ন্ত্রিত একটি অস্থায়ী সরকার-এর (Provisional Government) দাবির জন্যেও কোনও অহিংস সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করতে তিনি উৎসাহী ছিলেন না। এই বিষয়ে তিনি গান্ধীজির নীতি মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন শুরু করার সিদ্ধান্ত তিনি পূর্ণ সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু যুদ্ধের সময় সুভাষচন্দ্রের একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান ছিল ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অর্জন। ব্রিটিশ শাসনের অবিলম্বে উচ্ছেদ ছিল তাঁর একমাত্র স্বপ্ন ও লক্ষ্য। সুতরাং নেতাজি সুভাষ সম্পর্কে সবান্তকরণে উৎসাহিত বোধ করা নেহরুর পক্ষে সম্ভব হয়নি।

আর একটি কথা স্মরণ রাখা প্রয়োজন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর স্পষ্ট বোঝা গিয়েছিল যে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অনিবার্য। শুধুমাত্র সময়ের প্রশ্ন। জওহরলালই যে গান্ধীজির রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী ও তিনিই যে স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হবেন সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ ছিল না। তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের (Interim Government) প্রধানমন্ত্রী হন (২ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৬)। স্বাধীনতা সংগ্রামী জওহরলাল ইতিমধ্যেই ‘প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল’ রূপে চিন্তা-ভাবনা শুরু করেছিলেন। আজাদ হিন্দ আন্দোলনকে তিনি সেই দৃষ্টিকোণ থেকেও দেখেছিলেন। ব্রিটিশ বাহিনীর মধ্যে বিদ্রোহ ও সৈন্যদের সামরিক ছাউনি ত্যাগের (desertion) দৃষ্টান্ত ভবিষ্যতের স্বাধীন ভারতবর্ষের সামরিক বাহিনীর শৃঙ্খলা রক্ষার পক্ষে এক ক্ষতিকর দৃষ্টান্ত হতে পারে বলে তাঁর এবং তাঁর সহকর্মীদের এক গোপন আশঙ্কা থাকা স্বাভাবিক ছিল। সুতরাং INA-র অফিসারদের বীরের সম্মানদান ও কোনও শাস্তি ছাড়া মুক্তিদানের পরোক্ষ প্রভাব সম্বন্ধে কংগ্রেস নেতাদের মানসিক দ্বন্দ্ব যে ছিল না তা নয়। জওহরলালের অবচেতন বা সচেতন মনে আর একটি অস্বস্তিবোধ থাকাও সম্ভব ছিল। তিনি ছিলেন (গান্ধীজি ছাড়া) ভারতবর্ষের অবিসংবাদী নেতা। তাঁর জনপ্রিয়তা, সাধারণ মানুষের কাছে এক সম্মোহনী আবেদন ও দেশব্যাপী গ্রহণযোগ্যতা ছিল তর্কাতীত। ১৯৪১ সাল পর্যন্ত তাঁর একমাত্র রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন সুভাষচন্দ্র। ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত যুদ্ধচলাকালীন সময়ে ব্রিটিশ অপপ্রচার, সংবাদপ্রচার ও সংবাদ মাধ্যমের ওপর কঠোর নজর এবং নিষেধাজ্ঞার ফলে নেতাজি সুভাষ সম্বন্ধে ভারতবর্ষের জনগণ কার্যত প্রায় কিছুই জানতে পারেনি। দেশের রাজনৈতিক মঞ্চ ও জনমানস থেকে তিনি অনেকখানি সরে গিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৪৫ সাল থেকে সশরীরে না হলেও সুভাষচন্দ্রের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ঘটেছিল এক অপূর্ব গরিমা ও মহিমা নিয়ে। কংগ্রেস নেতাদের ওপর এর মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া কী হয়েছিল তা অনুমান সাপেক্ষ। স্বাধীনতা লাভের পর নেতাজি সুভাষচন্দ্র যে তাঁর যোগ্য স্বীকৃতি ও মর্যাদা সরকারি উচ্চমহলে পাননি তার উপরোক্ত ব্যাখ্যা অযৌক্তিক বলে উপেক্ষা করা যায় না।

ঐতিহাসিক লাল কেল্লায় আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচার কার্যত সুভাষচন্দ্রের প্রশস্তি এবং ভারতবর্ষের সামরিক শৌর্য-বীর্য, পূর্ণ স্বাধীনতার মর্যাদাবোধও গর্বের প্রতীকে রূপান্তরিত হয়েছিল। আদালতে ন্যায় বিচারের বিষয়টি গৌণ হয়ে পড়েছিল। ব্রিটিশ শাসনের প্রতি আনুগত্যের বন্ধন সম্পূর্ণ ছিন্ন হয়েছিল। ভারতীয় স্থল, বায়ু ও নৌ তিনটি অংশেরই সেনানীরা আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হয়ে উঠেছিল। তাদের স্বাধীনতার জন্যে দৃঢ় সঙ্কল্প ও মৃত্যুভয়হীন সংগ্রাম সকল সৈন্যদের অনুপ্রাণিত করেছিল। ভারতীয় বাহিনীর সকল শাখায় এমন এক রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ হয়েছিল যা ইতিপূর্বে কখনও দেখা যায়নি। এই মনোভাবের প্রথম লক্ষণ দেখা যায় যখন কলকাতার দমদমের ভারতীয় ব্রিটিশ বিমান বাহিনীর (Royal Indian Air-Force) কয়েকজন অফিসার তাঁদের উচ্চপদস্থ নেতাদের নির্দেশগ্রহণ করতে অস্বীকার করে। এর পরেই দেখা দেয় প্রখ্যাত নৌ-বিদ্রোহ।

১৯৪৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি বোম্বাইয়ে নৌ-বিদ্রোহ শুরু হয়। সেখানকার নৌ-সেনারা স্বল্প-বেতন, নিম্নমানের আহার্য ও নৌ-বাহিনীতে প্রকট বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে অনশন শুরু করে। ওই বিক্ষোভ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। জাহাজে জাহাজে বিদ্রোহ দেখা দেয়। বিদ্রোহীরা জাহাজ দখল করে। ব্রিটিশ পতাকা অপসারিত করে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে। বোম্বাই ও করাচি বন্দরে অবস্থা গুরুতর আকার ধারণ করে। ব্রিটিশ সৈন্যদের সঙ্গে বিদ্রোহী ভারতীয় নৌ-সেনাদের গোলাগুলি বিনিময় হয়। নৌ-বিদ্রোহের সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে জনসাধারণের মধ্যে তুমুল উত্তেজনা দেখা দেয়। সারা দেশে বিক্ষোভ ও ধর্মঘট শুরু হয়। সরকারি হুমকি ও ভীতিপ্রদর্শনে কোনও ফল হয়নি। শেষপর্যন্ত কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ হস্তক্ষেপ করেন। প্রধানত সদার বল্লভভাই প্যাটেলের চেষ্টায় বিদ্রোহ প্রশমিত হয়। আত্মসমর্পণ করার পর বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। নৌ-বিদ্রোহ যে আজাদ হিন্দ ফৌজের দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত ও প্রভাবিত হয়েছিল সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পর সৈন্যবাহিনীর মধ্যে ওই রকম প্রকাশ্য বিদ্রোহ কখনও হয়নি। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ প্রশাসনের সর্বোচ্চ মহলে এর পর পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে, ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর ভারতীয় সৈন্যদের ওপর নির্ভর করে ভারতে ব্রিটিশ শাসন টিকে থাকা আর সম্ভব হবে না। নতুন পরিবেশ ও পরিস্থিতি সম্পর্কে লর্ড ওয়াভেল ব্রিটিশ সম্রাট ষষ্ঠ জর্জকে লেখেন (২২ মার্চ, ১৯৪৬) যে, আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতাদের কোর্ট মাশালকে উপলক্ষ করে যে সর্বনাশ শুরু হয়েছিল পরবর্তী কালে উদার মনোভাব ও নীতি গ্রহণ করেও তা নিবারণ করা আর সম্ভব হয়নি। নৌ-বাহিনীর বিদ্রোহ, রয়েল ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্সের এবং ইন্ডিয়ান আর্মির ক্রমবর্ধমান বিক্ষোভ ও অসন্তোষ ব্রিটিশ শাসকদের অস্থির করে তুলেছে। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের দিন যে শেষ হয়ে এসেছে তা বুঝতে অসুবিধে ছিল না।

মৌলানা আজাদ তৎকালীন ঘটনাবলী প্রসঙ্গে তাঁর ‘India Wins Freedom’ গ্রন্থে লেখেন যে, INA আন্দোলন ও নৌ-বাহিনীর বিদ্রোহ ব্রিটিশদের বুঝিয়ে দিয়েছিল যে অতঃপর ভারতবর্ষের রাজনৈতিক সমস্যার সন্তোষজনক সমাধান ছাড়া কোনও উপায় নেই। সৈন্যবাহিনীর ওপর আর নির্ভর করা যাবে না। আজাদ যে সন্তোষজনক মীমাংসার কথা লিখেছিলেন তা পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া অন্য কিছু নয়। এই উপলব্ধিই ইংরাজদের ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতি ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব রক্ষার পক্ষে অত্যন্ত প্রতিকূল হয়ে পড়েছিল। যুদ্ধে জয়লাভ করলেও ব্রিটিশ সামরিক শক্তি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। ব্রিটেন দারুণ অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছিল। রণক্লান্ত ও বিধ্বস্ত ব্রিটেন নিজের পুনর্গঠন সমস্যায় বিব্রত হয়ে পড়েছিল। সুদূর ভারত সাম্রাজ্য রক্ষার জন্যে যে মানসিক ও শারীরিক শক্তি থাকা প্রয়োজন ছিল তা আর তার অবশিষ্ট ছিল না। ওই পরিস্থিতিতে ভারতীয় জনগণের মধ্যে স্বাধীনতার অগ্নিশিখাটি যিনি আরও প্রজ্জ্বলিত করেছিলেন, বারুদের স্তূপে অগ্নিসংযোজন করেছিলেন তিনি হলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। এই সত্যটি স্বীকার করেছিলেন এ্যাটলি স্বয়ং। এক একান্ত কথাবার্তায় তিনি বলেছিলেন যে, ক্ষমতা হস্তান্তরের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের পিছনে জাতীয় কংগ্রেসের রাজনৈতিক দাবি, চাপ ও আন্দোলন এবং অন্য কোনও ঘটনা বা বিক্ষোভের থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল নেতাজি সুভাষের নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ আন্দোলন ও তার গভীর সুদূরপ্রসারী প্রভাব। ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্থিতির প্রধান ভরসাস্থল ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর ভিত নড়িয়ে দিয়েছিল নেতাজি সুভাষচন্দ্রের INA-র কীর্তি কাহিনীর জনমানসে প্রতিক্রিয়া। এ্যাটলির এই একান্ত স্বীকারোক্তির যে ঘটনা ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার বাংলার তৎকালীন এক উচ্চপদাভিষিক্ত প্রশাসকের কাছে শুনে লিপিবদ্ধ করেছেন তা যে কাল্পনিক নয় তা ওয়াভেলের পূর্ব-উল্লিখিত চিঠিটি প্রমাণ করে।

আজীবন অহিংস আন্দোলনের প্রবক্তা মহাত্মা গান্ধী যে নেতাজি সুভাষচন্দ্রের সশস্ত্র সর্বাত্মক সংগ্রামের মত এবং পথকে অনুমোদন করতে পারবেন না তা প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু সুভাষচন্দ্রের যতই সমালোচনা ও বিরোধিতা তিনি ১৯৪১ সালের পূর্বে এবং পরে করে থাকুন না কেন, সুভাষচন্দ্রের দেশপ্রেম ও অসাধারণ দক্ষতা সম্পর্কে তাঁর মনে কোনও সন্দেহ ছিল না। INA সম্পর্কে তাঁর অভিমত তিনি ভাইসরয়ের একান্ত সবিচ স্যার ইভানস জেকিন্সকে একটি চিঠিতে জানান (২৯ অক্টোবর, ১৯৪৫)। ওই চিঠিতে তিনি জনগণের আবেগ ও অনুভূতির প্রতি সহানুভূতি জানাতে INA বন্দীদের মুক্তি দেবার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। তিনি লেখেন যে, সশস্ত্র আন্দোলনের মতাদর্শে বিশ্বাসী না হলেও তিনি তাঁদের দেশপ্রেম ও বীরত্বের কথা কখনও ভুলতে পারেন না। সামরিক আদালতে যাঁদের বিচার হচ্ছে তাঁদের প্রতি ভারতবর্ষের অটুট শ্রদ্ধা আছে। সেই জনমতকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করা কী অনুচিত হবে না?

গান্ধীজির ওই চিঠিতে তাঁর যে অভিমত ব্যক্ত হয়েছিল প্রকৃতপক্ষে সুভাষচন্দ্র ও আজাদ হিন্দ আন্দোলন সম্পর্কে তাঁর শ্রদ্ধা তার থেকে অনেক বেশি ছিল বলে মনে করার কারণ আছে। সুভাষচন্দ্র গোপনে দেশত্যাগ করার পর গান্ধীজি তাঁর ভূমিকা ও আদর্শের পুনর্মূল্যায়ন শুরু করেছিলেন। ১৯৪২-এর ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন ও ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’ শপথ গ্রহণে সুভাষচন্দ্রের পরোক্ষ প্রভাব লক্ষ্য না করে উপায় নেই। ত্রিপুরী কংগ্রেসের সময় তীব্র মতপার্থক্য ও তিক্ততার মধ্যেও তিনি সুভাষচন্দ্রকে লিখেছিলেন, “অসুস্থ থাকো আর সুস্থই থাকো তুমি অপ্রতিরোধ্য।” এটি তাঁর মামুলি সৌজন্য প্রকাশ ছিল না। মনের কথাই ছিল। সুভাষচন্দ্র যে সত্যই কতটা অপ্রতিরোধ্য তা গান্ধীজি আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে শুরু করেছিলেন তাঁর মহানিষ্ক্রমণের পর। অন্যদিকে সুভাষচন্দ্রও পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সংগ্রামের চরম মুহূর্তে গভীরভাবে অনুভব করেছিলেন গান্ধীজির মহত্ত্ব ও তাঁর অসামান্য ভূমিকার কথা। গান্ধীজির সঙ্গে তাঁর মৌলিক মতভেদ দূর হয়নি। তখনও তিনি গান্ধীজির মতাদর্শ ও রাজনৈতিক বিচার বিশ্লেষণের সমালোচনা করা বন্ধ করেননি। কিন্তু গান্ধীজির প্রতি শ্রদ্ধা ও আস্থা যেন আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল। কস্তুরবা গান্ধীর মৃত্যুসংবাদে গভীর দুঃখ পেয়ে তিনি যে বিবৃতি দিয়েছিলেন (২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৪) তাতে তিনি তাঁকে ‘ভারতীয় জনগণের জননী’ বলে অভিহিত করেছিলেন। ‘মহান স্বামী’র সঙ্গে মহীয়সী স্ত্রী সব দুঃখ-লাঞ্ছনা ভাগ করে নিয়েছিলেন বলে প্রণাম জানিয়েছিলেন। কারারুদ্ধ গান্ধীজির এই নিদারুণ শোকের কথা চিন্তা করে তিনি বেদনা বোধ করেছিলেন।

রেঙ্গুন বেতার থেকে (৬ জুলাই, ১৯৪৪) নেতাজি গান্ধীজির কাছে আবেদন করেছিলেন, “আমি যা কিছু করেছি সবই আমার জাতির মঙ্গলের জন্য, বিশ্বের কাছে ভারতের মর্যাদা বাড়িয়ে তোলার জন্য এবং ভারতের স্বাধীনতা ত্বরান্বিত করার জন্য করেছি। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার শেষ যুদ্ধ শুরু হয়েছে… হে জাতির জনক! ভারতের মুক্তির এই ধর্মযুদ্ধে আমরা আপনার আশীবাদ ও শুভেচ্ছা প্রার্থনা করি।” পরের দিন আর এক বার্তায় নেতাজি গান্ধীজিকে বলেন, “১৯৪১ সালে দেশ ছাড়বার পর আমি ব্রিটিশ প্রভাবমুক্ত যেসব দেশে ভ্রমণ করেছি, সেই সমস্ত দেশে আমি দেখেছি যে আপনাকে যেরূপ সর্বোচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয় সেরূপ মর্যাদা গত এক শতাব্দীতে অন্য কোনও ভারতীয় রাজনৈতিক নেতাকে দেওয়া হয়নি।” পরিশেষে তিনি জানান, “মহাত্মাজি, আমি আপনাকে এ বিষয়ে আশ্বস্ত করতে পারি যে এই বিপজ্জনক কাজে বার হবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার পূর্বে আমি সযত্নে এই প্রশ্নটির (বৈদেশিক শক্তির সাহায্য নেওয়া) সকল দিক বিবেচনা করে দেখার কাজে দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ ও মাসের পর মাস ব্যয় করেছিলাম। এতদিন ধরে সর্বোত্তম সামর্থ্যে আমার দেশের জনগণের সেবা করে আমার বিশ্বাসঘাতক হবার কিংবা কেউ আমাকে বিশ্বাসঘাতক বলুক তাকে এই সুযোগ দেবার কোনও অভিপ্রায় আমার নেই। এই বিপজ্জনক সন্ধানে বিদেশ যাবার ব্যবস্থা করে আমি শুধু আমার জীবন ও গোটা ভবিষ্যৎ কর্মজীবনের ঝুঁকি নিইনি। অধিকন্তু আমার দলের ভবিষ্যতেরও ঝুঁকি নিয়েছি। বিদেশ থেকে কর্মপরিচালনা ছাড়া আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে পারব এরূপ সামান্যতম আশা থাকলেও আমি সঙ্কটকালে কখনও ভারত ত্যাগ করতাম না।”

গান্ধীজিকে এই আশ্বাস দেবার সত্যিই কোনও প্রয়োজন ছিল না। গান্ধীজি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন, হৃদয়ে অনুভব করেছিলেন সুভাষচন্দ্র কী ধাতুতে গড়া। তাঁর আদর্শ, স্বদেশপ্রেম ও জীবনব্যাপী স্বার্থত্যাগ ও দুঃখ-যাতনা সহ্য করার ক্ষমতা তাঁকে স্বাধীনতা সংগ্রামী ও মানুষরূপে কোন স্তরে উন্নত করেছিল। গান্ধীজির উপলব্ধি ও অনুভূতির গভীরতা, সুভাষচন্দ্রের প্রতি স্নেহ ও শ্রদ্ধা ক্রমেই গভীরতর হয়েছিল। নির্মল কুমার বসু গান্ধীজির একান্ত-সচিব রূপে দাঙ্গা-বিধ্বস্ত নোয়াখালিতে গিয়েছিলেন। স্বাধীনতা লাভের পরের দিনগুলিতেও তিনি কলকাতায় মহাত্মার নিত্য সঙ্গী-সহচর ছিলেন। সেই ঐতিহাসিক ঘটনাগুলির দিনলিপি তিনি লিখেছিলেন কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির মহাফেজখানায় এই দিনলিপি সংরক্ষিত আছে।

১৯৪৭ সালের ২৩ জানুয়ারি তাঁর প্রার্থনাসভার ভাষণে গান্ধীজি সুভাষচন্দ্রের জীবন সম্বন্ধে বলেছিলেন। সুভাষচন্দ্রকে তিনি ‘Indian First and Indian last’ বলে বর্ণনা করে বলেন, যে সাহস ও সঙ্কল্প নিয়ে এবং যেরকম প্রতিকূল পরিবেশে ও সঙ্কটের মধ্যে সুভাষচন্দ্র মহাপরাক্রান্ত ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন তা অন্য কারোর পক্ষে সম্ভব হত না। সুভাষচন্দ্রের জীবন ও সংগ্রাম তুলসীদাসের কথার যাথার্থ্য প্রমাণ করে— ‘বীরের পক্ষে সবই মানায়।’ ১৯৪৭ সালের ২৫ আগস্ট কলকাতার বেলেঘাটা ও হাওড়ার ময়দানে গান্ধীজি ভাষণ দিয়েছিলেন। তিনি জানান যে আজাদহিন্দ ফৌজের কিছু অফিসার তাঁকে চিঠি লিখেছেন। তাঁর সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগও হয়েছে। ওই অফিসাররা তাঁকে জানিয়েছেন যে, নেতাজি তাঁদের উপদেশ দিয়েছিলেন তাঁরা যেন স্বদেশে ফিরে গান্ধীজির নির্দেশমত দেশের স্বাধীনতার জন্যে কাজ করেন। দেশের বাইরে স্বাধীনতা সংগ্রামের পরিকল্পনা যেমন তাঁর (সুভাষচন্দ্রের) তেমনি দেশের ভিতরে সংগ্রামের পরিকল্পনা গান্ধীজির। গান্ধীজির ওই অফিসারদের পরামর্শ দেন, তাঁরা যেন তাঁদের তরবারিকে লাঙ্গলে রূপান্তরিত করেন। দেশের খাদ্য সমস্যা মেটাবার জন্যে তাঁদের সঙ্ঘবদ্ধভাবে কৃষিকার্যে মন দিতে হবে। এই উপদেশ যদি তাঁদের মনঃপূত না হয় তাহলে তাঁরা এক পৃথক গোষ্ঠীরূপে দেশসেবায় নিজেদের নিয়োগ করতে পারেন। সারা জীবনই সৈনিকের কাজ করতে হবে এ ধারণা ঠিক নয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে তা সম্ভবও নয়। নেতাজির নিজের জীবনই তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি পেশাগত সৈনিক ছিলেন না। কিন্তু তিনি এক মহান বীর সৈনিক রূপে স্বীকৃত হয়েছেন। সারা দেশ যখন সাম্প্রদায়িকতায় জর্জরিত, ভ্রাতৃহত্যায় মত্ত তখন কীভাবে সবশ্রেণী ও ধর্মের মানুষকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে গড়ে তোলা যায় তার এক মহান দৃষ্টান্ত নেতাজি স্থাপন করেছিলেন। তাঁর অফিসাররা তাঁদের নেতাজিকে এত ভালবাসেন যে তাঁর নামেই তাঁদের চোখে জল আসে। সেই ভালবাসা এখন তাঁদের দেশের কাজে দেখাতে হবে। গান্ধীজি বলেন সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর মতপার্থক্য ছিল, কিন্তু সেটা কথা নয়। ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের মধ্যেও তা থাকতে পারে। আজকের দিনে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হল, নিরস্ত্র বা সশস্ত্র যে কোনও সংগ্রামের পথেই বিশ্বাসী হোক না কেন সর্বাগ্রে প্রয়োজন হল কঠোর শৃঙ্খলা। আমরা দু’জনেই এই আদর্শে বিশ্বাস করতাম। গান্ধীজি অসীম স্নেহ ও গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের রহস্যময় অন্তধানের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত করে বলেন যে, শারীরিকভাবে আজ অনুপস্থিত থাকলেও সুভাষচন্দ্রের নীতি ও আদর্শ সর্বত্র বিরাজমান।

গান্ধীজি যে কথা বলেছিলেন ওই একই কথার স্বীকৃতি ছিল আজাদ হিন্দ ফৌজ সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকারের এক গোপন রিপোর্টে। “সুভাষচন্দ্র বসু হয়তো মারা গেছেন কিন্তু তিনি যা কিছু করেছিলেন, তার অধিকাংশই আজও বেঁচে আছে (‘S.C. Bose may be dead but much that he did still lives’.)।

সুভাষচন্দ্রের জীবন ও সাধনা, তাঁর কীর্তি ভারতবর্ষের ইতিহাসে এবং পৃথিবীর সব পরাধীন দেশ ও জাতির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে চিরকালীন হয়ে থাকবে। এই নিয়ে কোনও বিতর্কের অবকাশ নেই।

***

অধ্যায় ৫০ / ৫০

সকল অধ্যায়

১. দেশনায়ক – ১
২. দেশনায়ক – ২
৩. দেশনায়ক – ৩
৪. দেশনায়ক – ৪
৫. দেশনায়ক – ৫
৬. দেশনায়ক – ৬
৭. দেশনায়ক – ৭
৮. দেশনায়ক – ৮
৯. দেশনায়ক – ৯
১০. দেশনায়ক – ১০
১১. দেশনায়ক – ১১
১২. দেশনায়ক – ১২
১৩. দেশনায়ক – ১৩
১৪. দেশনায়ক – ১৪
১৫. দেশনায়ক – ১৫
১৬. দেশনায়ক – ১৬
১৭. দেশনায়ক – ১৭
১৮. দেশনায়ক – ১৮
১৯. দেশনায়ক – ১৯
২০. দেশনায়ক – ২০
২১. দেশনায়ক – ২১
২২. দেশনায়ক – ২২
২৩. দেশনায়ক – ২৩
২৪. দেশনায়ক – ২৪
২৫. দেশনায়ক – ২৫
২৬. দেশনায়ক – ২৬
২৭. দেশনায়ক – ২৭
২৮. দেশনায়ক – ২৮
২৯. দেশনায়ক – ২৯
৩০. দেশনায়ক – ৩০
৩১. দেশনায়ক – ৩১
৩২. দেশনায়ক – ৩২
৩৩. দেশনায়ক – ৩৩
৩৪. দেশনায়ক – ৩৪
৩৫. দেশনায়ক – ৩৫
৩৬. দেশনায়ক – ৩৬
৩৭. দেশনায়ক – ৩৭
৩৮. দেশনায়ক – ৩৮
৩৯. দেশনায়ক – ৩৯
৪০. দেশনায়ক – ৪০
৪১. দেশনায়ক – ৪১
৪২. দেশনায়ক – ৪২
৪৩. দেশনায়ক – ৪৩
৪৪. দেশনায়ক – ৪৪
৪৫. দেশনায়ক – ৪৫
৪৬. দেশনায়ক – ৪৬
৪৭. দেশনায়ক – ৪৭
৪৮. দেশনায়ক – ৪৮
৪৯. দেশনায়ক – ৪৯
৫০. দেশনায়ক – ৫০

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন