প্রেসিডেন্সি কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন ই, এফ, ওটেন (E. E. Oaten)। ওটেন পাশ্চাত্য সভ্যতা ও শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাস করতেন। ১৯১৫ সালে ইডেন হিন্দু হোস্টেলে এক বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন যে, গ্রীকরা যেমন এক সময় যেসব অসভ্যজাতি তাদের সংস্পর্শে এসেছিল তাদের সভ্য করে তুলেছিল, তেমনি ভারতবর্ষে ইংরাজদের লক্ষ্য হল ভারতীয়দের সভ্য করে তোলা। স্বভাবতই তাঁর এই বক্তব্য ছাত্রদের মধ্যে অসন্তোষের সৃষ্টি করেছিল যদিও তখনি কোনও গোলমাল তারা করেনি। এরপরের ঘটনা ঘটল ১০ জানুয়ারি ১৯১৬। ওইদিন ওটেন তাঁর ঘরের সামনের বারান্দায় কলেজের কয়েকজন ছাত্রকে গোলমাল করার অভিযোগে অপমান করেন এবং কিছু বাদানুবাদের পর তিনি তাদের কয়েকজনকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছনাও করেন। বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা কলেজের অধ্যক্ষ এইচ. আর. জেমস (H. R. James)-এর কাছে প্রতিবাদ করে কোনও ফল না হওয়ায় কলেজে ছাত্র ধর্মঘট হয়। শেষপর্যন্ত দু’দিন ধর্মঘট চলার পর ওটেন ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন ও ওই অপ্রীতিকর পরিস্থিতির তখনকার মতো অবসান হয়। এর জের কিন্তু মেটেনি। ওটেনের বিরুদ্ধে ছাত্র বিক্ষোভ ও উত্তেজনা বাড়তেই থাকে। ছাত্র ধর্মঘটের নেতা ছিলেন সুভাষচন্দ্র। ঘটনার ফলে তিনি ‘লেখাপড়ায় ভাল কিন্তু গণ্ডগোল পাকানো ছেলে’ বলে কলেজে কর্তৃপক্ষের বিরূপ নজরে পড়েন। প্রেসিডেন্সি কলেজে ওইরকম ছাত্র ধর্মঘট ও বিক্ষোভ অকল্পনীয় ছিল। ছাত্রদের ভয় দেখিয়ে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেও যে কিছু ফল হল না তার মূলে ছিলেন সুভাষ।
এরপরে বিস্ফোরণ ঘটল ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯১৬। আবার সেই ওটেন কলেজের কয়েকজন ছাত্রকে নিগ্রহ করে বসলেন। এই খবর ছড়িয়ে পড়ার পর উত্তেজিত ছাত্ররা স্থির করল যে, আর কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবাদ, আবেদন-নিবেদন করে কোনও লাভ হবে না। নিজেদেরই যা করার তাই করতে হবে। ওটেনকে শিক্ষা দিতে হবে। ছাত্ররা ওটেনকে ধরে শারীরিক নিগ্রহ করল। এই সংবাদ সারা কলকাতায় দারুণ উত্তেজনা সৃষ্টি করল। সরকারি আদেশে কলেজ বন্ধ করে দেওয়া হল। একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হল প্রেসিডেন্সি কলেজে কেন এরকম ঘটনা ঘটছে তার কারণ খুঁজে বার করতে। তাঁর সঙ্গে কোনও আলোচনা না করেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রতিবাদে অধ্যক্ষ পদত্যাগ করলেন। কিন্তু পদত্যাগ করার পূর্বেই তিনি দোষী ছাত্রদের ডেকে পাঠালেন। সুভাষচন্দ্রকে লক্ষ্য করে বললেন, “বোস, তুমিই হচ্ছ কলেজের সব নষ্টের গোড়া। আমি তোমাকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করে দিলাম।” সুভাষচন্দ্র শুধু ‘ধন্যবাদ’ বলে বেরিয়ে এসে বাড়ি চলে গেলেন।
তদন্ত কমিটিতে তিনজন ইংরাজ ছাড়া দু’জন ভারতীয় সদস্য ছিলেন—আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ও হেরম্বচন্দ্র মৈত্র। কমিটির সামনে ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন সুভাষচন্দ্র ও আরও কয়েকজন ছাত্র। ওটেন নিজে কোনও অভিযুক্ত ছাত্রকে চিনতে পারেননি। কলেজের একজন বেয়ারা শুধু সুভাষ ও অনঙ্গ দাম বলে দু’জন ছাত্রকে ঘটনার পরেই দৌড়ে পালাতে দেখেছে বলে সাক্ষ্য দেয়। সুভাষের কলেজ থেকে বহিষ্কারের যে আদেশ ইতিমধ্যেই অধ্যক্ষ দিয়েছিলেন সরকার তা অনুমোদন করে। তিনি অন্য কোনও কলেজে পড়ার জন্যে আবেদন করলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তা নাকচ করে। কার্যত সুভাষচন্দ্র ‘রাস্টিকেটেড’ হলেন অর্থাৎ কোথাও পড়াশোনা করার সুযোগ আর তাঁর রইল না।
তদন্ত কমিটি সুভাষচন্দ্রকে প্রশ্ন করেন, তিনি ওটেনকে আক্রমণ করা সমর্থন করেন কি না। তিনি বলেন, এ আক্রমণ সমর্থন করা যায় না। কিন্তু ছাত্রদেরও উত্তেজিত হবার যথেষ্ট কারণ ছিল। এই প্রসঙ্গে তিনি কলেজে ইংরাজ কর্তৃপক্ষের ‘কুকীর্তির’ বহু ঘটনার উল্লেখ করেন। অনেকেরই মনে হয়েছিল ওইসব প্রসঙ্গে না গিয়ে সুভাষ যদি ওটেনকে মারার নিন্দা করতেন তাহলে তাঁর শাস্তি হত না। তাঁর পড়াশোনা বন্ধ হত না। কমিটির রিপোর্টে ছাত্রদের পক্ষে কোনও কথাই লেখা হল না। অপরাধী ছাত্রদের মধ্যে একমাত্র সুভাষের নামেরই উল্লেখ করা হল।
ওটেনকে নিগ্রহ করার ঘটনায় সুভাষচন্দ্র যে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু কলেজ থেকে বহিষ্কারের আদেশ ও পড়াশোনার পথ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তাঁর মনে ঠিক কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল সে নিয়ে কিছুটা সংশয় আছে। লিওনার্ড গর্ডন এই সম্পর্কে লিখেছেন যে, সুভাষচন্দ্র তাঁকে যে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল তার থেকে যাতে অব্যাহতি পাওয়া যায়, পড়াশোনায় ছেদ না পড়ে তার জন্যে খুব চিন্তিত ছিলেন। তাঁর পারিবারিক প্রভাব এর জন্যে খাটবার চেষ্টাও করা হয়েছিল। তাতে কাজ হয়নি। কিন্তু পরবর্তীকালে তাঁর আত্মজীবনীতে সুভাষচন্দ্র এ ঘটনাটি সম্বন্ধে তাঁর মানসিক প্রতিক্রিয়া অনেক বেশি “বীরত্বব্যঞ্জক” ভাবে উল্লেখ করেছেন (“Put them in a more heroic light”)। সুভাষচন্দ্রের আত্মজীবনীর এক বড় বৈশিষ্ট্য হল তাঁর আন্তরিকতা, সততা ও আত্মসমীক্ষা। পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে সুভাষচন্দ্রের আত্মজীবনী গান্ধীজির “My Experiment with Truth”-এর তুল্যমূল্য। সুতরাং ঘটনাটি সম্পর্কে তাঁর নিজের চিঠিপত্র ও অন্যান্য তথ্য একটু খুঁটিয়ে পড়া ও বোঝা প্রয়োজন।
সুভাষচন্দ্র যে আশা করছিলেন তদন্ত কমিটির রিপোর্টে তাঁর শাস্তি প্রত্যাহারের সুপারিশ থাকবে এ কথা তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে খোলাখুলি লিখেছেন। তিনি লিখেছেন, “অনুকূল কিছু ঘটতে পারে, নৈরাশ্যের মধ্যেও এরূপ একটা আশা নিয়ে আরও কিছুদিন কলকাতায় থেকে গেলাম।” সুতরাং তিনি যে উদ্বেগ ও আশঙ্কার মধ্যে ছিলেন এ কথা স্পষ্টই স্বীকার করেছেন তাঁর আত্মজীবনীতে। এর মধ্যে ‘বীরত্বব্যঞ্জক’ কিছুই নেই। ঘটনার পাঁচ বছর পরে শরৎচন্দ্র বসুকে লেখা এক চিঠিতেও (২৩ এপ্রিল, ১৯২১) তিনি লেখেন, “ওটেনকে মারার ব্যাপারে যখন আমার কাছে কৈফিয়ৎ চাওয়া হয়েছিল, আমি সেই ব্যাপার সম্পর্কে আমার যোগাযোগের কথা অস্বীকার করছিলাম। আমি তখন ঐ মোহে আচ্ছন্ন ছিলাম।” ওই “মোহ” বলতে সুভাষ ব্যক্তিগত স্বার্থরক্ষার জন্যে অনৈতিক আপসের কথা বলেছিলেন। ওই চিঠি লেখার সময়ে তিনি আই সি এস থেকে সবে পদত্যাগ করেছেন। কেউ কেউ পরামর্শ দিয়েছিলেন অন্তত একবার আই সি এস-এ যোগ দিয়ে পরে ছেড়ে দিলেও হবে। এতে অনেক সুবিধা হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি লেখেন, “আমার বিশ্বাস জন্মেছে যে আপোষ ব্যাপারটি মন্দ, এর ফলে মানুষের অধঃপতন হয় এবং তার উদ্দেশ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ⋯ আপোষহীন আদর্শের দ্বারাই কেবল একটি জাতি গঠন সম্ভব।”
হঠাৎ নিজের লেখাপড়ার পথ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গিয়ে ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা যে কোনও মেধাবী ও অত্যন্ত উজ্জ্বল প্রতিশ্রুতিবান যুবককে বিচলিত করবে এটাই স্বাভাবিক। সুভাষচন্দ্র তখনও পর্যন্ত রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হননি, যদিও স্বদেশপ্রেম ও স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন তাঁর মনকে উদ্দীপ্ত ও অধীর করে তুলেছে। কিন্তু পরীক্ষায় ভাল ফল করবেন, জনকল্যাণ, সমাজসেবা ও আধ্যাত্মিক উন্নয়নকে জীবনের ব্রত বলে গ্রহণ করবেন, এই তাঁর তখনকার লক্ষ্য। ঘটনার কয়েকদিন পরে সহপাঠী হেমন্তকুমার সরকারকে লেখা চিঠিতে (২৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯১৬) তিনি আশা প্রকাশ করেছেন যে ‘ভাল ছেলে বলে সুখ্যাতি’, উচ্চমহলে তাঁর পরিচিতি, ‘আশুবাবু’ তাঁর কথা জানেন, তাঁর বিরুদ্ধে চাপরাশীর সাক্ষ্য “বড় weak” ইত্যাদি কারণে তাঁর নির্দোষী বলে খালাস হবার সম্ভাবনা খুব বেশি। অন্তত transfer পাবেন বলে তাঁর খুব বিশ্বাস। এই মানসিক প্রতিক্রিয়া ছিল খুবই স্বাভাবিক।
তদন্ত কমিটির রিপোর্টে তাঁর সব আশাভঙ্গ হল। তাঁর ভাগ্য নির্ণয় হয়ে গেল। বাড়িতে বাবা-মা, বড় ভায়েরা কিন্তু এই ঘটনার পর সুভাষচন্দ্রকে কোনও তিরস্কার করেননি। তবে কলকাতার রাজনৈতিক পরিবেশ ক্রমেই ‘খারাপ’ হয়ে পড়তে থাকায় তাঁরা সুভাষচন্দ্রকে কলকাতার বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া ভাল হবে বলে মনে করেন। ঠিক হয় যে, তাঁকে কটকের মতো অপেক্ষাকৃত শান্ত ও নিরাপদস্থানে পাঠিয়ে দেওয়াই ভাল। ট্রেনে রাত্রে বাঙ্কের ওপর শুয়ে গত ক’মাসের ঘটনার কথা ভেবে সুভাষচন্দ্রের যা মনে হয়েছিল তা তিনি লিখেছিলেন তাঁর ‘আত্মজীবনী’তে। তিনি লেখেন, “আমার ছাত্রজীবন শেষ হয়ে গিয়েছে এবং আমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার ও অনিশ্চিত। কিন্তু আমি দুঃখিত হইনি—যা করেছি তার জন্য আমার মনে বিন্দুমাত্র অনুতাপ ছিল না, বরং আমি যে ঠিক কাজ করেছি, আমাদের সম্মান ও আত্মমর্যাদার জন্য লড়েছি এবং মহৎ এক উদ্দেশ্যে নিজেকে উৎসর্গ করেছি, এ জন্য আমার মধ্যে এক পরম তৃপ্তি ও আনন্দবোধ ছিল। নিজেকে বোঝালাম ত্যাগ বিনা জীবনের মূল্য কি, এবং ঘুমিয়ে পড়লাম।” ‘নিজেকে বোঝালাম’ কথাটির মধ্যেই সুভাষের মানসিক অর্ন্তদ্বন্দ্ব ফুটে উঠেছে।
এ ঘটনা তাঁর জীবনে যে কী বিরাট সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন আকস্মিকভাবে এনেছিল তা সুভাষচন্দ্র তখন উপলব্ধি করতে অক্ষম ছিলেন। দু’দশক পরে সুদূর অস্ট্রিয়ার স্বাস্থ্যনিবাসে থাকাকালে প্রেসিডেন্সি কলেজের ঐ ঘটনার মানসিক আঘাত ও তার প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে তিনি লেখেন, “১৯১৬ সালের ঘটনাগুলোর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য তখন আমি সামান্যই বুঝতে পেরেছিলাম। আমার অধ্যক্ষ আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন বটে, কিন্তু তিনি আমার ভবিষ্যৎ জীবনের গতি ঠিক করে দিয়েছিলেন। আমি আমার নিজের সামনে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলাম, ভবিষ্যতে যা থেকে সরে আসা আমার পক্ষে আর সহজ হবে না। এক সঙ্কটের মধ্যে সাহস ঐ স্থৈর্য নিয়ে দাঁড়িয়েছি এবং আমার কর্তব্য পালন করেছি। আমার মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও সেই সঙ্গে উদ্যমশীলতা গড়ে উঠেছিল, যা ভবিষ্যতে আমার খুব কাজে লাগবে। অত্যন্ত সীমাবদ্ধ ক্ষেত্র হলেও নেতৃত্বের ও তার আনুষঙ্গিক আত্মত্যাগের স্বাদ আমি পেয়েছিলাম। এক কথায়, আমার চরিত্র তৈরি হয়ে গিয়েছিল এবং প্রশান্ত চিত্তে ভবিষ্যতের সম্মুখীন হতে সমর্থ হয়েছিলাম।” সুভাষচন্দ্র যে ভেবেচিন্তে কাজটি করেছিলেন, ঠাণ্ডা মাথায় অধ্যক্ষের মুখে কলেজ থেকে তাঁর বহিষ্কারের আদেশ শুনে শুধু ‘ধন্যবাদ’ বলে ঘর ছেড়ে চলে এসেছিলেন তা নয়। তিনি যে নিজেকে একজন বড় সাহসী নেতা বলে জাহির করতে ওই কাজ করেছিলেন তাও নয়। সব কিছুই ঘটে গিয়েছিল আকস্মিকভাবে সাময়িক উত্তেজনার ফলে। কিন্তু এর মূলে ছিল তাঁর বিদ্রোহী মানসিকতা, ইংরাজ তথা ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান তীব্র ক্ষোভ। শ্বেতাঙ্গদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের অভিজ্ঞতা তাঁকে ক্রমেই আরও উত্তেজিত করে তুলছিল। ওটেনের আচরণ ও পরবর্তী নাটকীয় ঘটনা ঘৃতাহুতির কাজ করেছিল। সুভাষ ‘বীর নায়ক’ হওয়ার কথা চিন্তাও করেননি। কিন্তু ঘটনাচক্রে তাই হল। রাতারাতি তিনি ‘হিরো’ হয়ে উঠলেন। শুধু ছাত্রদের চোখেই নয়, সকলের কাছে। যাঁরা দেশের পরাধীনতার মুক্তির স্বপ্ন দেখছিলেন, তাঁদের মানসপটে এক নতুন নেতার আবিভাব ঘটল। সুভাষচন্দ্র বসুর কিংবদন্তি হয়ে ওঠা শুরু হল তখন থেকেই। ওই ওটেনই স্বদেশে ফেরার পর শেষ জীবনে বহু বছর আগের ঘটনাটি স্মরণ করে সুভাষের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করে একটি কবিতা লিখেছিলেন।
প্রেসিডেসি কলেজে শ্বেতাঙ্গ অধ্যাপক ও ছাত্রদের মধ্যে বিরোধ ও ওই সম্পর্কিত চাঞ্চল্যকর ঘটনা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের ‘মডার্ন রিভিউ’ পত্রিকায় (এপ্রিল, ১৯১৬) বিদেশী শিক্ষক ও ভারতীয় ছাত্রদের পারস্পরিক সম্পর্ক সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধে তাঁর নিজের প্রতিক্রিয়ার কথা ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ভারতীয় ছাত্রদের প্রয়োজন সহানুভূতি ও অনুপ্রেরণা। সামান্যতম অবমাননা তাদের অত্যন্ত আঘাত করে। বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন সংস্কৃতির আদান-প্রদানের মিলনভূমি হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু ব্রিটিশদের বর্তমান মনোভাবে তা সম্ভব হবে না। তারা বাঙালিদের সম্পর্কে যে ধারণা গড়ে তুলেছে তার মূলে আছে ভয় ও ঘৃণা। তাঁর নিজের শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতার উল্লেখ করে তিনি বলেন যে, অবাধ-মুক্ত মনের মেলামেশার মধ্য দিয়েই মানুষে-মানুষে স্থায়ী সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে। স্পষ্টতই, রবীন্দ্রনাথ ছাত্রদের মনের কথা বুঝতে পেরেছিলেন। তাদের প্রতি তাঁর সহানুভূতি ছিল। অবশ্যই তিনি শিক্ষক-নিগ্রহ সমর্থন করেননি। সুভাষের প্রতি কবির এই সস্নেহ সহানুভূতির মনোভাব আজীবন ছিল।
কটকে সুভাষচন্দ্র প্রায় এক বছর ছিলেন। ওই সময়টি তিনি কাটিয়ে ছিলেন সমাজসেবা ও জনকল্যাণমূলক কাজে। নিজের জীবন বিপন্ন করে তিনি কলেরা রোগীর সেবা করেছিলেন, মৃতদেহ সৎকারের জন্যে স্বেচ্ছাসেবকদের দল গড়েছিলেন। বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও ধর্মীয়স্থানে প্রায়ই ঘুরে বেড়াতেন। এইসব অভিজ্ঞতা তাঁকে আরও পরিণত করে তুলেছিল। তাঁর মধ্যে আত্মবিশ্লেষণের মনোভাব গড়ে ওঠে। নিজের মনের গোপনে যেসব কুপ্রবৃত্তি আছে তা কী করে জয় করতে হয় তা তিনি জেনেছিলেন। এইভাবে এক বছর কটকে কাটাবার পর তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আবেদন করে পড়াশোনা আবার শুরু করা যায় কি না তার চেষ্টা করতে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন