১৯৭৯ সালের ঘটনা। এক আমেরিকান ঐতিহাসিক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে সুভাষচন্দ্রের ওপর একটি বক্তৃতা দিতে এসেছিলেন। ভারতবর্ষের জাতীয় আন্দোলনের বিষয়ে তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ এবং নেতাজি সুভাষচন্দ্র সম্বন্ধে গবেষণার জন্যে তিনি ইতিমধ্যেই আমাদের কাছে বেশ পরিচিত। বক্তৃতার বিষয়বস্তু ছিল ‘Myths of a Hero’। তিনি ১৯৪৫-এর পরবর্তীকালে নেতাজি সুভাষ সম্পর্কে প্রচলিত গল্প ও কাহিনী কেমনভাবে কাজে লাগানো হয়েছে সে বিষয়ে আলোচনা করেছিলেন। কিন্তু তিনি হতাশ বিস্ময়ে লক্ষ্য করেন যে, শ্রোতারা তাঁর বক্তৃতায় কোনওরকম উৎসাহ-আগ্রহ বোধ করছেন না। সভা শেষ হলে ইতিহাস বিভাগের এক প্রবীণ অধ্যাপক, যিনি তাঁকে আমন্ত্রণ করেছিলেন, তাঁকে বলেন, “পরের বার বলতে এলে শুধুমাত্র উত্তেজনাবর্জিত নিরুত্তাপ তথ্য (cold, hard facts) পরিবেশন করবেন।” ওই বক্তা ছিলেন লিওনার্ড এ. গর্ডন (Leonard A. Gordon)। এঁর সম্প্রতি প্রকাশিত গ্রন্থ, ‘Brothers Against the Raj’ শরৎচন্দ্র ও সুভাষচন্দ্রের জীবন ও ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে দু’ভায়ের সংগ্রাম সম্বন্ধে অনেক নতুন তথ্য ও আলোচনায় সমৃদ্ধ। গর্ডন হতাশ হয়েছিলেন শ্রোতাদের মনোভাবে। অতীত দিনের সাধু, সন্ত, কিংবদন্তি ভারতের মহান ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এবং সুভাষচন্দ্রের জীবন ও কীর্তি তারই সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে, এই সত্যটুকু শ্রোতারা বুঝতে পারছেন না দেখে তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। গর্ডনের দৃষ্টিভঙ্গি ও ক্ষোভের সঙ্গে ঐতিহাসিকেরা অনেকেই হয়তো একমত হবেন না। কিন্তু তাঁর কথাটা ভাববার মতো নিশ্চয়।
সুভাষচন্দ্রের জীবন কাহিনী সত্যিই আজ ভারতবর্ষের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে কিংবদন্তির রূপ নিয়েছে। কিন্তু এই কিংবদন্তির বৈশিষ্ট্য হল—এ এক ঐতিহাসিক কিংবদন্তি। উত্তেজনা ও উত্তাপ বাদ দিলেও, মূলত কিংবদন্তির মহানায়কের জীবন, কর্ম ও সাধনার চমকপ্রদ ইতিহাস তথ্যনির্ভর। তবে, অস্বীকার করবার উপায় নেই যে, নেতাজি সুভাষচন্দ্র ইতিহাসে ও জনমানসে যতটা উজ্জ্বল ও প্রতিষ্ঠিত, দেশের মাটিতে স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর ভূমিকা তুলনামূলকভাবে আজও অজানা। অথচ ওই সুভাষচন্দ্র বসুকে না জানলে ও বুঝলে নেতাজি সুভাষচন্দ্রকে সঠিকভাবে জানা ও বোঝা সম্ভব নয়। ১৯৪১-এর আগের সুভাষচন্দ্র, পরবর্তী কয়েক বছরের ‘নেতাজি’র চেয়ে কম আকর্ষণীয় চরিত্র নন। সুভাষচন্দ্র ও নেতাজি সুভাষচন্দ্র এক মহাজীবনের ও রুদ্ধশ্বাস নাটকের দুটি অধ্যায় ও অঙ্কমাত্র।
সুভাষচন্দ্র তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ‘ভারত পথিক’ (An Indian Pilgrim) লিখেছিলেন ১৯৩৭ সালের ডিসেম্বর মাসে, অষ্ট্রিয়ার বাদগাস্টাইন স্বাস্থ্যনিবাসে। মাত্র দশদিনের অবসরে ন’টি পরিচ্ছেদ লিখেছিলেন। ইচ্ছা থাকলেও আত্মজীবনী লেখাটি আর শেষ করতে পারেননি। কিন্তু যেটুকু লিখেছিলেন তার মূল্য অসীম। এটি খুঁটিয়ে মন দিয়ে না পড়লে সুভাষচন্দ্র কেন ও কীভাবে পরবর্তীকালে ‘নেতাজি সুভাষচন্দ্র’ হয়েছিলেন তা বোঝা সম্ভব নয়। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ছোটবেলায় মনের ওপর যে ছাপ পড়ে তা দীর্ঘস্থায়ী হয়। সে ছাপ ভাল বা মন্দ যাই হোক না কেন বাড়ন্ত শিশুর ওপর তার প্রভাব খুব গভীর। তাঁর নিজের জীবনে এটি সোল আনা সত্যি ছিল। তাই তাঁর আত্মজীবনীতে তাঁর শৈশব ও কৈশোরের দিনগুলি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে, আপাত ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ ঘটনাও তিনি উল্লেখ করেছেন। বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন কেমনভাবে তা তাঁর জীবন ও দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে প্রভাব বিস্তার করেছে। ‘Morning shows the day’ কথাটা সব সময়ে সত্যি হয় না। সকাল বেলার মেঘলা আকাশের পর বেলা হলে ঝলমলে রোদ্দুর ওঠে। আবার ভোরের মেঘমুক্ত সূর্যোদয়ের পর সারাদিন জলবৃষ্টি হয়। কিন্তু সুভাষচন্দ্রের ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। শৈশব ও কৈশোরের সুভাষের মধ্যে পরবর্তীকালের দেশনেতা সুভাষকে খুঁজে পেতে কোনও অসুবিধা হয় না।
১৮৯৭ সালের ২৩ জানুয়ারি ওড়িশার কটক শহরে সুভাষচন্দ্রের জন্ম। বাবা জানকীনাথ বসু জন্মেছিলেন কলকাতার অনতিদূর কোদালিয়া গ্রামে। মা প্রভাবতী ছিলেন কলকাতার হাটখোলা দত্ত বাড়ির মেয়ে। ১৮৭৯ সালে উনিশ বছর বয়সে জানকীনাথ ভাগ্যান্বেষণে কটকে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। অল্পসময়ের মধ্যেই আইনজীবী রূপে পিতার সাফল্য ও সামাজিক প্রতিষ্ঠালাভ সম্পর্কে সুভাষচন্দ্র লিখেছেন যে, জানকীনাথের সাফল্য প্রমাণ করে সাহসী ব্যক্তিদের প্রতিই ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়। কথাটি তাঁর নিজের জীবনেও বহুলাংশে সত্যি।
জানকীনাথের পিতা হরনাথ বসু বংশমর্যাদাসম্পন্ন পরিবারভুক্ত হলেও বিত্তশালী ছিলেন না। কিন্তু তাঁর চারপুত্ৰই সামাজিক ও আর্থিক ক্ষেত্রে উন্নতি করেছিলেন ও ইংরাজি শিখেছিলেন। ১৯০১ সালে জানকীনাথ কটক মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। কয়েক বছর পর সরকারি উকিল ও ‘পাবলিক প্রসিকিউটর’-এর পদ পান। ১৯১২ সালে বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য হন ও ‘রায়বাহাদুর’ খেতাব পান। বলা বাহুল্য যে পদোন্নতি ও খেতাবের পিছনে ছিল রাজ আনুকূল্য। ১৯১৭ সালে তিনি উভয় সরকারিপদেই ইস্তফা দেন। কারণ, জেলা শাসকের সঙ্গে মতবিরোধ। ১৯৩০ সালে সরকারি দমননীতির প্রতিবাদে তিনি ‘রায়বাহাদুর’ খেতাব বর্জন করেন। তার মধ্যে অবশ্য বহু ঘটনা ঘটেছিল। স্বাধীনতা আন্দোলন অনেক ব্যাপক ও তীব্র হয়েছে। দুই পুত্র শরৎচন্দ্র ও সুভাষচন্দ্র ওই আন্দোলনের পুরোভাগে এসে পড়েছেন। জানকীনাথ সম্বন্ধে আরও কিছু তথ্য প্রাসঙ্গিক কেননা পুত্র সুভাষচন্দ্রের মানসিক গঠন ও চারিত্রিক বিবর্তনের সঙ্গে তা সম্পর্কিত। জানকীনাথের জীবনধারা ও দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে ভারতীয় ও ইউরোপীয় সংস্কৃতির এক মিশ্রণ ঘটেছিল। তিনি ইংরাজি সাহিত্য, ব্রিটিশ ‘উদারনীতি’, সাহেবি সাজপোশাক পছন্দ করতেন। অন্যদিকে তিনি ভারতীয়, হিন্দু ও বাঙালি বলে গর্ববোধ করতেন। ব্রাহ্মসমাজের প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। জানকীনাথ ‘সাহেব’ বলে পরিচিত হলেও সকল শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে তিনি সহজভাবে মেলামেশা করতে পারতেন। ইংরাজ শাসনের কিছু কিছু সুফল সম্বন্ধে তিনি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তাঁর মধ্যে একটা আনুগত্যবোধ ছিল। জানকীনাথের হৃদয় ছিল কোমল। দয়া-দাক্ষিণ্যের জন্যে তাঁর সুনাম ছিল। তিনি শ্রীরামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দেরও অনুরাগী ছিলেন। তাঁর স্ত্রী প্রভাবতী দেবীর কেতাবী শিক্ষা তেমন না থাকলেও তিনি নিজে পড়াশোনা করেছিলেন। বাংলা লিখতে ও পড়তে জানতেন। পরে তিনি অল্পস্বল্প ইংরাজিও শিখেছিলেন। তাঁর মনোবল ও ইচ্ছাশক্তি ছিল প্রবল। কঠোর নিয়মশৃঙ্খলায় বিশ্বাস করতেন। তাঁর পছন্দ-অপছন্দ ছিল সুস্পষ্ট। যে কোনও কাজ নিখুঁতভাবে করা তিনি পছন্দ করতেন। তিনি খুব বুদ্ধিমতী ছিলেন। তাঁর বাস্তবতাবোধ ও বিচারবুদ্ধি ছিল তীক্ষ্ণ। ১৯১২ সালে সুভাষচন্দ্রের পিতা-মাতা দু’জনেই বাগবাজারের পণ্ডিত শ্যামনাথ ভট্টাচার্যের কাছে দীক্ষা নেন। শ্যামনাথের মৃত্যুর কয়েক বছর পর জানকীনাথ ও প্রভাবতী পূর্ব বাংলার হিমাইতপুরের ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের (অনুকূলচন্দ্র চক্রবর্তী) কাছে পুনরায় দীক্ষা নেন। ক্রমে ক্রমে জানকীনাথের ধর্মভাব আরও বৃদ্ধি পায়। ১৯২২ সালে ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র জানকীনাথের বিশেষ অনুরোধ পুরীতে তাঁর বাড়িতে কিছুদিন ছিলেন।
বাড়ির ও পারিবারিক পরিবেশ, বাবা ও মা’র চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও মানসিকতা এবং তাঁদের সঙ্গে সম্পর্ক সুভাষচন্দ্রের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল। তিনি এই প্রসঙ্গে বলেছেন যে, পারিবারিক পরিবেশের জন্যে তাঁর মধ্যে স্বার্থপরতা বা লোভের প্রবৃত্তি জন্মায়নি। অতিরিক্ত প্রশ্রয় না পাওয়া ও বিলাসিতার মধ্যে মানুষ না হওয়ার জন্যে ছেলেমেয়েদের মধ্যে ঔদ্ধত্য, উন্নাসিকতা দেখা দেয়নি। শরৎচন্দ্র বন্ধুদের বলতেন যে তিনি তাঁর বাবার কাছ থেকে উচ্চাকাঙক্ষা ও মা’র কাছে নিয়মানুবর্তিতা পেয়েছিলেন। নিজের পরিবার, বিশেষ করে বাবা-মা’র সাহচর্য ও শিক্ষার ফলেই সুভাষচন্দ্রের মনে কোনও সঙ্কীর্ণতা বা প্রাদেশিকতা জন্মায়নি। তিনি এই কথার উল্লেখ করে লিখেছেন যে পিতা-মাতার প্রভাব সন্তানের জীবনে গোপনে কাজ করে। পরবর্তী জীবনে বিশ্লেষণ করলে ছেলে-মেয়েরা বুঝতে পারে তাদের জীবনের লক্ষ্য ও চরিত্র গঠনে তারা কতটা বাবা-মা’র সাহায্য পেয়েছে।
বাবা এবং মা’র সঙ্গে কৈশোর ও যৌবনে সুভাষচন্দ্রের সম্পর্ক ও তাঁদের প্রতি তাঁর মনোভাব ছিল কিছুটা জটিল ও স্ববিরোধী। ছোটবেলায় সুভাষচন্দ্র খেলাধুলা করতে ভালবাসতেন না। শুধু ড্রিল করাই তাঁর পছন্দ ছিল। এর অন্যতম কারণ ছিল তাঁর বাবা ও মা স্কুলের ছুটির পর ছেলেরা বাইরে খেলতে যাবে তা চাইতেন না। এতে লেখাপড়ার ক্ষতি হবে বলে তাঁরা মনে করতেন। অন্যান্য কেউ কেউ তাঁদের না জানিয়ে খেলতে যেত। কিন্তু সুভাষচন্দ্র কখনও তা করেননি। তার কারণ তাঁর স্বভাব ছিল শান্ত ও নিরীহ। তাছাড়া, পিতা-মাতাকে মান্য ও সন্তুষ্ট করা উচিত, ‘পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম’, ‘মাতা স্বর্গের চেয়েও গরীয়সী’ ইত্যাদি আপ্তবাক্য, উপদেশ তিনি গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন। বাবা ও মা অসন্তুষ্ট হবেন এমন কাজ করা তিনি অনুচিত মনে করতেন। কিন্তু একই সঙ্গে কিশোর সুভাষের এক বিদ্রোহী মন ছিল। নিজের আদর্শ, সব কিছু বাধা বিঘ্ন উপেক্ষা করে মানবসেবার ব্রত কার্যকর করতে তিনি স্থিরপ্রতিজ্ঞ ছিলেন। এর জন্যে বাবা-মা’র ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করতেও তাঁর দ্বিধা ছিল না।
একটু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি পিতা-মাতাকে মান্য করার উপদেশগুলির বদলে যেসব সংস্কৃত শ্লোকে ‘বিদ্রোহের’ কথা ছিল সেগুলির প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকেন। মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করলেও তিনি নিজের আদর্শের জন্যে সবকিছু করতে প্রস্তুত ছিলেন। বাবা-মা তাঁকে সংযত করতে চেষ্টা করতেন। বাবা বোঝাতেন। মা কান্নাকাটি করতেন। তবু সুভাষচন্দ্র নিজের সঙ্কল্পে অচল থাকতেন। তাঁরা যত বাধা দিতেন তিনি ততই বিদ্রোহী হয়ে উঠতেন। সুভাষের হৃদয়ে স্কুল জীবনেই নিজের মুক্তিসাধন, পার্থিব আকাঙক্ষামুক্তি ও মানবসেবার বাসনার আগুন জ্বলতে শুরু করে। পিতা-মাতার বাধ্য হওয়াই একটা ধর্ম, এই বিশ্বাস তাঁর শিথিল হয়ে যায়। সুভাষচন্দ্র তাঁর তখনকার মানসিক অবস্থা প্রসঙ্গে লিখেছেন, “আমার মধ্যে বরং এই রকম একটা ভাব এসেছিল যে, যে কোন দিক থেকেই আসুক না কেন, আমার লক্ষ্যপথের প্রতিটি বাধাকে অগ্রাহ্য করতে হবে।” ভবিষ্যতের নির্ভীক রাষ্ট্রনেতা সুভাষচন্দ্রের ও নেতাজি সুভাষচন্দ্রের বীজ কিশোর সুভাষের হৃদয়ে তখনই অঙ্কুরিত হতে শুরু করেছে। কয়েক বছর পরে সুভাষচন্দ্র যখন আই সি এস থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন তখন তাঁর মানসিক অস্থিরতা ও যন্ত্রণা তীব্রতর হয়েছিল। তাঁর বাবা, মা ও পরিবারের অন্যান্যরা কতখানি ক্ষুব্ধ, হতাশ এবং মর্মাহত হয়েছেন তা তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। ১৯২১ সালের ৬ এপ্রিল অক্সফোর্ড থেকে মেজদাদা শরৎচন্দ্রকে লেখা চিঠিতে সুভাষচন্দ্র তাঁর মানসিক দ্বন্দ্ব ব্যক্ত করে লিখেছিলেন, “একটি চিন্তা আমাকে পেয়ে বসেছে তা হল কিভাবে বাবা-মা’র প্রতি এবং আমার নিজের প্রতি কর্তব্যপালনে একটা সমন্বয় সাধন করা যায়…অতীতে আমি শুধু বাবা-মা’র নয়, অন্য অনেকের এমনকি আপনারও গভীর দুঃখের কারণ হয়েছি। সেজন্য আমি নিজেকে কখনও ক্ষমা করিনি, ভবিষ্যতেও করব না।…জ্ঞানগতভাবে ও নৈতিকভাবে বিদ্রোহ করা ছাড়া আমার অন্য কোনও উপায় ছিল না।” দু’ সপ্তাহ পরে লেখা (২০ এপ্রিল) আর একটি চিঠিতে তিনি তাঁর সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় ও প্রিয় মেজদাদাকে লেখেন, “কত অন্তরে আমি ব্যথা দিয়েছি, কত গুরুজনের অবাধ্যতা করেছি, আমি জানি। কিন্তু এই বিপদসঙ্কুল কর্মক্ষেত্রে অবতীর্ণ হওয়ার আগে আমার একমাত্র প্রার্থনা—তা যেন আমার প্রিয় দেশের মঙ্গলের জন্যই হয়।”
সুভাষচন্দ্রের ছাত্রজীবন, সেই কটকের মিশনারি স্কুল থেকে শুরু করে কেমব্রিজে ‘মানসিক ও নীতি বিজ্ঞান’-এ (Mental and Moral Sciences) ট্রাইপোজের (Tripos) জন্যে পড়াশোনা করা পর্যন্ত ছিল ঘটনাবহুল ও চমকপ্রদ। ছাত্রজীবনের বিভিন্ন ঘটনার ও অভিজ্ঞতার স্থায়ী প্রভাব ছিল তাঁর জীবনে। পাঁচ বছর বয়সে (১৯০২) সুভাষচন্দ্র কটকের প্রটেস্টান্ট ইউরোপীয় স্কুলে (পি.ই. স্কুল) ভর্তি হন। তাঁর অন্য সব ভাই বোনেরাও এই স্কুলে পড়েছিলেন। ভাল করে ইংরাজি শিখবে বলেই বাবা-মা ছেলেমেয়েদের এই স্কুলে পাঠাতেন। স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের বেশির ভাগই ছিল ইউরোপীয় ও অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। শতকরা মাত্র পনেরো জন ছিল ভারতীয়। ইংরাজি ছাড়া ছাত্রছাত্রীরা আচার-আচরণ, পরিচ্ছন্নতা, সময়ানুবর্তিতা ও নিয়মানুবর্তিতা শিখত স্কুলে। পাঠ্যসূচী সুভাষচন্দ্রের তেমন পছন্দ না হলেও তিনি স্কুলে অসুখী ছিলেন না। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের তাঁর ভাল লাগত। তাঁদের তিনি শ্রদ্ধা করতেন। কিন্তু শ্বেতাঙ্গ ছাত্রছাত্রী ও ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে কিছু বৈষম্য ছিল যা সুভাষচন্দ্রের পছন্দ হয়নি। ছেলেদের মধ্যে ঝগড়া ও মারামারি হলে স্কুল কর্তৃপক্ষ জাতিগত ভিত্তিতে পক্ষপাতিত্ব করতেন। এটা তিনি মন থেকে মেনে নিতে পারেননি।
একটু বড় হবার পর কিশোর সুভাষ একটা সূক্ষ্ম যন্ত্রণাবোধ করতে থাকেন। স্কুলের পরিবেশ মেনে নিতে মন চায়নি। কোনও ভারতীয় স্কুলে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছা প্রবল হয়। শেষপর্যন্ত ১৯০১ সালে সুভাষ পি. ই. স্কুল ছেড়ে কটকের র্যাভেন শ’ কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। পি. ই. স্কুলেই খুব অল্প বয়সে সুভাষচন্দ্র বর্ণবৈষম্য ও জাতিগত পক্ষপাতিত্বের প্রথম অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। এই অন্যায় বৈষম্যের বিরুদ্ধে তাঁর মন বিদ্রোহী হয়ে উঠে। এই ধরনের ইংরাজ-ঘেঁষা মনোভাবাপন্ন পাঠ্যক্রম ও পরিবেশে পড়াশোনা করা ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে ক্ষতিকর বলে তাঁর বিশ্বাস জন্মায়। শৈশবেই জোর করে ছেলেমেয়েদের ওপর ‘ইংরাজি শিক্ষা’ চাপিয়ে দেওয়ার তিনি বিরোধী ছিলেন। নিজেদের বিচার বুদ্ধি ও পাশ্চাত্যের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসার পরই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের প্রকৃত সুস্থ সাংস্কৃতিক মিলন আত্মস্থ করা সম্ভব বলে তিনি মনে করতেন। আজ প্রায় একশ বছর পরেও সুভাষচন্দ্রের এই অভিমতের প্রাসঙ্গিকতা এতটুকু কমেনি বরং বেড়েছে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন