দেশনায়ক – ১৮

কলকাতা কর্পোরেশনের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার পদে যোগদানের পর সুভাষচন্দ্র ‘ফরওয়ার্ড’-এর সম্পাদনার দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন। কোনও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করলে তিনি একাগ্র মনে সেই কাজ করতেন। ঘোর আপত্তি থাকলেও, কর্পোরেশনের দায়িত্বভার গ্রহণের পর তাই তিনি রাজনীতি সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ করেছিলেন। পৌরসভার কাজেই দিনরাত ব্যস্ত থাকতেন। রাজনৈতিক তৎপরতার সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ কোনও সম্পর্ক ছিল না। তবুও তাঁর সম্পর্কে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের গভীর সন্দেহ ছিল। তাঁর জনপ্রিয়তা, কর্পোরেশনে তাঁর নীতি ও কর্মসূচী, সাংগঠনিক ক্ষমতা, ব্রিটিশ শাসন-বিরোধী মনোভাব ও স্বাধীনতা স্পৃহা শাসকগোষ্ঠী ও পুলিশের কর্মকর্তাদের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠছিল। এঁদের মধ্যে যাঁর রোষানলে তিনি সবচেয়ে বেশি পড়েছিলেন তিনি হলেন কলকাতার কুখ্যাত পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্ট। বাংলার বিপ্লবীদের দৃষ্টিতে টেগার্ট ছিলেন এক নম্বর গণশত্রু। টেগার্টের স্থির বিশ্বাস ছিল যে, বিপ্লবীদের সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের গোপন যোগাযোগ আছে। তিনি আসলে নিজেও সন্ত্রাসবাদী ও সন্ত্রাসের সমর্থক। টেগার্টের ওই সন্দেহ বদ্ধমূল হল গোপীনাথ সাহার ঘটনাকে কেন্দ্র করে।

তরুণ বিপ্লবী ছাত্র গোপীনাথ সাহা টেগার্টকে হত্যার চেষ্টা করেন, কিন্তু ভুলবশত টেগার্টের বদলে আর্নেস্ট ডে নামে অন্য এক ইংরেজ তাঁর গুলিতে প্রাণ হারায়। আদালতে বিচারের সময় গোপীনাথ ভুল করে অন্য একজনকে হত্যা করার জন্যে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, তাঁর লক্ষ্য ছিল টেগার্ট। তিনি আশা প্রকাশ করেন, তাঁর প্রতিটি রক্তবিন্দু থেকে দেশের ঘরে ঘরে স্বাধীনতার বীজ উপ্ত হবে। বিচারে গোপীনাথের মৃত্যুদণ্ড হয়। ফাঁসির মঞ্চে দেশের স্বাধীনতার জন্যে আত্মোৎসর্গ করে গোপীনাথ শহীদ হন। গোপীনাথের আত্মবলিদান জনসাধারণকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। যাঁরা সন্ত্রাসবাদের বিরোধী, কোনও কারণেই হিংসার পথ সমর্থন করেন না তাঁরাও শহীদ গোপীনাথের সাহস, মনোবল ও দেশের স্বাধীনতার জন্যে চরম মূল্য দেওয়ার দ্বিধাহীন সঙ্কল্পে মুগ্ধ হন। গোপীনাথ সাহার বিচার ও ফাঁসি সুভাষচন্দ্রকে বিচলিত করে। ফাঁসির দিন সকালে সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায় সুভাষচন্দ্রের অফিসঘরে গিয়ে দেখেন দেওয়ালে টাঙানো একটি ভারতবর্ষের মানচিত্রের দিকে তাকিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন, আর গুনগুন করে গাইছেন, “তোমার পতাকা যারে দাও—তারে বহিবারে দাও শকতি”। সাবিত্রীপ্রসন্ন অবাক ! ইতিপূর্বে তিনি সুভাষচন্দ্রকে কখনও গান গাইতে শোনেননি। তিনি কখন ঘরে ঢুকেছেন তাও সুভাষচন্দ্র লক্ষ্য করেননি। একটু পরে যখন মুখ ফিরিয়ে তাকালেন তখন তাঁর মূর্তি দেখে সাবিত্রীপ্রসন্ন চমকে উঠলেন। “সারা মুখে যেন কে সিঁদুর ঢেলে দিয়েছে। অনেকক্ষণ ধরে গুমরে গুমরে কাঁদলে যেমন মুখের চেহারা হয়—ঠিক তেমনি। দু’ চোখের কোণে জল।” অফিসে তখনও লোকজন আসেনি। আবেগ-কম্পিত ভারী কণ্ঠে সুভাষচন্দ্র বললেন, “গোপীনাথ সা’র ফাঁসি হয়ে গেল—জেলের গেট থেকেই বরাবর এখানে আসছি।” আর কোনও কথা বললেন না। সাবিত্রীপ্রসন্ন লিখেছেন, “সুভাষবাবুকে এমন বিচলিত, এমন ব্যথাতুর, এমন ক্লান্ত যেন আমি এর আগে কখনও দেখিনি। দেখলাম তিনি স্নান সমাধা করেছেন—পরিধানে শুভ্র খদ্দরের ধুতি, পাঞ্জাবি ও চাদর—যেন তিনি বিশেষ কোনও উৎসব-অনুষ্ঠান থেকে ফিরছেন।”

একেবারে প্রত্যুষে সত্যিই এক মর্মস্পর্শী অনুষ্ঠানে সুভাষচন্দ্র যোগ দিয়ে এসেছিলেন। গোপীনাথের শেষকৃত্যের ব্যবস্থা প্রেসিডেন্সি জেলের ভেতরের এলাকায় হয়েছিল। সুভাষচন্দ্র, পূর্ণ দাস ও বহু ছাত্র শেষ কাজে যোগ দেবার জন্যে গিয়েছিলেন। কিন্তু প্রবেশপত্র না পাওয়ায় জেলের ভিতরে যেতে পারেননি। যখন শহীদ গোপীনাথের জামাকাপড় নিয়ে তাঁর দাদা জেলের বাইরে আসেন তখন সুভাষচন্দ্র তা স্পর্শ করেন। বলা বাহুল্য, সবকিছুর ওপর গোয়েন্দা বিভাগের কঠোর নজর ছিল। যাঁরা এদিন জেলের গেটে যাবেন, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে গোপীনাথ তথা বিপ্লবী আন্দোলনের প্রতি কোনওরকম সমর্থন বা সহানুভূতি জানাবেন, তাঁরা যে সরকারের চোখে সন্দেহভাজন হয়ে উঠবেন তা সুভাষচন্দ্রের অজানা ছিল না। কিন্তু ব্যক্তিসন্ত্রাস ও সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ নীতিগতভাবে সমর্থন না করলেও নিজের অনুভূতি, মৃত্যুঞ্জয়ী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাতে সুভাষচন্দ্রের কোনও দ্বিধা, ভয় ছিল না। সিরাজগঞ্জ সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে সন্ত্রাসবাদের নিন্দা করা হলেও গোপীনাথ সাহার সাহস, স্বদেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের প্রশংসা করে প্রস্তাব গৃহীত হয়। সুভাষচন্দ্র ওই সম্মেলনে যোগ দেননি। জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে কিন্তু গোপীনাথ সাহা সম্পর্কে অনুরূপ প্রস্তাব অনুমোদিত হয়নি। অহিংস আন্দোলনে বিশ্বাসী কট্টর গান্ধীপন্থীরা প্রস্তাবটির বিরোধিতা করেন। এর ফলে স্বরাজ্য দল ও বিপ্লবীদের সঙ্গে তাঁদের মতভেদ আরও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু স্বরাজ্য দল কংগ্রেসের বহির্ভূত কোনও স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়নি। কংগ্রেসের ‘পরিবর্তন-বিরোধী’ নেতাদের সঙ্গে স্বরাজ্যপন্থী নেতাদের ব্যক্তিগত সৌহার্দ্য, যোগাযোগ ও আলোচনা অব্যাহত থাকে। গান্ধীজি কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে উপলব্ধি করেন যে, বাস্তব পরিস্থিতিতে নীতির পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে পড়েছে। দেশবন্ধুর নেতৃত্বে স্বরাজ্যপন্থীদের শক্তি ও মর্যাদা এত বৃদ্ধি পেয়েছে যে, তাঁদের সঙ্গে একটা বোঝাপড়ায় আসা জরুরি হয়ে পড়েছে। এর ফলে তিনি দেশবন্ধু ও মতিলাল নেহরুর সঙ্গে এক আপস-মীমাংসা করেন। স্থির হয় যে, রাজনৈতিক আন্দোলনের ভার থাকবে স্বরাজ্যপন্থীদের ওপর। গান্ধীজি নিজেকে সম্পূর্ণভাবে খাদি আন্দোলনে নিয়োজিত করবেন। এই বোঝাপড়া ‘গান্ধী-দাশ’ চুক্তি নামে পরিচিত হয়। গান্ধীজি অবশ্য জাতীয় কংগ্রেস এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণে তাঁর প্রভাব হারাননি।

স্বরাজ্য দলের শক্তি ও প্রভাব বৃদ্ধিতে ভারত সরকার ও বাংলা সরকার ক্রমেই উদ্বিগ্ন বোধ করছিল। বাংলায় দেশবন্ধুর বিশ্বস্ত সহযোদ্ধা ছিলেন সুভাষচন্দ্র। তাঁর ওপর বাংলার সাহেব আমলারা, বিশেষ করে টেগার্ট অত্যন্ত রুষ্ট হচ্ছিলেন। গোপীনাথ সাহার ঘটনা টেগার্টকে আরও ক্রুদ্ধ করেছিল। এরপর আর একটি ঘটনা ঘটল। পুজোর পরে, ভোরবেলা কর্পোরেশনের রাস্তায় জল দেওয়া কর্মীরা পার্ক স্ট্রিটের ফুটপাথের পাইপ খুলে রাস্তা ধুচ্ছে। (তখন কলকাতার রাস্তায় জল দিয়ে ধোয়ার ব্যবস্থা ছিল ।) অত ভোরে রাস্তায় লোকজন খুব কম। হঠাৎ গুলির আওয়াজ। দেখা গেল, একজন কর্পোরেশন কর্মী গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে গেছেন। রক্ত ঝরে পড়ছে। কর্পোরেশন অফিসে খবর গেল। সুভাষচন্দ্র খবর দিলেন পুলিশে। খোঁজ-তল্লাশি করে দোষীকে খুঁজে বার করতে হবে। পার্ক স্ট্রিট সাহেব-পাড়া। রাস্তার দু’পাশের বড় বড় বাড়ির বাসিন্দারা প্রায় সবাই ব্রিটিশ বা ইউরোপীয়। অধিকাংশেরই বন্দুক বা রিভলবারের লাইসেন্স আছে। কোন বাড়ির কোণা থেকে গুলি ছোঁড়া হয়েছে তা খুঁজে বার করা, সাক্ষী-সাবুদ যোগাড় করা সহজ নয়। সুতরাং পুলিশের দিক থেকে তেমন কোনও আগ্রহই দেখা গেল না। তাছাড়া, নিহত হয়েছেন একজন অতি সাধারণ, কর্মী, ‘কালা আদমি’। সুভাষচন্দ্র কিন্তু সহজে ছেড়ে দেবার পাত্র নন। দাবি করলেন, কর্তব্যরত অবস্থায় নিহত পৌরকর্মীর পোষ্যদের অর্থসাহায্যের ব্যবস্থা করতে হবে সরকারকে, অকর্মণ্য পুলিশ বিভাগকে। যথাযথ প্রতিকার না হলে পুলিশ তথা সরকারের বিরুদ্ধে কলকাতা কর্পোরেশন আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এই ঘটনা সুভাষচন্দ্রের বিরুদ্ধে সরকার এবং টেগার্টের রোষানলে ঘৃতাহুতির কাজ করল। স্বরাজ্য দলের সাফল্যে, সাধারণ মানুষের মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনার সুস্পষ্ট জোয়ার রোধ করার জন্যে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়ল। কিন্তু স্বরাজ্য দল এমন কোনও আইন-বিরুদ্ধ কাজ বা আন্দোলন করেনি যে অভিযোগে দলের নেতা বা কর্মীদের আদালতে অভিযুক্ত করা যায়। তাই মরিয়া হয়ে ‘১৮১৮-র ৩ নং ধারা’ নামে একটি পুরনো আইনানুসারে বিনা বিচারে স্বরাজ্য দলের নেতৃস্থানীয় কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে কারারুদ্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। ১৯২৪ সালের ২৫ অক্টোবর ভোরে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হল। এঁদের মধ্যে ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু, অনিলবরণ রায় ও সত্যেন্দ্রনাথ মিত্র। সরকারের অজুহাত ছিল, দেশে সন্ত্রাসবাদ ও বিপ্লবীদের তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়ে অত্যন্ত বিপজ্জনক পরিস্থিতির সম্ভাবনা দেখা দেওয়ায় এই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সরকারের তাঁবেদার অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান কাগজ ‘দি স্টেটসম্যান’, ‘দি ইংলিশম্যান’ এবং ‘ক্যাথলিক হেরাল্ড’ অভিযোগ করল, সুভাষচন্দ্র এই ‘বিপ্লবী ষড়যন্ত্রের নায়ক’। সুভাষচন্দ্র ওই সংবাদপত্রগুলির বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেন। তাঁর হয়ে মামলা চালিয়েছিলেন শরৎচন্দ্র বসু। ‘ইংলিশম্যান’ ও ‘ক্যাথলিক হেরাল্ড’-এর বিরুদ্ধে তিনি জয়ী হয়েছিলেন। কাগজ দু’টিকে ক্ষতিপূরণের আদেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ‘স্টেটসম্যান’ বিস্ময়করভাবে অব্যাহতি পায়।

সরকারের অভিযোগ ছিল সর্বৈব মিথ্যা। ওই অভিযোগের পক্ষে কোনওরকম সাক্ষ্য-প্রমাণ দিতে সরকার ব্যর্থ হয়েছিল। স্পষ্টতই বোঝা গিয়েছিল যে, স্বরাজ্যপন্থীদের আঘাত হানা, কলকাতা পৌর শাসনে তাঁদের সাফল্য বানচাল করা এবং বিশেষ করে, সুভাষচন্দ্রকে কারারুদ্ধ করে রেখে তাঁকে অকর্মণ্য করে তোলাই ছিল ওইসব কিছুর মূল লক্ষ্য। প্রবল জনবিক্ষোভ দেখা দেওয়ায় সরকার সুভাষচন্দ্রকে মুক্তি দেবার কথা ভাবলেও পুলিশ কর্তৃপক্ষের প্রবল আপত্তিতে তা সম্ভব হয়নি। দেশবন্ধু অত্যন্ত ক্রুদ্ধ ও বিচলিত হয়েছিলেন। কলকাতা কর্পোরেশনের সভায় সুভাষ ও অন্যান্যদের গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে তিনি যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা আজও লোকের মুখে শোনা যায়। মেয়র রূপে তিনি বলেন, “আমি এইটুকু বলতে পারি, আমি যতটা বিপ্লবী সুভাষচন্দ্র বসু তার বেশি কিছু নন। ওরা (সরকার) আমাকে গ্রেপ্তার করছে না কেন? আমি জানতে চাই, কেন ? দেশকে ভালবাসা যদি অপরাধ হয়, তাহলে আমিও অপরাধী। এই পৌরসভার চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার শুধু নন, মেয়রও সমান অপরাধী।”

সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদী তথা বিপ্লবীদের ও বিপ্লব আন্দোলনের কতটুকু সম্পর্ক ছিল এই নিয়ে সরকারি কাগজপত্রে এবং পুলিশের রিপোর্টে অনেক লেখালেখি হয়েছিল। প্রমাণ থাকুক আর নাই থাকুক, সরকারের দৃষ্টিতে সুভাষচন্দ্র খুবই সন্দেহভাজন ছিলেন। স্বরাজ্য দলের শক্তি ও সাফল্য, কর্পোরেশনে সুভাষের ‘চিফ এক্সিকিউটিভ’ পদে নিয়োগ, অসহযোগ আন্দোলনের পর বিপ্লবী তৎপরতা বৃদ্ধি ইত্যাদি সবকিছুর পিছনে সুভাষচন্দ্র ও বিপ্লবী দলগুলির ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ কাজ করছে বলে সরকারি মহল সুনিশ্চিত ছিল। স্বয়ং দেশবন্ধুকেও সন্দেহের ঊর্ধ্বে মনে করা হত না। তাঁকেও বিপ্লবীদের প্রতি সহানুভূতিশীল বলে মনে করা হত। সংবাদপত্র-পত্রিকায় বিপ্লবী প্রচার সম্পর্কে এক পুলিশ রিপোর্টে সুভাষচন্দ্র পরিচালিত ‘আত্মশক্তি’ প্রসঙ্গে বলা হয়েছিল যে, বাংলাদেশে বিপ্লবী আন্দোলনের তিনি প্রধান সংগঠক। তাঁর সঙ্গে বিদেশের বিপ্লবীদের ও বলশেভিক প্রচারকদের যোগাযোগ আছে। পুলিশ অফিসারদের হত্যার ও অস্ত্রশস্ত্র গোপনে আমদানি করার সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ আছে। এই কাজে তিনি কপোরেশনের টাকা ব্যবহার করছেন। তিনি একজন ‘বিশিষ্ট কংগ্রেসি-কমিউনিস্ট’, এমন অভিযোগও তাঁর বিরুদ্ধে সরকারি রিপোর্টে করা হয়। এইসব গুরুতর অভিযোগের সপক্ষে আদালতে গ্রহণযোগ্য কোনও সাক্ষ্য-প্রমাণ ছিল না। থাকলে, সুভাষচন্দ্রকে দীর্ঘকাল বিনা বিচারে বন্দী না রেখে তাঁকে আদালতে অভিযুক্ত করে দীর্ঘমেয়াদী জেল, দীপান্তর বা আরও চরম শাস্তি দেবার চেষ্টা করতে টেগার্টের পুলিশ বিভাগ ছাড়ত না।

২৫ অক্টোবর খুব ভোরে ঘুম ভাঙিয়ে গ্রেপ্তার করার পর পুলিশ সুভাষচন্দ্রের বাড়ি তল্লাশি করে কিছুই পায়নি। তাঁকে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় আলিপুর নিউ সেন্ট্রাল জেলে। তাঁর মতো পদমর্যাদার ও বিখ্যাত ‘অতিথি’দের হঠাৎ থাকার ব্যবস্থা করতে জেল কর্তৃপক্ষ বেশ বিপাকে পড়েন। আলিপুর জেলে থাকাকালে সরকারি নির্দেশে জেলের মধ্যেই তিনি পৌরসভার কাগজপত্র, ফাইল ইত্যাদি দেখার ও প্রয়োজনীয় কাজ করার অনুমতি পান। তা না হলে কর্পোরেশনের কাজে অচল অবস্থা দেখা দিত। কিন্তু তাঁর সচিবের সঙ্গে কথাবার্তা বলার সময় একজন পুলিশ অফিসার ও জেলার উপস্থিত থাকতেন। এতে কাজকর্মের অসুবিধা হত এবং অভদ্র আচরণের জন্যে কোনও কোনও পুলিশ অফিসার সুভাষচন্দ্রের কাছে ধমক খেতেন। শাস্তিস্বরূপ সুভাষচন্দ্রকে বহরমপুর জেলে পাঠানো হয়। দু’ মাস পরে তাঁকে আবার কলকাতায় নিয়ে আসার আদেশ হল। আসার পথে তিনি জানলেন, আসলে তাঁকে সুদূর উত্তর বর্ষার মান্দালয় জেলে স্থানান্তরিত করা হচ্ছে। মাঝরাতে কলকাতায় পৌঁছে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল লালবাজারে। লালবাজারে সুভাষচন্দ্রের নরক দর্শন হয়েছিল। তাঁর ওই রাতের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি লিখেছেন, “ওই থানায় যে ঘরে আমাকে রাখা হয়েছিল তা ছিল একটি নোংরা অন্ধকূপ এবং মশা ও ছারপোকার কৃপায় নিমেষের জন্যও চোখের পাতা এক করা সম্ভব হয়নি। বাথরুমের অবস্থা ছিল নিদারুণ এবং গোপনীয়তা রক্ষার আদৌ কোনও ব্যবস্থা ছিল না। পৃথিবীতে নরক যদি কোথাও থাকে তা হল লালবাজার থানা—বহুশ্রুত এই কথাটির যাথার্থ্য আমি সেদিন উপলব্ধি করেছিলাম।”

পরের দিন ভোরের আলো ফোটার আগেই সুভাষচন্দ্র ও আরও সাতজন বন্দীকে প্রিজন ভ্যানে করে দ্রুত গতিতে নদীর ধারে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে সব বন্দীকে তিন ঘণ্টা একটি ছোট মোটর বোটে ‘নৌকা-বিহার’ করানোর পর একটি জাহাজে তোলা হল, অন্যদিক থেকে, গোপনে। আসলে আশঙ্কা ছিল সুভাষচন্দ্রকে বর্মার মান্দালয় জেলে পাঠানোর সংবাদ জানাজানি হলে বিক্ষোভ ও হাঙ্গামা হতে পারে। তাই অত সতর্কতা ও গোপনীয়তা। বন্দীদের মান্দালয় নিয়ে যাবার দায়িত্বে ছিলেন অ্যাসিস্টেন্ট ইন্স্পেক্টর জেনারেল অফ পুলিশ লোম্যান। জাহাজে ছিল কড়া পুলিশি পাহারা। তবু চারদিন পরে রেঙ্গুন পৌঁছবার আগের দিন রাতে লোম্যান এক ভয়ানক দুঃস্বপ্ন দেখেছিলেন—জাহাজ থেকে কয়েকজন রাজবন্দী পালিয়ে গেছেন। সুভাষচন্দ্র সত্যিই ইংরাজ সরকার ও পুলিশের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলেন সেই ১৯২৪ সালে। তখন তাঁর বয়স মাত্র সাতাশ, ‘নেতাজি’ হবার বহু পূর্বেই।

সকল অধ্যায়

১. দেশনায়ক – ১
২. দেশনায়ক – ২
৩. দেশনায়ক – ৩
৪. দেশনায়ক – ৪
৫. দেশনায়ক – ৫
৬. দেশনায়ক – ৬
৭. দেশনায়ক – ৭
৮. দেশনায়ক – ৮
৯. দেশনায়ক – ৯
১০. দেশনায়ক – ১০
১১. দেশনায়ক – ১১
১২. দেশনায়ক – ১২
১৩. দেশনায়ক – ১৩
১৪. দেশনায়ক – ১৪
১৫. দেশনায়ক – ১৫
১৬. দেশনায়ক – ১৬
১৭. দেশনায়ক – ১৭
১৮. দেশনায়ক – ১৮
১৯. দেশনায়ক – ১৯
২০. দেশনায়ক – ২০
২১. দেশনায়ক – ২১
২২. দেশনায়ক – ২২
২৩. দেশনায়ক – ২৩
২৪. দেশনায়ক – ২৪
২৫. দেশনায়ক – ২৫
২৬. দেশনায়ক – ২৬
২৭. দেশনায়ক – ২৭
২৮. দেশনায়ক – ২৮
২৯. দেশনায়ক – ২৯
৩০. দেশনায়ক – ৩০
৩১. দেশনায়ক – ৩১
৩২. দেশনায়ক – ৩২
৩৩. দেশনায়ক – ৩৩
৩৪. দেশনায়ক – ৩৪
৩৫. দেশনায়ক – ৩৫
৩৬. দেশনায়ক – ৩৬
৩৭. দেশনায়ক – ৩৭
৩৮. দেশনায়ক – ৩৮
৩৯. দেশনায়ক – ৩৯
৪০. দেশনায়ক – ৪০
৪১. দেশনায়ক – ৪১
৪২. দেশনায়ক – ৪২
৪৩. দেশনায়ক – ৪৩
৪৪. দেশনায়ক – ৪৪
৪৫. দেশনায়ক – ৪৫
৪৬. দেশনায়ক – ৪৬
৪৭. দেশনায়ক – ৪৭
৪৮. দেশনায়ক – ৪৮
৪৯. দেশনায়ক – ৪৯
৫০. দেশনায়ক – ৫০

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন