গান্ধীজি ও তাঁর অনুগত প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের গভীর মতপার্থক্য সত্ত্বেও কেন সুভাষচন্দ্রকে গান্ধীজি হরিপুরা কংগ্রেসের সভাপতিরূপে পছন্দ করেছিলেন এই নিয়ে প্রশ্ন করা স্বাভাবিক। প্রায় এক দশক ধরে গান্ধী-সুভাষের মধ্যে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মতানৈক্য যে ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছিল তা সুবিদিত ছিল। তবুও গান্ধীজি যে সুভাষচন্দ্রকেই কংগ্রেস সভাপতি করতে মনস্থ করেন এবং তা কংগ্রেস নেতারা সর্বসম্মতিক্রমে মেনে নেন তাঁর অন্যতম কারণ ছিল, গান্ধীজির আশা ছিল যে এই পদ দিয়ে সুভাষচন্দ্রকে তাঁর প্রভাবে আনতে পারবেন। সুভাষচন্দ্র ও বামপন্থীদের বিরোধিতা সম্পূর্ণ দূর করতে না পারলেও প্রশমিত করতে পারবেন। তা ছাড়া, তেমন উল্লেখযোগ্য বিকল্প প্রার্থীও এই সময় ছিল না। বেশির ভাগ ঐতিহাসিক এই ব্যাখ্যাটি দিলেও আর একটি কারণ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা সমীচীন হবে না। মতপার্থক্য ও বিরোধ সত্ত্বেও সুভাষচন্দ্রের প্রতি গান্ধীজির আন্তরিক স্নেহ ছিল। সুভাষচন্দ্রের স্বদেশপ্রেম, আদর্শনিষ্ঠা, সাহস, আত্মত্যাগ, সাংগঠনিক ক্ষমতাকে তিনি শ্রদ্ধা করতেন। তেমনি সুভাষচন্দ্রও গান্ধীজির অসামান্য অবদান এবং অনন্যচরিত্র সম্বন্ধে উচ্চধারণা পোষণ করতেন। জেনিভাতে এক সাক্ষাৎকারে (৭ জুন, ১৯৩৫) গান্ধীজির এত শক্তির পিছনে কারণগুলির বিশ্লেষণ করে তিনি বলেছিলেন, “প্রসন্নচিত্তে দরিদ্র ভিখারীর মতো জীর্ণ কাপড়ের টুকরো-পরা, মাত্র নব্বই পাউন্ড ওজনের শীর্ণকায় এই মানুষটির অসীম ক্ষমতার গোপন রহস্যটি কি? উত্তর কিন্তু খুবই সোজা। উদ্দেশ্য এবং অভিপ্রায়ের দিক হতে পুরোপুরি নিঃস্বার্থ এই মানুষটি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে একাত্ম।” এমনকি ত্রিপুরী কংগ্রেসের পর প্রথমে সভাপতিরূপে পদত্যাগ, পরে কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পরেও গান্ধীজির প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে গান্ধীজির অদ্বিতীয় ভূমিকার কথা তিনি মুক্তকণ্ঠে ব্যক্ত করেছিলেন। তিক্ত বিরোধ-বিতর্ক এবং তাঁর প্রতি অন্যায় আচরণ (যা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে গান্ধীজি সমর্থন করেছিলেন) সুভাষচন্দ্রের ঐতিহাসিক দৃষ্টি ও মূল্যায়নকে প্রভাবিত করেনি। গান্ধীজিও ক্রমে ক্রমে উপলব্ধি করেছিলেন যে, সুভাষচন্দ্রের দেশপ্রেম, অদম্য সাহস ও সঙ্কল্প, দেশের মুক্তির জন্যে নিঃশেষে সব কিছু উৎসর্গ করার কোনও তুলনা নেই। ১৯৩৮ সালে হরিপুরা অধিবেশন ও তার পরবর্তী কয়েক মাসে মনে হয়েছিল যে, গান্ধীজি ও সুভাষচন্দ্রের মধ্যে একটা বোঝাপড়ার সম্পর্ক গড়ে উঠছে। কিন্তু অচিরেই সেই সম্ভাবনা দূর হয়েছিল। গান্ধীজি যে কতটা তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক বুদ্ধিসম্পন্ন ও কৌশলী রাজনীতিবিদও ছিলেন তা সুভাষচন্দ্র সঠিক উপলব্ধি করতে পারেননি।
করাচি বিমানবন্দরে নামার পর (২৩ জানুয়ারি, ১৯৩৮) সুভাষচন্দ্রকে বিপুল সংবর্ধনা দেওয়া হয়। বিমানবন্দরে পাঁচশো গাড়ি গিয়েছিল। এত ভিড় হয়েছিল তাঁকে স্বাগত জানাতে যে তিনি বেরতে পারেননি। বিমানবন্দরের ওপরের বারান্দা থেকে তাঁকে সমবেত জনতাকে উদ্দেশ করে ভাষণ দিতে হয়েছিল।
গুজরাটের তাপ্তি নদীর ধারে হরিপুরায় কংগ্রেস অধিবেশন হয় (১৯-২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৮)। বিঠলভাই প্যাটেলের স্মৃতিতে কংগ্রেস অধিবেশন স্থলের নামকরণ হয়েছিল ‘বিঠল নগর’। অধিবেশনস্থল ও মঞ্চটি অপরূপভাবে সজ্জিত করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনের কলাভবনের অধ্যক্ষ নন্দলাল বসু। রাজনৈতিক গুরুত্ব ছাড়াও অপরূপ শিল্পকলা, চিত্রাঙ্কন ও দৃষ্টিনন্দন অধিবেশন প্রাঙ্গণ ও মঞ্চসজ্জার জন্যেও হরিপুরা কংগ্রেস খ্যাত হয়ে আছে। হরিপুরায় যাবার পথে সুভাষচন্দ্র অভূতপূর্ব সংবর্ধনা পান। হরিপুরা থেকে একটি প্রাচীন সুসজ্জিত রথে তাঁকে বিঠল নগরে শোভাযাত্রা করে নিয়ে যাওয়া হয়। রথটি টেনেছিল একান্নটি বলীবর্দ। হাজার হাজার মানুষ ভেঙে পড়েছিল সুভাষচন্দ্রকে এবং ওই শোভাযাত্রা দেখতে। মাত্র দু’ মাইল পথ অতিক্রম করতে লেগেছিল দু’ ঘণ্টা। স্বতঃস্ফুর্ত অভূতপূর্ব জন-সংবর্ধনায় সুভাষচন্দ্র অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন।
হরিপুরা কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার সংবাদ পেয়েই সুভাষচন্দ্র ঘোষণা করেছিলেন, “এ-কথা সকলেই স্বীকার করবেন যে ভারতকে বিশ্বের সম্মুখে অধিকতর রূপে উপস্থাপিত করতে হবে। কারণ ভারতের সমস্যা, বিশ্বের সমস্যা। প্রগতিশীল আন্দোলনগুলির সঙ্গে আমাদের আরো ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ওপর কেবল ভারতের মুক্তিই নির্ভর করে না, বিশ্বের উৎপীড়িত মানুষের মুক্তিও নির্ভর করবে।” তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেন যে, কংগ্রেসের অন্তর্ভুক্ত সকল শক্তিকে একটি ‘ব্যাপক সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী ফ্রন্টে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে’। হরিপুরা কংগ্রেসে তাঁর সভাপতির ভাষণেরও অন্যতম প্রধান সুরও ছিল একই।
সুভাষচন্দ্রের হরিপুরা-ভাষণের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ছিল অসাধারণ। তাঁর সমর্থক ও সমালোচক এবং বর্তমান কালের সকল ঐতিহাসিক একবাক্যে স্বীকার করেন যে, সর্বভারতীয় রাষ্ট্রনেতারূপে এটাই তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ। বক্তৃতার প্রারম্ভে তিনি মতিলাল নেহরুর পত্নী স্বরূপরানী নেহরু, জগদীশচন্দ্র বসু, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, হেরম্বচন্দ্র মৈত্রের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেন। শরৎচন্দ্র প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “শরত্যাবু সাহিত্যিক হিসাবে মহান হলেও, তিনি সম্ভবত মহত্তর ছিলেন দেশপ্রেমিক হিসেবে।” প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, শরৎচন্দ্র সুভাষচন্দ্রকে গভীর স্নেহ করতেন ও তাঁর পরম শুভার্থী ছিলেন। প্রয়াত স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের প্রচলিত ধারা অতিক্রম করে তিনি আন্তরিকতা এবং গভীর আবেগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে অনশন ধর্মঘটের ফলে রাজনৈতিক বন্দী হরেন্দ্র মুন্সীর মৃত্যুর উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমি শুধু আপনাদের এই প্রশ্নই করতে চাই যে ‘ডেনমার্ক রাজ্যে কিছু গলিত’ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে কি না যার ফলে যতীন দাস, সর্দার মহাবীর সিং, রামকৃষ্ণ নমদাস, মোহিতমোহন মৈত্র, হরেন্দ্র মুন্সী এবং অন্যান্যদের মতো উজ্জ্বল ও প্রতিশ্রুতিশীল মানুষেরা বেঁচে না থেকে মৃত্যুবরণের আগ্রহ বোধ করেন।” এই প্রসঙ্গে দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করতে হবে যে, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে একমাত্র যতীন দাস ছাড়া অন্য কোনও অনশনে মৃত্যুবরণকারী শহীদের নাম প্রায় অনুল্লেখিত।
বিশ্ব ইতিহাসের অভিজ্ঞতা ও সাম্রাজ্যবাদের বিভেদ-নীতির উল্লেখ করে সুভাষচন্দ্র বলেন, “আমার সন্দেহ নেই যে ব্রিটিশের উদ্ভাবনী শক্তি ভারত বিভাগ করার জন্যে এবং সেই ভাবে ভারতীয় জনসাধারণের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর ব্যর্থ করার জন্যে অন্য কোনও সাংবিধানিক কৌশল খুঁজে বার করবে।” ১৯৩৫ সালের শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা ব্যর্থ হলে, ব্রিটিশ সরকার যে ভারত-বিভাগের উদ্যোগ নেবে এই সতর্কবাণী সুভাষচন্দ্রের ভাষণে ছিল। দেশীয় রাজ্যগুলির প্রজাদের আন্দোলনে কংগ্রেসকে আরও সক্রিয়ভাবে যুক্ত করতে হবে বলে তিনি জোর দেন। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যগুলির মধ্যে ছিল; ধর্ম, জাতি, বর্ণ কিংবা স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সব নাগরিকের আইনের চোখে সমান মর্যাদা ও স্বীকৃতি; ধর্ম সম্বন্ধে রাষ্ট্রনিরপেক্ষতা; সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার; অনুন্নত শ্রেণীগুলি এবং মুসলমান ও সব সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্বার্থ ও অধিকার সুরক্ষা। সুভাষচন্দ্র দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করেন, “কংগ্রেস সামগ্রিক ভাবে ভারতীয় জনগণের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার রক্ষার জন্যে প্রস্তুত।” স্বাধীনতা অর্জনের জন্যে দেশবাসীকে আরও সংগ্রামের জন্যে তৈরি থাকতে হবে। তিনি বলেন স্বাধীনতা লাভের পর কংগ্রেস দলের লুপ্ত হয়ে যাওয়া উচিত—এই মতে তিনি বিশ্বাস করেন না। যে দল দেশকে স্বাধীন করছে সেই দলেরই দায়িত্ব হল দেশকে পুনর্গঠন করা ও সংবিধান রচনা করা। এর ফলে দেশ এক স্বৈরতন্ত্রী রাষ্ট্রে পরিণত হবে এই আশঙ্কা অমূলক। রাশিয়া, জার্মানী ও ইতালীতে যে তা ঘটেছে তার কারণ ওইসব দেশে আছে একটি মাত্র দল। আর সেই দলের, যেমন জার্মানীর নাৎসী পার্টির, নিজস্ব গণতান্ত্রিক ভিত্তি নেই। দল ‘নেতৃ-নীতি’র ভিত্তিতে গঠিত। কিন্তু কংগ্রেস দলের ভিত্তি ও সংগঠন হল গণতান্ত্রিক। ভারতবর্ষে একাধিক দল আছে। সুতরাং ভারতবর্ষ এক স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা নেই।
হরিপুরা ভাষণের এক বিশেষ উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল ভারতবর্ষের সার্বিক পুনর্গঠনের জন্যে একটি ব্যাপক পরিকল্পনা রচনার প্রয়োজনীয়তা এবং তার জন্যে এক সুচিন্তিত কর্মসূচী গ্রহণের ওপর গুরুত্ব দান। সুভাষচন্দ্র বলেন, দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা ও ব্যাধিদূরীকরণ, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে উৎপাদন ও বন্টন সম্পর্কিত প্রধান প্রধান জাতীয় সমস্যাগুলির কার্যকর সমাধান একমাত্র সমাজতান্ত্রিক ধারাতেই করা সম্ভব। এর জন্যে একটি পরিকল্পনা কমিশন গঠন করা প্রয়োজন। এই পরিকল্পনার দু’টি অংশ থাকবে—একটি অব্যবহিত কর্মসূচী এবং আর একটি দীর্ঘ-মেয়াদী কর্মসূচী। জাতীয় ঐক্য সম্পাদনের জন্যে জাতীয় ভাষা ও একটি সাধারণ লিপির উন্নয়ন করতে হবে। বিমান, টেলিফোন, বেতার, চলচ্চিত্র, টেলিভিশন প্রভৃতি আধুনিক বৈজ্ঞানিক উপকরণের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অংশকে পরস্পরের কাছে আনতে হবে। একটি সাধারণ শিক্ষা-নীতির মাধ্যমে সমগ্র জনসাধারণের মনে এক জাতীয় মনোভাব সৃষ্টি করতে হবে। জাতীয় ভাষা ও একই লিপির প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রোমান লিপি গ্রহণের কথা ভাবতে হবে। এই সমস্যাটি ও লিপি মনোনয়ের প্রশ্নটি ‘সর্বপ্রকার বিদ্বেষমুক্ত মনে সম্পূর্ণরূপে বৈজ্ঞানিক ও নিরপেক্ষ ভিত্তিতে’ বিবেচনা করা দরকার। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ সহ্য করা ভারতবর্ষের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়বে উল্লেখ করে তিনি জনসংখ্যা বৃদ্ধি বন্ধ করার জন্যে সর্বপ্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা বলেন। দেশ থেকে দারিদ্র্য দূর করার জন্যে জমিদারি প্রথার অবসান, ভূমি ব্যবস্থার বৈপ্লবিক সংস্কার, সমবায় আন্দোলনের সম্প্রসারণ, উৎপাদনবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে কৃষিকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে গড়ে তোলা, রাষ্ট্রের মালিকানায় ও রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রণে শিল্পোন্নয়নের ব্যাপক পরিকল্পনার অপরিহার্যতার কথা বলেন। শিল্পের পুনরুজ্জীবন ও আধুনিক শিল্পায়নের অপরিহার্যতা প্রসঙ্গে সুভাষচন্দ্র সুস্পষ্টভাবে বলেন, “আমরা যতই আধুনিক শিল্পায়ন অপছন্দ করি এবং তার সমবেত কুফলগুলির নিন্দা করি, আমরা আর ইচ্ছে করলেও শিল্পপূর্বযুগে ফিরে যেতে পারি না।” কিন্তু কুটির শিল্পের পুনরুজ্জীবনের জন্যে সর্বতোভাবে চেষ্টা করতে হবে।
সুভাষচন্দ্র অতীতে ভারতের সঙ্গে যেসব দেশের বাণিজ্য-সম্পর্ক ছিল সেই সব দেশের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি করার প্রয়োজনীয়তার কথাও বলেন। দেশে শৃঙ্খলাবোধ সৃষ্টি করা এবং গণশক্তিকে সুসংহত করার ওপর তিনি জোর দেন। ট্রেড ইউনিয়ন, কিষাণ সভাগুলির সঙ্গে কংগ্রেসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং ওই সংগঠনগুলিতে বহুসংখ্যক কংগ্রেস কর্মীদের যোগদান করা জরুরি বলে তিনি উল্লেখ করেন। তা না হলে শ্রমিক এবং কৃষকরা কংগ্রেসের আদর্শ ও কর্মসূচীতে অনুপ্রাণিত হবে না, গণ-সংগ্রামে অংশগ্রহণ করবে না।
হরিপুরা ভাষণে সুভাষচন্দ্র ভারতবর্ষের বৈদেশিক নীতি ও আন্তর্জাতিক সংযোগ স্থাপনের প্রশ্নটি উত্থাপন করেন। তিনি বলেন, আগামী বছরগুলিতে আন্তজাতিক ঘটনার বিবর্তন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে। প্রতি পর্যায়ে বিশ্ব পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়ন করে ভারতবর্ষকে তার সুযোগ নেওয়ার কথা চিন্তা করতে হবে। ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতর সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে।
একটি অত্যন্ত মানবিক সমস্যার প্রতি তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। শুধুমাত্র রাজনৈতিক বন্দী ও বিচারাধীন বন্দীদের প্রশ্নই নয়, যেসব স্বাধীনতা সংগ্রামী মুক্তি পেয়ে ভগ্নস্বাস্থ্যে, যক্ষার মতো মারাত্মক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে নিদারুণ অনশনের সম্মুখীন, যাদের পরিবার হাসি মুখে নয়, চোখের জলে মুক্ত বন্দীদের স্বাগত জানান, যাঁদের ভাগ্যে দেশসেবার জন্যে দুঃখ-দারিদ্র ছাড়া কিছুই জোটেনি, তাদের প্রতি কী কর্তব্য দেশবাসী পালন করছে? তাঁদের দুঃখ কষ্ট দূর করার জন্যে সাধ্যমত চেষ্টা করতে তিনি আবেদন করেন। এত গভীর চিন্তা, মমতা ও উদ্বেগ সর্বত্যাগী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্যে ইতিপূর্বে কোনও কংগ্রেস সভাপতি বা সর্বভারতীয় নেতা প্রকাশ করেননি।
সুভাষচন্দ্র সব বামপন্থী গোষ্ঠীগুলিকে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতার ভিত্তিতে কংগ্রেসের গণতন্ত্রীকরণ ও পুনঃসংগঠনের জন্যে সহযোগিতার আবেদন জানান। পরিশেষে, তিনি ভারতবর্ষের মুক্তি সংগ্রামকে এক আন্তজাতিক রূপ দিয়ে বলেন, “আমাদের সংগ্রাম শুধু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে নয়, বিশ্ব সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধেও এবং এ ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ মূল ভিত্তি বিশেষ। সুতরাং আমরা শুধু ভারতের স্বার্থেই সংগ্রাম করছি না, আমাদের এ সংগ্রাম মানবতার স্বার্থে। ভারতের মুক্তির অর্থ মানবতার পরিত্রাণ।”
হরিপুরা ভাষণ গান্ধীপন্থীদের মনে বেশ কিছুটা উদ্বেগ সৃষ্টি করেছিল। সুভাষচন্দ্রের বক্তৃতায় বামপন্থী সুর সুস্পষ্ট ছিল। ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিশন (National Planning Commission) গঠন ও তার লক্ষ্যের মধ্যে সোভিয়েত রাশিয়ার উন্নয়ন পরিকল্পনার প্রভাব লক্ষণীয় ছিল। ভবিষ্যতের গণ-আন্দোলনের প্রস্তুতির উল্লেখ, শ্রমিক ও কৃষক সংগঠনগুলির সঙ্গে নিকটতর সম্পর্কের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দান, ১৯৩৫ সালে প্রবর্তিত শাসনসংস্কার এবং প্রস্তাবিত ফেডারেশনের সুস্পষ্টতর বিরোধিতা রক্ষণশীল কংগ্রেসীদের মনঃপূত হয়নি। অমলেশ ত্রিপাঠী লিখেছেন, “ভাষণটি দক্ষিণপন্থীদের কর্ণে মধুবর্ষণ করেনি।” তাঁরা হরিপুরার ‘শোধ’ ত্রিপুরীতে নিয়েছিলেন। কথাটি বহুলাংশে সত্য হলেও সম্পূর্ণ ঠিক নয়। সুভাষচন্দ্রের ভাষণ অবশ্যই বামপন্থীদের বেশ খুশি করেছিল। কিন্তু সুভাষচন্দ্র গান্ধীজি ও তাঁর রক্ষণশীল অনুরাগীদের সঙ্গে তখনি যাতে না বিরোধ-বিতর্ক দেখা দেয় সে বিষয়ে সচেতন ছিলেন। তাঁর ভাষণেই তিনি বলেন, “মহাত্মা গান্ধী আগামী আরো বহু বহু বছর ধরে আমাদের জাতির জন্যে বেঁচে থাকুন—সমগ্র ভারত আন্তরিক ভাবে এই আশা ও প্রার্থনা করে। ভারত তাঁকে হারাতে পারে না এবং এই সঙ্কটকালে তো কিছুতেই নয়…জনগণকে ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্যে তাঁকে আমাদের প্রয়োজন…আন্দোলনকে তিক্ততা ও ঘৃণামুক্ত রাখার জন্যে তাঁকে আমাদের প্রয়োজন…ভারতের স্বাধীনতার স্বার্থে তাঁকে আমাদের প্রয়োজন। মানবতার স্বার্থে তাঁকে আমাদের আরো বেশি করে প্রয়োজন।” গান্ধীজির প্রতি সুভাষচন্দ্রের এই আবেগপূর্ণ শ্রদ্ধার প্রকাশে আন্তরিকতার অভাব ছিল না। গান্ধীপন্থীদের সন্তোষ ও সমর্থন লাভের জন্যে তিনি গান্ধীজির প্রতি ওই শ্রদ্ধা জানাননি। তখনও পর্যন্ত তাঁর সত্যিই বিশ্বাস ছিল যে, মতপার্থক্য থাকলেও গান্ধীজি সব কিছুর ঊর্ধ্বে। তিনি মুক্তি সংগ্রামের অপরিহার্য সর্বাধিনায়ক। গান্ধীজির নেতৃত্বে কংগ্রেসের মধ্যে থেকেই কাজ করা সম্ভব। আলাপ-আলোচনা ও খোলামেলা বিতর্কের মধ্য দিয়ে মতপার্থক্য দূর করে একসঙ্গে কাজ করা সম্ভব। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই তাঁর মোহভঙ্গ হয়েছিল। অনুরূপভাবে গান্ধীজি সুভাষচন্দ্রের প্রতি তাঁর পুত্রস্নেহ’র কথা বলেছিলেন। তিনি আশা করেছিলেন যে, জওহরলালের মতো সুভাষচন্দ্রেরও বামপন্থী মতবাদ ও দৃষ্টিভঙ্গি থাকলেও সুভাষচন্দ্র শেষপর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে যাবেন না। গান্ধীজির প্রত্যাশাও পূর্ণ হয়নি।
হরিপুর অধিবেশনে ও পরবর্তী কয়েক মাস সুভাষচন্দ্র ও গান্ধীপন্থীদের মধ্যে মোটামুটি একটা বোঝাপড়ার সম্পর্ক ছিল। তাঁর অনুগামীরা যাতে বামপন্থীদের আক্রমণাত্মক সমালোচনা না করেন সে দিকে গান্ধীজি নজর রেখেছিলেন। একবার এর জন্যে সর্দার প্যাটেলকে সতর্ক করে র্ভৎসনা করেছিলেন। সুভাষচন্দ্রও তাঁর হরিপুরা ভাষণে যেসব বামপন্থী চিন্তাধারা ও কর্মসূচীর কথা বলেছিলেন তার প্রতিটি তখনি কার্যকর করতে গিয়ে রক্ষণশীলদের সঙ্গে প্রকাশ্য সংঘর্ষে যেতে চাননি। সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের প্রশ্নগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হলেও তিনি মনে করেছিলেন যে, স্বাধীনতা সংগ্রামের সাফল্যের স্বার্থে কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ ঐক্য ও সংহতি অটুট রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করা উচিত। কংগ্রেস সভাপতিরূপে তাঁর এটা বিশেষ দায়িত্ব। লিওনার্ড গর্ডন লিখেছেন, সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস সভাপতির পদ পেয়ে খুব খুশি হয়েছিলেন। খুব জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ কোনও প্রশ্নে ছাড়া তিনি ওই পদ হারাতে ইচ্ছুক ছিলেন না। তাঁর এই বক্তব্যের সমর্থনে তিনি গান্ধীজির একটি চিঠির উল্লেখ করেছেন। এই চিঠিতে গান্ধীজি লিখেছিলেন যে, সুভাষচন্দ্র মনের মতো কাজ ভালবাসেন। সেই রকম কাজ তিনি পেয়েছেন এবং খুশি আছেন। সুভাষচন্দ্র সম্বন্ধে ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। কংগ্রেস সভাপতিকে বলা হত ‘রাষ্ট্রপতি’। স্বাধীনতার পূর্বে দেশের সর্বোচ্চ সম্মানের পদ। অবশ্যই ওই পদাভিষিক্ত হয়ে সুভাষচন্দ্র খুবই খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু তা পদের প্রতি লোভ বা পদমর্যাদার জন্যে নয়। কংগ্রেস সভাপতিরূপে কংগ্রেসকে একটি সুসংহত শক্তিশালী দলে রূপান্তরিত করে, আপসহীন, প্রগতিশীল লক্ষ্য ও কর্মসূচী গ্রহণ করে স্বাধীনতা সংগ্রামে জয় সুনিশ্চিত করতে তিনি চেয়েছিলেন। কংগ্রেসের মধ্যে বিভেদ তিনি চাননি। কিন্তু মূল আদর্শ ও লক্ষ্য থেকে তিনি বিচ্যুত হননি। পদের মোহ থাকলে তিনি অনায়াসেই গান্ধীজির সঙ্গে বোঝাপড়া করে নিয়ে ত্রিপুরী কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হতে পারতেন। কংগ্রেস ত্যাগ ও তারপর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে শেষ মরণপণ সংগ্রামের জন্যে তাঁকে দেশত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিতে হত না। সুভাষচন্দ্রের ওপর প্রসন্ন হয়ে গান্ধীজি হয়তো তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনয়ন সম্পর্কে পুনর্বিচার করতেন।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন