দেশনায়ক – ১৯

মান্দালয় জেলে সুভাষচন্দ্র ছিলেন প্রায় আড়াই বছর। তাঁর জীবনের এই অধ্যায়টির গুরুত্ব অসীম। বাল গঙ্গাধর তিলকের প্রতি তাঁর গভীরতম শ্রদ্ধা জানাতে তিনি তিলকের মান্দালয় জেলের দীর্ঘ ছ’বছরের নির্বাসিত জীবনের কথা আবেগ ও তীব্র অনুভূতির সঙ্গে স্মরণ করেছিলেন। তাঁর অসহনীয় দৈহিক ও মানসিক যন্ত্রণার কথা খুব কমসংখ্যক লোকই জানে বলে সুভাষচন্দ্র লিখেছিলেন। সব যন্ত্রণা ও পরাধীনতার মধ্যেও কারাবাসের অমানুষিক প্রতিক্রিয়া তুচ্ছ করা ও মানসিক স্থৈর্য বজায় রেখে গীতা-ভাষ্যের মতো একটি বিরাট যুগ-সৃষ্টিকারী গ্রন্থ রচনা শুধু লোকমান্যের মতো অসাধারণ ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন একজন দার্শনিক, এক শ্রেষ্ঠ ভারত সন্তানের পক্ষেই সম্ভব বলে সুভাষচন্দ্র উপলব্ধি করেছিলেন। মান্দালয়ে নির্বাসন, জেলের নোংরা, একঘেয়ে বৈচিত্র্যহীন জীবন তাঁর অসহনীয় মনে হলেও ওই জেল সুভাষচন্দ্রের কাছে ছিল একটি ‘পবিত্র তীর্থস্থান’। তিনি নিজে তিলকের কথা স্মরণ করে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। ভগ্নস্বাস্থ্য, মানসিক নির্যাতন উপেক্ষা করে কঠোরতর সংগ্রামের জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন। ছ’মাস দুঃসহ জীবনের পর লিখেছিলেন যে, স্বদেশ ও স্বগৃহ থেকে মান্দালয়ে বাধ্যতামূলক নির্বাসন তাঁর স্মৃতির ভাণ্ডার পরিপূর্ণ করবে, তাঁর কাছে সান্ত্বনা ও প্রেরণাস্বরূপ হবে। তিলক প্রসঙ্গে তিনি লেখেন, “আশা করি দেশবাসী লোকমান্যের মহত্ত্বের পরিমাপ করবার সময় এসব বিষয় মনে রাখবেন।” তিলক সম্পর্কে তিনি যে কথা বলেছিলেন তার প্রতিটি শব্দ সুভাষচন্দ্রের সম্বন্ধেও প্রযোজ্য। মান্দালয়ে সুভাষচন্দ্রের বন্দীজীবনের কথা না জানলে, তাঁর মনের গভীরতা, ব্যাপ্তি, জীবনের বিভিন্ন বিচিত্র দিক সম্বন্ধে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি এবং অনুভূতির অন্তত কিছু পরিচয় না পেলে সুভাষচন্দ্র বসু অনেকটাই অজানা থেকে যাবেন।

মান্দালয় জেলে আসার কয়েকদিন পর থেকেই তাঁর শরীর খারাপ হতে থাকে। সেখানকার জল-হাওয়া তাঁর সহ্য হয়নি। কারও পক্ষেই তা হওয়া সম্ভব ছিল না। মান্দালয় ছিল ‘ধূলার রাজ্য’। শরৎচন্দ্র বসুকে তিনি মান্দালয়ের পরিবেশ সম্পর্কে লেখেন, “জনৈক কবি একবার বলেছিলেন যে মৃত্যুর কাছে বছরের সব ঋতুই সমান, মান্দালয়ে ধূলাও তেমনি বারোমাস। কারণ পৃথিবীর এ প্রান্তে বর্ষা ঋতু বলে কিছু নেই।…বাতাসে ধূলো উড়ে বেড়ায়, ফলে শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে শরীরে প্রবেশ করে। খাদ্যের সঙ্গেও একে গ্রহণ করতে হয়। টেবিলে, চেয়ারে, বিছানায় সর্বত্রই এর কোমল স্পর্শ অনুভূত হয়…মাঝে মাঝে ধূলোর ঝড়ও ওঠে⋯মান্দালয়ের চারদিকেই ধূলো ছড়িয়ে আছে—সর্বত্র তা এত ব্যাপ্ত যে এক অর্থে একে দ্বিতীয় বিধাতাও বলা যায়। ঈশ্বর করেন, আমরা এই নব-বিধাতার হাত থেকে রক্ষা পাই।” সুভাষচন্দ্রের মনে হয়েছিল বন্দীরা যেন চিড়িয়াখানার প্রাণীর মতো দিন কাটাচ্ছেন। জেলের ওয়ার্ডগুলো কাঠের খুঁটি পুঁতে বেড়ার আকারে তৈরি। রাত্রে তালাবন্ধ, বন্দীদের বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে যে মানুষের মতো দেখতে কিছু প্রাণী আলোকিত খাঁচার মধ্যে শিকারের খোঁজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সুভাষচন্দ্র কিন্তু এই অবস্থার মধ্যেও রসবোধ হারাননি। জেলের বর্ণনা দিয়ে লেখেন, “এটি এক অদ্ভুত অনুভূতি। ঈশ্বর জানেন, আমাদের এ রূপান্তর কতদিনে শেষ হবে। সে যাই হোক, যে লেজ ও থাবা মানুষ একবার বহু আগেই ত্যাগ করতে পেরেছে, অবস্থার এই সাদৃশ্যের ফলে তা নিশ্চয়ই পুনরায় আমাদের গজাবে না।”

সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে একটি প্রচলিত ধারণা যে, তাঁর স্বভাব ছিল গম্ভীর। হাসি, ঠাট্টা বেশি করতেন না। সব বিষয়েই খুব ‘serious’। তিনি উপস্থিত থাকল হাল্কা কথাবার্তা, রসিকতা তেমন জমত না। ‘আত্মশক্তি’র অফিসে দা ঠাকুর (শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী) ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মাঝে মাঝে আসতেন। এই দু’জন সদাহাস্যময় রসিক স্বদেশপ্রেমিক মানুষকে সুভাষ গভীর শ্রদ্ধা করতেন। ওঁরা এলে আসর জমে উঠত। কিন্তু সুভাষ চুপচাপ নিজের কাজ করে যেতেন। একদিন শরৎচন্দ্র আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। বলে উঠলেন, “জানো, সুভাষ হাসতে ভয় পায়। ওর ভয় কি জানো ? দেশ স্বাধীন হবার আগে হাসাহাসি করলে ভারতমাতা যদি রাগ করেন।” সুভাষচন্দ্র কিন্তু খুবই রসিক ছিলেন। নিকট বন্ধুমহলে প্রাণ খুলে হাসতেন। দিলীপকুমার রায় তাঁর স্মৃতিচারণে সুভাষের চরিত্রের এই দিকটির কথা বলেছেন। তবে বাইরে থেকে তা বোঝা যেত না। মান্দালয় থেকে লেখা অনেক চিঠিতে সুভাষের রসবোধ ও সরস লেখার ক্ষমতার পরিচয় রয়েছে। তাঁর বহু চিঠিতে রাজনৈতিক প্রসঙ্গ থাকলেও মহাত্মা গান্ধীর তেমন কোনও উল্লেখ নেই। শুধু রাজবন্দীদের মুক্তি সম্পর্কে গান্ধীজির বক্তব্য পড়ে তিনি ‘কৌতূহলী’ হয়েছেন, এইটুকু মন্তব্য আছে। অন্য একটি চিঠিতে গান্ধীজি সম্বন্ধে সরস ইঙ্গিত আছে। তাঁর হজমের গোলমালের সম্ভাব্য কারণ সম্পর্কে ইন্‌স্পেক্টর জেনারেল অফ প্রিজনসের ধারণা হয়েছিল যে, অতিরিক্ত ভোজনের ফলেই সুভাষচন্দ্রের ডিসপেপসিয়া হচ্ছে। সুভাষ জানান যে, ওই প্রশ্ন অবান্তর কেননা তাঁর খাদ্য ভাতা কমিয়ে অর্ধেক করা হয়েছে। তবুও সুভাষচন্দ্রকে তিনি উপদেশ দেন মাঝে মাঝে অনশন করতে। এই উপদেশের কথা শরৎচন্দ্রকে জানিয়ে তিনি লেখেন, “তাহলে গভর্নমেন্টের কর্মচারীদের মধ্যেও, মহাত্মা গান্ধীর শিষ্য আছে দেখা যাচ্ছে। আমি তাঁকে বলেছি সে চেষ্টাও আমি করে ফেলেছি। কিন্তু তা আমাকে শুধু দুর্বল করে ফেলে।”

শরৎচন্দ্রের স্ত্রী মেজবৌদি বিভাবতী বসুকে তিনি একটি চিঠিতে লেখেন, “এ সপ্তাহে মেজদাদাকে লেখবার মতো কিছু নাই, তাই আপনাকে লিখতে বসেছি, আপনাকে কাজের সম্বন্ধে লেখার প্রয়োজন নাই, তাই ঘরকন্না সম্বন্ধে লিখব।” তাঁর ঘরকন্নার যে চিত্র তিনি ওই চিঠিতে তুলে ধরেছিলেন তা সরস, রম্যরচনার এক উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। তিনি ছোট ছেলেমেয়ে পছন্দ করলেও বেড়াল ছানা পছন্দ করেন না। বিশেষত যদি সবকটি বেড়ালই বদ রঙের হয়। অন্য কয়েদিদের বেড়াল প্রীতির ফলে বেড়ালের সংখ্যা বেড়েই চলেছে, জেল তাঁদের (বন্দীদের) গৃহ হলেও কিন্তু গৃহিণী নেই। গৃহিণীর অভাবে একজন কয়েদিকে ম্যানেজারবাবু করা হয়েছে। তিনিই গৃহস্থালীর সর্বেসর্বা। তাঁকেই তাঁরা খাওয়া-পরার জন্যে দায়ী করেন। খাওয়া খারাপ হলে গালাগালি করেন। মধুর অভাবে লোকে গুড় খায়। তেমনি নদীর অভাবে তাঁরা বড় চৌবাচ্চার মতো জেলের একটি ডোবায় সাঁতার কাটেন। জেলের এমনই গুণ যে, রজনীগন্ধা ফুল ফুটলেও ওই ফুলে গন্ধ নেই। এই ম্যানেজার একদিন তাঁর হোটেলে সুভাষচন্দ্রদের গরম গরম জিলিপি খাওয়ান। মহা আনন্দে এই সুখবর মেজদৌদিকে জানিয়ে সুভাষচন্দ্র লেখেন যে, এর আগে একদিন ম্যানেজারবাবু রসগোল্লাও খাইয়েছিলেন। যদিও গোল্লাগুলি রসে ভাসছিল, কিন্তু ভেতরে রস ছিল না। ছুঁড়ে মারলে রগ ফেটে যেতে পারত। তবুও সেদিন তাঁরা মহাখুশি হয়ে দু’হাত তুলে ম্যানেজারবাবুকে ‘আশীর্বাদ’ করেন ‘তিনি যেন চিরকাল জেলেই থাকেন’। এই ম্যানেজারবাবু কিছুদিন পরে ম্যানেজারি ছেড়ে শাকসবজির বাগান করার দিকে মন দেন। তাছাড়া ফুলের বাগান করার শখও তাঁর হয়। জেলের মধ্যে জমির অনেকটা জায়গায় রোদ লাগে না বলে তিনি রোদের মধ্যে একটা বড় আরশি ফুলের গাছগুলির ওপর কয়েকঘণ্টা ধরে ফেলে রাখছেন। তাঁর বিশ্বাস এই ‘বৈজ্ঞানিক উপায়ে’ ফুলের গাছগুলির খুব তাড়াতাড়ি বাড়ছে। সুভাষচন্দ্র তাই তাঁকে ‘দ্বিতীয় জগদীশ বোস’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। আর একটি চিঠিতে মেজবৌদিকে জানান, “আমাদের পায়রার খুব বংশবৃদ্ধি হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে পায়রার খোপও বাড়াতে হচ্ছে। মুরগী মোরগের পালও খুব বেড়ে গেছে। (এতে হিন্দুয়ানী নষ্ট হবে না তো?) ২/৩ জোড়া বিলিতি মোরগ ও মুরগীর সাহায্যে কি করে অল্প দিনের মধ্যে এক পাল ভাল জাতের মোরগ ও মুরগী হতে পারে—তা আমরা হাতে হাতে দেখছি। পায়রার সম্বন্ধেও ওই এক কথা খাটে। তবে ময়ূরপঙ্ক্ষীদের বাঁচানো গেল না—তারা ক্রমাগত মরে যায়। টিয়াপাখি বেঁচে আছে—মনের সুখে কি দুঃখে তা বলতে পারি না।”

মেজবৌদিকে প্রথম চিঠিতে মান্দালয় কারাজীবনের ‘ঘরকন্না’র কথা লেখার পর সুভাষচন্দ্রের সন্দেহ ছিল, তাঁর ওইসব গৃহস্থালীর খুঁটিনাটির কথা ভাল লাগবে কি না। যখন বিভাবতী দেবী জানালেন যে, ওই চিঠি পড়ে সকলে রস উপভোগ করেছেন, তখন সুভাষচন্দ্র খুব খুশি হয়েছিলেন। কেন তিনি জেলের আনন্দহীন, বৈচিত্র্যহীন, রসশূন্য দৈনন্দিন জীবনেও রসবোধ হারাতে চান না, তার কারণ ব্যাখ্যা করে লেখেন, “মধ্যে মধ্যে আশঙ্কা হয় যে, হয়তো জেলে থাকতে থাকতে জীবনের সব রস শুকিয়ে যাবে। শাস্ত্রে বলে ‘রসো বৈ সঃ’—অর্থাৎ ভগবান নাকি রসময়। সুতরাং রস যে লোক হারিয়েছে সে যে জীবনের সারবস্তু আনন্দ হারিয়েছে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নাই—তার জীবন তখন ব্যর্থ, নিরানন্দ ও দুঃসময়। আমার চিঠি পড়ে আপনারা যদি আনন্দ পান, তাহলে বুঝতে পারব যে, আমি আনন্দ দিবার ক্ষমতা এখনও হারাই নাই। পৃথিবীর বড় বড় লোকেরা যেমন দেশবন্ধু, রবি ঠাকুর ইত্যাদি অনেক বয়স পর্যন্ত এমনকি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আনন্দ ফুর্তি হারান নাই। সে আদর্শ আমাদের পক্ষে অনুকরণীয়।” সুভাষচন্দ্রের রসঘন চিঠিগুলি পড়ে বিভাবতী দেবী, জানকীনাথ-প্রভাবতী ও পরিবারের সকলের হাসি কান্নার অশ্রুতে চোখ ভরে যেত। সুভাষচন্দ্রের মনের এই দিকটি কিন্তু অনালোকিত হয়ে রয়েছে।

মান্দালয়ে বন্দীজীবনে সুভাষের অন্তহীন কর্মহীন দিনগুলির বেশির ভাগ সময় কাটত বই পড়ে। তাঁর বিভিন্ন বিষয় সম্বন্ধে জানার আগ্রহ ছিল অসীম। বাল্যকাল থেকেই তাঁর বই পড়ার উৎসাহ ছিল অদম্য। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা আরও বৃদ্ধি পায়। অত্যন্ত কর্মব্যস্ততার মধ্যেও তিনি প্রতিদিন পড়াশোনা করতেন। ১৯২৪ সালের অক্টোবর মাসে গ্রেফতারের পর তাঁকে যখন বহরমপুর জেলে রাখা হয় তখন তাঁর প্রধান চিন্তা ছিল, কী করে তাঁর মানসিক ক্ষুধার নিবৃত্তি হবে। যে সামান্য মাসিক ভাতা বন্দীদের জন্যে সরকারি বরাদ্দ ছিল তাতে খুব অল্প বই কেনা সম্ভব ছিল। তাই তিনি শরৎচন্দ্র বসুকে বলেছিলেন, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, জলধর সেন প্রমুখ যেন তাঁদের কিছু বই রাজবন্দীদের জন্যে উপহার রূপে পাঠান। সমসাময়িক ইংরাজি ও পাশ্চাত্য সাহিত্যের কিছু অনুবাদ গ্রন্থও সম্ভব হলে পাঠাতে বলেছিলেন। কলকাতার এক প্রখ্যাত পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সুভাষচন্দ্রের জন্যে টেনিসনের রচনাবলী ও অভিধান পাঠিয়েছিলেন। মান্দালয় থেকে তিনি অনুরোধ করে পাঠাতেন নানান রকমের বইয়ের জন্যে। ওইসব বইয়ের লেখকদের নাম ও বিষয়গুলির বৈচিত্র্যে সুভাষচন্দ্রের রুচি, পড়াশোনার বিস্তৃতি ও গভীরতার পরিচয় পাওয়া যায়। ভারতবর্ষের ইতিহাস, সমাজ সংস্কৃতি সম্বন্ধে তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল। প্রাচীন থেকে আধুনিক যুগের ইতিহাসের নানান দিক সম্পর্কে পড়াশোনা করতেন। লর্ড রোনাল্ডসের ‘হার্ট অফ আর্য ভারত’, নরেন্দ্রনাথ লাহার ‘এনসিয়েন্ট হিন্দু পলিটি’, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘এ নেশন ইন মেকিং’ ইত্যাদি বই তিনি জেলে আনিয়ে পড়েছিলেন। নতুন বই বেরলে তার সংবাদও তিনি রাখার চেষ্টা করতেন। ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদারের ‘এনসিয়েন্ট ইন্ডিয়ান কলোনিজ ইন দি ফার ইস্ট’ বইটি বহির্ভারত বা পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে ভারতের প্রাচীন যুগের সম্পর্কের ওপর এক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা গ্রন্থ। এই বইটি ওই সময় প্রকাশিত হয়। তিনি শুধু বইটি পাঠাবার জন্যে বলেননি, পড়ার পর ওই বিষয়টি সম্পর্কে তাঁর নিজের যেসব নথিপত্র নজরে এসেছে তা রমেশচন্দ্র ব্যবহার করেছেন কি না দেখার জন্যে। তা না হলে সেই সম্পর্কে ডঃ মজুমদারকে জানাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। ডঃ মজুমদারের কাছে কয়েকটি বিষয় সম্বন্ধে লিখেও পাঠিয়েছিলেন। তিনি আশা করেছিলেন, ডঃ মজুমদার ওই বিষয়ে আলোকপাত করতে পারবেন। প্রাচীন ভারতবর্ষ সম্বন্ধে তিনি অনেক বই কলকাতা থেকে আনিয়েছিলেন। বোঝাই যায় যে মামুলি নয়, ওই বিষয়ে গবেষণামূলক পড়াশোনা তাঁর ছিল।

সুভাষচন্দ্রের পড়াশোনার পরিধি ছিল বিস্ময়কর। অ্যাডাম উইলিয়ামসের নদীর ওপরে লেখা বই, ই. মে-র ‘পার্লামেন্টারি প্রসিডিওর’, হ্যামন্ডের ভারতীয় নির্বাচন, নির্বাচন পদ্ধতি, ব্রিটিশ পার্লামেন্টে স্পিকারদের ভূমিকা থেকে শুরু করে পাশ্চাত্য দর্শনের ওপর নানা গ্রন্থ, নীৎসের রচনাবলী, পাশ্চাত্য সাহিত্যের বই তিনি মান্দালয় জেলে পড়ে চিঠিপত্রে তার উল্লেখ করেছেন। শরীরচর্চা সম্পর্কে ম্যুলারের ‘মাই সিস্টেম’ বইটি তিনি অন্যদের পড়তে উপদেশ দিয়েছিলেন। বাংলা সাহিত্যে তাঁর গভীর অনুরাগ ছিল। বিবেকানন্দের রচনাবলী, বিশেষ করে তাঁর ‘পত্রাবলী’, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত, রবীন্দ্রনাথের কবিতা, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘মেবার পতন’, ‘দুর্গাদাস’, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও রমেশচন্দ্র দত্তের ঐতিহাসিক উপন্যাস, নবীনচন্দ্র সেনের ‘পলাশীর যুদ্ধ’ তাঁর বিশেষ প্রিয় ছিল। সুভাষচন্দ্রের পড়াশোনা সম্বন্ধে একটি পৃথক বই লেখা যায়। মান্দালয় জেলে থাকাকালে তিনি কত রকমের বই পড়েছিলেন তা জানলে অবাক হতে হবে। আর তিনি শুধু পড়েননি, বিভিন্ন বই সম্পর্কে তাঁর গভীর চিন্তাপূর্ণ মন্তব্য ও টীকাগুলি একত্র করলে একটি বই হবে। শিশিরকুমার বসু সম্পাদিত সুভাষচন্দ্রের সমগ্র রচনাবলীর চতুর্থ খণ্ডে এইগুলি সঙ্কলিত হয়েছে। মান্দালয়ে সুভাষচন্দ্র এত বেশি পড়াশোনা করেছিলেন, প্রায় প্রতি চিঠিতে বই পাঠানোর জন্যে এত লিখেছিলেন যে, শরৎচন্দ্র তাঁকে লিখতে বাধ্য হন, বন্দীদশায় তাঁর মাত্রাতিরিক্ত পড়াশোনা করা ঠিক হবে না। স্বাস্থ্যের পক্ষে এত মানসিক পরিশ্রম ক্ষতিকর হবে। এই প্রসঙ্গে অন্য একটি তথ্যের উল্লেখ করি।

সুভাষচন্দ্র জ্যোতিষ ও তন্ত্রবিচার গ্রন্থে আগ্রহী ছিলেন। ওই বিষয়ে ইংরাজি ও বাংলা বই তিনি পড়েছিলেন। সুরেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য সম্পাদিত ‘পুরোহিত দর্পণ’ বইটি পড়ে তিনি নিজের মন্তব্য লিখেছিলেন। এটি পড়লেই বোঝা যায় যে, তন্ত্র ও জ্যোতিষ শাস্ত্রের মতো দুরূহ বিষয়ে তাঁর দখল ছিল। তিনি জ্যোতিষে বিশ্বাস করতেন কি না সে বিষয়ে কিছু নির্দিষ্টভাবে বলা না গেলেও একটি ঘটনার কথা বলা যেতে পারে। দিলীপকুমার রায় একটি চিঠিতে (৩০ সেপ্টেম্বর, ১৯২৫) সুভাষচন্দ্রকে জানান যে, তিনি বারাণসীতে এক বিখ্যাত জ্যোতিষীর কাছে গিয়েছিলেন। শুনেছিলেন যে এই জ্যোতিষী নাকি নিখুঁত ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেন। দিলীপকুমার এ কথা বিশ্বাস করেননি। কিন্তু ওই জ্যোতিষীর কাছে যাবার পর তাঁর অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি সুভাষচন্দ্রকে লেখেন, “ভৃগু সংহিতার সাহায্যে তিনি তোমার সম্পর্কে যে সব কথা বললেন সেগুলি শুনে আমি খুব অবাক হয়ে গিয়েছি। ভৃগু সংহিতার কথা তুমি নিশ্চয়ই শুনেছ। এবার বলছি কী ঘটেছিল…আমি আমার দুজন বন্ধুর সঙ্গে জ্যোতিষীর কাছে গিয়ে তোমার কুণ্ডলী বা রাশিচক্র দেখালাম, এটি আমি তোমার এক বন্ধুর কাছে সংগ্রহ করেছি। তোমার নাম বলেছিলাম এস বসু। তোমার সম্পর্কে আর কিছুই জানাইনি জ্যোতিষীকে। তিনি নিজেও তোমার পরিচয় জানতেন না, মন্তব্যগুলি যথার্থ প্রমাণিত হওয়ার আগে তোমার আসল পরিচয় সম্পর্কে কোনও ইঙ্গিত দিইনি আমি। শ্লোক আউড়ে তিনি তোমার সাধারণ প্রকৃতি ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যে চিত্র দিয়েছেন, সেটি আমি একটি কাগজে টুকে নিয়েছি…মনে হয় এগুলি তোমার মনোযোগ আকর্ষণ করবে।” সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে ওই জ্যোতিষী বলেছিলেন, গৌরবর্ণ, মোটামুটি ভাল স্বাস্থ্য, সুদর্শন, পাশ্চাত্য বিদ্যা ও ইংরাজিতে সুপণ্ডিত, ইউরোপ সফর করেছেন একবার, উচ্চ সরকারি পদ পেয়েছিলেন, কঠিন পরীক্ষায় পাস করেছেন, ভাল ছাত্র এবং ধর্মশাস্ত্রে সুপণ্ডিত, অত্যন্ত সহানুভূতিসম্পন্ন মানুষ, বিদেশীদের প্রতি বিদ্বেষপোষণ করেন না, একটি বা দুটি ভ্রাতার মৃত্যু হবে, ২৮ বছর বয়স পূর্ণ হবার পরে সুন্দরী ও বিদুষী মহিলার সঙ্গে বিবাহ হবে, ৩০ বা ৩২ বছর বয়সে পুত্রসন্তান হবে, দেশ বিদেশে যশোলাভ (দেশ দেশান্তরে কীর্তি), পুনরায় ইউরোপ সফর, সুদৃঢ় নৈতিক চরিত্রের জন্যে বিখ্যাত, পিতা প্রভাবশালী ব্যক্তি, অত্যন্ত দানশীল প্রকৃতি, তপশ্চর্যাপূর্ণ জীবন, পরমায়ু ৭০-৭১, ধর্মপ্রাণ ও সৎ, অবৈধ প্রণয়ে আগ্রহী নন, ২৮ থেকে ৩০ বছর বয়সের মধ্যে তীব্র মানসিক সঙ্কটে পড়বেন, ২৯ বছর বয়সে মুক্তি পাবেন, ৩১ বছর বয়সে সমৃদ্ধির জীবন শুরু হবে, ২৭ থেকে ২৯ বছর পর্যন্ত বন্দীজীবন, দয়ালু প্রকৃতির।

দিলীপকুমার লেখেন, “তোমার চরিত্র সম্পর্কে তিনি যে চিত্রটি তৈরি করেছেন সেটি বিস্ময়করভাবে সত্য। অন্তত আমার মতে তাই।” সুভাষচন্দ্রের নিজের এই সম্পর্কে কী মনে হয়েছিল তা জানা নেই। সুভাষচন্দ্র সম্বন্ধে যাঁরা জানেন তাঁদের অভিমত কী, তা অনুমান সাপেক্ষ।

ওড়িয়া ভাষা ও সাহিত্যে সুভাষচন্দ্রের আগ্রহ ছিল। ওড়িশার প্রখ্যাত কংগ্রেস নেতা গোপবন্ধু দাসের সঙ্গে তাঁর মান্দালয় থেকে পত্রালাপ ছিল। ওড়িশার উন্নতির বিষয়ে তাঁর গভীর ভাবনা চিন্তা ছিল। গোপবন্ধু সুভাষকে ওড়িয়া ভাষায় লেখা বই পাঠাতেন। এসব বই পড়ে তিনি আরও বই পাঠাতে অনুরোধ করতেন। বিজয় মজুমদারের Orissa in the Making বইটি পড়তে তিনি বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। মান্দালয়ে সহবন্দী জীবনলাল চট্টোপাধ্যায়ের কাছে তিনি বর্মী ভাষাও শিখেছিলেন।

মানুষের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের জন্যে নিয়মিত পাঠাভ্যাস সুভাষচন্দ্র অপরিহার্য মনে করতেন। সব প্রতিষ্ঠানের, এমনকি কারাগারেও, গ্রন্থাগার থাকা তিনি অবশ্য প্রয়োজন মনে করতেন। পাঠ, শরীর-চর্চা ও চিন্তা বা ধ্যান—অন্তত দেড় দু’ ঘণ্টার জন্যে, তিনি সার্বিক উন্নতির পক্ষে একান্ত প্রয়োজন মনে করতেন। সুভাষচন্দ্রের আর এক দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জগতের মধ্যে ব্যবধান দূর হওয়া প্রয়োজন। জাতির সার্বিক অগ্রগতির স্বার্থে উভয় জগতের মানুষের মধ্যে সমন্বয়ের ওপর তিনি জোর দিয়েছিলেন।

সকল অধ্যায়

১. দেশনায়ক – ১
২. দেশনায়ক – ২
৩. দেশনায়ক – ৩
৪. দেশনায়ক – ৪
৫. দেশনায়ক – ৫
৬. দেশনায়ক – ৬
৭. দেশনায়ক – ৭
৮. দেশনায়ক – ৮
৯. দেশনায়ক – ৯
১০. দেশনায়ক – ১০
১১. দেশনায়ক – ১১
১২. দেশনায়ক – ১২
১৩. দেশনায়ক – ১৩
১৪. দেশনায়ক – ১৪
১৫. দেশনায়ক – ১৫
১৬. দেশনায়ক – ১৬
১৭. দেশনায়ক – ১৭
১৮. দেশনায়ক – ১৮
১৯. দেশনায়ক – ১৯
২০. দেশনায়ক – ২০
২১. দেশনায়ক – ২১
২২. দেশনায়ক – ২২
২৩. দেশনায়ক – ২৩
২৪. দেশনায়ক – ২৪
২৫. দেশনায়ক – ২৫
২৬. দেশনায়ক – ২৬
২৭. দেশনায়ক – ২৭
২৮. দেশনায়ক – ২৮
২৯. দেশনায়ক – ২৯
৩০. দেশনায়ক – ৩০
৩১. দেশনায়ক – ৩১
৩২. দেশনায়ক – ৩২
৩৩. দেশনায়ক – ৩৩
৩৪. দেশনায়ক – ৩৪
৩৫. দেশনায়ক – ৩৫
৩৬. দেশনায়ক – ৩৬
৩৭. দেশনায়ক – ৩৭
৩৮. দেশনায়ক – ৩৮
৩৯. দেশনায়ক – ৩৯
৪০. দেশনায়ক – ৪০
৪১. দেশনায়ক – ৪১
৪২. দেশনায়ক – ৪২
৪৩. দেশনায়ক – ৪৩
৪৪. দেশনায়ক – ৪৪
৪৫. দেশনায়ক – ৪৫
৪৬. দেশনায়ক – ৪৬
৪৭. দেশনায়ক – ৪৭
৪৮. দেশনায়ক – ৪৮
৪৯. দেশনায়ক – ৪৯
৫০. দেশনায়ক – ৫০

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন