দেশনায়ক – ১২

১৯২১ সালের জুন মাসে সুভাষচন্দ্র ইংলন্ড ত্যাগ করে ১৬ জুলাই জাহাজ থেকে বোম্বাই-এ নামলেন। এদিনই বিকেলে তিনি গান্ধীজির সঙ্গে দেখা করেন। তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল অসহযোগ আন্দোলনের ও তাঁর কর্মসূচী সম্পর্কে গান্ধীজির নিজের কাছ থেকে শুনে একটা স্পষ্ট ধারণা করা। গান্ধীজির নীতি, আদর্শ, কর্মসূচী ও পদ্ধতি সম্পর্কে পড়াশোনা থাকলেও সুভাষের মনে যে বেশ কিছু প্রশ্ন এবং সংশয় ছিল সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। অসহযোগ আন্দোলন প্রায় এক বছর পূর্বে শুরু হয়ে গেলেও (১ আগস্ট, ১৯২০) তখনও পর্যন্ত প্রত্যাশামত সাড়া জাগাতে পারেনি। বিশেষ করে বাংলাদেশে গান্ধীজির কর্মসূচী তেমন ব্যাপক উদ্দীপনা সৃষ্টি করেনি, যদিও সারা দেশজুড়ে এক নতুন আন্দোলনের জোয়ার শুরু হয়েছিল। রাজনৈতিক পরিস্থিতি যে অনিশ্চিত তা শরৎচন্দ্র চিঠিতে সুভাষকে জানিয়েছিলেন। সতর্কভাবে বিবেচনা করে তবেই সুভাষের আই সি এস থেকে পদত্যাগ করে রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগ দেওয়া ঠিক হবে এই ইঙ্গিতও তিনি দিয়েছিলেন। শরৎচন্দ্র নিজে তখনও প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে বেশ দূরে ছিলেন। সুভাষচন্দ্র কিন্তু এ পরামর্শ শোনেননি। কেন তিনি আন্দোলনের বর্তমান অবস্থা জেনেও নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল থাকছেন তাও তিনি জানিয়েছিলেন। পূর্বেই তা উল্লেখ করা হয়েছে। গান্ধীজিকে তিনি গভীর শ্রদ্ধা করতেন। তাঁর নেতৃত্ব ও আদর্শ সম্পর্কে তাঁর আকর্ষণ ছিল। তাঁর মা’র গান্ধীজির আদর্শের প্রতি আস্থা আছে জেনে তিনি খুব আশ্বস্ত ও উৎসাহিত বোধ করেছিলেন। কিন্তু গান্ধীজি, তাঁর সামগ্রিক কর্মসূচী ও লক্ষ্য সম্বন্ধে বিশদভাবে জানার গভীর কৌতূহল ছিল সুভাষচন্দ্রের। লক্ষণীয় হল, সুভাষচন্দ্র দেশে ফিরে ‘স্বদেশ সেবার যজ্ঞে’ নিজেকে কীভাবে নিয়োগ করতে পারেন তা জানতে চেয়ে চিঠি লিখেছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশকে (১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯২১)। কংগ্রেসের বিষয়ে নানা প্রস্তাবও দিয়েছিলেন ওই চিঠিতে। কিন্তু কিছুটা বিস্ময়কর হল যে, ওই দীর্ঘ চিঠিতে কোথাও গান্ধীজির নাম পর্যন্ত উল্লেখ নেই। অথচ ১৯২১ সালের পূর্বেই ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে ‘গান্ধী যুগে’র সূচনা হয়ে গিয়েছিল। ১৯১৯ সালের কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনই ‘গান্ধী কংগ্রেস’ বলে চিহ্নিত হয়েছে। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন ও আরও বিশিষ্ট কয়েকজন নেতা গান্ধীজির মত ও পথের সঙ্গে সম্পূর্ণ ঐকমত্য হতে পারেননি। সুভাষচন্দ্রের মনেও যে কংগ্রেসের সংগঠন, কর্মপদ্ধতি ও কর্মসূচী অসম্পূর্ণ ও অস্পষ্ট বোধ হচ্ছিল তাও সুস্পষ্ট ছিল দেশবন্ধুকে লেখা চিঠিতে। তিনি লিখেছিলেন যে, কংগ্রেস যদিও এখন “existing order ভাঙ্গিতে ব্যস্ত” তবুও “এখন থেকেই ভাঙ্গার সঙ্গে সঙ্গে নূতন করিয়া সৃষ্টি আরম্ভ করিতে হইবে। জাতীয় জীবনের যে কোনও সমস্যা সম্বন্ধে একটা Policy ঠিক করিতে গেলে অনেক দিনের চিন্তা এবং গবেষণা চাই।”

সুভাষচন্দ্ৰ অধীর হয়ে পড়েছিলেন গান্ধীজির কাছ থেকে তাঁর সব প্রশ্নের উত্তর পেতে। প্রথম সাক্ষাতেই তিনি খোলাখুলি তাঁর মূল প্রশ্নগুলি করেন। গান্ধীজির বক্তব্যে তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেননি। অখুশি অতৃপ্ত মন নিয়ে তিনি ফিরে যান। গান্ধীজি ও সুভাষচন্দ্রের পরবর্তীকালের সম্পর্ককে ‘রোদ ও মেঘের খেলা’ বলে গর্ডন বর্ণনা করেছেন। প্রকৃতপক্ষে কিন্তু জওহরলাল নেহরু ও সুভাষচন্দ্রের মধ্যে সম্পর্কেও আলো-ছায়া থাকলেও শেষ পর্যন্ত ওই সম্পর্ক ছায়াচ্ছন্নই হয়ে পড়েছিল। কেন, কী পরিস্থিতি ও কোন প্রশ্নে গান্ধী-সুভাষ ও নেহরু-সুভাষ সম্পর্কে জটিলতা দেখা দিয়েছিল তা পরে পরিস্ফুট হবে।

গান্ধীজির সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাতের ঘটনাটি সুভাষচন্দ্রের মনে গভীর রেখাপাত করেছিল। বিদেশ থেকে ফিরেই সরাসরি সাহেবি পোশাক পরে গান্ধীজির সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে তিনি খুব অস্বস্তিতে পড়েছিলেন। লজ্জিত হয়ে নিজের পোশাকের জন্যে ক্ষমা চাইলে গান্ধীজির প্রাণখোলা হাসি সুভাষচন্দ্রকে সহজ করে তোলে। নানান প্রশ্ন তিনি গান্ধীজিকে করেন। গান্ধীজিও ধৈর্য ধরে সব প্রশ্ন শোনেন ও উত্তর দেন। তিনটি প্রশ্ন ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম: অসহযোগ আন্দোলনের বিভিন্ন কার্যকলাপ কী করে শেষ ধাপ অর্থাৎ কর-বন্ধে পরিণত হবে? দ্বিতীয়: শুধুমাত্র কর-বন্ধ বা আইন অমান্য করলেই কি ব্রিটিশ সরকার ভারতকে স্বাধীনতা দিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হবে? তৃতীয়: গান্ধীজি বলেছেন, এক বছরের মধ্যেই ‘স্বরাজ’ প্রতিষ্ঠিত হবে। এরকম প্রতিশ্রুতি তিনি কীভাবে দিতে পারেন? প্রথম প্রশ্নের উত্তরে সুভাষচন্দ্র সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। অন্য দুটি প্রশ্নের উত্তরে গান্ধীজি যে ঠিক কী বলতে চাইছিলেন তা বোঝাই যায়নি। মনে হয়েছিল ওই বিষয়ে গান্ধীজির কোনও স্পষ্ট ধারণা ছিল না। খুব হতাশ ও নিরুৎসাহ হয়ে সুভাষ কলকাতায় আসেন। গান্ধীজি তাঁকে চিত্তরঞ্জনের সঙ্গে দেখা করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। অবশ্য সুভাষচন্দ্র বহু পূর্বেই মনস্থির করেছিলেন যে তাঁর প্রথম কাজ হবে দেশবন্ধুর সঙ্গে দেখা করা। তাঁর উপদেশ ও নির্দেশমত নিজের কর্মপন্থা স্থির করা।

সুভাষচন্দ্রের কেমব্রিজ থেকে লেখা চিঠি পেয়ে চিত্তরঞ্জন খুবই খুশি হয়েছিলেন। চিঠির উত্তরে তিনি সুভাষকে জানিয়েছিলেন যে বর্তমানে একনিষ্ঠ কর্মীর একান্ত অভাব। স্বদেশে ফিরে সুভাষ নিজের মনোমত অনেক কাজ পাবেন। প্রথম যখন সুভাষচন্দ্র চিত্তরঞ্জের বাড়িতে যান তখন তিনি ছিলেন না। তাঁকে গভীর স্নেহ ও আন্তরিকতার সঙ্গে চিত্তরঞ্জনের স্ত্রী বাসন্তী দেবী অভ্যর্থনা জানান। প্রথম পরিচয়েই বাসন্তী দেবী ও সুভাষের মধ্যে মাতা-পুত্রের সম্পর্ক গড়ে উঠতে শুরু করে। পরবর্তী জীবনে এই সম্পর্ক আরও গভীর হয়ে উঠেছিল। সুভাষচন্দ্রের মা বাসন্তী দেবীকে বলতেন, “আপনিই মা, আমি তো ধাত্রী।” শুনে বাসন্তী দেবী অভিভূত হয়ে বলতেন, “এমন মা না হলে এমন ছেলে কি আর হয়।” সুভাষচন্দ্রের সব কাজের, সব ঝড়ঝাপটার মধ্যে বাসন্তী দেবী ছিলেন অনুপ্রেরণার উৎস। প্রকৃতই সুভাষ তাঁর ও প্রভাবতীর দুই মায়েরই সন্তান ছিলেন। দেশবন্ধুর সঙ্গে ক’দিন পরে সুভাষের দেখা হয়। তাঁর আত্মজীবনী ‘ভারত পথিক’-এ সুভাষ চিত্তরঞ্জনের সঙ্গে তাঁর ‘ওটেন ঘটনা’র পর দেখা হয়েছিল তার কোনও উল্লেখ করেননি। চিঠিপত্রেও নয়। কিন্তু তাঁর ‘ভারতের মুক্তি সংগ্রাম’ (The Indian Struggle) গ্রন্থে সুভাষ লিখেছেন যে এ সময় তিনি বিশিষ্ট ব্যবহারজীবী রূপে খ্যাত চিত্তরঞ্জন দাশের কাছে উপদেশ নেবার জন্যে একবার গিয়েছিলেন। এটা বিস্ময়কর। চিত্তরঞ্জনের সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়া, তাঁর পরামর্শের কথা সুভাষচন্দ্র আত্মজীবনীতে বা অন্য কোথাও উল্লেখ পর্যন্ত করলেন না এটা সম্ভব হল কেমন করে? বিশেষ করে যে দেশবন্ধু ছিলেন তাঁর জীবনের ‘ধ্রুবতারা’র মতো? হয়তো জানকীনাথ বসু পুত্রের ব্যাপারে চিত্তরঞ্জনের পরামর্শ চেয়েছিলেন। সেই সময় সুভাষ পিতার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু চিত্তরঞ্জনের সঙ্গে তাঁর সরাসরি তেমন কোনও কথা হয়নি।

প্রথম দর্শনেই সুভাষচন্দ্র মুগ্ধ, অভিভূত হয়েছিলেন। ইতিপূর্বে চিত্তরঞ্জনের সর্বস্ব ত্যাগের দৃষ্টান্ত, তরুণ সুভাষকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। কিন্তু সেই মানুষটিকে কাছ থেকে দেখে, তাঁর সঙ্গে কথা বলে তাঁর প্রতি সুভাষচন্দ্রের শ্রদ্ধা শতগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। তিনি দেখলেন একজন মানুষকে যিনি যুবকদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও সুখ-দুঃখের কথা বুঝতে পারেন গভীর মমতা ও সহানুভূতি দিয়ে। ঠিক এইরকম এক মানুষই সুভাষ খুঁজছিলেন। ওই ঐতিহাসিক প্রথম সাক্ষাৎকার সম্পর্কে সুভাষ লিখেছেন, “আমাদের আলোচনা যখন শেষ, আমার মন তৈরি। মনে হল নেতা খুঁজে পেয়েছি। তাঁকেই অনুসরণ করব।” কথায়-কাজে, মনে-প্রাণে সুভাষচন্দ্র বসু তাই করেছিলেন, যতদিন দেশবন্ধু জীবিত ছিলেন এবং তাঁর মৃত্যুর পরও।

দেশবন্ধুকে সুভাষচন্দ্র তাঁর দু’টি চিঠিতেই জানিয়েছিলেন যে, তিনি ‘জাতীয় কলেজে’ অধ্যাপনা, পত্র-পত্রিকার সম্পাদনায় সহায়তা বা সাংবাদিকতার কাজ, জাতীয় কংগ্রেসের নীতি, কর্মসূচী সম্বন্ধে প্রচার পুস্তিকা প্রকাশের কাজ ইত্যাদি করতে আগ্রহী আছেন। শরৎচন্দ্রকেও তিনি তাঁর ইচ্ছার কথা বলেছিলেন। ১৯২১ সালের ২ মার্চের চিঠিতে সুভাষচন্দ্র দেশবন্ধুকে লিখেছিলেন, “শিক্ষকতা এবং Journalism বোধহয় আমার মনের মতো কাজ হইবে। এই নিয়ে আমি এখন আরম্ভ করতে পারি, তারপর সুবিধামত অন্য কাজেও হাত দিতে পারি। আমার পক্ষে চাকুরি ছাড়া মানে দারিদ্র ব্রত গ্রহণ করা। সুতরাং বেতন সম্বন্ধে আমি কিছু বলিব না। খাওয়া-পরা চলিলেই আমার যথেষ্ট হইবে।” সুভাষচন্দ্রের মতো একজন অসাধারণ মেধাবী, স্বদেশপ্রেমিক, আদর্শবাদী, যে কোনও ত্যাগ-কষ্ট স্বীকারে প্রস্তুত তরুণের কাছ থেকে এইরকম প্রস্তাব দেশবন্ধুর কাছে ঈশ্বরের আশীবাদের মতো মনে হয়েছিল। দেশ, জাতি ও রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে এইরকম একজন সহযোগীর প্রয়োজন তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করছিলেন।

অল্পদিনের মধ্যেই দেশবন্ধু সুভাষচন্দ্রের ওপর একাধিক গুরুদায়িত্ব দিলেন। সুভাষচন্দ্র ন্যাশনাল কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব, বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটি ও জাতীয় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রচার বিভাগের পূর্ণ দায়িত্বভার পেলেন। অসহযোগ আন্দোলনে সাড়া দিয়ে বহু অধ্যাপক, শিক্ষক ও ছাত্র স্কুল-কলেজ ত্যাগ করছিলেন। বহু কৃতী, উজ্জ্বল জীবনের সম্ভাবনাময় ছাত্র, তরুণ শিক্ষক অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিচ্ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সব ভাল ছেলেরা কলেজ ছেড়ে দিয়েছে শুনে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় নাকি বলেছিলেন, “ভাল ছেলে বলেই ছেড়ে দিয়েছে।” ছাত্রদের উদ্দেশ্য করে দেশবন্ধু বলেছিলেন যে, তারাই হচ্ছে দেশের আশা-ভরসা। তিনি যেসব ছেলেরা কলেজ ছেড়েছে তাদের জন্যে একটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। ১৯২১ সালের জানুয়ারি মাসে ‘কলিকাতা বিদ্যাপীঠ (Calcutta National College) প্রতিষ্ঠিত হয়। যেসব জাতীয় বিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল সেগুলির পরীক্ষা ও তত্ত্বাবধানের জন্যে গৌড়ীয় সর্ববিদ্যায়তন (Board of National Education) স্থাপিত হয়। কলকাতার ওয়েলিংটন স্কোয়ারে ‘ফরবস ম্যানসন’-এ বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি, কলিকাতা বিদ্যাপীঠ ও গৌড়ীয় সর্ববিদ্যায়তন এবং আয়ুর্বিজ্ঞান বিদ্যালয়ের কর্মকেন্দ্র স্থাপিত হয়। কবি, সাহিত্যিক, স্বাধীনতা সংগ্রামী সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায় সুভাষচন্দ্রের একনিষ্ঠ সহকর্মী ছিলেন। সদ্য বিলাত প্রত্যাগত তরুণ সুভাষচন্দ্র কীভাবে সম্পূর্ণ প্রতিকূল পরিবেশে বিদ্যাপীঠের অধ্যক্ষের কঠিন দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হয়েছিলেন তার চিত্তাকর্ষক স্মৃতিচারণ করেছেন সাবিত্রীপ্রসন্ন তাঁর ‘সুভাষচন্দ্র ও নেতাজি সুভাষচন্দ্র’ গ্রন্থে।

সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে কিরণশঙ্কর রায় ব্যারিস্টার হয়ে ইংলন্ড থেকে দেশে ফেরেন। তিনি সর্ববিদ্যায়তনের সম্পাদক নিযুক্ত হন। বিদ্যাপীঠে সুভাষচন্দ্র ইংরাজি, ভূগোল ও দর্শন পড়াতেন। কিরণশঙ্কর পড়াতেন ইতিহাস ও ইংরাজি কবিতা। হেমন্তকুমার সরকার ও সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায় পড়াতেন বাংলা। একদিন সন্ধ্যাবেলা সারা দিনের কাজের পর সাবিত্রীপ্রসন্ন ও কিরণশঙ্কর সিঁড়ি দিয়ে কিছুটা নামার পর দেখলেন সুভাষচন্দ্র সঙ্গে নেই। কিরণশঙ্করবাবু সাবিত্রীপ্রসন্নকে বললেন, “আরে এ ভদ্রলোকের আবার কী হল? যান তো একবার দেখে আসুন।” সাবিত্রীপ্রসন্ন গিয়ে দেখেন অধ্যক্ষ সুভাষচন্দ্র সকলের ‘ডেস্ক’ গুছিয়ে রাখছেন। টুকরো ছেঁড়া সব কাগজ নিজের হাতে তুলে নিয়ে ঘরের বাইরে এক কোণে জমা করছেন। সাবিত্রীপ্রসন্নকে জিজ্ঞাসা করলেন, “ঝাড়দার আসে তো?” ভিতরে ও বাইরের কোনও অপরিচ্ছন্নতা সুভাষচন্দ্র পছন্দ করতেন না। যখন যেখানেই তিনি কাজ করুন না কেন সব কিছু সুবিন্যস্ত রাখার ওপর নজর দিতেন। দিনের কাজের শেষে পরের দিনের জরুরি কাজের তালিকা করে টেবিলের ওপর রেখে যেতেন।

দেশবন্ধুর সকল প্রচেষ্টা, সুভাষচন্দ্র ও তাঁর আদর্শনিষ্ঠ সহকর্মীদের আন্তরিক প্রয়াস সত্ত্বেও জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার পরিকল্পনা সফল হয়নি। ক্রমে ক্রমে নেতৃস্থানীয় শিক্ষকরা প্রায় সকলেই রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগ দিয়ে কারাবরণ করেন। স্বভাবতই এর ফলে পড়াশোনা ব্যাহত হয়। তাছাড়া সরকারি অনুমোদনহীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ার পর ভবিষ্যতে কর্মজীবনের সমস্যা ও সঙ্কটের কথা চিন্তা করে অভিভাবকদের মধ্যে জাতীয় বিদ্যালয়গুলি সম্বন্ধে অনীহা দেখা দেয়। ইতিপূর্বে স্বদেশী আন্দোলনের সময় যে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার উদ্যোগ ও প্রবর্তন হয়েছিল তাও দু’একটি ক্ষেত্রে ছাড়া সফল হয়নি।

দেশজুড়ে তখন অসহযোগ আন্দোলন ক্রমেই তীব্রতর হয়ে উঠছে। প্রথমে গান্ধীজির ‘অসহযোগ’ নীতি ও পরিকল্পনার সঙ্গে চিত্তরঞ্জনের মতপার্থক্য হলেও শেষপর্যন্ত তিনি গান্ধীজিকেই সমর্থন করেন। বিপ্লবীরাও গান্ধীজির মত ও পথের বিরোধী ছিলেন। কিন্তু বিপ্লবীদের কাছে দেশবন্ধুর এক বিশেষ ভাবমূর্তি ছিল। বিপ্লবী সংগঠনগুলি তাঁকে শ্রদ্ধা করত, যদিও দেশবন্ধু অহিংস আন্দোলনে বিশ্বাসী ছিলেন। বিপ্লবীদের কাজকর্ম তিনি সমর্থন করতেন না। কিন্তু তাঁদের গভীর স্বদেশপ্রেম, স্বাধীনতা স্পৃহা ও আত্মত্যাগের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ছিল। মূলত দেশবন্ধুর প্রচেষ্টায় বিপ্লবীরা স্বরাজ প্রতিষ্ঠার জন্যে কংগ্রেসের আন্দোলনের বিরোধিতা না করতে সম্মত হলেন। তাঁদের মধ্যে অনেকে কংগ্রেসের সক্রিয় সদস্য হয়ে আন্দোলনে যোগদানও করেন। এর ফলে বাংলাদেশে অসহযোগ আন্দোলন আরও ব্যাপক এবং শক্তিশালী হয়ে ওঠে। সুভাষচন্দ্রও তাঁর অন্যান্য দায়িত্বপূর্ণ কাজ ছাড়াও রাজনৈতিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতায় কংগ্রেস কার্যনির্বাহক সমিতির সদস্যরা যখন দেশবন্ধুর অতিথিরূপে ছিলেন তখন সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে প্রথম মতিলাল নেহরু, লালা লাজপৎ রায়, মহম্মদ আলি প্রমুখ বিশিষ্ট নেতাদের ব্যক্তিগত পরিচয় হয়। সর্বভারতীয় নেতাদেরও সুভাষচন্দ্রের প্রতি দৃষ্টি পড়ে।

সকল অধ্যায়

১. দেশনায়ক – ১
২. দেশনায়ক – ২
৩. দেশনায়ক – ৩
৪. দেশনায়ক – ৪
৫. দেশনায়ক – ৫
৬. দেশনায়ক – ৬
৭. দেশনায়ক – ৭
৮. দেশনায়ক – ৮
৯. দেশনায়ক – ৯
১০. দেশনায়ক – ১০
১১. দেশনায়ক – ১১
১২. দেশনায়ক – ১২
১৩. দেশনায়ক – ১৩
১৪. দেশনায়ক – ১৪
১৫. দেশনায়ক – ১৫
১৬. দেশনায়ক – ১৬
১৭. দেশনায়ক – ১৭
১৮. দেশনায়ক – ১৮
১৯. দেশনায়ক – ১৯
২০. দেশনায়ক – ২০
২১. দেশনায়ক – ২১
২২. দেশনায়ক – ২২
২৩. দেশনায়ক – ২৩
২৪. দেশনায়ক – ২৪
২৫. দেশনায়ক – ২৫
২৬. দেশনায়ক – ২৬
২৭. দেশনায়ক – ২৭
২৮. দেশনায়ক – ২৮
২৯. দেশনায়ক – ২৯
৩০. দেশনায়ক – ৩০
৩১. দেশনায়ক – ৩১
৩২. দেশনায়ক – ৩২
৩৩. দেশনায়ক – ৩৩
৩৪. দেশনায়ক – ৩৪
৩৫. দেশনায়ক – ৩৫
৩৬. দেশনায়ক – ৩৬
৩৭. দেশনায়ক – ৩৭
৩৮. দেশনায়ক – ৩৮
৩৯. দেশনায়ক – ৩৯
৪০. দেশনায়ক – ৪০
৪১. দেশনায়ক – ৪১
৪২. দেশনায়ক – ৪২
৪৩. দেশনায়ক – ৪৩
৪৪. দেশনায়ক – ৪৪
৪৫. দেশনায়ক – ৪৫
৪৬. দেশনায়ক – ৪৬
৪৭. দেশনায়ক – ৪৭
৪৮. দেশনায়ক – ৪৮
৪৯. দেশনায়ক – ৪৯
৫০. দেশনায়ক – ৫০

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন