১৯৩৭ সালের মার্চ মাসে কলকাতা মেডিকেল কলেজের মার্টিন ওয়ার্ড থেকে সুভাষচন্দ্র বিনাশর্তে মুক্তি পান। ভারত সরকার এবং বাংলা সরকার উভয়েই চায়নি যে তিনি ১৯৩৭-এর নির্বাচনোত্তর নতুন মন্ত্রিসভা গঠনে কোনও ভূমিকা গ্রহণ করেন। সেইরকম সময় হিসেব করেই তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। এরপর কয়েক মাস ডালহৌসির শৈলাবাসে স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্যে বিশ্রাম নেবার পর চিকিৎসার উদ্দেশ্যে তিনি অস্ট্রিয়ার বাদগাস্টাইনে পৌঁছন (নভেম্বর, ১৯৩৭)। সেখান থেকে ১৯৩৮ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি লন্ডনে যান। ইংলন্ডে প্রবেশের অনুমতি তিনি অবশেষে পেয়েছিলেন। এর পিছনে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কিছু সদস্যের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ছিল। ১৯৩৩ সালে সুভাষচন্দ্রকে যখন প্রথমে চিকিৎসার জন্যে ইউরোপের যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, তখন থেকেই টমাস উইলিয়মস, থর্প থার্টল, মর্লে, ম্যাক্সটন, গ্রেনফেল, সোরেনসন, জাগগার, হাউস অফ লর্ডসের আর্ল অফ কিননৌল প্রমুখ সদস্যরা সুভাষচন্দ্রকে কারারুদ্ধ করে রাখা, ইউরোপে বিভিন্ন দেশে তাঁর ভ্রমণ করার ওপর বাধা-নিষেধ আরোপ করা এবং ব্রিটেনে প্রবেশ করার অনুমতি না দেওয়া সম্বন্ধে নানান প্রশ্ন করে ব্রিটিশ সরকারকে বিব্রত করেছিলেন। মর্লের একটি প্রশ্নের উত্তরে সরকারের পক্ষ থেকে রোনাল্ড টেনিসন পীল জানান (৭ ডিসেম্বর, ১৯৩৫), সুভাষচন্দ্রকে ইংলন্ডে প্রবেশ না করতে দেওয়ার অন্যতম কারণ হল, “এদেশে অনেক ভারতীয় ছাত্র আছেন যাঁদের ওপর বসু এক অবাঞ্ছিত প্রভাব বিস্তার করতে পারেন। আর তাঁর উপস্থিতি গ্রেট ব্রিটেনে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের উন্নতি সহজতর করে তুলবে।”
লর্ড কিননৌল প্রশ্ন করেছিলেন (১ ডিসেম্বর, ১৯৩৬), ব্রিটিশ সরকার কি সুভাষচন্দ্র বসুকে চিরদিন বিনাবিচারে বন্দী রাখতে চান? এই প্রশ্নের এক দীর্ঘ উত্তরে ভারত-সচিব লর্ড জেটল্যান্ড বলেন, প্রশ্নকর্তা সুভাষচন্দ্র বসুর জীবনের সম্পূর্ণ ঘটনা ঠিকমত জানেন না। “দুর্ভাগ্যক্রমে, অত্যন্ত কর্মদক্ষতাসম্পন্ন, সম্ভাবনাময়, প্রতিভাবান একজন ব্যক্তি হয়েও মিস্টার বসু হয় ভুলক্রমে নতুবা দুর্ভাগ্যের ফলে তাঁর প্রায় সব কর্মক্ষমতা সৃজনশীল উদ্দেশ্যে ব্যয় না করে ধ্বংসাত্মক কাজে ব্যবহার করছেন।” ব্রিটিশ সরকার ১৯২১-২২ সালে প্রিন্স অফ্ ওয়েলসের ভারত সফরের সময়ে বয়কট ও বিক্ষোভ আন্দোলনে যে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন তা ভোলেননি। সেই প্রায় সুদূর অতীতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ভারত-সচিব বলেন, “সুভাষচন্দ্র অবৈধ স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী সংগঠিত করার কাজে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। এর উদ্দেশ্য ছিল পুলিশকে তার প্রকৃত কাজকর্ম থেকে বঞ্চিত করা এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে তাদের কাজকর্ম নিজেদের হাতে নিয়ে নেওয়া।” তিনি আরও বলেন যে, ভিয়েনায় থাকাকালেও সুভাষচন্দ্র তাঁর ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ অব্যাহত রেখেছিলেন। লর্ড জেটল্যান্ডের উত্তরে এটাও বোঝা গিয়েছিল যে, আসন্ন ভারতীয় নির্বাচনে সুভাষচন্দ্রকে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হবে না। তিনি কারারুদ্ধ থেকে ‘অনুপস্থিত প্রার্থী’ রূপে দাঁড়াতে পারেন। কিন্তু জিতলেও, যতদিন না তাঁর ওপর সব নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়, তিনি আইনসভার সদস্যপদ গ্রহণ করতে পারবেন না। ব্রিটিশ সরকারের সুভাষ-ভীতি কী পর্যায়ে পৌঁছেছিল, ভারত-সচিবের উত্তরে তা বোঝা গিয়েছিল।
ভারতে ব্রিটিশ শাসনের স্বার্থ নিরাপদ এবং সুনিশ্চিত করার কথা বিবেচনা করলে এই ভীতি অমূলক ছিল না। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৩২ সালের তৃতীয় গোলটেবিল বৈঠকে কংগ্রেস যোগ না দিলেও ওই বৈঠকের এবং পরবর্তী আলোচনার ভিত্তিতেই ১৯৩৫-এর ভারত-শাসন আইন প্রস্তুত হয় ও শাসনতান্ত্রিক সংস্কারগুলি বলবৎ হয়। এই আইনের মাধ্যমে ভারতবর্ষে প্রকৃত স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তিত হয়নি, নতুন আইনে ভাইসরয়ের হাতে অনেক বেশি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। অনুরূপভাবে প্রাদেশিক গভর্নরদের হাতেও বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। দেশীয় রাজ্যসমূহের (Princely States) প্রজাদের রাজনৈতিক অধিকার স্বীকৃত হয়নি। দেশীয় রাজন্যবর্গ ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে যোগদান করবে কি না, সে সিদ্ধান্ত তাঁদের ওপরই ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। সাম্প্রদায়িক নির্বাচন ব্যবস্থা অক্ষুণ্ণ থাকায় সাম্প্রদায়িকতা বৃদ্ধি পেয়ে ঐক্যবদ্ধ সুসংহত জাতীয় আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
১৯৩৬ সালে লক্ষৌয়ে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে তাঁর সভাপতির ভাষণে জওহরলাল নেহরু ঘোষণা করেছিলেন যে, মন্ত্রিসভা গঠনে কংগ্রেস উৎসাহী নয়। কিন্তু শেষপর্যন্ত প্রাদেশিক আইনসভাগুলির নির্বাচনে কংগ্রেস অংশগ্রহণ করে। সাধারণ (General) আসনগুলিতে কংগ্রেস প্রার্থীরা বিপুল ভোটাধিক্যে জয়লাভ করে। মোট ১১টি প্রদেশের (Provinces) মধ্যে ৭টিতে কংগ্রেস মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। এ ছাড়া সিন্ধু ও আসাম প্রদেশে কংগ্রেস একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে ওই দুই প্রদেশেও মন্ত্রিসভা গঠন করেন। সুভাষচন্দ্র প্রথম থেকেই ১৯৩৫ সালের শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার ঘোর বিরোধী ছিলেন। নতুন ব্যবস্থায় সরকারী হস্তক্ষেপ ও ক্ষমতাহীন মন্ত্রী সুনিশ্চিত করা হয়েছিল বলে তাঁর অভিমত ছিল। দেশীয় রাজন্যবর্গকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া, নানান জটিল বিধি-বিধানের মাধ্যমে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তাদের সংখ্যাগত গুরুত্ব অপেক্ষা আরও অনেক বেশি প্রতিনিধিত্ব লাভ করেছিল। এর ফলে যে হিন্দু সম্প্রদায় ভারতীয় জনসংখ্যার তিন-চতুর্থাংশ এবং কগ্রেসের দাবিগুলির পিছনে যাদের সক্রিয় ভূমিকা ছিল, তাদের প্রতি বৈষম্য দেখান হয়েছিল। সুভাষচন্দ্রের দৃষ্টিতে নতুন শাসন ব্যবস্থার পিছনে আসল উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় কংগ্রেসকে দুর্বল করে স্বাধীনতা আন্দোলনের শক্তি হ্রাস করা; সাম্প্রদায়িক বিভেদকে উস্কানি দিয়ে হিন্দু-মুসলমানের বিরোধের সুযোগ গ্রহণ করা; সংখ্যালঘুদের প্রকৃত স্বার্থ রক্ষা না করে ওই অজুহাতে মুসলিম লীগকে প্রভাব বিস্তারে সাহায্য করা। সুভাষচন্দ্রের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ও জনপ্রিয়তা, আপসহীন মনোভাব এবং পূর্ণ স্বাধীনতার লক্ষ্য থেকে এতটুকু বিচ্যুত না হওয়ার লৌহ সঙ্কল্পের কথা ভারত সরকার ও ব্রিটিশ সরকার খুব ভালভাবেই জানতেন। সুতরাং সুভাষচন্দ্র যাতে রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা না নিতে পারেন, সরাসরি গণ-সংযোগ, গণ-আন্দোলন না করতে পারেন, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না পারেন তার জন্যে যা কিছু করণীয় তা করতে তাঁরা বদ্ধপরিকর ছিলেন।
ইউরোপে থাকাকালেও সুভাষচন্দ্র ভারতীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও স্বাধীনতা আন্দোলনের গতি প্রকৃতি গভীর মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য এবং বিচার-বিশ্লেষণ করতেন। নিজের অভিমত ব্যক্ত করতেন। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জাতীয় আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। ১৯৩৪ সালে কংগ্রেসের মধ্যে কিছুসংখ্যক সমাজবাদী কংগ্রেসকর্মী শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্যে কাজ করার উদ্দেশ্যে জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে কংগ্রেস সোস্যালিস্ট পার্টি (Congress Socialist Party) গঠন করেন। এঁরা জাতীয় কংগ্রেসেরই অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। পৃথক কোনও দল গঠন করেননি। কংগ্রেস সোস্যালিস্ট দলের লক্ষ্য ছিল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে শ্রমিক ও কৃষকদের যোগদানে উৎসাহিত করা। তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। দলের বিশিষ্ট নেতাদের মধ্যে ছিলেন আচার্য নরেন্দ্র দেব, সম্পূৰ্ণানন্দ, আবদুল বারি, এম. আর. মাসানি, ডঃ রামমনোহর লোহিয়া, কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায়, অচ্যুত পট্টবর্ধন প্রমুখ। কংগ্রেস সোস্যালিস্ট পার্টি ও কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে অন্যান্য পার্থক্যের মধ্যে একটি মৌলিক বিরাট পার্থক্য ছিল। কংগ্রেস সোস্যালিস্ট দল জাতীয় কংগ্রেসকে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী সংগঠন এবং আন্দোলন বলে মনে করতেন। কিন্তু কমিউনিস্টরা কংগ্রেস দলকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সহযোগী বলে দেখতেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল্যায়নে কমিউনিস্টদের এটি ছিল আর এক মস্ত বড় ভুল। জওহরলাল সমাজতান্ত্রিক চিন্তার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন। সমাজতন্ত্রী দলের প্রতি তাঁর সহানুভূতি ও সমর্থন ছিল, তিনি ১৯৩৬ এবং ১৯৩৭ সালে কংগ্রেসের সভাপতিও হয়েছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও, এবং সমাজবাদী দলে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা যুক্ত থাকলেও, জাতীয় কংগ্রেসের নীতি ও কর্মসূচী নির্ধারণে কংগ্রেস সসাস্যালিস্টদের তেমন কোনও প্রভাব পড়েনি। তবে গান্ধীজির নীতি ও নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ এবং বিরোধিতার লক্ষণ সুষ্পষ্ট হচ্ছিল।
সুভাষচন্দ্র কংগ্রেসের মধ্যে সোস্যালিস্ট দল বা গোষ্ঠীর জন্মকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। তিনি আশা করেছিলেন, ভারতীয় রাজনীতিতে, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে এই দল ‘জঙ্গী’ ভূমিকা নিতে পারবে। এক বিবৃতিতে (১৭ এপ্রিল, ১৯৩৫) তিনি জানান, কংগ্রেসের মধ্যে যে ‘দক্ষিণপন্থী ঝোঁক’ দেখা দিয়েছে, যে ‘পার্লামেন্টারি পলিসি’ গ্রহণ করা হচ্ছে, তার বিরুদ্ধেই এই দলের জন্ম হয়েছে। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ভয় ও ‘চোখ রাঙিয়ে’ এই দলের শক্তি ও গুরুত্ব বৃদ্ধি রোধ করা যাবে না। তবে দলের নামটির নির্বাচন তেমন ঠিক হয়নি বলে তাঁর মনে হয়েছিল। ‘সমাজতন্ত্র’-র নানা রূপ, রঙ, নানা অর্থ আছে। দলের ধ্যান-ধারণার মধেও কিছু অস্বচ্ছতা, অস্পষ্টতা আছে। ‘মধ্য-ভিক্টোরীয় যুগের গণতন্ত্র সম্পর্কিত ধারণাগুলি’ স্বাধীন ভারতবর্ষের সংবিধান রচনার সময় গ্রহণ করা সম্পর্কে সুভাষচন্দ্রের সন্দেহ ও আশঙ্কা ছিল। তাঁর মতে স্বাধীনতা সংগ্রামী দলেরই দেশের নতুন সংবিধান রচনায় অধিকার থাকা উচিত। সেই সাহস দেখাতে, দায়িত্ব পালন করতে সোস্যালিস্ট দল পারবে কি না সে বিষয়ে তিনি সংশয় প্রকাশ করেন। তবুও ওই দলের যে ‘এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি’ আছে সে কথাও তিনি জানান। তিনি আশা প্রকাশ করেন, ‘অন্তর্নিহিত হীনম্মন্যতাকে চিরতরে ঝেড়ে ফেলে আগামী ভারতবর্ষের পুরো দায়িত্বের বোঝা কাঁধে তুলে নেবার দায়িত্ব সোস্যালিস্ট দল গ্রহণ করবে।” সুভাষচন্দ্রের এই প্রত্যাশা কিন্তু পূর্ণ হয়নি।
কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল প্রথমে ১৯৩৬-১৯৩৭ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার বিরোধী ছিলেন। পরে এই মত পরিবর্তন করে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সিদ্ধান্ত সমর্থন করেন। কিন্তু মন্ত্রিত্ব গ্রহণের পক্ষে তাঁরা ছিলেন না। এই বিরোধিতাও ফলপ্রসূ হয়নি। সুভাষ খুবই হতাশ হন। তিনি মনে করেছিলেন যে, শেষপর্যন্ত সোস্যালিস্টরা গান্ধী-প্রভাব মুক্ত হতে পারেননি। তার অন্যতম প্রধান কারণ হল, সমাজতন্ত্রী মনোভাবাপন্ন বলে ব্যাপক পরিচিত, সোস্যালিস্ট দলের আদর্শ ও লক্ষ্যের সমর্থক, কংগ্রেস সভাপতি জওহরলাল নেহরুর ‘ভাবপ্রবণ রাজনীতির প্রভাব’। লক্ষ্ণৌ কংগ্রেসের অধিবেশনের কয়েক মাস পূর্বে ইউরোপে নেহরুর সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের দেখা হয়েছিল। নেহরু তাঁর স্ত্রী কমলার চিকিৎসার জন্যে সেখানে গিয়েছিলেন। সুইজারল্যান্ডে এক স্বাস্থ্যনিবাসে সুভাষচন্দ্রের উপস্থিতিতেই কমলা নেহরুর মৃত্যু হয়। সুভাষচন্দ্র লক্ষৌ-কংগ্রেসে যোগদানের সঙ্কল্পের কথা জওহরলালকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন। জওহরলাল চাননি যে গ্রেপ্তার সুনিশ্চিত জেনেও সুভাষচন্দ্র ওই সময়ে দেশে যান। কিন্তু তবুও সুভাষচন্দ্র মত পরিবর্তন করেননি। চিঠিপত্রে সুভাষচন্দ্র জওহরলালকে অগ্রজের মতো শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন। কিন্তু উভয়ের সম্পর্কে তখন চিড় ধরেছিল। সুভাষচন্দ্র তাঁর The Indian Struggle বইটি জওহরলালকে উপহার দিয়েছিলেন। বইটিতে জওহরলাল ও অন্যান্য প্রসঙ্গে সুভাষচন্দ্রের কিছু বক্তব্য তাঁর পছন্দ হয়নি। তিনি বইটির পরবর্তী সংস্করণে কিছু কিছু সংশোধন করার জন্যে সুভাষচন্দ্রকে বলেন। সুধী প্রধান ওই সময়ের নেহরু-সুভাষ সম্পর্কের উল্লেখ করে বলেছেন যে, নেহরু সম্পর্কে সুভাষচন্দ্রের ক্ষোভকে, “সে যুগের প্রত্যেকটি রাজনীতি সচেতন বাঙালীর মনোভাব” বলা যায়। কথাটি বহুলাংশে সত্যি।
The Indian Struggle-এ নেহরুর সমালোচনা বেশ তীক্ষ্ণ। এর পরবর্তীকালে সুভাষের প্রতি নেহরুর বিরূপ মনোভাব, তাঁর কার্যকলাপের বিরোধিতার এটি যে অন্যতম কারণ ছিল তা মনে করলে খুব ভুল হবে না। আদর্শ ও নীতিগত বিরোধ ছাড়াও দু’জনের মধ্যে ক্রমশ দূরত্ব বাড়ার পিছনে দুই বিরাট ব্যক্তিত্বের প্রশ্নটিও জড়িয়ে পড়েছিল। তাঁর গ্রন্থে সুভাষচন্দ্র স্বীকার করেছিলেন, জনপ্রিয়তায় একমাত্র গান্ধীর পরেই জওহরলালের স্থান। কিন্তু নেহরু যে বলেছেন, “ফ্যাসিবাদ ও কম্যুনিজমের মধ্যে কোনও মধ্যপথ নেই, দুটির মধ্যে একটিকে বেছে নিতে হবে এবং কম্যুনিজমের আদর্শই আমি বেছে নিয়েছি”—এটা তাঁর ব্যক্তিগত অভিমত। জাতীয় কংগ্রেসের নয়। আর, নেহরুর জনপ্রিয়তার অর্থ এই নয় যে কংগ্রেসের সকলেই তাঁর মতামত স্বীকার করেন। স্বয়ং গান্ধীজি সম্বন্ধেও এরকম কথা বলা যাবে না। তাঁর The Indian Struggle পড়ে নেহরু যেমন খুব খুশি হননি, তেমনি জওহরলালের ‘আত্মজীবনী’ (An Autobiography), (এটিও ইউরোপে প্রকাশিত হয়েছিল) পড়ে সুভাষচন্দ্রের মনে হয়েছিল বইটি লেখার ফলে নেহরু উদারপন্থী ইংরেজ জনগণের মধ্যে বিশেষ জনপ্রিয় হয়েছেন। সমসাময়িক ভারতীয় রাজনৈতিক পটভূমিতে এই মন্তব্যটি খুব প্রশংসাসূচক ছিল না। গান্ধীজির প্রতি জওহরলালের অটল আনুগত্যের কঠোর সমালোচনা করে সুভাষচন্দ্র লেখেন যে, পর পর দু’বার (১৯৩৬ এবং ১৯৩৭) নেহরু কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হওয়ায় বামপন্থী কংগ্রেসীদের আশা জেগেছিল এবার তিনি কংগ্রেসে একটা নতুন গতিশীল চিন্তা ও কর্মসূচীর সূচনা করতে পারবেন। গান্ধীজির প্রতি আনুগত্য ও শ্রদ্ধা সত্ত্বেও গান্ধীবাদের বিকল্পে বিশ্বাসী একটি দল গড়তে পারবেন। কিন্তু জীবনে নেহরু কখনও ‘মহাত্মার বিরুদ্ধে কিছু করার সাহস পাননি’, এখনও তা পারলেন না। সুভাষচন্দ্রের এই মন্তব্যের সবটুকু তাঁর গ্রন্থের প্রথম ভাগে ছিল না, পরে সংযোজিত হয়েছিল। কিন্তু যেটুকু তাঁর বই-এর প্রথমভাগে ছিল তা সমকালীন কংগ্রেস রাজনীতি, গান্ধী-নেহরু-সুভাষের সম্পর্ক এবং তার পরবর্তী অধ্যায় বোঝার পক্ষে তাৎপর্যপূর্ণ।
ইংলণ্ডে প্রবেশের অনুমতি না পাওয়ায় সুভাষচন্দ্র খুবই ক্ষুব্ধ ছিলেন। এই নিয়ে পার্লামেন্টে প্রশ্ন ওঠা ছাড়াও ব্রিটিশ সংবাদপত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হয়েছিল। সুভাষচন্দ্র ‘দি নিউ স্টেটসম্যান এন্ড নেশন’ (The New Statesman and Nation) পত্রিকায় একটি চিঠি লিখে (৩১ আগস্ট, ১৯৩৫) তাঁর ক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানান। তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, তাঁর The Indian Struggle বইটি লন্ডনে প্রকাশিত ও ব্রিটেনে প্রচারের জন্যে অনুমতি প্রাপ্ত, অথচ বইটি ভারতবর্ষে নিষিদ্ধ। ইংরেজ আইনের ব্যাখ্যা কি তাহলে ব্রিটেনে একরকম, আর ভারতবর্ষে আর একরকম? ‘ডেইলি হেরাল্ড’-এ (Daily Herald) স্বদেশে ফিরলেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে এই সতর্কবাণীর প্রতিবাদে তাঁর বক্তব্য প্রকাশ করা হয়েছিল (২১ মার্চ, ১৯৩৬)। অন্যান্য ব্রিটিশ সংবাদপত্রেও বিভিন্ন সময়ে সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে সংবাদ প্রকাশিত হয়। ‘ইভনিং নিউজ’ (Evening News), ‘ইভনিং স্ট্যান্ডার্ড’ (Evening Standard) এবং ‘ইভনিং ক্রনিকল’ (Evening Chronicle)-এ তাঁকে জওহরলাল নেহরুর পরবর্তী সম্ভাব্য কংগ্রেস সভাপতি রূপে উল্লেখ করা হয় (১৮ নভেম্বর ১৯৩৭)।
সুভাষচন্দ্র বসুর লন্ডনে পৌঁছনো ও বিপুল সংর্বধনার সংবাদ ব্রিটিশ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় (১১ জানুয়ারি, ১৯৩৮)। ‘ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ান’-এ তাঁর এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারও বেরয়। পত্রিকাটির সংবাদদাতা লেখেন, “যেসব ইংরেজ প্রথম বারের মতো তাঁর সঙ্গে মিলিত হন, তাঁরা সকলেই তাঁর মধুর এবং শান্ত ব্যবহার আর ভারতীয় বিষয়সমূহ সম্পর্কে আলোচনায় তাঁর প্রত্যয় লক্ষ্য করে মুগ্ধ হয়েছেন।”
লন্ডনে সুভাষচন্দ্র লর্ড হ্যালিফ্যাক্স, ভারত-সচিব লর্ড জেটল্যান্ড, ব্রিটিশ শ্রমিক দল (Labour Party) ও উদারনৈতিক দলের (Liberal Party) এবং অন্যান্য বিশিষ্ট নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, কথাবার্তা বলেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন ক্লিমেন্ট এ্যাটলি, গ্রিনউড, বেভিন, স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস, লর্ড এ্যালেন প্রমুখ। খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে হ্যারল্ড ল্যাস্কি, জে. বি. এস. হ্যালডেন, জি. ডি. এইচ. কোল, গিলবার্ট মারে প্রমুখের সঙ্গে তাঁর দেখা ও কথাবার্তা হয়েছিল। লর্ড জেটল্যান্ড কমিউনিজম সম্পর্কে সুভাষচন্দ্রের অভিমত জানতে চেয়েছিলেন।
যে সুভাষচন্দ্রকে ব্রিটেনে প্রবেশের অনুমতি দিতেই ব্রিটিশ সরকারের এত প্রবল আপত্তি ছিল, যাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ ব্রিটিশ দূতাবাস ও গোয়েন্দা বাহিনী লক্ষ্য করেছিল, তাঁর সঙ্গে ভারত-সচিব থেকে শুরু করে বড় বড় রাজনৈতিক নেতাদের দেখা করতে সম্মত হওয়া এবং কথাবার্তা বলার মূল কারণ ছিল, ইতিপূর্বেই সংবাদ প্রচারিত হয়েছিল যে, সুভাষচন্দ্র জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হচ্ছেন। সুতরাং ভাবী কংগ্রেস সভাপতির সঙ্গে কথাবার্তা বলে তাঁর মনোভাব জানা এবং সম্ভব হলে, তাঁকে কিছুটা প্রভাবিত করার ইচ্ছা ব্রিটিশ সরকারী মহলের ছিল। এছাড়া অন্য অনেকেই ছিলেন ভারতবন্ধু ও হিতৈষী।
লন্ডনে সুভাষচন্দ্র ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির প্রখ্যাত নেতা রজনী পাম দত্তকে একটি সাক্ষাৎকারে যা বলেছিলেন সেটি ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র ‘ডেইলি ওয়াকার-এ প্রকাশিত হয়েছিল (২৪ জানুয়ারি, ১৯৩৮)। অন্যান্য প্রশ্নের মধ্যে রজনী পাম দত্ত জিজ্ঞাসা করেছিলেন, সুভাষচন্দ্র তাঁর The Indian Struggle গ্রন্থে ফ্যাসিজম সম্বন্ধে যা বলেছেন সে নিয়ে অনেক বিতর্ক হচ্ছে, ওই নিয়ে তিনি কি কিছু বলবেন? এর উত্তরে তিনি খুব স্পষ্ট ও খোলাখুলিভাবে যা বলেছিলেন তা আজও এই বিতর্কিত ও কিছুটা স্পর্শকাতর বিষয়টি সম্বন্ধে সুভাষচন্দ্রের বক্তব্য বুঝতে সহায়ক হবে। তিনি বলেন, “তিন বছর আগে ঐ গ্রন্থ রচিত হয়েছে। তার পরে আমার চিন্তাধারা অনেক পরিণতি লাভ করেছে। আমি সঠিক যা বলতে চেয়েছিলাম তা হল—আমরা ভারতবাসী, জাতীয় স্বাধীনতা কামনা করি এবং তা অর্জন করবার পর সোস্যালিজম অর্থাৎ সমাজবাদের পথে অগ্রসর হতে চাই। ‘কমিউনিজম ও ফ্যাসিজম-এর সমম্বয়’ বলতে আমি এ কথাই বুঝিয়েছিলাম। হয়তো আমার ব্যবহৃত শব্দগুলি সুষ্ঠু হয়নি। কিন্তু আরও একটা কথা মনে করা দরকর। আমি যখন বইটি লিখেছিলাম তখনও ফ্যাসিজম সাম্রাজ্যবাদী অভিযানের পথে অগ্রসর হতে শুরু করেনি। এবং আমার কাছে এটাই জাতীয়তাবাদের এক উগ্ররূপ হিসাবে প্রতিভাত হয়েছিল। আমি একথাও বলতে চাই যে, ভারতবর্ষে যাঁরা কমিউনিজমের পক্ষপাতী তাঁদের একটি বড় অংশ কমিউনিজমের যে রূপ প্রদর্শন করেন, তা জাতীয়তা বিরোধী বলেই আমার ধারণা। এবং তাঁদের কয়েকজন জাতীয় কংগ্রেসের প্রতি যে শত্রুতা প্রদর্শন করছেন তাতে আমার এই ধারণা আরও দৃঢ় হয়।”
লন্ডনে থাকতেই তিনি খবর পান যে সর্বসম্মতিক্রমে তিনি হরিপুরায় আসন্ন কংগ্রেস অধিবেশনের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। খবর পেয়েই স্বদেশ যাত্রা করে ১৯৩৮ সালের ২১ জানুয়ারি তিনি কলকাতা পৌঁছন।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন