তীর্থভ্রমণ, গুরুর সন্ধান ও ভারত পরিভ্রমণের শারীরিক ক্লেশ এবং অনিয়ম সুভাষচন্দ্রের স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর হয়েছিল। গৃহে প্রত্যাবর্তনের পরই তিনি কঠিন টাইফয়েডে আক্রান্ত হন। এমনিতেই তাঁর লেখাপড়ায় মন ছিল না। পরীক্ষায় সবোচ্চ স্থান অধিকার করার জন্যে যে একাগ্রতা ও মানসিকতা প্রয়োজন তা তাঁর ছিল না। বরং ওই বিষয়ে তাঁর এক অনীহা, এমনকি বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি হয়েছিল। এর ফলে পরের বছর ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় তাঁর ফল ভাল হয়নি। অবশ্যই তিনি প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর মতো অসাধারণ মেধাবী ছাত্রের কাছে তা ছিল অতি সহজ। স্বভাবতই সকলেই সুভাষের পরীক্ষার ফলাফলে হতাশ হয়েছিলেন। তিনি নিজেও সাময়িকভাবে অনুশোচনা করেন। মনস্থির করেন যে ‘দর্শন’ (Philosophy)-এ অনার্স নিয়ে বি. এ. পড়বেন ও ভাল ফল করবেন।
দর্শনে অনার্স নিয়ে পড়ার সিদ্ধান্তের মূল কারণ সুভাষচন্দ্রের গভীর কৌতূহলী মন। স্কুলের জীবন থেকেই তিনি চাইতেন জীবন ও জগৎ সম্পর্কে মৌলিক প্রশ্নগুলির উত্তর সন্ধান করতে। তাঁর বাল্যকালের এই বৈশিষ্ট্যটি পূর্বেই প্রকাশ হয়েছিল। পাশ্চাত্য দার্শনিক চিন্তা তাঁকে ক্রমেই আকৃষ্ট করছিল। পাশ্চাত্য দর্শনের শুরু সংশয় নিয়ে। সবকিছুকে বিচার করে তবেই গ্রহণ করতে হবে। পূর্বের কোনও বদ্ধমূল ধারণা, তা যতই পুরনো হোক না কেন, তাকে যুক্তি দিয়ে যাচাই করে নিতে হবে। এই প্রবণতার ফলে সুভাষচন্দ্র নিজের জীবনেও একদিন যা কিছু গ্রহণ করেছেন, সেই নিয়েও প্রশ্ন করতে শুরু করেন। এমনকি, যে বেদান্তকে অবলম্বন করে নিজেকে গড়ার সঙ্কল্প করেছিলেন তাও তিনি সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করেন। দিলীপকুমার রায়ের সঙ্গে প্রথম পরিচয়েই তিনি তাঁকে বলেন, “আমাদের মধ্যে তর্কবিতর্কের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। কারণ এ দেশে বড় বড় বক্তা, বাক্-যোদ্ধার বিশেষ প্রয়োজন আছে।” এই নিয়ে কথাবার্তার মধ্যে শ্রীরামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের প্রসঙ্গ ওঠে।
সুভাষচন্দ্র ‘তর্কযুদ্ধ’ ও ‘তর্কসভা’র ওপর এত জোর দেওয়ায় বিস্মিত হয়ে দিলীপকুমার বলেন, “কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণ কি বলেননি যে, তর্ক দিয়ে কখনো সত্যের সন্ধান পাওয়া যায় না?” বোঝাই যায়, সুভাষচন্দ্র যে শ্রীরামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ অনুরাগী তা দিলীপকুমার জানতেন। এর উত্তরে সুভাষ কিছুটা অসহিষ্ণু হয়ে বলেন, “তিনি কি বলেছিলেন, তাতে আমার দরকার কি?⋯ আমরা চিরকাল সেই অতীতকে আঁকড়ে থাকব না, থাকতে পারি না। আমাদের হিন্দুসভ্যতা ও সংস্কৃতির সবচেয়ে ক্ষতি করেছে tradition, সংস্কার। আমাদের গড়ে তুলতে হবে ভবিষ্যৎকে।” দিলীপকুমার নিজে শ্রীরামকৃষ্ণকে গভীর শ্রদ্ধা করতেন। সুভাষকেও শ্রীরামকৃষ্ণের অনুরাগী ও ভাবানুসারী বলে জানতেন। তাই, সুভাষের ওই কথায় কিছুটা বিস্মিত ও আহত বোধ করেন। তা অনুমান করে সুভাষচন্দ্র বলেন যে, তিনি শ্রীরামকৃষ্ণকে অশ্রদ্ধা করছেন না, তবে রামকৃষ্ণ-শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দকে তাঁর বেশি ভাল লাগে। এদিকে দিলীপকুমার আবার তেমন বিবেকানন্দভক্ত ছিলেন না। তিনি খোলাখুলি বলেই ফেলেন, “কিন্তু আমার লাগে না। বিবেকানন্দ তাঁর গুরুর কাছাকাছি স্তরে পৌঁছেছেন এ কথা আমি বিশ্বাস করি না। তাছাড়া, এ কথা তো বিবেকানন্দ নিজেই কতবার স্বীকার করেছেন।” সুভাষ উত্তর দেন, “সেইখানেই তো তাঁর মহত্ত্ব⋯আজ বিশ্বময় শ্রীরামকৃষ্ণকে বিখ্যাত করেছেন তো বিবেকানন্দই।” উত্তেজিত হয়ে দিলীপকুমার বলে বসেন, “কিন্তু ঈশ্বরপ্রেমী বাজারদরের পরোয়া করে না—তার দরকারও নেই।” সুভাষচন্দ্র ওই বিষয় নিয়ে আর কথা বাড়াতে চাননি। তিনি বলেন, “ও আলোচনা এখন থাক।”
দিলীপকুমার রায় সুভাষচন্দ্রের স্মৃতিচারণ করেছিলেন বহু বছর পরে। আর, এই আলোচনা দু’জনের মধ্যে হয়েছিল একেবারে প্রথম সাক্ষাৎকারে। তখন সবে দু’জনে প্রেসিডেন্সি কলেজে ঢুকেছেন। সুতরাং স্মৃতিভ্রম হওয়া খুবই স্বাভাবিক। তাছাড়া, ঠিক কোন কথার উত্তরে ও পরিস্থিতিতে কী কথা কে বলেছিলেন তা সঠিক মনে রেখে বলাও দুরূহ। দিলীপকুমার নানান কারণে বিশেষ বিবেকানন্দ অনুরাগী ছিলেন না। তিনি নিজেই সে কথা স্বীকার করেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণের উক্তিও তিনি যেভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন তাও ঠিক নয়। শ্রীরামকৃষ্ণ আধুনিক অর্থে যুক্তিবাদী ছিলেন না এটা ঠিকই। কিন্তু যেভাবে তিনি শ্রীরামকৃষ্ণ প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছিলেন সেটা সঠিক এবং প্রাসঙ্গিক হয়নি। কিন্তু একটি কথা বোঝা যায়। সুভাষচন্দ্র তখনও পর্যন্ত তাঁর কোনও বিশ্বাসেরই শিকড় ঠিকমতো খুঁজে পাননি। সংশয় ও নিরন্তর প্রশ্নের পরই চূড়ান্ত বিশ্বাস ও সিদ্ধান্তে পৌঁছবার পর সঙ্কল্পে এবং লক্ষ্যে তিনি ছিলেন অবিচল। পরবর্তীকালে তাঁর জীবনের এটি ছিল এক বৈশিষ্ট্য।
আই সি এস থেকে পদত্যাগ, স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগদান ও দেশবন্ধুর প্রতি আনুগত্য, গান্ধীজির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা সত্ত্বেও মৌলিক প্রশ্নে মতপার্থক্য, ফরওয়ার্ড ব্লক দল গঠন, দেশত্যাগ করে বহির্ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মরণপণ সংগ্রাম—সব কিছুর মধ্যেই প্রতিফলিত হয়েছিল তাঁর আদর্শ ও বিশ্বাসের গভীরতা এবং আত্ম-প্রত্যয়। শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ সম্পর্কেও তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি তেমনি যৌবনের প্রাথমিক দোদুল্যমান মনোভাবের পর স্থির নিশ্চয়তায় পৌঁছেছিল। তিরিশের দশকে যখন সুভাষচন্দ্র ভারতবর্ষের রাজনৈতিক মঞ্চে নিজেকে এক অসীম সম্ভাবনাময়, অগ্নিগর্ভ, নির্ভীক ও আদর্শনিষ্ঠ তরুণ জননেতারূপে প্রতিষ্ঠিত করে তুলছেন সেই সময় বিভিন্ন জনসভায় ও চিঠিপত্রে তিনি বারবার স্বামী বিবেকানন্দের কথা বলেছেন। কলকাতায় মহাজাতি সদনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের অনুষ্ঠানে (১৯ আগস্ট, ১৯৩৯) তাঁর ভাষণে সুভাষচন্দ্র প্রাদেশিকতা, এমনকি জাতীয়তার গণ্ডি অতিক্রম করে যে মহাজাতি ভারতের মাটিতে জন্মগ্রহণ করেছিল, বিশ্বমানবের জন্যে বাণী উচ্চারিত হয়েছিল, তার উৎসমূল প্রসঙ্গে রামমোহন ও শ্রীরামকৃষ্ণের বাণীর কথা স্মরণ করেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণকে বাদ দিয়ে যে স্বামী বিবেকানন্দকে জানা বা বোঝা যায় না তা তিনি স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছিলেন। ১৯৩৬ সালের ৬ মার্চ ‘উদ্বোধন’-এর সম্পাদককে একটি চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, “শ্রীরামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দের নিকট আমি কত যে ঋণী, তাহা ভাষায় কি করিয়া প্রকাশ করিব? তাঁহাদের পুণ্যভাবে আমার জীবনের প্রথম উন্মেষ। নিবেদিতার মতো আমিও মনে করি যে, রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ একটা অখণ্ড ব্যক্তিত্বের দুই রূপ। আজ যদি স্বামীজী জীবিত থাকিতেন তিনি নিশ্চয়ই আমার গুরু হইতেন—অর্থাৎ তাঁকে নিশ্চয়ই আমি গুরুপদে বরণ করিতাম। যাহা হউক, যতদিন জীবিত থাকিব ততদিন রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের অনুগত ও অনুরক্ত থাকিব, এ কথা বলা বাহুল্য।”
সুভাষচন্দ্র বসু যখন ‘নেতাজি’র ভূমিকায় ভারতবর্ষের মুক্তি সংগ্রামের শেষ পর্যায়ে এক ঐতিহাসিক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় সংযোজন করেছিলেন তখনও যে তাঁর পিছনে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের ভাবধারা ও অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়ক, আজাদ হিন্দ সরকারের রাষ্ট্রপতি নেতাজি সুভাষ সিঙ্গাপুরের রামকৃষ্ণ মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী ভাস্বরানন্দের কাছে মা-কালীর পায়ের কাছে বসা শ্রীরামকৃষ্ণের ছবিটি চেয়েছিলেন। স্বামীজি চেয়েছিলেন কিছু যুবক যারা দেশের জন্যে সব কিছু উৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাকবে, যারা কখনও মুহূর্তের জন্যেও বিস্মৃত হবে না যে তারা ‘জন্ম হতেই মায়ের জন্য বলিপ্রদত্ত’। স্বামীজির ওই আহ্বানে কতজন যুবক মনপ্রাণ দিয়ে সাড়া দিয়েছিল তার সঠিক হিসাব পাওয়া সম্ভব হবে না। তবে তাদের মধ্যে এক উজ্জ্বল চিরযুবা ত্যাগদৃপ্ত বলদৃপ্ত পুরুষ ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তাঁকে, অর্থাৎ মাতৃভূমির জন্যে, রক্ত দিলে তিনি তাঁদের স্বাধীনতা দেবেন। কথা ও কাজে মিল ঘটেছিল তাঁর নিজের জীবনে। বিবেকানন্দ তাঁর ভক্ত ও শিষ্যদের বলেছিলেন যে, ‘আমি চাই তোরা খাটতে খাটতে মরে যা।’ স্বামীজি তাদের আরও বলেছিলেন, ‘মৃত্যুকে ভালবাসতে।’ স্বামীজির যখন মৃত্যু হয় সুভাষচন্দ্রের তখন পাঁচ বছর বয়স, স্বামীজিকে দেখার, তাঁর দীক্ষিত শিষ্য হবার কোনও সুযোগই তাঁর হয়নি। কিন্তু সর্বার্থে তিনি বিবেকানন্দের সার্থক ভাব-শিষ্য ছিলেন।
প্রেসিডেন্সি কলেজে বেশ মন দিয়ে পড়াশোনা শুরু করেছিলেন সুভাষচন্দ্র। কিন্তু ১৯১৬ সালের গোড়ায় তাঁর জীবনে এক আকস্মিক ঝড় এসে সবকিছু পরিবর্তন করে দিল। জীবন এক নতুন মোড় নিল। কলেজের ইংরাজ অধ্যাপক ই. এফ. ওটেনের বর্ণবিদ্বেষী ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে কলেজের সহপাঠীদের প্রতিবাদের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সুভাষচন্দ্র হঠাৎই প্রচারের পাদপীঠে এসে দাঁড়ালেন। এই ঘটনা বর্ণনা করার পূর্বে বর্ণবৈষম্য ও ভারতে শ্বেতাঙ্গদের ঔদ্ধত্য সম্পর্কে সুভাষচন্দ্রের মনোভাবের কিছু পরিচয় দেওয়া প্রয়োজন।
উনিশ শতকে বাংলা তথা ভারতবর্ষে জাতীয়তাবোধের উন্মেষ, ব্রিটিশ শাসন বিরোধী মনোভাব এবং আন্দোলনের সূচনার পিছনে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণগুলি সম্বন্ধে অনেক গবেষণা হয়েছে। পাশ্চাত্য শিক্ষার ও পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক চিন্তাধারার প্রভাব সম্পর্কেও বহু আলোচনা হয়েছে। ফলে, এই কারণগুলির গুরুত্ব সম্বন্ধে সকলের মোটামুটি ভালই ধারণা আছে। কিন্তু বর্ণ ও জাতি বৈষম্য, ভারতে বসবাসকারী ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গদের এদেশের মানুষের প্রতি ঔদ্ধত্যপূর্ণ দুর্ব্যবহার এবং আইন আদালতে তার কোনও প্রতিকারের ব্যবস্থা না থাকায় সর্বশ্রেণীর মানুষের মনে কী রকম ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছিল সে বিষয়ে আমাদের জ্ঞান কম। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান হতাশা ও বিক্ষোভের মূলে এর অবদান ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। রাজা রামমোহন রায়ের উদ্যোগে ১৮২৬ সালে বৈষম্যমূলক ‘জুরি আইন’ বিরোধী প্রতিবাদ থেকে শুরু করে ১৮৮৩ সালের ইলবার্ট বিল বিরোধী আন্দোলন পর্যন্ত যে কটি রাজনৈতিক আন্দোলন হয়েছিল তার সবকটির মূলে ছিল বর্ণবৈষম্য এবং আইনের দৃষ্টিতে সমতা নীতির অভাব। ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহ ও অল্পকাল পরেই নীল বিদ্রোহের পিছনেও বর্ণবৈষম্য ও শ্বেতাঙ্গদের ঔদ্ধত্য ও অত্যাচার এক বড় কারণ ছিল। রাজা রামমোহন রায়, রাধাকান্ত দেব, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তি থেকে দেশের সাধারণ মানুষ পর্যন্ত কেউই এর থেকে অব্যাহতি পাননি। হিন্দু ও মুসলমান উভয় ধর্মের মানুষই এর ফলে ব্রিটিশ শাসনের কল্যাণকর রূপ ও সুফল সম্বন্ধে ক্রমেই মোহমুক্ত হতে থাকেন। ১৮৮৫ সালে জাতীয় কংগ্রেসের জন্ম ও কংগ্রেসের নেতৃত্বে রাজনৈতিক আন্দোলন ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠলেও বর্ণবৈষম্য ও ঔদ্ধত্যের অবসান হয়নি। জীবনের সর্বক্ষেত্রে এই তিক্ত অভিজ্ঞতা রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন শিক্ষিত ভারতীয় যুবকদের আরও অসহিষ্ণু করে তোলে। সুভাষচন্দ্রের মনোভাবও একই রকম ছিল। প্রথমে রাজনৈতিক আন্দোলন ও সন্ত্রাসবাদী বৈপ্লবিক কার্যকলাপের প্রতি তাঁর তেমন কোনও আকর্ষণ না থাকলেও অল্পদিনের মধ্যেই তিনি ব্রিটিশ শাসন-বিরোধী রাজনৈতিক আবর্তের মধ্যে জড়িয়ে পড়েন।
সুভাষচন্দ্র বলেছেন যে, কলকাতায় ব্রিটিশদের ব্যবহার এবং প্রথম মহাযুদ্ধের সূচনা (১৯১৪) তাঁকে রাজনীতির দিক থেকে গড়ে উঠতে ও নিজের জন্যে একটি স্বাধীন কার্যনীতি উদ্ভাবন করতে বাধ্য করেছিল। কটকের স্কুল জীবনে তিনি বর্ণবৈষম্যের কিছু আঁচ পেলেও প্রত্যক্ষ কোনও অভিজ্ঞতা তাঁর হয়নি। কিন্তু কলকাতায় এসে তিনি অন্য এক অবস্থা দেখলেন। প্রতিদিন কলেজে যাতায়াতের সময় ট্রামে প্রায়ই অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটত। ইংরাজ যাত্রীরা ইচ্ছা করেই ভারতীয়দের সঙ্গে রূঢ় ও অপমানসূচক ব্যবহার করত। মাঝে মাঝেই তারা সামনের আসনের ভারতীয় যাত্রীদের দিকে এমনভাবে পা তুলে দিত যাতে তাদের গায়ে জুতোর ছোঁয়া লাগে। সুভাষচন্দ্রের কাছে এ ধরনের অসভ্যতা অসহনীয় ছিল। প্রায়ই তাঁর সঙ্গে শ্বেতাঙ্গ যাত্রীদের ঝগড়া বেধে যেত। রেলেতেও এরকম ঘটনা প্রায়ই ঘটত। উচ্চপদমর্যাদার ভারতীয়রাও অপমান থেকে রেহাই পেতেন না। ওইসব ঘটনার গল্প লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে যুবকদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করত। আদালতে অভিযোগ করে প্রায়ই সুরাহা হত না। ফলে ক্রমেই একটি বিশ্বাস জন্মাতে থাকে যে ইংরাজরা শক্তের ভক্ত। কথায় কোনও কাজ হবে না। সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন, “এই ব্যাপারটাই মনস্তত্ত্বের দিক থেকে সন্ত্রাসবাদমূলক বৈপ্লবিক আন্দোলনের ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল—অন্তত বাঙ্গলাদেশে।” কথাটা খুবই খাঁটি। সুভাষচন্দ্র নিজে বুঝেছিলেন যে, ভারতবর্ষকে পৃথিবীতে মাথা তুলে দাঁড়াতে হলে দৈহিক শক্তি ও সামরিক শক্তিতে বলীয়ান হতেই হবে। সামরিক শক্তি ছাড়া কোনও জাতির পক্ষে স্বাধীনতা অর্জন ও স্বাধীনতা রক্ষা করা সম্ভব নয়। প্রথম মহাযুদ্ধ তা প্রমাণ করেছে। সুভাষচন্দ্রের এই বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্তের মধ্যেই ভবিষ্যতের ‘নেতাজি’র জন্মের বীজ রোপিত হয়।
ছাত্রজীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতার ফলে সুভাষচন্দ্রের মনে ইংরাজ-বিদ্বেষ ও ঘৃণা এত তীব্র হয়েছিল যে ১৯১৯ সালে কেমব্রিজে পড়ার সময় তিনি এক চিঠিতে তাঁর ওই দেশে থাকার অনুভূতি প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, “সবচেয়ে বেশি আনন্দ পাই যখন দেখি শ্বেতকায় কোনও লোক আমার কাজ করছে, জুতো পরিষ্কার করে দিচ্ছে।” এত ঘৃণা কিন্তু সুভাষচন্দ্রের স্বভাব ও চরিত্র-বিরোধী ছিল। তারুণ্যের উচ্ছ্বাস ও উত্তেজনায় লেখায় এই মনোভাব সুভাষচন্দ্রের জীবনে ছিল না। মানুষকে তিনি ভালবাসতেন। আঘাত দিতে পারতেন না। কিন্তু কলেজ জীবনে ব্রিটিশ-বিরোধী মনোভাব, বর্ণবৈষম্য ও জাতি শ্রেষ্ঠত্বের দম্ভের বিরুদ্ধে তাঁর তীব্র ঘৃণার পটভূমিতে ‘ওটেন ঘটনা’র এক বিশেষ তাৎপর্য ছিল।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন