এই সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তথা বাংলাদেশে শিক্ষাজগতের সবচেয়ে খ্যাতনামা ও প্রভাবপ্রতিপত্তিশালী ব্যক্তি ছিলেন স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজের ঘটনা সম্পর্কে গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য ছিলেন বলে অনেকেই আশা করেছিলেন যে, সুভাষচন্দ্রের ওপর বহিষ্কারের আদেশ প্রত্যাহার করা হবে, সুভাষ অব্যাহতি পাবেন। তা কিন্তু হয়নি। ওই সময়ে ওটেনকে নিগ্রহ করার ঘটনা এমনই উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল যে, তা সহজে মেটানো সম্ভব ছিল না। সরকারের উচ্চতম মহলেও ঘটনাটি আলোড়ন ও উদ্বেগ সৃষ্টি করেছিল। সুভাষচন্দ্র ইতিপূর্বেই ছাত্র বিক্ষোভ ও ধর্মঘটের নেতা রূপে চিহ্নিত হয়েছিলেন। তাছাড়া তিনি কলেজের অধ্যক্ষের কাছে ও পরে তদন্ত কমিটির সামনেও কোনওরকম দুঃখপ্রকাশ পর্যন্ত করেননি। এই পরিস্থিতিতে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বা হেরম্বচন্দ্র মৈত্রের পক্ষে ছাত্রদের আচরণ উপেক্ষা বা লঘু করে দেখার সুপারিশ করা সম্ভব ছিল না। এই প্রসঙ্গে আর একটি ঘটনা জানা প্রয়োজন। এটি কৃষ্ণা বসু তাঁর ‘প্রসঙ্গ সুভাষচন্দ্র’ বইটিতে লিখেছেন। তিনি শুনেছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের স্ত্রী বাসন্তী দেবীর মুখে। সুভাষের সঙ্গে দেশবন্ধু ও তাঁর প্রথম সাক্ষাতের স্মৃতিচারণ করে বাসন্তী দেবী বলেন, “প্রথম তাকে কবে দেখি জানো? সে অনেক কাল আগের কথা। ওটেনকে যেদিন প্রেসিডেন্সি কলেজে মার দেওয়া হয় সেদিন। ওটেনকে প্রহার দিয়ে বাবুরা এসে হাজির। আমরা সব রাত্রে খাবার টেবিলে বসেছি, ‘বয়’টা এসে খবর দিল প্রেসিডেন্সি কলেজের কয়েকটি ছেলে দেখা করতে চায়। উনি (দেশবন্ধু) তো অমনি বললেন, ডেকে দাও এখানে। আমি বলি, কী কাণ্ড! আমরা যে খাচ্ছি, এখানে ডাকবে কি! উনি বললেন, তা কী আর হয়েছে। ছেলের দলের সঙ্গে সুভাষ এসে দাঁড়াল। সেই প্রথম দেখা। উনি মনোযোগ দিয়ে সমস্ত ঘটনা শুনলেন। তারপর বললেন, যাক যা হবার তো হয়ে গেছে। এখন দেখা যাক ব্যাপার কী দাঁড়ায়।” কিন্তু দেশবন্ধুও কিছু করতে পারেননি। বাসন্তী দেবীর স্মৃতিচারণের মধ্যে কিছু ভুল হয়েছিল কি না বলা শক্ত। কেননা, সুভাষচন্দ্র নিজে বলেছেন যে, দেশবন্ধুর সঙ্গে তাঁর প্রথম পরিচয় হয়েছিল ১৯২১ সালে। সুভাষচন্দ্র আই সি এস থেকে পদত্যাগ করে বিলেত থেকে কলকাতায় ফেরার পর। ওটেনের ঘটনা প্রসঙ্গে তাঁর কোনও লেখা বা চিঠিতে তিনি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের কাছে ঘটনার দিনই রাত্রে যাওয়ার কথা উল্লেখ করেননি। সম্ভবত ওই দিন রাত্রে প্রেসিডেন্সি কলেজের কিছু ছাত্র তাঁর কাছে গিয়েছিল। সুভাষ তাদের মধ্যে ছিলেন না। কিন্তু সুভাষের নাম এমনভাবে ঘটনাটির সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল, এবং বাসন্তী দেবী নিজে সুভাষকে পরে ওই নিয়ে এতবার জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, তিনি ধরেই নিয়েছিলেন সুভাষও ওই ছাত্রদের মধ্যে সেদিন রাত্রে ছিলেন। এইরকম ভ্রম হওয়া দীর্ঘকালের ব্যবধানে খুবই স্বাভাবিক। তবে দেশবন্ধু পারলে নিশ্চয় ছাত্রদের সাহায্য করতেন। কিন্তু তখনই কারওর পক্ষেই বিশেষ কিছু করা সম্ভব ছিল না।
আশুতোষ মুখোপাধ্যায় যে সুভাষচন্দ্রকে আবার কলেজে পড়ার সুযোগ করে দিতে আগ্রহী ছিলেন সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তিনি অত্যন্ত ছাত্রবৎসল ছিলেন। বিশেষ করে মেধাবী ছাত্রদের প্রতি তাঁর বিশেষ মমতা ছিল। বসু পরিবারের সঙ্গে তাঁর অবশ্যই ভাল পরিচয় ছিল। এর ফল হল; সুভাষচন্দ্র স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হলেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, যদি অন্য কোনও কলেজ তাঁকে ভর্তি করে নেয় তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আপত্তি নেই। সুভাষ সোজাসুজি স্কটিশ চার্চ কলেজের অধ্যক্ষ ডঃ আরকুহার্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বলেন যে, তিনি ‘দর্শন’-এ অনার্স নিয়ে পড়াশোনা করতে চান। সব শুনে, সুভাষের সঙ্গে কথা বলে খুশি হয়ে তিনি সম্মত হন। প্রেসিডেন্সি কলেজের নতুন অধ্যক্ষও এই ভর্তির ব্যাপারে আপত্তি জানালেন না। শরৎচন্দ্র বসু তাঁর সঙ্গে দেখা করে তাঁর ছোটভায়ের পক্ষে এই অনুরোধ জানান। সুভাষ নিজেও তাঁর সঙ্গে দেখা করেন।
স্কটিশ চার্চ কলেজে সুভাষচন্দ্র আবার মন দিয়ে পড়াশোনা শুরু করলেন। অধ্যক্ষ আরকুহার্ট খুব বিচক্ষণ ও সহানুভূতিশীল মানুষ ছিলেন। তিনি দর্শনের ভাল অধ্যাপকও ছিলেন। বাইবেলও পড়াতেন। তাঁর পড়ানো সুভাষের খুব আকর্ষণীয় মনে হত। কলেজে কোনও গোলমালে যেন জড়িয়ে না পড়েন সে বিষয়ে সুভাষ খুব সতর্ক থাকতেন। অবশ্য আরকুহার্টের মতো সুবিবেচক ছাত্রদরদী অধ্যক্ষ থাকার ফলে কলেজে ছাত্র অসন্তোষের কারণও ঘটেনি। ১৯১৯ সালে বি. এ. পরীক্ষায় ‘দর্শন’-এ অনার্সে প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় স্থান পেয়ে সুভাষ উত্তীর্ণ হন। প্রথম স্থান না পাওয়ায় সুভাষচন্দ্র খুব খুশি হননি। দর্শন নিয়ে এম. এ. পড়ার ইচ্ছা তাঁর আর ছিল না, যদিও দর্শন বিষয়টি সম্বন্ধে তাঁর আগ্রহ কমেনি। তাঁর মনে নতুন ভাবনা-চিন্তা দেখা দিচ্ছিল। তিনি স্থির করলেন ‘পরীক্ষামূলক মনস্তত্ত্ব’ নিয়ে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা করবেন। বিষয়টি ছিল অপেক্ষাকৃত নতুন। সুভাষও তাই এই বিষয় নিয়ে পড়ার জন্যে বেশি আগ্রহী হয়েছিলেন।
সুভাষচন্দ্র বসুর জীবনের কোনও কিছুই ঠিক ছকে বাঁধা পথে চলেনি। ভেবেছেন এক, কিন্তু ঘটনাচক্রে ঘটেছে অন্যরকম। আবার তাই হল। বাড়িতে না জানিয়ে যখন সুভাষ সাধু সঙ্গ, গুরুর সন্ধান ও তীর্থভ্রমণে বেরিয়ে দু’মাস পরে বাড়ি ফিরেছিলেন তখন তাঁর সঙ্গে জানকীনাথের একান্তে যে কথাবার্তা হয়েছিল তাতে সুভাষের ধারণা জন্মেছিল যে তাঁর বাবা আর কখনও কোনও বিষয়ে জোর করবেন না। সুভাষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করবেন না। কিন্তু তাঁর অনুমান ঠিক হয়নি। জানকীনাথ হঠাৎ একদিন সন্ধ্যাবেলায় কলকাতার বাড়িতে সুভাষকে ডেকে জানতে চাইলেন তিনি ইংলণ্ডে আই সি এস (ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস) পরীক্ষা দেবার জন্যে যেতে রাজি আছেন কি না। যদি থাকেন তাহলে তাঁকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত হতে হবে। মনস্থির করার জন্যে তাঁকে চব্বিশ ঘন্টা সময় দেওয়া হল। বোঝাই যায় যে, জানকীনাথ তাঁর সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিলেন। অন্যদের সঙ্গে, বিশেষ করে সুভাষচন্দ্রের সবচেয়ে প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় মেজদাদা শরৎচন্দ্রের সঙ্গে তিনি এই বিষয়ে কথা বলে নিয়েছিলেন। আই সি এস পাস করে উচ্চ সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করা তখন মেধাবী, উচ্চবিত্ত ভারতীয় তরুণদের ও তাদের অভিভাবকদের সর্বোচ্চ লক্ষ্য। সুভাষচন্দ্রের মেধা ছিল প্রশ্নাতীত। পুত্র সিভিল সার্ভিসে সুযোগ পেলে শুধু তারই নয়, বংশের সামাজিক মর্যাদা, আভিজাত্য বৃদ্ধি পাবে এটা জানকীনাথের মনে হওয়া স্বাভাবিক ছিল। পুত্রের মতিগতির ওপরও তাঁর ভরসা ছিল না। দেশের, বিশেষ করে কলকাতার রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমেই যেমন জটিল ও উত্তপ্ত হয়ে পড়ছিল তাতে সুভাষচন্দ্রের মতো একটি তরুণের জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা খুব বেশি ছিল। প্রেসিডেন্সি কলেজের ঘটনার পর জানকীনাথ ও বাড়ির অন্য অগ্রজরা সুভাষকে নৈতিক সমর্থন জানালেও মনে মনে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। স্বভাবতই আই সি এস পরীক্ষা দেবার জন্যে সুদূর ইংলন্ডে পাঠালে সুভাষকে এইসব থেকে দূরে করে দেওয়া এবং একই সঙ্গে তার জীবনকে অন্যপথে চালিত করা—দুই-ই সম্ভব হবে বলে তিনি ভাবছিলেন।
জানকীনাথের আকস্মিক এই প্রস্তাবে সুভাষ গভীর বিস্মিত হলেন। কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তিনি মন স্থির করে তাঁর সম্মতি জানালেন। কেন সুভাষচন্দ্র ইংলন্ডে আই সি এস পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন? আত্মজীবনীতে এই প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন যে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মনস্তত্ত্ব নিয়ে পড়া ছাড়ার জন্যে তাঁর তেমন কষ্ট হয়নি। কিন্তু আই সি এস পাস করে ব্রিটিশ সরকারের অধীনে চাকরি করার কথা তিনি ভাবতেও পারছিলেন না। তবে তাঁর মনে হয়েছিল যে মাত্র আট মাসের প্রস্তুতিতে তিনি আই সি এস পরীক্ষায় কিছুতেই পাস করতে পারবেন না। দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দেবার সুযোগও থাকবে না। তার মধ্যে তাঁর ওই পরীক্ষায় বসার বয়স পেরিয়ে যাবে। আর, যদিও বা কোনও ক্রমে পরীক্ষায় পাস করে যান, তখন ভাববেন কী করবেন না করবেন। সুভাষ তাঁর মানসিক সঙ্কট ও উদ্বেগের কথা লিখেছিলেন ইংলন্ডে যাত্রা করার ক’দিন আগে দুটি চিঠিতে। একটি লিখেছিলেন প্রিয়বন্ধু হেমন্তকুমার সরকারকে (২৬ আগস্ট, ১৯১৯) অন্যটি ভোলানাথ রায়কে (১ সেপ্টেম্বর, ১৯১৯)।
হেমন্তকুমার সরকারকে তিনি লেখেন যে, বাড়ি থেকে বিলেত যাবার “offer” পেয়ে তিনি “গুরুতর সমস্যা”র মধ্যে পড়েছেন। তিনি ভেবে দেখেছেন যে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় তাঁর পাস করার আশা নেই। ফেল করলে, সবার মত হল তিনি কেমব্রিজ বা লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করবেন। নিজের ইচ্ছা প্রসঙ্গে লেখেন, ‘আমার নিজের primary ইচ্ছা বিলাতে University Degree লাভ করা কারণ তাহা না হইলে Education Line-এ সুবিধা করিতে পারিব না। যদি আমি এখন বলি Civil Service পড়িতে যাইব না—তাহা হইলে এখনকার মতো (এবং চিরকালের মতো) বিলাত যাত্রার প্রস্তাব ভোলা থাকিবে। ভবিষ্যতে আর ঘটিয়া উঠিবে কি না জানি না। এরূপ অবস্থায় আমার কি এই সুযোগ প্রত্যাখ্যান করা উচিত?” সুভাষ তারই সঙ্গে লেখেন যে, যদি পরীক্ষায় পাস করে যান তাহলে “গুরুতর মুশকিল” হবে। তিনি “উদ্দেশ্য ভ্রষ্ট” হবেন। নিজের সিদ্ধান্ত সঠিক হল কি না এই নিয়ে সুভাষ উদ্বিগ্ন বোধ করছিলেন। বন্ধু হেমন্তকুমারকে তাই একান্ত অনুরোধ জানান তাড়াতাড়ি কলকাতায় আসতে। তাঁর পরামর্শের খুব প্রয়োজন সুভাষ বোধ করছিলেন। এর সপ্তাহখানেক পরে ভোলানাথ রায়কে সুভাষ তাঁর আসন্ন বিলাত যাত্রা প্রসঙ্গে লেখেন যে, আই সি এস পরীক্ষায় সফল না হলে তিনি কেমব্রিজে পড়তে যাবেন।
সুভাষচন্দ্র ১৯১৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর কলকাতা থেকে জাহাজে যাত্রা শুরু করে ২০ অক্টোবর লন্ডনে পৌঁছন। হেমন্তকুমার সরকারের কাছ থেকে চিঠির উত্তর পেয়ে তিনি কিছুটা আশ্বস্ত বোধ করেছিলেন। প্রিয়বন্ধুকে সুভাষ আবার লেখেন (৩ সেপ্টেম্বর, ১৯১৯) গত কয়দিন “মানসিক তুফানের” মধ্যে দিয়ে তিনি গিয়েছেন। “অনেক সংগ্রামে”র পর তিনি বিলাত যাত্রা স্থির করেছেন। তবু মনের চাঞ্চল্য যায়নি।
সুভাষচন্দ্র যেদিন হঠাৎ দিলীপকুমার রায়কে জানান যে, আই সি এস পরীক্ষায় বসতে ইংলন্ডে যাচ্ছেন দিলীপকুমার নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারেননি। অবাক বিস্ময়ে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন, “তুমি, সুভাষ! তুমি আই সি এস দিতে চাও?” নিরুত্তর সুভাষ শুধু মৃদু হেসেছিলেন। ঐ হাসি রহস্যময় ছিল।
সুভাষচন্দ্রের বিলাতযাত্রার আগেই জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল (১৩ এপ্রিল, ১৯১৯)। এই নৃশংস ঘটনা এবং উত্তর-পশ্চিম ভারতে যে ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল তার সম্বন্ধে বাইরে অন্যান্য অঞ্চলের সাধারণ মানুষ তেমন কিছু জানতে পারেনি। খবর পাঠানোর ওপর কড়া সেন্সর চালু ছিল। সুভাষচন্দ্র তাই একটা “আত্মসন্তুষ্টি”র ভাব নিয়েই ইউরোপ যাত্রা করেছিলেন। তাঁর এই “আত্মসন্তুষ্টি” কিছুটা বিস্ময়কর। কেননা, যতই কঠোর সেন্সর ব্যবস্থা থাকুক না কেন, পঞ্জাবের নারকীয় ঘটনার কাহিনী কলকাতায় পৌঁছেছিল ও উত্তেজনার সৃষ্টি করেছিল। বিশেষ করে, জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথের ‘স্যার’ উপাধি ত্যাগ ও ভাইসরয়কে লেখা ঐতিহাসিক চিঠিটি সারা দেশে ও বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। সুতরাং, কলকাতার বসু পরিবারে, বিশেষ করে শরৎচন্দ্র ও সুভাষচন্দ্রের মতো সচেতন ও সংবেদনশীল মনে, ঐ ঘটনা তেমন কোনও আলোড়ন সৃষ্টি করেনি তা মনে হয় না। সম্ভবত, সুভাষচন্দ্র ওই মুহূর্তে কোনও রাজনৈতিক আবর্তে পড়তে মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন না। তা সত্ত্বেও তাঁর পিতা-মাতার উদ্বেগ দূর হয়নি। পুত্রকে অল্প সময়ের মধ্যে বিলেতে পাঠাবার সিদ্ধান্তের পিছনে ঐ উদ্বেগই কাজ করেছিল। সুভাষচন্দ্র নিজেও কিছুটা আত্মসমীক্ষা করছিলেন। নিজের ভবিষ্যৎ জীবন সম্বন্ধে ভাবনা-চিন্তা করছিলেন। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, পাশ্চাত্যে যাওয়ার এবং ইংলন্ডের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে ডিগ্রি অর্জনের ইচ্ছা তাঁর ঐ সময়ে খুবই প্রবল হয়ে উঠেছিল। মনে হয়েছিল, ঐ অভিজ্ঞতা তাঁর ভবিষ্যতের কর্মজীবনে খুবই কাজে লাগবে। এই সময় লেখা তাঁর বিভিন্ন চিঠিপত্র পড়ে মনে হয় যে অধ্যাপনা বা সাংবাদিকতা করার প্রতি তাঁর একটা প্রবণতা এসেছিল। বিলাত থেকে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনকে লেখা প্রথম চিঠিতেই তিনি ওই ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।
আই সি এস পরীক্ষার ব্যাপারটা প্রথম থেকেই তাঁর কাছে গৌণ ছিল। এটি ছিল বিদেশ যাবার একটি সুযোগ ও উপলক্ষ মাত্র। প্রথম থেকেই তিনি মনস্থির করেছিলেন যে আই সি এস পরীক্ষায় ফল যাই-ই হোক না কেন, তিনি বিদেশের পড়াশোনা শেষ করে, অভিজ্ঞতা অর্জন করে দেশে ফিরে বৃহত্তর কর্মজীবনে নামবেন। ব্রিটিশ সরকারের অধীনে কোনও চাকরি গ্রহণ করা তাঁর চিন্তারও অতীত ছিল। তবুও আই সি এস পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত তাঁর মনে ইংলন্ডে পৌঁছবার কয়েক মাস পরেও কাঁটার মতো বিঁধেছিল। হেমন্তকুমার সরকারের কাছে একটি চিঠিতে এই প্রসঙ্গে তিনি লেখেন (১৯ জানুয়ারি, ১৯২০), “এখনও বুঝিতে পারি নাই—আমি আদর্শভ্রষ্ট হয়েছি কি না। আমি আত্মপ্রতারণা করিয়া নিজেকে বুঝাইতে চাই না যে Civil Service-এর জন্য পড়াটা ভাল। চিরকাল ঐ জিনিসটা ঘৃণা করিতাম—এখনও বোধহয় করি—এ অবস্থায় Civil Service-এর জন্য চেষ্টা করা আমার দুর্বলতার নিদর্শন অথবা কোনও দূরবর্তী মঙ্গলের সূচক তাহা ঠিক বুঝিতে পারিতেছি না। আমার একমাত্র প্রার্থনা যে আমার হিতৈষীরা আমার সম্বন্ধে কোনও hasty opinion না form করেন। অনেক ঘটনার শেষে এসে না পৌঁছালে তার অর্থ ঠিক বুঝিতে পারা যায় না। আমার সম্বন্ধেও কি তাহা হইতে পারে না?”
সুভাষচন্দ্র ওই চিঠিতে যেন নিজের ভাগ্যলিপি দেখতে পাচ্ছিলেন। শুধু আই সি এস পরীক্ষার জন্যে বিলেতে যাওয়ার সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেই নয়, এরকম একাধিকবার ঘটেছিল তাঁর জীবনের বহু স্মরণীয় সন্ধিক্ষণে।
ইংলন্ডে পোঁছে সুভাষচন্দ্র ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে। তিনি পৌঁছবার কয়েক সপ্তাহ আগেই কেমব্রিজে নতুন শিক্ষা বৎসরের পড়াশোনা শুরু হয়ে গেলেও কিছু অসুবিধার পর তিনি শেষপর্যন্ত ভর্তি হবার সুযোগ পান। তিনি Mental and Moral Sciences-এ (মানসিক ও নীতি বিজ্ঞান) ট্রাইপোজের (Tripos) জন্যে পড়া শুরু করেন। একটি চিঠিতে তিনি লেখেন (১২ নভেম্বর, ১৯১৯), “আমার মতলব আগামী বৎসর Civil Service পরীক্ষা দেওয়া এবং পাস করি বা ফেল করি ১৯২১ সালের মে মাসে Moral Science Tripos-এর পরীক্ষা দেওয়া। এখানকার degree আমাকে লইতে হইবেই, কারণ ভবিষ্যতে আমার বিশেষ কাজে লাগিবে।”
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন