মুসোলিনীর সঙ্গে রোমে সুভাষচন্দ্রের একাধিকবার সাক্ষাৎ ও কথাবার্তা হয়েছিল। ১৯৩৩ সালের ডিসেম্বর মাসে রোমে ‘ওরিয়েন্টাল ইনস্টিটিউট’-এর (Oriental Institute) উদ্বোধন করেছিলেন মুসোলিনী। ইতালী সরকার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সুভাষচন্দ্রকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এর পরই ইউরোপে প্রবাসী প্রাচ্য দেশীয় ছাত্রদের সম্মেলন (Congress of Oriental Students of Europe) অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে সুভাষচন্দ্রের ভাষণ চীন, ভারত, পারস্য, আরব, ইজরাইল প্রভৃতি দেশের ছাত্রদের মুগ্ধ করেছিল। রোমে থাকাকালে মুসোলিনীর সঙ্গে তাঁর দু’বার সাক্ষাৎ হয়। এর পরে আর একবার উভয়ের মধ্যে পরপর তিনদিন দীর্ঘ আলোচনা হয়েছিল। ১৯৩৫ সালে পিতার পারলৌকিক কাজ শেষ করে ইউরোপে ফেরার পর তাঁর সঙ্গে মুসসালিনীর সাক্ষাৎ হয়। সুভাষচন্দ্র তাঁর সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থ, The Indian Struggle, মুসোলিনীকে উপহার দেন।
মুসোলিনী-ভাষচন্দ্র সাক্ষাৎকার ও আলোচনার একটি তাৎপর্যপূর্ণ পটভূমি ছিল। অষ্টাদশ ও উনিশ শতকের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ঘটনা শিক্ষিত জাতীয়তাবাদী ভারতীয় তরুণদের মনে উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিল। এইসব ঘটনা ও বিশিষ্ট নায়কদের মধ্যে ইতালীর জনগণের ঐক্য ও স্বাধীনতা লাভের প্রয়াস এবং গারিবল্ডি ও ম্যাৎসিনীর নাম ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। সুভাষচন্দ্র বাল্যকালেই ইতালীর এই দুই বীর নায়কের কথা শুনে রোমাঞ্চিত হয়েছিলেন। মুসোলিনী অন্যান্য দেশের মানুষ সম্বন্ধে জানতে ও যোগাযোগ করতে উৎসাহী ছিলেন। ১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথ রোমে গেলে মুসোলিনী তাঁকে সাড়ম্বর স্বাগত জানিয়ে মুগ্ধ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সম্বন্ধে প্রশংসাসূচক অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন। এই নিয়ে রবীন্দ্রনাথ সমালোচিত হয়েছিলেন। পরে রোমাঁ রোলাঁর সঙ্গে কথাবার্তার পর রবীন্দ্রনাথ তাঁর পূর্বের অভিমত পরিবর্তন করেন। ফ্যাসিবাদের তীব্র সমালোচনা করেন। গান্ধীজি দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করে ফেরার পথে রোমে মুসোলিনীর সঙ্গে দেখা করেন। গান্ধীজিও মুসোলিনীর কথাবার্তায়, তাঁর নেতৃত্বাধীনে ইতালীর উন্নতি ও সমৃদ্ধি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা ও মনোভাবের কথা রোমাঁ রোঁলাকে জানিয়েছিলেন। অবশ্য তারই সঙ্গে এও লিখেছিলেন যে, তিনি মুসোলিনীকে ঠিক বুঝতে পারছেন না। প্রখ্যাত বিপ্লবী ডঃ তারকনাথ দাস আমেরিকায় নির্বাসিত জীবনযাপন করতেন। তিনি রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের ‘মডার্ন রিভিউ’ (Modern Review) পত্রিকায় একটি প্রবন্ধে মুসোলিনীর নেতৃত্বের বিশেষ প্রশংসা করেছিলেন।
এই পরিপ্রেক্ষিতে সুভাষচন্দ্র যে মুসোলিনীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁর সঙ্গে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্বন্ধে আলোচনা করতে বিশেষ আগ্রহী হবেন তা খুবই স্বাভাবিক ছিল। ভারতের ইতালীয় দূতাবাস সূত্রে মুসোলিনীও ভারতবর্ষের জাতীয় আন্দোলন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সুভাষচন্দ্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। গান্ধীজির সঙ্গে দেখা ও কথাবার্তার পর ভারত সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ ও কৌতূহল অবশ্যই বৃদ্ধি পেয়েছিল। সুতরাং সুভাষচন্দ্রের গুরুত্ব বোঝার পক্ষে তাঁর অসুবিধা ছিল না। তাই প্রত্যাশিতভাবেই এস. এস. গঙ্গে জাহাজে করে সুভাষচন্দ্র ভেনিসে পৌঁছলে (৩ মার্চ, ১৯৩৩) ইতালী সরকারের পক্ষ থেকে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান হয়।
রোমে Oriental Institute-এর প্রতিষ্ঠার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তাঁর ভাষণে মুসোলিনী বলেন যে, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য কোনওদিনই মিলিত হতে পারবে না, এই অভিমত ভ্রান্ত। ইতালী ও এশিয়ার মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগসূত্রের ইতিহাস সুপ্রাচীন। ভবিষ্যতে এই সম্পর্ক নিকটতর হবে। এরই ওপর পৃথিবীর মানুষের মুক্তি নির্ভর করবে। বলা বাহুল্য, অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিভিন্ন দেশ থেকে আমন্ত্রিত শ্রোতারা মুসোলিনীর ভাষণে খুশি হয়েছিলেন। তাঁদের আতিথেয়তার সব ভার বহন করেছিলেন ইতালীর সরকার। সুভাষচন্দ্রের তখন প্রধান চিন্তা এবং লক্ষ্য ছিল ভারতের মুক্তি সংগ্রাম সম্পর্কে প্রচার করা, ইউরোপে সহানুভূতির পরিবেশ সৃষ্টি এবং বিশিষ্ট নেতাদের নৈতিক সমর্থন লাভ করা। সুতরাং মুসোলিনীর মনোভাব, বক্তব্য এবং সাধারণভাবে ইতালীর অনুকূল পরিবেশ তাঁকে খুবই আকৃষ্ট এবং আশান্বিত করেছিল। সুভাষচন্দ্রকে মুসোলিনী প্রশ্ন করেছিলেন, তিনি সত্যিই বিশ্বাস করেন কি না যে ভারতবর্ষ শীঘ্রই স্বাধীন হবে। সুভাষচন্দ্রের ইতিবাচক উত্তরের পর, মুসোলিনী এবার প্রশ্ন করেন, এই স্বাধীনতা আসবে কোন পথে? সংস্কারের না বিপ্লবের পথে? যখন সুভাষচন্দ্র জানান যে, বিপ্লবের পথেই দেশের স্বাধীনতা আসবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন, তখন মুসোলিনী বলেন যে, এই পথেই তা সম্ভব। সুভাষচন্দ্রের নিজের কোনও পরিকল্পনা আছে কি না তা জানতে চাইলে তিনি নীরব থাকলে, মুসোলিনী বলেন, অবিলম্বে সুভাষচন্দ্রকে এরকম এক পরিকল্পনা করতে হবে এবং কাজ শুরু করতে হবে।
১৯৩৪ সালে মুসোলিনীর সঙ্গে কথাবার্তায় সুভাষচন্দ্র বেশ উৎসাহ বোধ করেছিলেন। মিলান থেকে অশোকনাথ বসুকে লেখা একটি চিঠিতে (১৫ জানুয়ারি, ১৯৩৪) তিনি তা ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি লেখেন, “রোমে থাকতে বড়কর্তার সঙ্গে দু’বার দেখা হয়েছিল। এ বিষয়টা গোপন রাখবে—তবে ডাঃ থিয়েরফেলডারকে বলতে পার। তা ছাড়া ‘গভর্নর অফ রোম’-এর সঙ্গে দেখা হয়েছিল এবং তাঁর সাহায্যে মিউনিসিপ্যালিটির কাজকর্ম দেখতে পেয়েছিলাম। প্রফেসর টুচ্চি (Tucci) ভারতবর্ষ থেকে ফিরে আসাতে তাঁর সঙ্গেও দেখা ও কথাবার্তা হয়েছিল। আশা করি রোমে ক্রমশ একটা ভাল আড্ডা গড়ে উঠবে।” সুভাষচন্দ্র মুসোলিনীর কথাবার্তায় এবং ইতালীকে একটি সুশৃঙ্খল, সমৃদ্ধ, সম্ভাবনাপূর্ণ দেশ রূপে গড়ে তোলায় তাঁর সাফল্য দেখে প্রভাবিত হয়েছিলেন। গান্ধীজি, রবীন্দ্রনাথও হয়েছিলেন। তাঁদের তুলনায় সুভাষচন্দ্র যে আরও বেশি হবেন তাও ছিল খুবই স্বাভাবিক। গান্ধীজিকে ব্রিটিশ সরকার কখনই (তখন তো নয়ই) ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রধান শত্রু বলে মনে করেনি। বরং ভারতে সশস্ত্র বিপ্লবী তৎপরতা বৃদ্ধি ও প্রসারের বিরুদ্ধে গান্ধীজির অহিংস নীতি তাদের কাছে সহায়ক মনে হত। রবীন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদের জন্যে কোনও বিপ্লবী পরিকল্পনার সঙ্গে তাঁর সামান্যতম সম্পর্কও ছিল কল্পনাতীত। কিন্তু সুভাষচন্দ্র কংগ্রেসের অহিংস নীতি ও কর্মসূচীর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত থাকলেও তাঁর বিপ্লবী মন ও সত্তা ছিল সংশয়াতীত, দেশ ও জাতি গঠনে সামরিক শক্তি, জীবনের সর্বক্ষেত্রে কঠোর শৃঙ্খলা এবং নিয়মানুবর্তিতা, শক্তিশালী নেতৃত্ব তিনি অপরিহার্য মনে করতেন। বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষের এর অভাব তিনি লক্ষ্য করে দুঃখিত, উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন। কলকাতা কংগ্রেসে তাঁর স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সংগঠনে সুভাষচন্দ্রের ওই চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছিল। ইউরোপের জীবনধারা, নিয়ম-শৃঙ্খলা, পরিকল্পিতভাবে উন্নয়ন প্রচেষ্টা প্রত্যক্ষ করে ভারতবর্ষেও তার প্রয়োজনীয়তার কথা তিনি আরও গভীর ও তীব্রভাবে অনুভব করেছিলেন। এরই প্রকাশ ঘটেছিল তাঁর মনে পরবর্তীকালে পৃথিবীতে কম্যুনিজম ও ফ্যাসিজমের মধ্যে এক সম্ভাব্য সমন্বয়ের চিন্তায়।
সুভাষচন্দ্রের ভাবনা-চিন্তায় তাঁর প্রথম বছরের ইউরোপ-প্রবাসের অভিজ্ঞতা কীভাবে কাজ করছিল তার পরিচয় পাওয়া যায় জেনিভা থেকে লেখা একটি চিঠিতে (২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৪)। তিনি লিখেছিলেন, “বিজ্ঞান শিখ্লে চিন্তা ও কাজের অভ্যাসগুলি exact হয়। আমাদের জাতের বড় দোষ যে আমরা বড় ‘লেলা-ক্ষ্যাপা’—চরিত্রের মধ্যে exactness এবং বাঁধন নেই। সেটা আনতে হলে আমাদের শিক্ষা বৈজ্ঞানিক হওয়া চাই। ···চরিত্রের প্রকৃত ভিত্তি স্থাপন করতে হলে—বিবেকানন্দের আশ্রয় নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। আমাদের জাতীয় চরিত্রের প্রধান দোষ—আমাদের একাগ্রতা নেই—concentration নেই···এই একাগ্রতার সঙ্গে চাই ‘tenacity—লেগে থাকা’।” বিজ্ঞানী মন এবং একাগ্রতার সঙ্গে (যেটি পাশ্চাত্যে দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন) এই চিঠিতেই তিনি আর একটি চারিত্রিক গুণ অপরিহার্য বলেছিলেন। তিনি লেখেন যে, শুধু ভালবাসার দ্বারা হীনতা ও কুটিলতাকে জয় করা যায়। নীচতার প্রতিদানে নীচতা দেখালে চলবে না, ভালবাসা ও উদারতা দেখাতে হবে। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন যীশু ও শ্রীচৈতন্যের কথা। তিনি বলেন, “সন্ন্যাসীর আদর্শ বাইরে নয়—প্রাণের ভিতরে। গৈরিক ধারণ করলে সন্ন্যাসী হয় না। এই যুগের জন্য যে সন্ন্যাস, সে সন্ন্যাসের অর্থ—কর্ম সন্ন্যাস। অর্থাৎ সমস্ত ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করে একটা মহান আদর্শের জন্য জীবনটা ঢেলে দিতে হবে। এর নাম নিঃস্বার্থ কর্ম।”
সুভাষচন্দ্রের আদর্শ, লক্ষ্য ও জীবনসাধনা বোঝার পক্ষে এই চিঠিটির অসীম গুরুত্ব রয়েছে। সুভাষচন্দ্রকে ফ্যাসিবাদী, নাৎসী অনুরাগী, অসহিষ্ণু, একতন্ত্রী প্রভৃতি নানা আখ্যা দিয়ে সেই সময়ে এবং পরেও অনেকে সমালোচনা করেছেন। কিন্তু কোন ঐতিহাসিক পটভূমি ও পরিস্থিতিতে, কোন উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ ও মনোভাবের বিবর্তন ঘটেছিল তার যথাযথ বিশ্লেষণ তাঁর সমালোচকরা করেননি। আজও একই দৃষ্টিক্ষীণতায় (myopia) কিছু মানুষ ভুগছেন। লক্ষণীয় হল, সুভাষচন্দ্র যখন উপরোক্ত চিঠিটি লিখেছিলেন তাঁর অল্প ক’দিন আগেই তাঁর সঙ্গে মুসোলিনীর সাক্ষাৎ হয়েছিল। ফ্যাসিস্ট ইতালীর জাগতিক উন্নতি ও অগ্রগতি দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। ইতিপূর্বেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত, বিধ্বস্ত, অবমানকর ভাসাই চুক্তিতে লাঞ্ছিত জার্মানী কেমনভাবে অল্প সময়ের মধ্যে জাতীয়তাবোধে উদ্দীপ্ত হয়ে হিটলারের নেতৃত্বে পুনর্জীবিত হয়ে উঠছিল তা তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই ব্রিটিশ শাসনে শোষিত, লাঞ্ছিত, সর্বদিক থেকে বঞ্চিত নিজের মাতৃভূমি ভারতবর্ষের এক তুলনামূলক চিত্র তাঁকে বিচলিত ও চিন্তিত করেছিল। তিনি পর্যবেক্ষণ করছিলেন নবজাগ্রত জার্মানী, ইতালী, এবং মার্কসবাদী সোভিয়েত রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় এবং আর্থ-সামাজিক তত্ত্ব ও কাঠামোর কোন কোন গুণের সমন্বয় ভারতবর্ষের মতো দেশগুলির স্বাধীনতা অর্জনে ও পুনর্গঠনে কার্যকর হতে পারে। কিন্তু তাঁর আকাঙিক্ষত সমন্বয়ের অপরিহার্য উপাদান ছিল একান্তভাবে ভারতীয়। এর মূল আধার, সুভাষচন্দ্রের দৃষ্টিতে, ছিল ‘কর্ম সন্ন্যাস’—আদর্শের জন্যে নিঃস্বার্থ কর্ম।
জামানী ও ইতালীতে ভারতবর্ষ সম্বন্ধে আগ্রহ ও সহানুভূতির পরিবেশ সৃষ্টি করা, হিটলার ও মুসোলিনীকে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সহমর্মিতার মনোভাব গ্রহণ করাবার প্রচেষ্টার পিছনে আর একটি বড় কারণ ছিল। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, সুভাষচন্দ্র ইউরোপে আসার কয়েক বছর পূর্বেই স্থির নিশ্চিত হয়েছিলেন যে আর একটি বড় আন্তজাতিক যুদ্ধ আসন্ন। জার্মানী ও ইতালী ওই ইউরোপীয় যুদ্ধে ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে থাকবে। সুতরাং ব্রিটেনের পরাক্রান্ত শত্ৰুশক্তির সঙ্গে ভারতবর্ষের মৈত্রী ও সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তোলা রাজনৈতিক ও সামরিক কৌশলগত কারণে বিশেষ প্রয়োজন। হিটলার সম্বন্ধে সুভাষচন্দ্র কোনও সময়েই মোহগ্রস্ত হননি। ‘ইউরোপ: আজ ও আগামীকাল’—বিশ্লেষণে (২১ আগস্ট, ১৯৩৭) তিনি হিটলারের অধীন জার্মানী ‘নাৎসী দানবের আবির্ভাব’ রূপে বর্ণনা করেছিলেন। মুসোলিনী সম্পর্কে বরং তাঁর ভাল ধারণা ও প্রত্যাশা জন্মেছিল। ইতালী অ্যাবিসিনিয়া আক্রমণ করলে জাতীয়তাবাদী ভারতীয় নেতারা এবং রবীন্দ্রনাথ নিন্দা করেছিলেন। আফ্রিকার এক স্বাধীন দেশকে এভাবে পদানত করা তাঁরা নগ্ন সাম্রাজ্যবাদ বলে মনে করেছিলেন। সুভাষচন্দ্রও অ্যাবিসিনিয়ার ওপর আক্রমণের সমালোচনা করেছিলেন। যদিও তার তীব্রতা কিছু কম ছিল। এর অন্যতম কারণ ছিল, তিনি আশা করেছিলেন আসন্ন ইউরোপীয় যুদ্ধে ব্রিটেনের বিরুদ্ধে ইতালী লড়াই করবে। ওই যুদ্ধে শেষপর্যন্ত ব্রিটেন জয়লাভ করলেও তার সামরিক শক্তি দুর্বল হয়ে পড়বে। ইতালীর অ্যাবিসিনিয়া জয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির মধ্যে বিরোধকে বাড়িয়ে তুলবে। আর, সেই ক্ষেত্রে অ্যাবিসিনিয়ার পরাজয় মূল্যহীন হবে না। সুভাষচন্দ্রের আর একটি অনুমান কিন্তু নির্ভুল প্রমাণিত হয়নি। তাঁর বিশ্বাস ছিল, “মুসোলিনী এত সুচতুর রাজনীতিবিদ যে তিনি অদূর কিংবা সুদূর ভবিষ্যতে কোনও বিপজ্জনক অভিযানে নিজেকে কিংবা তাঁর দেশকে জড়িয়ে ফেলবেন না···বিজয় সম্বন্ধে সুনিশ্চিত না হলে (ইতালী) কোনও যুদ্ধে যোগ দেবে না।” বাস্তবে কিন্তু তা ঘটেনি।
প্রাগে তৎকালীন চেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এডওয়ার্ড বেনেস-এর (Edward Penes) সঙ্গে চেকোস্লোভাকিয়ার মুক্তি আন্দোলন (বিশেষভাবে প্রথম মহাযুদ্ধের সময়), প্রবাসে ব্রিটেন ও রাশিয়ার সহায়তায় অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্যে চেক মুক্তি বাহিনী সংগঠন সম্পর্কে সুভাষচন্দ্র আলোচনা করেছিলেন। ১৯৩৮ সালের জানুয়ারি মাসে ভারতে ফেরার পথে সুভাষচন্দ্র আবার বেনেস-এর সঙ্গে (তখন তিনি রাষ্ট্রপতি) দেখা করে ভারতের মুক্তি সংগ্রাম নিয়ে আলোচনা করেছিলেন।
ইউরোপে রোমাঁ রোলাঁর সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের সাক্ষাৎকার ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। জেনিভা শহরে এই সাক্ষাৎকার হয়েছিল (৩ এপ্রিল, ১৯৩৫), রোলাঁকে সুভাষচন্দ্র এক ‘মহান ব্যক্তি, চিন্তাবিদ—ভারত ও ভারতীয় সংস্কৃতির পরম বন্ধু’ বলে শ্রদ্ধা করতেন। রোমাঁ রোলাঁ প্রখ্যাত সাহিত্যিক ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীজির সঙ্গে তাঁর পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও প্রীতির সম্পর্ক ছিল। তিনি গান্ধীজির জীবনীও লিখেছিলেন। তিনি শ্রীরামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দের গভীর অনুরাগী ছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দের অসাধারণ দুটি জীবনী-গ্রন্থ তিনি লিখেছিলেন। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, অন্যায়-বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রতি তাঁর গভীর মমতা ও সহানুভূতি ছিল। স্বৈরতন্ত্র ও মানুষের মর্যাদা এবং অধিকারের অবমাননার বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার ছিলেন। রোমাঁ রোলার সঙ্গে তাঁর গৃহে সাক্ষাৎকারের চিত্তস্পর্শী কাহিনী সুভাষচন্দ্র তাঁর গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন। রোঁলাকে প্রথম দর্শনের অনুভূতি অপূর্বভাবে প্রকাশ করে তিনি লিখেছেন, “দীর্ঘকায় পুরুষ···বিবর্ণ মুখচ্ছবি, আশ্চর্য দূটি উজ্জ্বল তীব্র চোখ। অনেকবার ছবিতে এ মুখ দেখেছি—মানুষের দুঃখ-বেদনার ভারে অবনত সেই করুণ মুখচ্ছবি! সেই বিশীর্ণ মুখমণ্ডলে এক অপরূপ বেদনার প্রকাশ ছিল—কিন্তু তা পরাজয়ের বেদনা নয়। কারণ যে মুহূর্তে তিনি কথা বলতে আরম্ভ করলেন তাঁর রক্তহীন গণ্ডদেশে রক্তাভা দেখা দিল—এক অসাধারণ জ্যোতিতে চোখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল—আর তাঁর প্রত্যেকটি কথায় জীবন ও আশা ধ্বনিত হয়ে উঠল।”
দু’জনের মধ্যে ভারতবর্ষের পরিস্থিতি, জাতীয় আন্দোলনের রূপ, সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছিল। গান্ধীজির নেতৃত্বে শান্তিপূর্ণ অহিংস আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা সম্বন্ধে তাঁর সংশয়ের কথা সুভাষচন্দ্র অকপটে ব্যক্ত করেন। রোলাঁর এই বিষয়ে কী মনোভাব ও অভিমত তিনি জানতে চান। রোলাঁ বলেন গান্ধীজির সত্যাগ্রহ ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অর্জনে ব্যর্থ হলে তিনি গভীর বেদনা ও নৈরাশ্য বোধ করবেন। যদি গান্ধীজির নীতি ও পথে জাতীয় আন্দোলন ব্যর্থতার মুখোমুখি হয়, তখন কি বিকল্প পথের কথা ভাবা ঠিক হবে? সুভাষচন্দ্রের এই প্রশ্নের উত্তরে রোলাঁ বলেন, “যে ভাবেই হোক সংগ্রাম চালাতেই হবে।” রোলাঁর উত্তরে সুভাষচন্দ্র খুব উৎসাহিত বোধ করেন। উভয়ের মধ্যে অত্যন্ত খোলামেলা অন্তরঙ্গ আলোচনা দীর্ঘসময় ধরে চলেছিল। শান্তিকামী, অহিংস আদর্শনিষ্ঠ রোঁলা স্বীকার করেন যে, তাঁর অন্তৰ্জীবনে যে দ্বন্দ্ব রয়েছে তার অন্যতম হল এই অহিংসার প্রশ্নটি। শোষণ, সামরিক সাম্রাজ্যবাদ, বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থা ও মানবতা বিরোধী সব অন্যায় হল এক ‘চিরস্থায়ী পাপ’। এর অবসানের জন্যে সমস্ত শক্তি নিয়োগ করা উচিত। তা না হলে ‘মানবসমাজের ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী’। রোমাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎকার ও তাঁর বক্তব্য সুভাষচন্দ্রকে নতুন আশা ও প্রেরণা দিয়েছিল। রোলাঁও অভিভূত হয়েছিলেন। সুভাষচন্দ্রের প্রতি তাঁর গভীর স্নেহ ও শ্রদ্ধা জন্মেছিল। সুভাষচন্দ্রের কল্যাণ ও সাফল্য তিনি কামনা করতেন। সুভাষচন্দ্র তাঁর The Indian Struggle 1920-1934 লন্ডনে প্রকাশিত হবার পরেই রোমাঁ রোলাঁকে পাঠিয়েছিলেন। রোলাঁ বইটি পরে মুগ্ধ হয়েছিলেন। চিঠিতে সেই কথা জানিয়ে তিনি সুভাষচন্দ্রকে লিখেছিলেন (২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৫), “ভারতে বিপ্লবের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে এটি একটি অবশ্যপাঠ্য গ্রন্থ···বইটিতে ঐতিহাসিকের শ্রেষ্ঠ গুণাবলী, স্বচ্ছচিন্তা ও বিচারবুদ্ধি দেখিয়েছেন। ···আপনার সব ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত না হলেও আমি স্বীকার করি আপনার যুক্তি আছে···আপনার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রশংসা করি।”
১৯৩৬ সালে লক্ষ্ণৌ কংগ্রেসে যোগদানের জন্যে ব্রিটিশ সরকারের সতর্কবাণী উপেক্ষা করে সুনিশ্চিত কারাবাসের কথা জেনেও, সুভাষচন্দ্র স্বদেশে ফেরার সিদ্ধান্তে অবিচল আছেন জেনে রোমাঁ রোলাঁ তাঁকে চিঠি লিখে বলেছিলেন দেশে ফেরা স্থগিত রাখতে। ওই চিঠির উত্তরে (৮ এপ্রিল, ১৯৩৬) সুভাষচন্দ্র গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে জানান যে, কারাপ্রাচীরের অন্তরালে জীবনের শ্রেষ্ঠ দিনগুলি কাটানোর মূল্য পরাধীন জাতির স্বাধীনতাকামী মানুষদের সর্বদাই দিতে হয়েছে এবং হবে। রোলাঁর প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি লেখেন যে, ভারতবর্ষের জাতীয় ও সামাজিক মুক্তির প্রতি তাঁর চিন্তা ও শুভেচ্ছা শক্তি ও প্রেরণার উৎসস্বরূপ।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন