দেশনায়ক – ২৬

গান্ধীজির নেতৃত্বে কংগ্রেসের অহিংস আন্দোলনে যুক্ত থাকলেও সশস্ত্র আন্দোলনের প্রতি সুভাষচন্দ্রের মনোভাব কী ছিল তা কিছুটা জটিল ও বিতর্কিত বিষয়। বিপ্লবী কর্মতৎপরতার সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের যোগাযোগ সম্পর্কে সরকার ও গোয়েন্দা বিভাগের বরাবরই গভীর সন্দেহ ছিল। বিনা বিচারে তাঁকে মান্দালয় জেলে দীর্ঘকাল বন্দী করার পিছনে ছিল এই সন্দেহ ও আতঙ্ক। এর জন্যে গোয়েন্দা বিভাগ তাঁর বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগ আনতে এবং রিপোর্ট দিতেও দ্বিধা করেনি। ১৯২৮ সাল থেকে বিপ্লবী তৎপরতা আবার বৃদ্ধি পেতে থাকে। অসহযোগ আন্দোলন স্তিমিত হবার পরই তার লক্ষণ দেখা দিয়েছিল। বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলির মধ্যে ছিল ‘হিন্দুস্থান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন’ দলের কয়েকজন সদস্যের কাকোরীর কাছে একটি ট্রেনে ডাকাতির চেষ্টা (১ আগস্ট, ১৯২৫)। কয়েকজন বিপ্লবী ধরা পড়েন ও তাঁদের বিচার ‘কাকোরী ষড়যন্ত্রের মামলা’ নামে খ্যাত হয়। বিচারে রামপ্রসাদ, বিসমিল, রাজেন্দ্রনাথ লাহিড়ী, রোশনলাল ও আসফাক্-উল্লার ফাঁসির আদেশ হয়। কয়েকজনের দীর্ঘ কারাদণ্ড হয়। উত্তর ভারতের প্রখ্যাত বিপ্লবী চন্দ্রশেখর আজাদ ‘হিন্দুস্থান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন’ বিপ্লবী দলটিকে ‘হিন্দুস্থান সোস্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন’ নামে পুনর্গঠিত করেন। এই দলের ভগৎ সিং সন্ডার্স নামে এক কুখ্যাত পুলিশ অফিসারকে হত্যা করেন (১৭ নভেম্বর, ১৯২৮)। কয়েকমাস পর ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত দিল্লিতে আইনসভা কক্ষে দু’টি বোমা বিস্ফোরণ করেন (৮ এপ্রিল, ১৯২৯)। ওই সময় আইনসভায় দমনমূলক ‘ট্রেডস্ ডিসপিউট বিল’ সম্বন্ধে বিতর্ক হচ্ছিল। তাঁরা দু’জনে পালাবার কোনও চেষ্টা করেননি, কেননা ওঁরা চাননি নিরীহ লোকেদের ওপর কোনও অত্যাচার, নির্যাতন হয়।

দিল্লির আইনসভা কক্ষে বোমা বিস্ফোরণের পর পুলিশ লাহোর ও সাহারানপুরে দু’টি বোমা তৈরির কারখানা আবিষ্কার করে। বহু বিপ্লবী গ্রেপ্তার হন। তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা ‘লাহোর ষড়যন্ত্রের মামলা’ (১৯২৯) নামে খ্যাত হয়। এই বিচার চলাকালেই অভিযুক্ত বিপ্লবীরা জেলের দুঃসহ অবস্থা ও বন্দীদের প্রতি দুর্ব্যবহারের বিরুদ্ধে অনশন শুরু করেন। অন্য সব বন্দী অনশন ত্যাগ করলেও যতীন দাস আমৃত্যু অনশন করে ৬৪ দিন পর মৃত্যুবরণ করেন (২৩ সেপ্টেম্বর, ১৯২৯)। একই সময়ে বরিশালে সতীন্দ্রনাথ সেন অনশন শুরু করেন। দীর্ঘ অনশনের পর সুভাষচন্দ্রের অনুরোধে তিনি অনশন ভঙ্গ করেন। তাঁর অনশনও ব্যাপক উদ্বেগ ও ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল। তাঁর সংগ্রামী জীবনের অধিকাংশ কালই কারান্তরালে কেটেছিল। লাহোর ষড়যন্ত্রের মামলায় ভগৎ সিং, সুখদেব ও রাজগুরুর প্রাণদণ্ড এবং অনেকের দীর্ঘমেয়াদী কারাদণ্ড হয়। যতীন দাসের অনশন ও মৃত্যু এবং ভগৎ সিং ও তাঁর সহ-বিপ্লবীদের ফাঁসি সারা দেশে প্রচণ্ড আলোড়ন ও বিক্ষোভ সৃষ্টি করে। সুভাষচন্দ্র গভীরভাবে মর্মাহত হন। এর প্রতিফলন গান্ধীজির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কেও হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে বিপ্লবী মতাদর্শ ও কর্মপন্থা সম্পর্কে সুভাষচন্দ্রের প্রকাশ্য মনোভাবের উল্লেখ প্রয়োজন।

সুভাষচন্দ্রকে গ্রেপ্তার করে বিনা বিচারে দীর্ঘদিন মান্দালয়ে বন্দী রাখার পর যখন মুক্তির প্রশ্নটি সরকারের বিবেচনাধীন তখন পুলিশ বিভাগই প্রবল আপত্তি জানায়। বিলেতে হাউস অফ কমন্স-এ লর্ড উইন্টারটন রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তিদানের বিপক্ষে যুক্তি দেখান যে, বন্দীরা বিপ্লবাত্মক কার্যকলাপ ও হত্যার ষড়যন্ত্রে দোষী। এই অভিযোগের তীব্র প্রতিবাদ করে সুভাষচন্দ্র সংবাদপত্রে বিবৃতি দিয়ে জানান যে, এই অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। রাজনৈতিক বন্দীদের অপরাধ হল তাঁরা একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক সঙঘ গড়ে তুলেছেন। নিজে মুক্ত হবার পর সুভাষচন্দ্র রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির দাবিতে জোরাল আন্দোলন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। এঁদের মধ্যে বিপ্লবী বন্দীরাও ছিলেন। রাজবন্দীদের মুক্তি সমস্যাকে তিনি ‘জাতীয় পরাধীনতার প্রতীকী সমস্যা মাত্র’ বলে অভিহিত করেছিলেন। রাজশাহী শহরে এক বিশাল জনসমাবেশে তিনি বলেন যে, মন্টেগু-চেমসফোর্ড শাসন সংস্কার (১৯১৭) বিপ্লবী কাজকর্মের ফলেই সম্ভব হয়েছে। আর একটি জনসভায় স্বাধীনতা অর্জনের জন্যে আত্মশক্তির বিকাশের প্রয়োজন প্রসঙ্গে তিনি কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে অর্জুনের ক্লৈব্যের উল্লেখ করে বলেন, “ক্লৈব্য এসে আমাদের দেশকে আজ আক্রমণ করেছে। এমনি ক্লৈব্য একদিন কুরুক্ষেত্র-সমরের পূর্বে অর্জুনকেও আক্রমণ করেছিল। এই ক্লৈব্যের জন্যই অর্জুনের মনে নানা প্রকার সংশয় উপস্থিত হয়েছিল। দেশের অনেক লোকের মনে স্বাধীনতা সম্বন্ধে যে সংশয় জাগে, তার কারণ অর্জুনের ক্লৈব্য।” প্রায় সাংকেতিক ভাষায় হলেও সুভাষচন্দ্রের এই ভাষণের ইঙ্গিত ছিল সুস্পষ্ট।

‘যুগান্তর’ গোষ্ঠীর বিপ্লবীরা সুভাষচন্দ্রের অনুরাগী ও সমর্থক ছিলেন। বেঙ্গল ভলানটিয়ার্স (Bengal Volunteers)-এর হেমচন্দ্র ঘোষ ও জ্যোতিষচন্দ্র জোয়ারদার, চট্টগ্রামের সূর্য সেন (মাস্টারদা) প্রমুখ বিপ্লবীদের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। ‘বেঙ্গল ভলানটিয়ার্স’-এর (সংক্ষেপে বি. ডি. নামে পরিচিত) আসল লক্ষ্য ছিল সশস্ত্র অভ্যুত্থান। জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনেও তরুণ বিপ্লবীদের অনেকেই ঐ সময় যোগ দিচ্ছিলেন। ভগৎ সিং ও সূর্য সেনও কংগ্রেসের সঙ্গে কিছু সময়ের জন্যে যুক্ত ছিলেন। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের (১৮ এপ্রিল, ১৯৩০) নেতা মাস্টারদা ও তাঁর বেশ কয়েকজন সহ-বিপ্লবী কলকাতা কংগ্রেসের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্য ছিলেন। শরৎচন্দ্র বসু চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলায় অনন্ত সিং ও আরও কয়েকজন অভিযুক্ত বিপ্লবীর পক্ষে আদালতে দাঁড়িয়েছিলেন। এর ফলে সরকারি ও পুলিশ মহলে সন্দেহ দৃঢ়তর হয় যে, শরৎচন্দ্র ও সুভাষচন্দ্র দুই ভাই-ই বিপ্লব-আন্দোলনের সমর্থক ও বিপ্লবীদের সঙ্গে তাঁদের গোপন যোগাযোগ আছে।

শহীদ যতীন দাসের কারাগারে অনশনে মৃত্যুতে সৃভাষচন্দ্রের প্রতিক্রিয়ায় প্রকাশ পেয়েছিল তিনি কত গভীরভাবে মৃত্যুঞ্জয়ী বিপ্লবীদের শ্রদ্ধা করতেন। যতীন দাস ১৯২২ সালে সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে উত্তরবঙ্গে বন্যাত্রাণে কাজ করেছিলেন। সমাজসেবী প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ কলকাতা তরুণ সমিতি, দক্ষিণ কলকাতা কংগ্রেস কমিটি এবং কয়েক বছর পরে কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীতেও ‘মেজর’ যতীন দাস সক্রিয় ছিলেন। তিনি সুভাষচন্দ্রের বিশেষ স্নেহভাজন হয়েছিলেন। লাহোর জেলে বন্দীদের প্রতি দুর্ব্যবহার ও বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে রাজবন্দীরা অনশন শুরু করলে যতীন্দ্রনাথ প্রথমে অনশন করতে ইচ্ছুক ছিলেন না। তিনি বলেছিলেন, “অনশন ধর্মঘট কাকে বলে তা আমি জানি। তোমাদের সে সম্পর্কে কোনও অভিজ্ঞতা নেই। আমি যদি অনশন ধর্মঘট শুরু করি তবে শেষ পর্যন্ত তা চালিয়ে যাব।” যতীন দাস মৃত্যুবরণ করে তাঁর কথা রেখেছিলেন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন, যতীন্দ্রনাথ শিক্ষা দিয়ে গেছেন কর্ম ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মৃত্যুকে জয় করা যায়। মৃত্যুর পূর্বে যতীন্দ্রনাথ বলে যান বাঙালি রীতিতে তাঁর শেষ কাজ যেন করা না হয়। কারণ, “আমি বাঙালি নই। আমি একজন ভারতীয়।” যতীন্দ্রনাথের মৃতদেহ ট্রেনে করে কলকাতায় আনা হয়। সুভাষচন্দ্র ও কিছু স্বেচ্ছাসেবক সারা রাত শবাধারের পাশে প্রহরায় ছিলেন। পরের দিন সুভাষচন্দ্র, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত প্রমুখ নেতারা খালি পায়ে সহস্র সহস্র মানুষের শোক মিছিলের নেতৃত্ব দেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের মৃত্যুর পর এত বড় শোক মিছিল আর কলকাতা মহানগরীতে হয়নি।

যতীন দাসের আত্মোৎসর্গ সম্পর্কে গান্ধীজি নীরব ছিলেন। এই নিয়ে প্রচুর সমালোচনা হয়েছিল। বহু মানুষ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। গান্ধীজির নীরবতার কারণ ছিল, তিনি বিপ্লবী সংগঠনগুলির কর্মতৎপরতা এবং লাহোর জেলে বন্দীদের অনশন সমর্থন করেননি। সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, সুভাষচন্দ্র বারবার তারবার্তা পাঠিয়ে গান্ধীজিকে একটি বাণী পাঠাবার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু গান্ধীজি কোনও বাণী পাঠাননি। তিনি যতীন দাসের মৃত্যুকে ‘ইচ্ছাকৃত আত্মহত্যা’ (Diabolical Suicide) বলে মনে করেছিলেন। জানি না, গান্ধীজি সত্যিই ওইরকম কথা বলেছিলেন কি না। সাবিত্রীপ্রসন্ন ‘diabolical’ শব্দটির অনুবাদ করেছেন ‘ইচ্ছাকৃত’। কিন্তু এই ইংরাজি শব্দটির আক্ষরিক অনুবাদ হল ‘শয়তানসুলভ’। কথাটি খুবই খারাপ, নিন্দনীয়। গান্ধীজি বাক্য ব্যবহারে সাধারণত খুবই সংযমী ও বিচক্ষণ ছিলেন। যাই হোক, তিনি যে যতীন্দ্রনাথের আমৃত্যু অনশনের সিদ্ধান্তের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন না এটা অনস্বীকার্য। প্রকৃতপক্ষে বিপ্লবীদের নীতি ও রাজনৈতিক পথ ও লক্ষ্য সম্বন্ধে তাঁর বিভিন্ন সময়ের মন্তব্যের মধ্যে একটা স্ব-বিরোধ দেখা দিত। তিনি গোপীনাথ সাহা, যতীন্দ্রনাথ দাসের মৃত্যুতে নীরব ছিলেন। একটিও প্রশংসাসূচক কথা বলেননি। কিন্তু ভগৎ সিং-এর ফাঁসির পর তিনি তাঁর সাহস ও স্বদেশপ্রেমের প্রশংসা করেছিলেন। একাধিকবার বিভিন্ন পটভূমিতে গান্ধীজি ‘ক্ষাত্রধর্ম’, কাপুরুষতার চেয়ে অস্ত্রধারণের প্রয়োজনীয়তা এবং আদর্শের জন্যে যুদ্ধে প্রাণবিসর্জনের কথা বলেছেন। সুভাষচন্দ্র সম্বন্ধেই তাঁর নানা সময়ে নানা অর্থবহ মন্তব্য আছে। বিপ্লব আন্দোলন যখন ব্যাপক হয়ে উঠেছে সেই সময় গান্ধীজির কিছু কিছু বক্তব্য পুলিশ ও সরকার-সমর্থক সংবাদপত্রকে বিভ্রান্ত করেছিল। যেমন, ‘স্টেটস্‌ম্যান’ মন্তব্য করে (২৮ আগস্ট, ১৯৩০) যে, কংগ্রেসের কার্যকলাপ আর বিপ্লবীদের অপরাধমূক কাজের মধ্যে সঠিক তফাৎ বোধগম্য হচ্ছে না। গান্ধীজি প্রবল উৎসাহে অহিংস পথের কথা প্রচার করছেন বটে, কিন্তু তিনি এমন সব কথাবার্তাও বলছেন যা মাথা গরম যুবকদের ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদের জন্যে সংক্ষিপ্ত সহজতর পথ (short-cut) নিতে উৎসাহিত করছে।

সুভাষচন্দ্রের ১৯২৯-১৯৩২ সালের বক্তৃতা ও কর্মতৎপরতা বিশ্লেষণ করলেও বিপ্লবীদের নীতি ও কার্যকলাপ সম্বন্ধে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে এক আপাত স্ব-বিরোধ লক্ষ্য করা যায়। একাধিকবার প্রকাশ্য বিবৃতি ও ভাষণে তিনি সন্ত্রাসবাদ ও সন্ত্রাসবাদী কাজের প্রতি তাঁর যে সমর্থন নেই তা ব্যক্ত করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে হাওড়া জেলা রাজনৈতিক সম্মেলনে (২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯২৯) তাঁর প্রদত্ত ভাষণটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এর মাত্র ক’দিন আগে যতীন দাসের মৃত্যু ও শোকযাত্রা কলকাতার ও সারা দেশের মানুষকে বিহ্বল ও উত্তেজিত করেছিল। বক্তৃতার শুরুতেই সুভাষচন্দ্র তার উল্লেখ করে যতীন্দ্রনাথের জীবন ‘দধীচির তপস্যাসিদ্ধ’ বলে অভিহিত করেন। নিজের অস্থিপুঞ্জ দিয়ে যতীন্দ্রনাথ স্বাধীনতার আগুন জ্বালিয়ে গেছেন বলে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন। কিন্তু একই বক্তৃতায় তিনি বলেন, “জানি না দেশে এখনো এমন লোক আছেন কি না যারা মনে করেন যে আড়াইখানা বোমা ও দেড়খানা পিস্তলের দ্বারা তাঁরা ভারত উদ্ধার করতে পারবেন। কিন্তু ভারতের উদ্ধার সাধন অত সহজ নয়। আড়াইখানা বোমা ও দেড়খানা পিস্তলের দ্বারা Terrorism করা যায়। কিন্তু করা যায় না Revolution। Terrorism ও Revolution এক কথা নয়। Terrorism মুষ্টিমেয় লোকের দ্বারা সংঘটিত হতে পারে; কিন্তু Revolution সম্ভব হবে শুধু সেই দিন, যেদিন সমগ্র জাতি জাগবে।” বিপ্লব অস্ত্রের দ্বারা সংঘটিত হতে পারে, কিংবা বিনা অস্ত্রেও হতে পারে। পৃথিবীতে রক্তপাতহীন বিপ্লবের দৃষ্টান্ত আছে। নিজের বিশ্বাস ব্যক্ত করে তিনি বলেন, Terrorism (সন্ত্রাসবাদ)-এর যুগ চিরকালের জন্যে শেষ হয়ে গেছে। এখন প্রয়োজন গণ-সংগঠন (mass organization)। যেখানে অত্যাচার, যেখানে কায়েমী স্বার্থের (vested interest) প্রতিকূলতা— সেখানেই আন্দোলন শুরু করতে হবে। “হয়তো কখনো সমাজের উচ্চবর্ণদের বিরুদ্ধে সত্যাগ্রহ আরম্ভ করতে হবে; হয়তো কখনো ধনিক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে গরীব চাষী ও মজুরদের সংঘবদ্ধ করে আন্দোলন চালাতে হবে; হয়তো কখনো রাষ্ট্রীয় দাবি আদায় করবার জন্যে আইন অমান্য বা খাজনা বন্ধ করতে হবে… যেদিন জাতি হিসাবে সঙঘবদ্ধ হতে পারব সেইদিনই আমরা আমাদের সহযোগিতা ও সহায়তা প্রত্যাহার করে বন্দুক-কামান-বিশিষ্ট আমলাতন্ত্রকে বিনা অস্ত্রেই আমাদের পদানত করতে পারব।”

সুভাষচন্দ্রের এই ভাষণটি বিপ্লব আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা ও সার্থকতা সম্বন্ধে তাঁর তৎকালীন দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার পক্ষে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। খুব স্পষ্টতই তিনি ব্যক্তিসন্ত্রাসকে সমর্থন করছিলেন না। এর সার্থকতা আর নেই বলে তিনি মনে করেছিলেন। রাষ্ট্রীয় বিপ্লবের আদর্শ ও পথকে তিনি অনেক বৃহত্তর দৃষ্টিতে দেখছিলেন। শ্রমিক আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন, সরকারি খাজনা বন্ধ আন্দোলন (যেমন সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের নেতৃত্বে পশ্চিম ভারতের বারদৌলিতে কৃষকরা করেছিলেন) গান্ধীজির সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন ও সত্যাগ্রহ এবং শক্তিশালী জনমত ও সংগঠনের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব বলে তখনও তাঁর বিশ্বাস ছিল। গান্ধীজির নীতি ও নেতৃত্ব সম্বন্ধে তাঁর সংশয় থাকলেও তিনি সম্পূর্ণ আস্থা হারাননি, হতাশ হননি। আরও অপেক্ষা করে আন্দোলনের অগ্রগতি সতর্কভাবে লক্ষ্য করতে প্রস্তুত ছিলেন। পঞ্জাবে ছাত্র সম্মেলনে (১৯ অক্টোবর, ১৯২৯) তিনি পাঞ্জাবী ছাত্রদের বলেন, “স্বাধীনতার সেনাবাহিনী গড়ে তোলার সময় এসে গেছে।” অন্যরা সঙ্গে আসুক না আসুক, হাজার হাজার মানুষ এই সেনাদলে যোগ দেবে। এই সেনাদলের যুদ্ধনীতি কী হবে সে বিষয়ে তিনি খুব সুস্পষ্টভাবে কিছু বলেননি। তবে তাঁর মনে যে এক অন্তর্দ্বন্দ্ব চলছিল সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ ছিল না। শেষপর্যন্ত যদি এইসব উপায়ে স্বাধীনতা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অর্জিত না হয় তাহলে তিনি দেশকে বিদেশী শাসনমুক্ত করার জন্যে সশস্ত্র সংগ্রামের কোনও বিকল্প পথ নেই বলে স্থির করে ফেলেছিলেন। নির্দিষ্ট সময়সীমা বলতে তাঁর মনে হয়েছিল আসন্ন ইউরোপীয় যুদ্ধ শুরু হওয়া পর্যন্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার এক দশক পূর্বেই তিনি বুঝেছিলেন ওই যুদ্ধ অনিবার্য। ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধ বা সশস্ত্র অভ্যুত্থানের তখনই হবে প্রকৃষ্ট সময়— এই অভিমত তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছিলেন। বিক্ষিপ্ত ব্যক্তি-সন্ত্রাস এই পরিস্থিতিতে ফলপ্রসূ হওয়ার বদলে ক্ষতিকর হবে বলে তিনি মনে করছিলেন। কিন্তু বিপ্লবীদের স্বদেশপ্রেম, প্রবল স্বাধীনতাস্পৃহা, দুর্জয় সাহস ও আত্মবলিদানের সঙ্কল্পকে তিনি গভীর শ্রদ্ধা করতেন। সে কথা প্রকাশ্যে মুক্ত কণ্ঠে ব্যক্ত করতে তাঁর কোনও ভয় ছিল না।

বিনয়-বাদল-দীনেশের রাইটার্স বিল্ডিং-এ আক্রমণের ঘটনার (৮ ডিসেম্বর, ১৯৩০) সময়ে সুভাষচন্দ্রের প্রতিক্রিয়ায় সুস্পষ্ট হয়েছিল কতখানি শ্রদ্ধা তিনি করতেন দুঃসাহসী মৃত্যুভয়শূন্য বিপ্লবী তরুণদের। ১৯৩০-এর আগস্ট মাসে ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতালের ছাত্র বিনয় বসু পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল লোম্যানকে হত্যা করে আত্মগোপন করেন। কয়েক মাস পরে বিনয় ও তাঁর দুই বিপ্লবী বন্ধু বাদল গুপ্ত ও দীনেশ গুপ্ত কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিং-এ প্রবেশ করে কারাগার মহাপরিদর্শক (I.G. of Prisons) সিম্পসনকে হত্যা করেন। আর একজন শ্বেতাঙ্গ অফিসার তাঁদের গুলিতে আহত হন। পালানো অসম্ভব বুঝে তিনজনই আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। বাদলের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু হয়। বিনয় কয়েকদিন পরে হাসপাতালে মারা যান। দীনেশ সুস্থ হয়ে ওঠার পর তাঁর বিচার ও ফাঁসি হয়। এই ঘটনা ‘অলিন্দ যুদ্ধ’ নাম খ্যাত হয়ে শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা ভারতবর্ষে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র তখন সুভাষচন্দ্র। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ইতিপূর্বে ১৯২৮ সালের মেয়র পদের নির্বাচনে সুভাষচন্দ্র ৩৭-৪৬ ভোটের ব্যবধানে উদারনৈতিক দলের প্রার্থী বি. কে. বসুর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। ইউরোপীয় সদস্য, কিছু নির্দল, উদারনৈতিক দল ও কিছু মুসলমান এবং কয়েকজন বিক্ষুব্ধ কংগ্রেস কাউন্সিলাররা জোটবদ্ধ হয়ে তাঁকে পরাজিত করেছিলেন। কিন্তু ১৯৩০ সালে সুভাষচন্দ্র জেলে থাকাকালেই কলকাতার মেয়র নির্বাচিত হন। ১০ ডিসেম্বর কলকাতা কর্পোরেশনের সভায় মেয়র সুভাষচন্দ্র রাইটার্স আক্রমণের ঘটনাটিকে ‘বেদনাদায়ক’ বলে অভিহিত করে বলেন, এই ঘটনা প্রমাণ করছে কংগ্রেস কর্মসূচী ও কংগ্রেস নেতারা দেশের তরুণদের পুরোপুরি প্রভাবিত করতে ব্যর্থ হয়েছে! এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত তরুণদের শুধুমাত্র ‘বিপথগামী যুবক’ বলে চিহ্নিত করলে হবে না। কেন এমন ঘটল তার কারণ অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। প্রধান কারণটি হল, ভারত স্বাধীনতা চায় এবং তা অবিলম্বে চায়। প্রয়োজনে কংগ্রেসের পথ ছাড়াও “যে-কোনও মূল্যে ও যে-কোনও পন্থায়” তারা স্বাধীনতা পেতে চায়। কংগ্রেস ‘অহিংসায় অঙ্গীকারবদ্ধ’। কিন্তু গান্ধীজি থেকে শুরু করে সাধারণ কংগ্রেস কর্মী তাঁদের কর্মসূচীর মাধ্যমে সকলকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছেন যে, অহিংসার পথে স্বাধীনতা অচিরে আসবে। তাঁর ভাষণের পরিশেষে সুভাষচন্দ্র বলেন যে, ভারতের স্বাধীনতা লাভের পক্ষে শ্রেষ্ঠ ও সহজতম পথ হল অহিংসার পথ। কিন্তু সেই স্বাধীনতা অর্জন না হওয়া পর্যন্ত “যুবকদের নিন্দা করে বা বিপথগামী অভিহিত করে প্রস্তাব পাস করেই আমরা সন্তুষ্ট থাকব না বলে আমরা আশা করি।” মেয়র রূপে সুভাষচন্দ্রের এই বক্তব্যের অন্তর্নিহিত বক্তব্য ও ইঙ্গিত কী ছিল তা অনুমান করা কঠিন ছিল না। মেয়র হওয়ার পূর্বে নির্বাচিত হওয়ার সময় এবং মেয়র পদে থাকাকালেও সুভাষচন্দ্রকে পুলিশি নির্যাতন ও কারাগারের দুঃসহ জীবন সহ্য করতে হয়েছিল। ব্রিটিশ সরকার ও পুলিশ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিতে সুভাষচন্দ্র কোনওদিনই প্রকৃত গান্ধীপন্থী অহিংস আন্দোলনে বিশ্বাসী রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না। তাদের এই সন্দেহ যে অমূলক ছিল তা বলা ঠিক হবে না।

হিজলী জেলে বিনাবিচারে আটক রাজনৈতিক বন্দীদের ওপর গুলি চালনা (১৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৩১) ও চট্টগ্রামে হত্যাকাণ্ডের (৩০ আগস্ট, ১৯৩১) বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও তীব্র প্রতিবাদ সুভাষচন্দ্রের বিপ্লবী মানসিকতাকে প্রকাশ করেছিল। হিজলী বন্দীনিবাসে সশস্ত্র প্রহরীদের নির্যাতন ও অমানবিক ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকে কেন্দ্র করে বিরোধ চরমে উঠলে পুলিশের গুলি চালনা ও নৃশংস আক্রমণের ফলে বিপ্লবী বন্দী সন্তোষ মিত্র ও তারকেশ্বর সেন নিহত হন। বহু বন্দী আহত হন। সুভাষচন্দ্র ও যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত হিজলীতে গিয়ে শহীদদের শবদেহ কলকাতায় এনে দাহ করার ব্যবস্থা করেন। ঘটনার প্রতিবাদে সুভাষচন্দ্র কর্পোরেশনের অল্ডারম্যানের পদ ও প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতির পদ ত্যাগ করেন। শহীদদের বীরের মৃত্যু সমগ্র দেশ চিরকাল মনে রাখবে বলে তিনি জনসভায় মর্মস্পর্শী ভাষণ দিয়েছিলেন। চট্টগ্রামে কুখ্যাত পুলিশ অফিসার আসানুল্লাকে বিপ্লবী হরিপদ ভট্টাচার্য হত্যা করলে পুলিশ পরের দিন শহরে গুণ্ডাদের ছেড়ে দিয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে অবাধ লুঠ, মারপিট ও মানুষের ওপর অত্যাচার উপভোগ করেছিল। এই ঘটনার নিন্দা করে সুভাষচন্দ্র তদন্তের দাবি করেছিলেন। বহুদিন পরে কয়েকজন অফিসারের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। সুভাষচন্দ্র সব রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে সর্বভারতীয় আন্দোলন চেয়েছিলেন। ইতিমধ্যে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সম্ভাব্য বোঝাপড়া নিয়ে আলাপ-আলোচনা-আপসের কথা শুরু হয়েছিল। গান্ধীজি ও কংগ্রেসের নেতারা তাতে সাড়া দেবার কথা চিন্তা করছিলেন। সুভাষচন্দ্র তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি বল্লভভাই প্যাটেলকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, “আমরা যেন ভুলে না যাই শহীদ সন্তোষকুমার মিত্র ও তারকেশ্বর সেনের মৃতদেহ ইংল্যান্ড ও ভারতের মধ্যে শায়িত রয়েছে।”

সকল অধ্যায়

১. দেশনায়ক – ১
২. দেশনায়ক – ২
৩. দেশনায়ক – ৩
৪. দেশনায়ক – ৪
৫. দেশনায়ক – ৫
৬. দেশনায়ক – ৬
৭. দেশনায়ক – ৭
৮. দেশনায়ক – ৮
৯. দেশনায়ক – ৯
১০. দেশনায়ক – ১০
১১. দেশনায়ক – ১১
১২. দেশনায়ক – ১২
১৩. দেশনায়ক – ১৩
১৪. দেশনায়ক – ১৪
১৫. দেশনায়ক – ১৫
১৬. দেশনায়ক – ১৬
১৭. দেশনায়ক – ১৭
১৮. দেশনায়ক – ১৮
১৯. দেশনায়ক – ১৯
২০. দেশনায়ক – ২০
২১. দেশনায়ক – ২১
২২. দেশনায়ক – ২২
২৩. দেশনায়ক – ২৩
২৪. দেশনায়ক – ২৪
২৫. দেশনায়ক – ২৫
২৬. দেশনায়ক – ২৬
২৭. দেশনায়ক – ২৭
২৮. দেশনায়ক – ২৮
২৯. দেশনায়ক – ২৯
৩০. দেশনায়ক – ৩০
৩১. দেশনায়ক – ৩১
৩২. দেশনায়ক – ৩২
৩৩. দেশনায়ক – ৩৩
৩৪. দেশনায়ক – ৩৪
৩৫. দেশনায়ক – ৩৫
৩৬. দেশনায়ক – ৩৬
৩৭. দেশনায়ক – ৩৭
৩৮. দেশনায়ক – ৩৮
৩৯. দেশনায়ক – ৩৯
৪০. দেশনায়ক – ৪০
৪১. দেশনায়ক – ৪১
৪২. দেশনায়ক – ৪২
৪৩. দেশনায়ক – ৪৩
৪৪. দেশনায়ক – ৪৪
৪৫. দেশনায়ক – ৪৫
৪৬. দেশনায়ক – ৪৬
৪৭. দেশনায়ক – ৪৭
৪৮. দেশনায়ক – ৪৮
৪৯. দেশনায়ক – ৪৯
৫০. দেশনায়ক – ৫০

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন