সামগ্রিকভাবে অসহযোগ আন্দোলন মানুষের মধ্যে উৎসাহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টি করলেও ক্রমেই একটি প্রশ্ন বড় হয়ে উঠছিল। গান্ধীজি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এক বছরের মধ্যে স্বরাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু তার কোনও লক্ষণই দেখা যাচ্ছিল না। ফলে প্রত্যাশা পূর্ণ না হওয়ার আশঙ্কায় ক্ষোভ ও হতাশা বাড়ছিল। ঠিক এই সময় ঘোষণা করা হল, ব্রিটেনের যুবরাজ ‘প্রিন্স অব ওয়েলস’ ভারত ভ্রমণ করবেন। ১৭ নভেম্বর (১৯২১) তিনি বোম্বাই-এ পৌঁছবেন। কংগ্রেসের পক্ষে এই ঘোষণা এক সুবৰ্ণসুযোগ এনে দিল আন্দোলনকে উজ্জীবিত করে জনসাধারণকে স্বরাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে উদ্দীপ্ত করার। স্থির হল, যুবরাজের ভারতে পদার্পণের দিনটিতে সারা দেশে হরতাল পালন ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হবে। দেশের অন্যান্য স্থানের তুলনায় হরতাল ও বিক্ষোভ বেশি সফল হল কলকাতায়। এর প্রধান কৃতিত্ব ছিল সুভাষচন্দ্রের। শান্তিপূর্ণ পরিবেশে, কিন্তু অভূতপূর্ব উৎসাহ ও উত্তেজনার মধ্যে ‘বয়কট’ ও বিক্ষোভ সফল করার মূলে ছিলেন তিনি। তাঁর কর্মক্ষমতা দেখে সকলে বিস্মিত হল। ওই সময় রাস্তায় রাস্তায় ঘোরার সময়ে তাঁকে দেখলেই লোকজন ঘিরে দাঁড়াত। প্রত্যক্ষদর্শী সাবিত্রীপ্রসন্ন অবাক হয়ে দেখেছিলেন বিভিন্ন অঞ্চলের নানান শ্রেণীর মানুষ তাঁকে চিনে এগিয়ে এসে কথাবার্তা বলত। বোঝাই যেত কী অমানুষিক পরিশ্রম করে তিনি জনসংযোগ ও সংগঠন গড়ে তুলেছেন। আর এক প্রত্যক্ষদর্শী উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, সুভাষচন্দ্র ক্লান্তি কাকে বলে জানতেন না। ‘বুল ডগ’-এর মতো জিদ বা ধরে থাকার ক্ষমতা ছিল তাঁর। কোনও কাজ একবার ধরলে তা শেষ না করে তিনি ছাড়তেন না। অন্য কারওর শৈথিল্যও বরদাস্ত করতেন না। বাঙালির সহজাত ‘আলসেমি’ তাঁর স্বভাব ও চরিত্রে ছিল না। আহার, নিদ্রা, বিশ্রাম কোনও কিছুই তিনি চাইতেন না যতক্ষণ না কাজ শেষ হয়।
কলকাতা তথা বাংলার যুব সমাজের কাছে তিনি কত শ্রদ্ধেয় ও প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন তা সুস্পষ্ট হয় এ সময় থেকে।
কলকাতায় বিক্ষোভ এত সফল হয়েছিল যে পরের দিন ‘স্টেটসম্যান’ ও ‘ইংলিশম্যান’ কাগজ লিখল, কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবকরা শহর দখল করে ফেলেছে। দেখে মনে হবে সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। ব্রিটিশ শাসনের সমর্থক এসব কাগজে দাবি করা হল এখনি যেন কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। বিচলিত, উদ্বিগ্ন বাংলার সরকার ইস্তাহার প্রচার করে কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীকে বেআইনি বলে ঘোষণা করল। পরে দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও অনুরূপ আদেশ ঘোষিত হল।
সরকারি নিষেধাজ্ঞা ও দমননীতি জনসাধারণকে আরও ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত করে তোলে। এরপর সুভাষচন্দ্রের পক্ষে বিদ্যাপীঠের অধ্যক্ষ পদে থাকা আর সম্ভব ছিল না। তিনি ওই পদ ছেড়ে ‘মালকোচা দিয়ে’ নেমে পড়লেন স্বেচ্ছাসেবকদের নাম তালিকাভুক্ত করতে। কিন্তু সরকারি আদেশ অমান্য করে স্বেচ্ছাসেবকরূপে যোগ দিতে খুব বেশি সাড়া পাওয়া গেল না। তখন সকলের কাছে এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে দেশবন্ধু স্থির করলেন তাঁর স্ত্রী বাসন্তী দেবী ও একমাত্র পুত্র চিররঞ্জন স্বেচ্ছাসেবকরূপে পথে নামবেন। এই প্রস্তাবে সুভাষচন্দ্রের সায় ছিল না। তিনি বলেন যে, একজন পুরুষও থাকা পর্যন্ত কোনও মহিলাকে কারাবরণ করতে যেতে দেওয়া ঠিক হবে না। কিন্তু দেশবন্ধু তাঁর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেননি। বিক্ষোভ দেখানোর জন্যে বাসন্তী দেবীও গ্রেপ্তার হলেন। এই সংবাদ রটে যাওয়ার পরে ভীষণ উত্তেজনা দেখা দেয়। দলে দলে মানুষ স্বেচ্ছাসেবক হবার জন্যে এগিয়ে আসেন। এই ঘটনাটির চিত্তস্পর্শী স্মৃতিচারণ করে বাসন্তী দেবী বলেছিলেন, “উনি (দেশবন্ধু) হুকুম করলেন আমাকে পিকেটিং করতে বার হতে হবে। সুভাষের প্রচণ্ড আপত্তি। বাড়ির মেয়েরা কেন যাবে আমরা থাকতে, আমি যাব। উনি বললেন সে হয় না। তোমার যে বাইরে অনেক কাজ, তুমি জেলে গেলে এসময় চলবে না।” এরপর বাসন্তী দেবীকে গ্রেপ্তার করার দিনই গভীর রাত্রে তাঁকে ছেড়ে দেবার পর তিনি বাড়ি ফিরে এলে, সুভাষচন্দ্র এসে হাজির। ছাড়ার খবর তিনি পাননি। বাসন্তী দেবীকে দেখে শুরু হল তাঁর কান্না। বাসন্তী দেবী যত বোঝান, “কি বিপদ! ও সুভাষ কাঁদছ কেন? এই তো আমি এসে গেছি। আমার তো কিছু হয়নি। তত সে আরও বেশি কাঁদে। এরকম ছেলেমানুষী কেউ দেখেছে কখনো?” জেলে না যেতে দেবার জন্যে কান্না, বাসন্তী দেবী কারাবরণ করায় কান্না, পরে কলকাতা কর্পোরেশনের ‘চীফ এক্সিকিউটিভ অফিসার’ হতে বলায় কান্না! এর জন্যে দেশবন্ধু সুভাষচন্দ্রকে বলতেন ‘Crying Captain’। একান্ত সুহৃদ দিলীপকুমার রায়ও দেখেছিলেন সুভাষের মনটা কত কোমল। তিনি লিখেছেন, “যে করুণা মাতৃত্বে ফোটে সেই করুণা, সেই দরদ দিয়ে বিধাতা ওর মনকে গড়েছিল।”
দেশবন্ধু না চাইলেও সুভাষচন্দ্রকে জেলে যেতে হয়েছিল কয়েকদিন পরেই। অসহযোগ আন্দোলনের ক্রমবর্ধমান তীব্রতা ও ব্যাপ্তি সরকারের পক্ষে আর বরদাস্ত করা সম্ভব হচ্ছিল না। ১০ ডিসেম্বর দেশবন্ধু ও সুভাষচন্দ্র সহ বহু নেতা গ্রেপ্তার হলেন। উভয়েরই ছ’ মাসের কারাদণ্ড হল। সুভাষের কারাবরণের সংবাদে পিতা জানকীনাথ শরৎচন্দ্রকে লিখলেন, “সুভাষ ও তোমাদের সবার জন্যে আমি গর্বিত। আমি এতটুকু দুঃখিত নই, কেননা আমি আত্মত্যাগের নীতিতে বিশ্বাস করি। প্রকৃতপক্ষে প্রতিদিনই আমি এর প্রত্যাশা করেছিলাম। তোমার মা’ও খুব সাহসের সঙ্গে এটা মেনে নিয়েছেন এবং তিনিও বিশ্বাস করেন যে এইরকম আত্মত্যাগ শেষপর্যন্ত স্বরাজ প্রতিষ্ঠিত করবে। স্নেহের সুভাষকে আমাদের অন্তরের আশীবাদ জানিও।” সুভাষের স্বদেশপ্রেম, আদর্শনিষ্ঠা, আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত বসু পরিবারের সকলের মধ্যেই সংক্রামিত হয়ে পড়েছিল। শরৎচন্দ্রও ক্রমেই জাতীয় আন্দোলনে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়ছিলেন।
আলিপুর জেলে সুভাষচন্দ্র দেশবন্ধুর সঙ্গে যে ক’মাস ছিলেন সেই সময়টি সুভাষচন্দ্রের জীবনের এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা। পরে যখন তিনি বর্মার মান্দালয় জেলে বন্দী ছিলেন তখন বিভিন্ন চিঠিতে তিনি ওই কারাজীবনের ও দেশবন্ধুর যে স্মৃতিচারণ করেছিলেন তা এক অমূল্য সম্পদ। এক আত্মত্যাগী সর্বজন শ্রদ্ধেয় জাতীয় নেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, আর তারুণ্যের প্রতীক, নির্ভীক, আদর্শনিষ্ঠ, দেশবন্ধুর পরম স্নেহের ও আস্থাভাজন সুভাষচন্দ্র বসু—এই দুই পরিচিত নামের পিছনে যে দু’জন ‘মানুষ’ ছিলেন তার অন্তরঙ্গ দুর্লভ চিত্র ফুটে উঠেছিল ওই চিঠিগুলিতে। চিঠিগুলি না পড়লে দেশবন্ধু ও ‘নেতাজি সুভাষ’ দু’জনই বহুলাংশে অজানা থেকে যাবেন।
১৯২৫ সালের ১৬ জুন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের যখন মৃত্যু হয় তখন সুভাষচন্দ্র মান্দালয় জেলে বিনা বিচারে বন্দী ছিলেন। রেঙ্গুনের সংবাদপত্রে ওই সংবাদ পড়ে প্রথমে তিনি বিশ্বাস করতেই চাননি। কিন্তু যখন জানলেন যে মর্মান্তিক সংবাদটি ভুল নয়, তিনি প্রচণ্ড মানসিক আঘাতে হতচেতন, হতবুদ্ধি হয়ে পড়েন। দিলীপকুমার রায়কে তিনি লেখেন, “আমি তাঁর অত্যন্ত কাছ থেকে নিতান্ত অসতর্ক মুহূর্তগুলিতে তাঁর যে ছবি দেখেছিলাম সময় এলে জগতের সামনে তার কথঞ্চিত আভাস দিতে পারব আশা করি।” সুভাষচন্দ্র ‘অসতর্ক মুহূর্তে’ দেখার ওপর যে বিশেষ জোর দিয়েছিলেন তার তাৎপর্য অসীম। আর একটি চিঠিতে তিনি লেখেন তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হয়েছিলেন বলেই দেশবন্ধুর প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধা, ভক্তি ও ভালবাসা জন্মেছিল। জেলে দু’জনে পাশাপাশি ‘সেলে’ ছিলেন। এ সময় দেশবন্ধুকে দেখাশোনা করা ছাড়া তিনি তাঁর একবেলার রান্নার কাজও করেছিলেন। এই নিয়ে তাঁর একটা গর্ব ছিল। প্রায়ই এই কথাটি শোনাতেন। দেশবন্ধুর কাছে থাকা, তাঁকে নিকট থেকে দেখা ও বোঝার যে সুযোগ সুভাষ পেয়েছিলেন তা ছিল তাঁর শ্রেষ্ঠ গৌরবের বিষয়। জেলে যাওয়ার আগে তিনি মাত্র কয়েকমাস দেশবন্ধুকে রাজনৈতিক নেতা ও গুরু রূপে দেখেছিলেন। ‘খাঁটি মানুষ’ দেশবন্ধুকে জানা ও চেনার তেমন সুযোগ তখনও হয়নি। ইংরাজিতে একটি কথা আছে—‘Familiarity breeds contempt’, বেশি ঘনিষ্ঠতা হলে অশ্রদ্ধা জন্মায়। এই কথাটির উল্লেখ করে সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন, দেশবন্ধু ও তাঁর ক্ষেত্রে ঠিক এর বিপরীত ঘটেছিল। কারাগারের ক্ষুদ্র পরিবেশে দেশবন্ধুকে দিনের পর দিন দেখে, খুব কাছাকাছি এসে চিত্তরঞ্জনের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা শতগুণ বেড়ে গিয়েছিল। দেশবন্ধুর কোমল হৃদয়, অসীম মমতা, ভাল-মন্দ শত্রু-মিত্র সবকিছু নির্বিশেষে সকলকে ভালবাসার ক্ষমতার কয়েকটি মর্মস্পর্শী ঘটনার তিনি উল্লেখ করেছেন।
জেলেতে মাথুর নামে এক দাগী আসামী একই ‘Yard’-এ ভৃত্যের কাজ করত। সে এর আগে আটবার জেলে গিয়েছিল। কিন্তু সেও দেশবন্ধুর অনুরক্ত হয়ে পড়েছিল। কারামুক্তির সময় দেশবন্ধু তাকে বলেছিলেন সে যেন বরাবর তাঁর কাছে যায় ; আর অপরাধ না করে। কয়েদিটি রাজি হয়েছিল। সেইমত জীবন কাটিয়েছিল। ঘটনাটির উল্লেখ করে সুভাষচন্দ্র লিখেছিলেন, “অনেকে বলেন যে, মানুষের জীবনের ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ ঘটনা দিয়ে তার মহত্ত্বের বিচার করা উচিত—এ কথা যদি সত্য হয় তবে তাঁর দেশের কাজের দিকটা বাদ দিলেও স্বর্গীয় দেশবন্ধু একজন মহাপুরুষ ছিলেন। দেশবন্ধু বিশ্বাস করতেন মানুষের ভালমন্দ স্বীকার করে নিয়েই তাকে ভালবাসা উচিত।” সুভাষ দেশবন্ধুর চরিত্রের এই মানবিকতা দেখে কেবলমাত্র মুগ্ধ ও অভিভূত হননি, নিজের জীবনেও তা গ্রহণ ও পালন করেছিলেন। রাষ্ট্রনেতা সুভাষচন্দ্র, ‘নেতাজি’ তাঁর ঐতিহাসিক অবদান ছাড়াও শুধু চারিত্রিক গুণ ও মানবিকতার জন্যেই এক মহান পুরুষ রূপে শ্রদ্ধেয় হতেন। দেশবন্ধু সম্পর্কে তাঁর লেখাগুলি শুধুমাত্র শোকাহত মনের সাময়িক ভাবোচ্ছাসের প্রকাশ ছিল না। দেশবন্ধুর আদর্শ ও দৃষ্টান্তে তাঁর নিজের জীবনও আলোকিত হয়েছিল। যে দাগী আসামী মাথুরকে দেশবন্ধু স্নেহ করতেন, তাঁর কাছে আশ্রয় দেবেন বলেছিলেন, তার সম্বন্ধে সুভাষচন্দ্র শরৎচন্দ্রকে মান্দালয় জেল থেকে লেখেন যে, দেশবন্ধুর জামাতা সুধীরচন্দ্র রায় যদি মাথুরকে কাজ না দিতে পারেন তাহলে যতদিন তিনি (সুভাষ) না ফিরছেন ততদিন শরৎচন্দ্র যেন তার একটা আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন। মাথুরকে আশ্রয় দিলে দেশবন্ধুর বিগত আত্মার ইচ্ছানুযায়ী কাজ হবে। ওই চিঠিতেই তিনি অনুরোধ করেছেন যে, একটি ছাত্রকে তিনি সাহায্য করতেন। এখন সে বিপদে পড়েছে। পড়াশোনা, থাকার ব্যাপারে অসুবিধা হচ্ছে। শরৎচন্দ্র যেন তাকে আগের মতোই সাহায্য করে যান। তিনি নিজেও অন্য কয়েকজন বন্ধুকে ওই বিষয়ে লিখছেন। এরকম অনেক ছাত্রকেই সুভাষ সাহায্য করতেন। দেশবন্ধুকে সুভাষচন্দ্র শুধুমাত্র তাঁর রাজনৈতিক গুরু ও নেতা রূপে গ্রহণ করেননি, দেশবন্ধুর জীবনের ধ্যান-ধারণা সব কিছুই তিনি আদর্শ বলে মনে করেছিলেন।
মহাত্মা গান্ধীকে কংগ্রেস ও কংগ্রেস রাজনীতির ‘ডিক্টেটর’ বলে অনেকে মনে করতেন। দেশবন্ধুকেও বাংলার রাজনীতি ও ‘স্বরাজ’ পার্টিতে তাই মনে করতেন অনেকে। সুভাষচন্দ্র সম্বন্ধেও এরকম একটা ধারণা প্রচলিত ছিল। কেউ কেউ এখনও তা ভাবেন। সম্প্রতি একটি লেখায় নীরদচন্দ্র চৌধুরী বলেছেন, ‘নেতাজি’ যুদ্ধের পর ফিরে এলে দেশের ‘ডিক্টেটর’ হতেন। এই অনুমান ভিত্তিহীন। দেশবন্ধু তাঁর অনুগামীদের সম্পূর্ণ আনুগত্য পেয়েছিলেন। তাঁর কথাই শেষ কথা ছিল এটা ঠিকই, কিন্তু তাঁর মধ্যে ‘ডিক্টেটর’-এর স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব ছিল না। সুভাষচন্দ্র শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে লিখেছিলেন, “অনেকে মনে করে যে, আমরা অন্ধের মত তাঁকে অনুসরণ করতুম। কিন্তু তাঁর চেলাদের সঙ্গে ছিল তাঁর সবচেয়ে ঝগড়া। নিজের কথা বলিতে পারি যে, অসংখ্য বিষয়ে তাঁর সঙ্গে ঝগড়া হত। কিন্তু আমি জানতুম যে যত ঝগড়া করি না কেন—আমার ভক্তি ও নিষ্ঠা অটুট। যত ঝড়-ঝঞ্ঝা আসুক না কেন—তিনি আমাকে পাবেন তাঁর পদতলে।” এই শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও আনুগত্যই ছিল দেশবন্ধুর ‘ডিক্টেটর’ হওয়ার মূলে। প্রায় দু’দশক পরে এইরকম আনুগত্য পেয়েছিলেন নেতাজি সুভাষ নিজেও। অবশ্য দেশবন্ধু-সুভাষচন্দ্রের সম্পর্কের গভীরতা ও মাধুর্য এক দুর্লভ অতুলনীয় দৃষ্টান্ত।
১৯২২ সালে দেশবন্ধু, সুভাষচন্দ্র ও অন্যান্যরা যখন মুক্তি পেলেন তার মধ্যে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে আমেদাবাদে অনুষ্ঠিত বার্ষিক অধিবেশনে কংগ্রেস ব্যক্তিগত এবং গণ-আইন অমান্য আন্দোলনের কর্মসূচী গ্রহণ করে। প্রস্তাবিত আন্দোলন কার্যকর করার পূর্ণ দায়িত্ব গান্ধীজির ওপর অর্পণ করা হয়। এই কংগ্রেসে সভাপতিত্ব করার কথা ছিল দেশবন্ধুর। তাঁর অনুপস্থিতিতে গান্ধীজি দেশবন্ধুর লিখিত ভাষণটি পাঠ করেন। অল্পকাল পরে গান্ধীজি ঘোষণা করেন, পশ্চিম ভারতের সুরাট জেলার অন্তর্গত বারদৌলিতে তিনি গণআইন অমান্য আন্দোলন শুরু করবেন। এই ঘোষণা সারা দেশে বিপুল উৎসাহ ও উত্তেজনা সৃষ্টি করে। কিন্তু আন্দোলন শুরু হওয়ার পূর্বেই উত্তর প্রদেশের গোরখপুর জেলার অন্তর্গত চৌরিচৌরার পুলিশ-ফাঁড়ির ওপর এক হিংসাত্মক জনতার আক্রমণে বাইশজন পুলিশ নিহত হয় (৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯২২)। এই ঘটনায় গভীর মর্মাহত হয়ে গান্ধীজি অসহযোগ আন্দোলন স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেন। অনতিকাল পর গান্ধীজি গ্রেপ্তার হন। তাঁর দু’বছরের কারাদণ্ড হয়। গান্ধীজির গ্রেপ্তার ও কারাদণ্ডের সংবাদ প্রত্যাশিত বিক্ষোভ বা আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারেনি। ইতিমধ্যে তুরস্কে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে। তুরস্ক কামাল পাশার নেতৃত্বে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ায় খিলাফত আন্দোলনও অর্থহীন হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে অসহযোগ আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন