মান্দালয়ের কারাজীবন সুভাষচন্দ্রের শরীর ও মনের ওপর স্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল। জেলে থাকার পূর্বের ও মুক্তিলাভের পরের সুভাষচন্দ্রের জীবন সম্বন্ধে দৃষ্টিভঙ্গি ও ধ্যানধারণার লক্ষণীয় পরিবর্তন ঘটেছিল। জেলের অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি তাঁকে আরও পরিণত করে তুলেছিল। জেলের নির্জনতায় তিনি জীবনের কঠিন সমস্যাগুলি তলিয়ে বোঝার সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, জেলে থাকাটা তাঁর ভাল লাগে বললে ভণ্ডামি হবে। কোনও ভদ্র ও সুশিক্ষিত ব্যক্তি কারাবাস পছন্দ করতেই পারে না। জেলের আবহাওয়া যে কোনও মানুষকে বিকৃত ও অমানুষ করে তোলার উপযোগী। কিন্তু তিনি তাঁর অন্যায় নির্বাসন ও অসহনীয় কারাজীবনকে আধ্যাত্মিক দিক থেকে দেখেছিলেন। ঈশ্বরের আশীর্বাদ বলে গ্রহণ করেছিলেন। ‘দাগী অপরাধী’দের খুব কাছ থেকে দেখে, তাদের জীবনের দুঃখ-বঞ্চনা, তাদের প্রতি সমাজ ও বিচার ব্যবস্থার অন্যায়ের কথা শুনে ও প্রত্যক্ষ করে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, ‘অপরাধী’ বলে চিহ্নিত হলেও সকলেই প্রকৃত অপরাধী নয়। যদি তাদের প্রতি আমাদের সহানুভূতি থাকে, তাদের প্রবৃত্তিগুলিকে মানসিক ব্যাধি বলে ধরা হয়, জেলের পরিবেশ উন্নত করা যায়, তাদের মানসিক অভাব ও শূন্যতা দূর করার চেষ্টা করা হয়, তাহলে তারা সুস্থ সামাজিক জীবনে পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। তিনি বলেছিলেন, “আমাকে বলতেই হবে যে এতদিন জেলে বাস করার পর কারা শাসনের একটা আমূল সংস্কারের একান্ত প্রয়োজনের দিকে আমার চোখ খুলে গেছে এবং ভবিষ্যতে কারা সংস্কার আমার একটা কর্তব্য হবে।” অবশেষে তাঁর মুক্তিলাভ সম্বন্ধে সুভাষচন্দ্র লিখেছিলেন, “সম্প্রতি জীবন আমার কাছে একটি রোমান্টিক নাটকে পরিণত হয়েছে।”
নিজের কারাজীবনকে সুভাষচন্দ্র বেশি গৌরবান্বিত করে দেখা পছন্দ করতেন না। শত অসুবিধার মধ্যেও রাজনৈতিক বন্দীর যে এক বড় সান্ত্বনা আছে, যা অন্য বন্দীদের নেই, তা তিনি অকপটভাবে স্বীকার করেছিলেন। রাজনৈতিক বন্দী জানে যে মুক্তির পর সমাজ তাকে বরণ করে নেবে। বন্ধু-বান্ধব, সাধারণ মানুষ, আত্মীয়, পরিজনদের তার প্রতি সহানুভূতি, শুভেচ্ছা আছে। কাজেই কারাবাস নিয়ে আত্মম্ভরিতার কোনও কারণ নেই। কিন্তু এ অভিজ্ঞতা এক বিরাট প্রাপ্তি। জীবনে দুঃখ-যন্ত্রণা পাওয়ার প্রয়োজন আছে। দুঃখ-যন্ত্রণাই মানুষকে উচ্চতর, উন্নততর সাফল্যলাভের জন্য অনুপ্রাণিত করে। ‘Suffering’ ছাড়া মানুষ কখনও নিজের অন্তরের আদর্শের সঙ্গে অভিন্নতা বোধ করতে পারে না। পরীক্ষার মধ্যে না পড়লে সে নিজের অসীম শক্তি সম্বন্ধে স্থির নিশ্চিত হতে পারে না। জেলের অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে তিনি লেখেন, “আমি নিজেকে এখন আরও ভালভাবে চিনিতে পারিয়াছি এবং নিজের ওপর আমার বিশ্বাস শতগুণে বাড়িয়াছে।” সুভাষচন্দ্রের বিশ্বাস জন্মেছিল যে, কারাজীবনের দিনগুলি জীবনের বিভিন্ন সমস্যাকে বুঝতে, অনুভূতি ও সহানুভূতির ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে। এই অভিজ্ঞতা শিল্পী ও সাহিত্যিকের সৃষ্টিকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারে। এই প্রসঙ্গে তিনি লেখেন, “কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা যে তাঁর জেলের অভিজ্ঞতার নিকট কতখানি ঋণী সে কথা বোধহয় ভেবে দেখা হয় না।”
মান্দালয়ের কারাজীবন সুভাষচন্দ্রের স্বদেশপ্রেমকে গভীরতর, তীব্রতর করে তুলেছিল। তিনি লিখেছিলেন যে, এত কষ্টের মধ্যেও যদি তিনি আনন্দ অনুভব না করতেন তাহলে পাগল হয়ে যেতেন। তিনি তাঁর মেজবৌদিকে লেখেন, “আমি অনুভব করছি আমার জন্মভূমিকে এখন যত ভালবাসি, জীবনে এত ভালবাসি নাই, আর সেই স্বর্গাদপি গরীয়সী জন্মভূমির জন্য যদি কষ্ট সইতে হয়—সে কি আনন্দের বিষয় নয়? আজ আমি বাইরে দেশছাড়া—কিন্তু অন্তরের মধ্যে, কল্পনার মধ্যে দেশকে পেয়ে থাকি। আর সে পাওয়ার মধ্যে কি কম আনন্দ?” একই সুর অনুরণিত হয়েছিল যখন তিনি জেলে বন্দী থাকাকালেই উত্তর কলকাতা থেকে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্যপদের জন্যে কংগ্রেস প্রার্থী হয়েছিলেন। নির্বাচনী আবেদনে তিনি বলেছিলেন, মান্দালয়ে বন্দীর নিবাসিত জীবনের পূর্বেও তিনি বাংলা, ভারতভূমিকে ভালবাসতেন। কিন্তু এই বিচ্ছেদের ফলে সোনার বাংলাকে, পুণ্য ভারতভূমিকে শতগুণ বেশি ভালবাসতে শিখেছেন। “স্বরাজ লাভের পুণ্য প্রচেষ্টাই যেন আমার জীবনের জপ, তপ ও স্বাধ্যায়, আমার সাধনা ও মুক্তির সোপান হয় এবং জীবনের শেষ দিবস পর্যন্ত আমি যেন ভারতের মুক্তি-সংগ্রামে নিরত থাকতে পারি।” এই নিবেদন পত্রটি ভোটপ্রার্থীর বাক্-সর্বস্ব অন্তঃসারশূন্য প্রতিশ্রুতি ছিল না। এর প্রতিটি কথা ছিল সত্য। হৃদয় থেকে উৎসারিত। ইংরাজ কর্তৃপক্ষ তা জানত। তাই এটি প্রকাশ করার অনুমতি তারা দেয়নি। সুভাষচন্দ্রের মুক্তির পর এটি তাঁর ‘তরুণের স্বপ্ন’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।
স্কুল জীবন থেকেই সুভাষচন্দ্রের দৃষ্টি ও অনুভূতিতে গর্ভধারিণী মা ও মাতৃভূমি একাত্ম হয়ে গিয়েছিল। তাঁর স্বদেশপ্রেমে এক গভীর অধ্যাত্মচেতনা ছিল। মান্দালয়ে তা আরও পরিস্ফুট হয়। ১৯২৫ সালে সুভাষচন্দ্রের উদ্যোগে রাজবন্দীরা দুর্গাপূজা করার জন্যে জেল সুপারের কাছে অনুমতি ও অর্থের জন্য আবেদন করেন। সুভাষচন্দ্রের দৃষ্টিতে দুর্গাপূজা ছিল ‘ধর্মীয় জাতীয় উৎসব’। জেল সুপার মেজর ফিন্ডলে পূজা করার অনুমতি দেন। তিনি ভেবেছিলেন, যেহেতু ভারতীয় জেলে খ্রিস্টান বন্দীরা অনুরূপ সুবিধা পান এই অনুমতির অনুমোদন পেতে অসুবিধা হবে না। কিন্তু ফিল্ডলের অনুমতি দান অনুমোদন করা তো দূরের কথা, তিনি এর জন্যে র্ভৎসিত হন। পূজা অবশ্য এর পূর্বেই হয়ে গিয়েছিল। মহাষ্টমীর দিন সুভাষচন্দ্র মনের আনন্দে এই সংবাদ মাকে জানিয়ে লেখেন, “আজ বাংলার ঘরে ঘরে মা এসে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। সৌভাগ্যক্রমে আজ জেলের মধ্যেও তিনি এসে দেখা দিয়েছেন।…মা বোধহয় আমাদের কথা ভোলেন নাই, তাই এখানে এসেও তাঁর পূজা অর্চনা করা সম্ভব হয়েছে।”
পূজা হয়ে গেলেও সরকারের সঙ্গে সুভাষের নেতৃত্বে বন্দীদের বিরোধ চলতে থাকে। সরকার পুজোর খরচ বহন করতে অস্বীকার করে। সরকারের সিদ্ধান্ত পুনর্বিচারের দাবি করে বন্দীরা লেখেন যে, আলিপুর জেলে মাত্র কয়েকজন খ্রিস্টান অপরাধ বন্দীকে ধর্মানুষ্ঠান পালনের জন্যে বছরে ১২০০ টাকা দেওয়া হয়। কিন্তু উচ্চশিক্ষিত, সংস্কৃতিবান হিন্দু রাজবন্দীদের ধর্মানুষ্ঠানের জন্যে এক পয়সাও দেওয়া হয় না। এটা কী রকম সুবিচার? তাঁরা স্মরণ করিয়ে দেন, “আমাদের ধর্ম শুধুমাত্র পরধর্মসহিষ্ণুই নয়, প্রতিটি ধর্মকেই মর্যাদার আসন দেয় এবং বিশ্বাস করে কোনও সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অধিকারে হস্তক্ষেপ করার অর্থই হল ঈশ্বরের বিধানকে অস্বীকার করা।” বন্দীরা জানিয়ে দেন, ভারতীয়রা তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতাকে রক্ষার জন্যে যে কোনও মূল্য দিতে প্রস্তুত। বন্দীরা কারারুদ্ধ, নিঃসঙ্গ হতে পারেন, কিন্তু তাঁদের সঙ্গে রয়েছে জনসাধারণ, বন্ধু-হিতৈষীরা। প্রয়োজনে বন্দীরা মৃত্যু বরণ করবেন সানন্দে। তাঁরা জানিয়ে দেন যে, দাবি না মানা হলে তাঁরা অনশন ধর্মঘট শুরু করবেন। স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে ছিলেন চিঠির রচয়িতা সুভাষচন্দ্র এবং জীবনলাল চট্টোপাধ্যায়, সত্যেন্দ্রচন্দ্র মিত্র, ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী, সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী, বিপিনবিহারী গাঙ্গুলী, সুরেন্দ্রমোহন ঘোষ ও মদনমোহন ভৌমিক। এই চিঠিতে ফল না হওয়ায় বন্দীরা অনশন শুরু করেন।
বন্দীদের অনশনের সংবাদ সরকারের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। ‘ফরওয়ার্ড’-এ এটি প্রকাশিত হলে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হয়। দিল্লিতে ভারতীয় আইনসভায় বিতর্ক হয়। শেষ পর্যন্ত সরকার রাজবন্দীদের দাবি মেনে নিতে সম্মত হয়। পনেরো দিন অনশনের পর বন্দীরা অনশন প্রত্যাহার করেন।
১৯২৬ সালের শেষ দিকে প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক সভাগুলির নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গীয় প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক সভায় কংগ্রেস প্রার্থী রূপে সুভাষচন্দ্র বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হবেন বলে আশা করা হলেও শেষপর্যন্ত উদারপন্থী (Liberal) দলের নেতা যতীন্দ্রনাথ বসু তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়ান। তিনি খুবই জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। সুভাষচন্দ্র তাঁর সহজাত ঔদার্যে স্বীকার করেছিলেন যে তাঁর (যতীন্দ্রনাথের) উদারনৈতিক মতাদর্শ ছাড়া যতীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে বলার মতো কিছুই নেই। প্রতিদ্বন্দ্বী সম্পর্কে এই মনোভাব ও উক্তি বর্তমান রাজনৈতিক জগতে অচিন্তনীয়। ওই সময়েও তা ছিল বিরল। সুভাষচন্দ্র বিপুল ভোটে জিতলেও তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়নি।
সুভাষচন্দ্রের স্বাস্থ্য ক্রমেই আরও খারাপ হয়ে পড়ছিল। ১৯২৬ সালের শীতকালে ব্রঙ্কো-নিমোনিয়ায় আক্রান্ত হবার পর তা উদ্বেগের কারণ হয়ে পড়ে। স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্যে তাঁকে রেঙ্গুন জেলে পাঠানো হয়। সেখানে এক মেডিকেল বোর্ড পরীক্ষা করে তাঁকে মুক্তি দেবার সুপারিশ করেন। এই বোর্ডের অন্যতম সদস্য ছিলেন সুভাষচন্দ্রের অগ্রজ ভ্রাতা ডাঃ সুনীলচন্দ্র বসু। তাঁকে ওই বোর্ডের সদস্য করা ছিল বিস্ময়কর। যখন বোর্ডের সুপারিশ সম্পর্কে সরকারের সিদ্ধান্তের জন্যে সকলে উদগ্রীব সেই সময় রেঙ্গুন জেলের সুপারিন্টেডেন্ট মেজর ফ্লাওয়ার ডিউ-এর সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের বিরোধ হয়। এর ফলে তাঁর মুক্তিলাভের সম্ভাবনা দূরীভূত হয়। সুভাষচন্দ্র ফ্লাওয়ার ডিউ-এর উদ্ধত অসৌজন্যমূলক ব্যবহার ও আচরণে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে রেঙ্গুন জেল থেকে অন্য যে কোনও জেলে স্থানান্তরিত হতে চেয়েছিলেন। ফ্লাওয়ার ডিউ-এর সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের বিরোধের ঘটনাটি তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা, নির্ভীকতা ও আত্মসম্মান বোধের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি কোন ধাতুতে গড়া ছিলেন তা ঘটনাটি থেকে বোঝা যায়। তখন সুভাষচন্দ্রের মুক্তির জন্যে নানান দিক থেকে চাপ আসছে। সরকার বাধ্য হয়ে ব্যাপারটি বিবেচনা করছে। এই সময় সুভাষচন্দ্র চিফ জেলার মিঃ সলোমনকে একটি চিরকুট লিখে পাঠান (১৯ মার্চ, ১৯২৭) যে তিনি যেন ‘অনুগ্রহ করে’ ইংলিশম্যান কাগজের দু’টি সংখ্যা আনাবার ব্যবস্থা করেন এবং প্রাতঃরাশের আগে তাঁর কাছে যাতে পৌঁছয় তার ব্যবস্থা করেন। দু’ঘণ্টার মধ্যে চিরকুটটি তাঁর কাছে ফিরে আসে। তলায় জেল সুপার মেজর ফ্লাওয়ার ডিউ-এর নিজের হাতে লেখা একটি সই করা নোট, সুভাষচন্দ্র যেন চিফ জেলারকে ‘হুকুম না করেন’। সুভাষচন্দ্র ফ্লাওয়ার ডিউ-এর এই নোট অত্যন্ত অশোভন এবং অসৌজন্যপূর্ণ বলে মনে করেন। এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি বর্মার গভর্নরকে দুটি চিঠি লেখেন। তিনি জানান, যে চিফ জেলারকে কোনও হুকুম করেননি তিনি। সুভাষচন্দ্র স্মরণ করিয়ে দেন, আই সি এস পরীক্ষায় তিনি ইংরাজি রচনায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। মেজর ফ্লাওয়ার ডিউ জাতিতে ইংরেজ হলেও, ইংরাজি ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞান তাঁর চাইতে সুভাষচন্দ্রের অনেক বেশি। কর্পোরেশনের চিফ এক্সিকিউটিভ রূপে তিনি যখন কাজ করেছেন তখন অনেক উচ্চশিক্ষিত ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইউরোপীয় তাঁর অধীনে কাজ করতেন। তাঁদের বেতনও ফ্লাওয়ার ডিউ-এর দ্বিগুণ ছিল। বিবেচনাবোধ তাঁর আছে। তা শেখার দরকার নেই। নিয়মিত সময়ে সংবাদপত্র পাওয়া তাঁর ন্যায্য স্বীকৃত অধিকার। কিন্তু তা তিনি পাচ্ছেন না। বহুবার বলা ও লেখার পরেও একই অব্যবস্থা চলেছে। ফ্লাওয়ার ডিউকে বলেও কোনও ফল হয়নি। সুভাষচন্দ্র দাবি করেন যে, অসৌজন্যমূলক আচরণের জন্যে ফ্লাওয়ার ডিউকে তাঁর মন্তব্য প্রত্যাহার ও দুঃখপ্রকাশ করতে হবে। দু’দিন পরে আর একটি চিঠিতে সুভাষচন্দ্র লেখেন যে, বিষয়টি ‘জটিল’ করে ফেলার ইচ্ছা তাঁর ছিল না। কিন্তু ফ্লাওয়ার ডিউ কী ধরনের ব্যবহার প্রথম থেকেই তাঁর সঙ্গে করেছেন তা জানানো প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
রেঙ্গুন জেলে আসার (ডিসেম্বর ১৯২৬) পর প্রথম পরিচয়েই ফ্লাওয়ার ডিউ তাঁকে সতর্ক করে দেন যে, সুভাষচন্দ্র যেন বাইরের কারও সঙ্গে যোগাযোগ না করেন। তাঁর ওই সাবধানবাণীর ভাষা ও তাঁর আচরণ ছিল অত্যন্ত আপত্তিকর। তারপর সুভাষচন্দ্র অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি চিকিৎসার জন্যে কোনও যত্ন নেওয়া দূরের কথা, গ্রাহ্যের মধ্যেও আনেননি। তাঁর অফিসে দেখা করতে গেলে তিনি সুভাষচন্দ্রকে বসতে পর্যন্ত বলেননি। সপ্তাহের প্রতি সোমবার জেল সুপারের দায়িত্ব হচ্ছে তাঁকে দেখতে আসার। কিন্তু তিনি ক’দিন তাঁকে দেখতে এসেছেন তার খোঁজ নিলেই বোঝা যাবে ওই দায়িত্ব তিনি কতটা পালন করেছেন। তিনি আদেশ জারি করেছেন যে, কোনও বন্দী যদি সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে কথা বলে, তার শাস্তি হবে। ফ্লাওয়ার ডিউ-এর চরম অভদ্র উদ্ধত ব্যবহারে সুভাষচন্দ্র এত ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে, তাঁকে অবিলম্বে রেঙ্গুন জেল থেকে অন্য যে কেনও জেলে যাতে পাঠানো হয় তার জন্যে দিল্লিতে কর্তৃপক্ষকে বলার জন্যে তিনি মতিলাল নেহরু ও কলকাতার মেয়র যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তকে তারবার্তা পাঠিয়েছিলেন। প্রতিবাদের ফলে কয়েকদিনের মধ্যেই সুভাষচন্দ্রকে ইনসিন জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে সুভাষচন্দ্র একটি সামান্য ব্যাপার নিয়ে এত স্পর্শকাতর না হলেই ভাল করতেন। তখন তাঁর মুক্তির প্রশ্নটি জোরাল হয়ে উঠেছিল। ঠিক ওই সময়ে এত বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করা তাঁর পক্ষে ক্ষতিকরই হয়েছিল। সাধারণ বুদ্ধিতে, সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে এই বক্তব্য যুক্তিগ্রাহ্য। কিন্তু সুভাষচন্দ্রকে এ মাপকাঠিতে দেখা ও বিচার করা সম্ভব নয়। চলিত কথায়—ফ্লাওয়ার ডিউ সিংহের লেজে পা দিয়েছিলেন। তাই সিংহের গর্জন ও তেজের প্রকাশ ছিল অনিবার্য।
ইনসিনের জেল সুপার মেজর ফিন্ডলে পূর্বে মান্দালয় জেলে ছিলেন। তিনি সুভাষচন্দ্রের স্বাস্থ্যের শোচনীয় অবস্থা দেখে সরকারকে একটি কড়া নোট পাঠান। কিন্তু তাতেও সরকার তাঁকে বিনাশর্তে মুক্তি দিতে সম্মত হল না। প্রস্তাব করা হল যে, যদি তিনি নিজের খরচে সরাসরি সুইজারল্যান্ডে যেতে সম্মত হন তাহলে তাঁকে মুক্তি দিয়ে রেঙ্গুন থেকে ইউরোপগামী জাহাজে তুলে দেওয়া হবে। শর্তকন্টকিত ওই প্রস্তাব সুভাষচন্দ্র অসম্মানজনক বলে প্রত্যাখ্যান করেন। কবে তাঁকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করতে দেওয়া হবে, বা কখনও হবে কি না, ওই প্রস্তাবে তার কোনও সুষ্পষ্ট উল্লেখ ছিল না। বাংলার পুলিশ মহলে সুভাষচন্দ্র সম্বন্ধে গভীর সন্দেহ ও ততোধিক ভয় ছিল। প্রশাসনের উচ্চমহল তাঁর মুক্তির ব্যাপারে চাপে পড়ে কিছুটা নরম হলেও পুলিশ কর্তৃপক্ষের তাতে প্রবল আপত্তি ছিল। আর, এই ব্যাপারে পুলিশের বক্তব্যই বেশি প্রাধান্য পেত। শরৎচন্দ্র বসুকে সুভাষচন্দ্র লেখেন, “পরলোকগত দেশবন্ধু আমাকে ‘যুবক-বৃদ্ধ’, বলে ডাকতেন। তিনি আমাকে নৈরাশ্যবাদী বলে মনে করেছিলেন। একটি বিষয়ে আমি নৈরাশ্যবাদী বটে, কারণ আমি সব ঘটনারই অশুভ দিকটা বড় করে দেখি। বর্তমান ঘটনার সব চাইতে খারাপ ফল কি হতে পারে, তাও আমি চিন্তা করে দেখেছি, কিন্তু তবুও আমি স্থির করেছি, জন্মভূমি থেকে চিরকালের জন্য নির্বাসনের চাইতে জেল থেকে মৃত্যুবরণ করাই শ্রেয়।” আর একটি চিঠিতে তিনি এক সহকর্মী বন্ধুকে লেখেন যে, জেলের প্রাচীরের বাইরে যাওয়ার আশা যতই সুদূর পরাহত হচ্ছে, ততই তাঁর মন শান্ত ও উদ্বেগশূন্য হয়ে আসছে। “ষোল আনা দিতে হলে অপর দিকে ষোল আনা পাওয়া চাই…এখনও ষোল আনা পাওয়া ও ষোল আনা দেওয়ার জন্যে আমার মনপ্রাণ আকুল হয়ে উঠেছে।” তার মুক্তি নিয়ে সরকার যে রকম শর্ত দিচ্ছিল ও কিছু কিছু লোক মনে করছিল যে তিনি আরও ভাল শর্তের জন্যে ‘পাটোয়ারি চাল’ দিচ্ছেন, সেই প্রসঙ্গে সুভাষ শরৎচন্দ্রকে লেখেন, “আমি দোকানদার নই, দর কষাকষি আমি করি না। কূট চালের পিচ্ছিল পথ আমি ঘৃণা করি, আমি একটি আদর্শ অবলম্বন করে দাঁড়িয়ে আছি। ”
শেষপর্যন্ত সুভাষচন্দ্রকে আলমোড়া জেলে বদলি করার সিদ্ধান্ত হয়। জাহাজে করে রেঙ্গুন থেকে ডায়মন্ডহারবারে পৌঁছলে তাঁকে বাংলার গভর্নরের লঞ্চে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই লঞ্চে একটি মেডিকেল বোর্ড তাঁর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। এই বোর্ডের চার সদস্যের মধ্যে ছিলেন ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় ও স্যার (ডাঃ) নীলরতন সরকার। পরের দিন সকালে সুভাষচন্দ্রকে মুক্তি দেওয়া হয়। দিনটি ছিল ১৬ মে, ১৯২৭, অথচ মুক্তির আদেশে সই করা ছিল ১১ মে! অথাৎ একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত পুলিশ কর্তৃপক্ষের চেষ্টা চলছিল যদি মুক্তির আদেশ বাতিল করানো যায়।
সুভাষচন্দ্রকে মুক্তি দেবার পিছনে একটি বড় কারণ ছিল ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কয়েকজন সদস্যের নিরলস প্রচেষ্টা। এঁদের মধ্যে ছিলেন পেথিক-লরেন্স (Pethick-Lawrence), ল্যান্সবেরী (George Lansbury), থার্টল (Thurtle) এবং টি. উইলিয়ামস (T. Williams)। ১৯২৭ সালের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু করে নভেম্বর মাস পর্যন্ত সুভাষচন্দ্রের মুক্তি, তাঁকে বিনা বিচারে বন্দী করে রাখা, তাঁর স্বাস্থ্য সম্পর্কে প্রশ্ন হাউস অফ কমন্সে উত্থাপন করে তাঁরা ভারত সম্পর্কে ভারপ্রাপ্ত সচিব ও সহ-সচিবকে বিব্রত ও প্রায় বিপর্যস্ত করে তুলেছিলেন। ল্যান্সবেরী তো পার্লামেন্টে অভিযোগ করেছিলেন, “ভারত সরকার এই লোকটিকে হত্যা করার চেষ্টা করছে।” স্পিকার তাঁর এই মন্তব্যটি পার্লামেন্টের বিবরণী (Proceedings) থেকে বাদ দেবার আদেশ দেন। সুভাষচন্দ্রের ‘বিচার’ সম্পর্কে পার্লামেন্টে ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া তথ্য যে মিথ্যা তাও ল্যান্সবেরী প্রমাণ করে দিয়ে ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রীকে দুঃখ প্রকাশে বাধ্য করেছিলেন। ওই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলি কিন্তু সুভাষচন্দ্রের জীবনীকারদের লেখায় উপযুক্ত গুরুত্ব পায়নি।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন