দেশনায়ক – ৩২

ভেনিসে পৌঁছবার কয়েকদিন পর সুভাষচন্দ্র অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা শহরে পৌঁছন। মূলত নিজের চিকিৎসার জন্যে ইউরোপে যাওয়ার অনুমতি পেলেও সুভাষচন্দ্র ইউরোপে থাকাকালে ভারতবর্ষ ও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে সারা ইউরোপে আগ্রহ, সহানুভূতি ও সমর্থনের পরিবেশ গড়ে তোলার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর ওই প্রচেষ্টা ও উদ্যোগ কতখানি কার্যকর হয়েছিল, কীভাবে অত্যন্ত প্রতিকূল পরিস্থিতি ও বিরুদ্ধতার মধ্যেও তিনি কতখানি সফল হয়েছিলেন, ভারত সরকার এবং ব্রিটিশ সরকারের ঘুম কেড়ে নিয়ে তাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছিলেন তা এক বিস্ময়কর কাহিনী। সুদূর ইউরোপে থেকেও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও আন্দোলনের ওপর তাঁর প্রখর দৃষ্টি ছিল। তাঁর মনোভাব ও প্রতিক্রিয়া দেশে-বিদেশে দৃষ্টি আকর্ষণ করতো, গুরত্ব পেত। শারীরিকভাবে অনুপস্থিত থাকলেও সুভাষচন্দ্রের পরোক্ষ প্রভাব সবসময়ই প্রবলভাবে অনুভূত হত। ব্রিটিশ পাসপোর্ট থাকলেও তাঁকে ইংলন্ডে প্রবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। দেশে ফেরার ওপরেও কঠোর নিষেধাজ্ঞা ছিল। তাঁর ইউরোপ প্রবাসের মোটামুটি পাঁচ বছরের মধ্যে (১৯৩৩-১৯৩৮) দু’বারই যখন তিনি দেশে ফিরেছেন তখনই তাঁকে গ্রেপ্তার করে বন্দী করে রাখা হয়েছিল ও আবার ইউরোপে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি কখনও বিচলিত হননি। নিজের মুক্তির জন্যে সরকারের কোনও অন্যায় আদেশ, শর্ত মেনে নেননি। মান্দালয় থেকে যখন অসম্মানজনক শর্ত মেনে না নিলে তাঁর মুক্তির আশা সুদূর পরাহত সেই সময় সুভাষচন্দ্র শরৎচন্দ্রকে লিখেছিলেন, “আমার মুক্তির সম্ভাবনা বিরল বলে কেউ যেন দুঃখ না করেন। সর্বোপরি আমাদের প্রিয় বাবা-মা’কে সান্ত্বনা দিন, কারণ তাঁদের ভাগ্যই সবচেয়ে কষ্টকর; আর সেই সঙ্গে সান্ত্বনা দেবেন আর সকলকে, যাঁরা ভালবাসেন আমাকে। স্বাধীনতার অমূল্য সম্পদ সংগ্রহ করার আগে ব্যক্তিগত ও সংঘবদ্ধভাবে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হবে আমাদের…আমি নিজে শান্ত আছি এবং তাঁর (ঈশ্বরের) দেওয়া সব কষ্টের মুখোমুখি হতে পারব শান্ত মনোভাব নিয়ে। আমি আমার নিজস্ব বিনীত উপায়ে, আমাদের জাতির সমস্ত অতীত পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছি বলে মনে করি। আমাদের আদর্শের মৃত্যু নেই, আমাদের আদর্শ জাতির স্মৃতিপট থেকে মুছে যাবে না এবং আমাদের উত্তরসূরীরা আমাদের অতি প্রিয় স্বপ্নের কথা স্মরণ করে গর্বিত বোধ করবে—এই বিশ্বাসই আমাকে আমার চিরদিনের দুঃখ-যন্ত্রণার মধ্যে বাঁচিয়ে রাখবে।” ১৯৪৫ সালে তাঁর রহস্যময় শেষ বিদায়ের দিনটি পর্যন্ত সুভাষচন্দ্র সেই প্রায়শ্চিত্ত করে গিয়েছিলেন। বাঁচিয়ে রেখেছিলেন সেই আদর্শকে। কিন্তু তাঁর প্রিয় স্বপ্নের জন্যে আজীবন দুঃখ-যন্ত্রণার কথা বর্তমান প্রজন্ম কতটা গর্বের সঙ্গে স্মরণ করে সে বিষয়ে মনে প্রশ্ন জাগে।

সুভাষচন্দ্র দেশ ছাড়ার পূর্ব থেকেই আইন অমান্য আন্দোলনের গতি স্তিমিত হয়ে পড়েছিল। ভাইসরয় লর্ড উইলিংডনের কঠোর দমননীতি, নির্যাতন ও সন্ত্রাস আন্দোলনকে বহুলাংশে প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছিল। গান্ধীজি, জওহরলাল, সর্দার প্যাটেল, সুভাষচন্দ্র প্রমুখ নেতাদের গ্রেপ্তারও উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাব সৃষ্টি করেছিল। ১৯৩২ সালের নভেম্বর মাসে লন্ডনে আহুত তৃতীয় গোলটেবিল বৈঠকে কংগ্রেস যোগদান করেনি। তার পূর্বেই র‍্যামসে ম্যাকডোনাল্ড ‘সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা’ ঘোষণা করেছিলেন। এই প্রসঙ্গ পূর্বেই আলোচিত হয়েছে। কংগ্রেসকে উপেক্ষা করেই ভারতবর্ষের শাসনতন্ত্র সম্পর্কে গুরত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পরবর্তী আলোচনার ফলস্বরূপ ভারত-শাসন আইনের খসড়া প্রস্তুত হয়। এই খসড়াই বিল রূপে উত্থাপিত হয়ে ব্রিটিশ পালামেন্টের অনুমোদন লাভ করে ১৯৩৫ সালের ভারত-শাসন আইন (Government of India Act of 1935) রূপে বলবৎ হয়।

১৯৩৩ সালের ৮ মে গান্ধীজি ‘আত্মশুদ্ধি’র জন্যে তিন সপ্তাহের অনশন শুরু করলেন। অস্পৃশ্যতা দূরীকরণের কাজে তাঁর অনুগামীরা যথেষ্ট অগ্রসর হতে ব্যর্থ হওয়ায় তার প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ ছিল গান্ধীজির এই অনশন। তাঁর স্বাস্থ্য ও জীবন সম্বন্ধে উদ্বিগ্ন হয়ে সরকার তাঁকে মুক্তি দেয়। গান্ধীজির পরামর্শে আইন অমান্য আন্দোলন স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়। কংগ্রেসের বহু নেতা গান্ধীজির অনশনের সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। তাঁরা মনে করেন যে, গান্ধীজির অনশন স্বাধীনতা আন্দোলনকে মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করছে। গান্ধীজি আইন অমান্যকারীদের মুক্তি দেবার আবেদন করলেও ভাইসরয় তা প্রায় তাচ্ছিল্যের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেন। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাছে গান্ধীজির আন্দোলন স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত আত্মসমর্পণ তুল্য মনে হয়েছিল। কংগ্রেস কর্মীদের নৈতিক বল ক্ষুণ্ণ হয়ে ব্যাপক হতাশার সৃষ্টি করেছিল। হতাশাগ্রস্ত গান্ধীজি নিজেও কংগ্রেস থেকে তাঁর অবসর গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ্যেই ব্যক্ত করতে থাকেন। এর ফলে হতাশা আরও ব্যাপক ও গভীরতর হয়।

মহাত্মা গান্ধীর অনশনের সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করে সুভাষচন্দ্র ও বল্লভভাই প্যাটেলের বড় ভাই বিঠলভাই প্যাটেল ভিয়েনা থেকে এক বিবৃতি দেন (মে, ১৯৩৩)। এই বিবৃতি ‘বোস-প্যাটেল ঘোষণা বা ইস্তাহার’ নামে খ্যাত। তাঁরা দু’জনে খোলাখুলি বলেন, “রাজনৈতিক নেতা হিসেবে গান্ধীজি ব্যর্থ হয়েছেন।” গত তের বছরে প্রমাণিত হয়েছে, “কেবল নিজেরা দুঃখবরণ করে অথবা শত্রুকে ভালবেসে আমাদের শাসককুলের হৃদয়ের পরিবর্তন ঘটাতে পারব সে আশা অলীক। প্রয়োজন হল সমগ্র কংগ্রেসের রূপান্তর। যদি না তা সম্ভব হয়, কংগ্রেসের মধ্যেই একটি নতুন দল গঠন করা প্রয়োজন। অসহযোগ বর্জন নয়, বরং তার রূপ পরিবর্তন করে আরও আক্রমণাত্মক করে স্বাধীনতা সংগ্রাম চালাতে হবে।” বিঠলভাই চিকিৎসার জন্যে ওই সময় ভিয়েনায় ছিলেন। তিনি খ্যাতনামা আইনজীবী ছিলেন। অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। পরে স্বরাজ্যপন্থী হন। কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক রূপে তিনি ইংলন্ডে গিয়েছিলেন। ভারতীয় ব্যবস্থাপক সভার প্রথম নির্বাচিত সভাপতি রূপে (১৯২৫) তিনি বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দেন ও মর্যাদা লাভ করেন। বিদেশে প্রচারের ব্যাপারে তিনি খুবই আগ্রহী ছিলেন। এই বিষয়ে তাঁর এবং সুভাষচন্দ্রের মধ্যে মতৈক্য ছিল। ডাবলিনে বিঠলভায়ের উদ্যোগে ‘ইন্দো-আইরিশ লীগ’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তিনি সুভাষচন্দ্রের গুণগ্রাহী ছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত ১৯৩৩ সালের অক্টোবর মাসে এক সুইস স্যানাটোরিয়ামে তাঁর মৃত্যু হয়। তিনি তাঁর উইলে এক লক্ষ টাকার অধিক সম্পদ জাতীয় কল্যাণে ও বিদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামের কাজের প্রচারের জন্যে রেখে যান। এই অর্থ দেখাশোনা ও ব্যয়ের দায়িত্ব তিনি সুভাষচন্দ্রকে ন্যস্ত করে যান। সুভাষচন্দ্র এই দায়িত্বভারকে এক ‘পবিত্র ন্যাস’ বলে গ্রহণ করেন। কিন্তু বিঠলভাই প্যাটেলের এই শেষ ইচ্ছা সুভাষচন্দ্র পূরণ করতে পারেননি। বল্লভভাই প্যাটেল আদালতে এই উইলের বিরোধিতা করেন। আইনগত বাধায় সুভাষচন্দ্র ঐ অর্থ স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রচারের কাজে ব্যয় করার সুযোগ পাননি। সুভাষচন্দ্রের প্রতি বল্লভভাই প্যাটেলের বিরূপতার এটি এক দুঃখজনক ঘটনা।

১৯৩৩ সালে (১১-১২ জুন) লন্ডনে ‘ইন্ডিয়ান পলিটিক্যাল কনফারেন্স’-এ (Indian Political Conference) সভাপতিত্ব করার জন্যে সুভাষচন্দ্র আমন্ত্রিত হন। ব্রিটেনে প্রবেশের অনুমতি না থাকায় তিনি সম্মেলনে যোগ দিতে পারেননি। তিনি তাঁর লিখিত ভাষণটি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘বিপ্লবের কৌশল’ (Technique of Revolution)। এটি তাঁর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রচনা। সুভাষচন্দ্র গান্ধীজির রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও মনোভাবকে শত্রুর কাছে বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ বলে অভিহিত করে বলেন যে, স্বাধীনতার পথে আপসের কোনও প্রশ্ন নেই। অসহযোগ আন্দোলনের সময় থেকে আইন অমান্য আন্দোলনের দুঃখজনক পরিণতির বিশ্লেষণ করে গান্ধী-আরউইন চুক্তিকে তিনি ‘সরকারের পৌষ মাস ও জাতির সর্বনাশ’ বলে বর্ণনা করেন। ব্রিটিশ শক্তির সম্পূর্ণ পরাজয় ও ভারতবর্ষের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন ছাড়া অন্য কোনও সমাধানের পথ খোলা নেই। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনকে ‘একটি সুসজ্জিত এবং সুরক্ষিত দুর্গে’র সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেন, দুটি উপায়ে এই দুর্গ অধিকার করা সম্ভব: দুর্গটিকে সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক অবরোধ করে দুর্গের সৈন্যদলকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা; বলপূর্বক দুর্গ অধিকার করা। কিন্তু বলপূর্বক অধিকারের কোনও চেষ্টাই আজ পর্যন্ত করা হয়নি, কেননা, ‘কংগ্রেস অহিংসার অঙ্গীকারে বদ্ধ’। আর, অর্থনৈতিক অবরোধ নানান কারণে ও সাংগঠনিক দুর্বলতার জন্যে সফল হয়নি।

বর্তমান পরিস্থিতি ও পূর্ব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কী কী উপায়ে শক্তিশালী ব্রিটিশ শক্তিকে পরাভূত করা সম্ভব তার ব্যাখ্যা করে সুভাষচন্দ্র যা বলেন তা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গ্রহণযোগ্য সম্ভাব্য উপায়গুলি হল: কর ও রাজস্ব আদায়ে বাধা দান; সঙ্কটকালে ভারতে ব্রিটিশ সরকার আর্থিক ও সামরিক সাহায্য যাতে না পায় তা সুনিশ্চিত করা; ভারতে সৈন্যদল, পুলিশ ও সরকারী কর্মচারীদের (যারা ভারতীয়) বিদেশী শাসকদের প্রতি সমর্থন, সহানুভূতি বিনষ্ট করে তাদের সরকারী আদেশ অমান্য করতে উদ্বুদ্ধ করা। আর একটি পথ হল, “অস্ত্রশস্ত্রে বলীয়ান হয়ে বলপ্রয়োগে ক্ষমতা দখলের আয়োজন করা।” যদিও সুভাষচন্দ্র বলেন যে, “শেষ পথটি বাদ দিতে হবে কারণ কংগ্রেস অহিংসায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ”—এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, এটি ছিল তাঁর মুখের কথা, মনের কথা নয়। ওইটুকু সতর্ক না হলে সুভাষচন্দ্রের পক্ষে জেলের বাইরে একদিনের জন্যেও থাকা সম্ভব হত না। তাঁকে সব দিক থেকে ‘শেষ করার’ জন্যে ব্রিটিশ সরকার ব্যবস্থা নিত। কিন্তু সুভাষচন্দ্র মনেপ্রাণে অনুভব করেছিলেন, সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া আর অন্য কোনও উপায়ে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদ সম্ভব নয়। এর জন্যে সব রকমের প্রাথমিক মানসিক ও সাংগঠনিক প্রস্তুতি, বিদেশে ব্যাপক প্রচার ও সহানুভূতি অর্জন, এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সম্ভাব্য সব শত্রুপক্ষের সাহায্য লাভের চেষ্টা করে যাওয়া অত্যন্ত জরুরি বলে তিনি মনে করেছিলেন। তিনি স্থির নিশ্চিত ছিলেন, অল্পকালের মধ্যেই এক বড় যুদ্ধ শুরু হতে চলেছে। সেই যুদ্ধের পূর্ণ সুযোগ ভারতবর্ষকে গ্রহণ করতে হবে। এতটুকু কালক্ষেপের আর সময় নেই। ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত ইউরোপে থাকাকালে সুভাষচন্দ্র যা কিছু করেছিলেন, বলেছিলেন, যেখানে যেখানে গিয়েছিলেন, যাঁদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন সব কিছুর পিছনে ছিল ওই একটিই লক্ষ্য। তাঁর মধ্যে এক জরুরি চেতনাবোধ (sense of urgency) ছিল অত্যন্ত সুস্পষ্ট।

কংগ্রেসের অহিংস আন্দোলনের প্রতি অবিচল আস্থা, আপসমূলক নীতি ও মনোভাব, যুগোপযোগী বলিষ্ঠ সামাজিক এবং আর্থিক পরিকল্পনা গ্রহণে ব্যর্থতা, প্রাচীনপন্থী নেতাদের দুর্বলতা সুভাষচন্দ্রকে ক্রমেই এত হতাশ করে তুলছিল যে কংগ্রেসের পক্ষে কোনও বৈপ্লবিক কর্মসূচী গ্রহণ ও কার্যকর করা সম্ভব বলে তাঁর আর আস্থা ছিল না। তিনি নতুন এক দল গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথাও ভাবতে শুরু করেছিলেন। আলোচ্য ভাষণে তিনি তাঁর ইঙ্গিতই শুধু দেননি, ওই রকম এক নতুন দলের সংগঠন, চরিত্র, কর্মসূচীর রূপরেখা পর্যন্ত দিয়েছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, দেশকে স্বাধীন ও নতুন করে গড়ে তোলার জন্যে প্রয়োজন দৃঢ়সঙ্কল্প নারী ও পুরুষ যাঁরা যে কোনও ত্যাগ ও দুঃখ স্বীকারে প্রস্তুত থাকবেন। প্রয়োজন নতুন নেতৃত্বের। এঁরা হবেন যুদ্ধকালীন সেনাপতিদের মতো। দেশ স্বাধীন হবার পর এক নবীন যুবগোষ্ঠীর হাতে সামগ্রিক দায়িত্ব তুলে না দেওয়া পর্যন্ত তাঁদের কাজ শেষ হবে না। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সারা বিশ্বে প্রচারকার্যের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে, কেননা, “ইংরেজরা জন্ম-প্রচারক, ইংরেজদের বন্দুকের চেয়েও প্রচারকার্য শক্তিশালী অস্ত্র।” নতুন দলটির কর্মীরা সর্বসময়ের কর্মী হবেন। তাঁরা “স্বাধীনতার উন্মাদনায় সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী হবেন…ব্যর্থতায় তাঁরা নিরুৎসাহ হবেন না, দুরূহ কাজে তাঁরা ভয় পাবেন না…জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মহান এক ব্রত উদ্যাপনের কর্মে প্রচেষ্টায় আত্মনিয়োগ করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হবেন।” সুভাষচন্দ্র তাঁর এই প্রস্তাবিত দলকে ‘সাম্যবাদী সঙ্ঘ’ নাম দেওয়া যেতে পারে বলেছিলেন। এটি হবে এক সুনিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয়, সর্বভারতীয় দল। সকল শ্রেণীর মানুষের মধ্যেই এই দল কাজ করবে। জাতীয় কংগ্রেস, নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস, কিষাণ সংগঠন, নারী সংগঠন, যুব সংগঠন, ছাত্র সংগঠন, অনুন্নত শ্রেণীর সংগঠন—সকলের মধ্যেই এই দলের প্রতিনিধি থাকবে। বৃহত্তর প্রয়োজনের স্বার্থে সাম্প্রদায়িক সংগঠনের সঙ্গেও কাজ করতে হবে। কোনও দল বা ব্যক্তিবিশেষের প্রতি বিদ্বেষ থাকবে না। দলের আদর্শ ও উদ্দেশ্য প্রচার করার জন্যে বিভিন্ন স্থানে শাখা গঠন করতে হবে।

তাঁর প্রস্তাবিত সাম্যবাদী দলের মধ্য দিয়ে সুভাষচন্দ্র ভবিষ্যৎ ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন। এক স্বাধীন, শক্তিশালী, গতিশীল, উন্নত, আধুনিক ভারতবর্ষের স্বপ্ন। লক্ষণীয় হল যে, তিনি জাতীয় কংগ্রেসের বিকল্প বা প্রতিদ্বন্দ্বী কোনও দলের কথা চিন্তা করেননি। কংগ্রেসের মধ্যেই এক বৃহত্তর, উচ্চতর আদর্শে অনুপ্রাণিত, স্বার্থশূন্য, সংগ্রামী গোষ্ঠী বা দলের কথা ভেবেছিলেন। এই প্রসঙ্গে স্মরণীয় যে, কয়েক বছর পরে তিনি যখন ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ গঠন করেন তখনও তিনি এক পৃথক স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল গঠনের চিন্তা করেননি। ঘটনাচক্রে বাধ্য হয়ে ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ এক পৃথক রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছিল। জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে বিভেদ বা ভাঙ্গন সৃষ্টি করা কখনও তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না। কংগ্রেসকে প্রকৃত অর্থে ‘জাতীয়’ প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করা, স্বাধীনতা সংগ্রামে সর্বাত্মকভাবে নিয়োজিত করাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। গান্ধীজি, জওহরলাল ও অন্য কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে তাঁর বিরোধ ছিল আদর্শ, নীতি ও কর্মসূচীর প্রশ্নে। ব্যক্তিস্বার্থ বা ক্ষমতার লড়াই-এর লেশমাত্র ছিল না তাঁর মধ্যে। দুঃখের বিষয় হল সমসাময়িক ও পরবর্তীকালে অনেক কংগ্রেস নেতা ও লেখক সুভাষচন্দ্র সম্বন্ধে এই অভিযোগ এবং সমালোচনা করেছেন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। প্রসঙ্গত অমলেশ ত্রিপাঠীর বক্তব্য উল্লেখ করা যেতে পারে। তাঁর ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস’ গ্রন্থে সুভাষ-গান্ধী বিরোধ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, “শুধু পারিবারিক মর্যাদা, ব্যক্তিত্ব বা মেজাজের পার্থক্য, শিক্ষার হেরফের ইত্যাদি ভাবলেই চলবে না, ভাবতে হবে পরিবর্তনশীল বৈদেশিক পরিস্থিতির কথা, কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ সংগঠনের, মত ও পথ নিয়ে পার্থক্যের কথা, ভারতীয় ও আঞ্চলিক ঐতিহ্যের তারতম্যের কথা।” ত্রিপাঠী বলেছেন, তিরিশের দশকের সর্বভারতীয় এবং বাংলার রাজনীতির স্ব-বিরোধ, অনিশ্চয়তা, বাঙালি মধ্যবিত্তের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক এবং অস্তিত্বের সঙ্কট, সরকারী দমননীতির ফলে জর্জরিত, বাঙালীর এক সঙ্কটকালে, “মৃত্যুঞ্জয়ী মনোবল, আদর্শের দিগন্ত ইউরোপে অবস্থান ও ভ্রমণের ফলে প্রসারিত, কিছুটা বা বিভ্রান্ত, রোগজীর্ণ দেহ নিয়ে সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তন হয়েছিল।” “উনিশ শতকের বাংলার গর্ব ও বিশ শতকের বাংলার অভিমান” সুভাষচন্দ্রের মধ্যে উদ্যত খড়্গের মতো ঝলসে উঠেছিল। এই বিশ্লেষণ সুন্দর ও যথার্থ। কিন্তু সুভাষচন্দ্রকে শুধু মাত্র বাংলার নেতা, বাঙালির গর্ব বলে দেখার যে প্রবণতা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে খ্যাতনামা ঐতিহাসিক অমলেশ ত্রিপাঠীও তার থেকে মুক্ত হতে পারেননি। সুভাষচন্দ্র তিরিশের দশকে, সবার্থে শুধুমাত্র এক বড় মাপের সর্বভারতীয় নেতাই ছিলেন না, সারা বিশ্বে তাঁর এক বিশেষ পরিচিতি ও মর্যাদা গড়ে উঠেছিল।

‘সাম্যবাদী’ দল বা সঙ্ঘ নামকরণটি কিছু সংশয় ও জটিলতা সৃষ্টি করেছিল, এখনও তা সম্পূর্ণ দূর হয়নি। ‘কমিউনিজম’ ও ‘কমিনিউস্ট’দের সম্বন্ধে সুভাষচন্দ্রের দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিমত কী ছিল, এবং নাৎসিজম, ফ্যাসিজম সম্বন্ধে তাঁর ভাবনা-চিন্তার বিষয়টি কিছু পরে আসবে। জওহরলাল নেহরুর একটি বিবৃতি (১৮ ডিসেম্বর, ১৯৩৩) প্রসঙ্গে সুভাষচন্দ্র সাম্যবাদের মর্মবস্তু কী সে সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব অভিমত ব্যক্ত করেন। জওহরলাল বলেছিলেন, “বর্তমান পৃথিবীতে হয় কোনও ধরনের কম্যুনিজমকে না হয় কেনো ধরনের ফ্যাসিজিমকে বেছে নিতে হবে…এই দুই-এর মধ্যে কোনও মধ্যপথ নেই এবং দুই-এর মধ্যে আমি কম্যুনিস্ট আদর্শকেই বাছাই করেছি।” সুভাষচন্দ্র জওহরলালের এই মতবাদকে মূলগতভাবে ভ্রান্ত বলে মনে করেছিলেন। তিনি কম্যুনিজম এবং ফ্যাসিজিম-এর সমন্বয় সাধনের উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, উভয় মনোভাবের মধ্যে মৌলিক প্রভেদ থাকলেও কোনও কোনও বিষয়ে এই দুই মতবাদের মধ্যে সাদৃশ্যও আছে। এই সাদৃশ্যগত দিকগুলির ভিত্তিতেই দুই-এর সমন্বয় সাধন সম্ভব। এই সমন্বয়কে সুভাষচন্দ্র নামকরণ করেছিলেন: ‘সাম্যবাদ’ বা ‘The doctrine of synthesis of equality’। তাঁর মতে ভারতবর্ষে এই সমন্বয় কার্যকর করার প্রয়োজন আছে।

‘কমিউনিজম’, ‘সোস্যালিজম’, ‘ফ্যাসিজম’, ‘নাৎসিজম’ প্রভৃতি বিভিন্ন মতবাদ তিরিশের দশকে ইউরোপে ব্যাপকভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, আলোচিত হচ্ছিল। রাষ্ট্রপরিচালনা ও শাসনব্যবস্থায় এই মতবাদগুলির সার্থক প্রয়োগ ও তার সুফল-কুফল সম্বন্ধে বিতর্ক শুরু হয়েছিল। ভারতবর্ষেও এর প্রভাব পড়েছিল। জাতীয় কংগ্রেসে, বিপ্লবীদের মধ্যে, শ্রমিক-কৃষক সংগঠন ও আন্দোলনে, যুব-ছাত্র মানসে তার প্রতিফলন ঘটছিল। কংগ্রেসের মধ্যেই ‘কংগ্রেস সোস্যালিস্ট পার্টি’র (Congress Socialist Party) সৃষ্টি হয়েছিল। দুই শীর্ষস্থানীয় তরুণ নেতা—জওহরলাল ও সুভাষচন্দ্র—ওইসব বিভিন্ন মতাদর্শ সম্বন্ধে গভীরভাবে চিন্তা শুরু করেছিলেন এবং ওই মতবাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। মতাদর্শের এই বিতর্ক ও আলোড়ন জাতীয় আন্দোলনে প্রতিফলিত হতে শুরু করেছিল।

অমলেশ ত্রিপাঠী লিখেছেন, “কেউ কেউ বলেছেন (বা বলতেন) সুভাষ নাৎসী-ফাসিস্ত মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। যদি হয়ে থাকেন তবে ১৯৩৩ ও ১৯৩৮-এর মধ্যে হবেন। তার আগে নয়।” এটা ঠিক নয়। ১৯৩৩-এর আগেই সুভাষচন্দ্র এইসব মতবাদ সম্বন্ধে পড়াশোনা-ভাবনাচিন্তা করছিলেন। বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনে তাঁর ভাষণে (৩০ মার্চ, ১৯২৯) সুভাষচন্দ্র বলেন, “সমাজ ও রাষ্ট্র-সম্পৰ্কীয় কোনও মতবাদকে অভ্রান্ত ও অখণ্ড সত্য বলে মনে করা সমীচীন নয়। অধিকাংশ ism বা মতবাদের ভেতর অল্পাধিক সত্য আছে। তাই Socialism-এ সত্য যা আছে তাই আমরা চাই। কিন্তু তাই বলে Fascism-এর শৃঙ্খলা, সংঘবদ্ধতা ও আজ্ঞানুবর্তিতা একেবারে বর্জনীয় নয়।” এই বক্তৃতাতেই তিনি সোভিয়েত রাশিয়ায় ‘মার্ক্সসিজম’-এর প্রয়োগ সম্বন্ধে মন্তব্য করেছিলেন। কলকাতা কর্পোরেশনে মেয়রের ভাষণে (২৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৩০) তিনি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের নীতি ও কর্মসূচীর উল্লেখ করে বলেন, “আধুনিক ভাষায় প্রকাশ করতে গেলে আমি বলব যে, আধুনিক ইউরোপ যাকে সমাজতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদ বলে, এই নীতি ও কর্মসূচীতে আমরা তার সমন্বয় পাই। এখানে আছে ন্যায়বিচার, সাম্য, প্রীতি, যা সমাজতন্ত্রের ভিত্তি, এবং তার সঙ্গে মিশে আছে ফ্যাসিবাদের দক্ষতা ও শৃঙ্খলা—বর্তমান ইউরোপে তা যে অবস্থায় আছে।” কিন্তু সবকিছুর আগে যা ভারতবাসীর প্রয়োজন তা ছিল, সুভাষচন্দ্রের দৃষ্টিতে, ‘জাতীয়তাবাদ’—Nationalism। স্বাধীনতা সংগ্রামের সাফল্যের জন্যে তার কাছে এই জাতীয়তাবাদই বিশেষ জরুরি ছিল। তারই সঙ্গে কোন নতুন নীতি ও আদর্শটুকু স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন ও পরিচালনায় ফলপ্রসূ হতে পারে, দেশকে শক্তিশালী, উন্নত, প্রকৃত প্রজাকল্যাণমূলক রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারে তা নিয়ে তিনি নিরন্তর চিন্তা করেছিলেন। তাঁর ইউরোপ প্রবাসের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার এক বিশেষ মূল্য ছিল তাঁর জীবনে।

সকল অধ্যায়

১. দেশনায়ক – ১
২. দেশনায়ক – ২
৩. দেশনায়ক – ৩
৪. দেশনায়ক – ৪
৫. দেশনায়ক – ৫
৬. দেশনায়ক – ৬
৭. দেশনায়ক – ৭
৮. দেশনায়ক – ৮
৯. দেশনায়ক – ৯
১০. দেশনায়ক – ১০
১১. দেশনায়ক – ১১
১২. দেশনায়ক – ১২
১৩. দেশনায়ক – ১৩
১৪. দেশনায়ক – ১৪
১৫. দেশনায়ক – ১৫
১৬. দেশনায়ক – ১৬
১৭. দেশনায়ক – ১৭
১৮. দেশনায়ক – ১৮
১৯. দেশনায়ক – ১৯
২০. দেশনায়ক – ২০
২১. দেশনায়ক – ২১
২২. দেশনায়ক – ২২
২৩. দেশনায়ক – ২৩
২৪. দেশনায়ক – ২৪
২৫. দেশনায়ক – ২৫
২৬. দেশনায়ক – ২৬
২৭. দেশনায়ক – ২৭
২৮. দেশনায়ক – ২৮
২৯. দেশনায়ক – ২৯
৩০. দেশনায়ক – ৩০
৩১. দেশনায়ক – ৩১
৩২. দেশনায়ক – ৩২
৩৩. দেশনায়ক – ৩৩
৩৪. দেশনায়ক – ৩৪
৩৫. দেশনায়ক – ৩৫
৩৬. দেশনায়ক – ৩৬
৩৭. দেশনায়ক – ৩৭
৩৮. দেশনায়ক – ৩৮
৩৯. দেশনায়ক – ৩৯
৪০. দেশনায়ক – ৪০
৪১. দেশনায়ক – ৪১
৪২. দেশনায়ক – ৪২
৪৩. দেশনায়ক – ৪৩
৪৪. দেশনায়ক – ৪৪
৪৫. দেশনায়ক – ৪৫
৪৬. দেশনায়ক – ৪৬
৪৭. দেশনায়ক – ৪৭
৪৮. দেশনায়ক – ৪৮
৪৯. দেশনায়ক – ৪৯
৫০. দেশনায়ক – ৫০

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন