সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে ফরওয়ার্ড ব্লক দেশব্যাপী স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করার পক্ষে প্রচার ও অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির জন্যে চেষ্টা শুরু করে। অক্টোবর মাসে নাগপুরে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী এক সম্মেলনে সুভাষচন্দ্র ‘জনগণের হাতে ক্ষমতা চাই’ (All powers to the Indian people) ডাক দেন। ওই সময় তিনি চীন পরিদর্শনের জন্যে অনুমতির আবেদন করলে ভারত সরকারের গোয়েন্দা বিভাগ অসম্মতি জানায়। জাপানের আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে চীনের প্রতি সমর্থন এবং সহানুভূতি প্রকাশের জন্যে ১৯৩৮ সালে তিনি কংগ্রেস সভাপতিরূপে একটি ‘মেডিকেল মিশন’ পাঠাবার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। মিশনের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন ডাঃ অটল (নেতা), ডাঃ এন. কোটনিশ, ডাঃ এম. বি. চোলকার, ডাঃ দেবেশ মুখার্জী ও ডাঃ বি. কে. বসু। এঁদের মধ্যে ডাঃ কোটনিশের নাম চীনে তাঁর অক্লান্ত সেবা ও শেষপর্যন্ত সেবাকার্যেই মৃত্যুর জন্যে স্মরণীয় হয়ে আছে।
১৯৪০ সালের মার্চ মাসে রামগড়ে জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন বসে। সভাপতিত্ব করেন মৌলানা আজাদ। প্রায় একই সময় রামগড়ে, কংগ্রেস অধিবেশনের কাছেই, ফরওয়ার্ড ব্লক ও কিষাণ সভার যৌথ উদ্যোগে ‘নিখিল ভারত আপস-বিরোধী সম্মেলন’ (Anti-Compromise Conference) অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে স্থির হয় যে, সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে কোনওরকম সহযোগিতা ও সাহায্য না করার জন্যে জনগণকে বোঝাতে ব্যাপক আন্দোলন শুরু করা হবে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে রক্ষা করার জন্যে কোনওমতেই ভারতবর্ষের সম্পদকে ব্যবহার করার বিরোধিতা করতে হবে। এই সিদ্ধান্তমত এপ্রিল মাসে ফরওয়ার্ড ব্লক দেশব্যাপী যুদ্ধ-বিরোধী গণ-আন্দোলন শুরু করে। পক্ষান্তরে রামগড় কংগ্রেসে স্বাধীনতার দাবি পুনরায় করা হলেও কোনও গণ-আন্দোলনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি। প্রকৃতপক্ষে রামগড় কংগ্রেস অধিবেশনের তুলনায় ‘আপস-বিরোধী সম্মেলন’ অনেক বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ ও উৎসাহ সৃষ্টি করেছিল। বহু কংগ্রেসকর্মী এই সম্মেলনে যোগ দেন। সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, “সুভাষচন্দ্রকে নিয়ে সেখানে যে শোভাযাত্রা হয়েছিল সেটা কংগ্রেসের ইতিহাসে অদৃষ্টপূর্ব। যার ফলে চিরাচরিত প্রথা পরিহার করে আদি কংগ্রেসের সভাপতির শোভাযাত্রা বাহির করাই হল না।
সুভাষচন্দ্রের ফরওয়ার্ড ব্লকের জনপ্রিয়তা ও কংগ্রেস নীতিবিরোধী কার্যকলাপে জওহরলাল খুবই ক্ষুব্ধ হচ্ছিলেন। তিনি ভি. কে. কৃষ্ণ মেননকে তাঁর ক্ষোভের কথা জানিয়ে লেখেন (২ মার্চ, ১৯৪০), “সুভাষ বোস এখন টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ছেন এবং সুনিশ্চিতভাবে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন…সুভাষ বোসের মাথায় কোনও ধারণা আছে বলে মনে হয় না। বামপন্থী ও দক্ষিণপন্থীদের সম্পর্কে বক্তৃতার বাইরে তিনি যা কিছু বলছেন তা বোধগম্য নয়।” আসলে, জওহরলালের বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে বিশ্লেষণ ও দৃষ্টিভঙ্গি সুভাষচন্দ্রের সম্পূর্ণ বিরোধী ছিল। তাঁর কাছে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামের চেয়েও নাৎসী ও ফ্যাসিদের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক শক্তির জয় সুনিশ্চিত করা অনেক জরুরি মনে হয়েছিল। ব্রিটেনকে তিনি গণতান্ত্রিক শক্তি এবং শাসনের প্রতীক মনে করতেন। স্বাধীন ভারতবর্ষের স্বপ্ন ও তার জন্যে সংগ্রাম তাঁর জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিল। কিন্তু আন্তজাতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে আপসমূলক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের পথে অগ্রসর হওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত তাঁর সুভাষ-বিরোধিতা, সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজের ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের কঠোর সমালোচনার মূলে ছিল ওই একদেশদর্শী মনোভাব। এর ফলে তিনি সুভাষচন্দ্রের গভীর উৎসমূলে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
সুভাষচন্দ্রের জীবন ও কর্ম সম্বন্ধে জওহরলাল পুনর্মূল্যায়ন শুরু করেন এবং প্রকাশ্যে তাঁর নতুন উপলব্ধি ব্যক্ত করেন আজাদ হিন্দ ফৌজের অতুলনীয় সংগ্রামের প্রকৃত ইতিহাস জানার পর। নেতাজি সুভাষচন্দ্রকে তিনি নতুন আলোকে দেখেন। কিছুটা কৈফিয়ৎ দেবার সুরে তিনি দিল্লিতে অনুষ্ঠিত সুভাষচন্দ্রের জন্মোৎসবে বলেছিলেন (২৩ জানুয়ারি, ১৯৪৬), কেউ কেউ তাঁকে প্রশ্ন করেন, সুভাষচন্দ্র যখন দেশে ছিলেন তখন তিনি তাঁর বিরোধিতা করেছিলেন, এখন তাঁর প্রশংসা করছেন কেন? নেহরু বলেন তাঁদের মধ্যে মাঝে মাঝে রাজনৈতিক বিরোধ হলেও তাঁর কখনও সন্দেহ হয়নি যে, সুভাষচন্দ্র স্বাধীনতা সংগ্রামের এক বীর সৈনিক। এক সুস্থ জাতির মধ্যে মতপার্থক্য থাকবেই এবং সেটাই কাম্য। “যে জাতি মেষের মতো আচরণ করে তারা কোনও উন্নতি করতে পারে না (A people who behave like sheep cannot make any progress.)।” তিনি বলেন যে বর্তমানে I.N.A.র সমর্থনে যে জন-আবেগ দেখা দিয়েছে তার দ্বারা তিনি তাড়িত নন। ‘আজাদ হিন্দ ফৌজের’ সংগ্রামের পূর্ণ ইতিহাস জানার পর তিনি তাঁর অভিমত স্থির করেছেন। আজও তিনি বলতে পারেন না ওই পরিস্থিতিতে তিনি নিজে কী করতেন। তবে এটা নিশ্চিত, যেভাবে নেতাজি ওই সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছিলেন তা অনুপ্রেরণার সৃষ্টি করে। নেতাজির অবস্থায় পড়লে তিনিও (জওহরলাল) হয়তো একই অবস্থান নিতেন। তবে তিনি পূর্বেও বিশ্বাস করতেন এবং এখনও করেন যে, অন্য দেশের সাহায্য নিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের প্রচেষ্টা বিপজ্জনক। কিন্তু তারই সঙ্গে জওহরলাল স্বীকার করেন যে, I.N.A-র কাহিনী যা I.N.A.-র তিন অফিসারের বিচারের সময় উদ্ঘাটিত হয়েছে, প্রমাণ করেছে যে, সুভাষচন্দ্র দৃঢ়তার সঙ্গে জাপানীদের কর্তৃত্ব স্থাপনের সব চেষ্টার বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজের স্বাধীন সত্তা রক্ষা করেছিলেন। জাপানীরা কখনও তাঁকে দিয়ে তাদের ইচ্ছামত কাজ করাতে পারেনি। তাঁর আর এক বড় কৃতিত্ব ছিল যে, পূর্ণ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ঐক্য তাঁর বাহিনীতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
রামগড় অধিবেশনে কংগ্রেস পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি করলেও ইউরোপের বিভিন্ন রণক্ষেত্রে জার্মান বাহিনীর চমকপ্রদ সাফল্য ও মিত্রবাহিনীর বিপর্যয় যুদ্ধ সম্বন্ধে গান্ধীজি ও নেহরুর দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটায়। কংগ্রেস ঘোষণা করে যে ভারতবাসী নাৎসি বাহিনীর বিজয় কামনা করে না। গান্ধীজি বলেন, “ব্রিটেনের ধ্বংসস্তূপ থেকে আমরা স্বাধীনতা চাই না (We do not seek independence out of Britain’s ruin.)।” জওহরলাল ঘোষণা করেন যে, “ভারতবর্ষ নাৎসীবাদের জয়ের চিন্তার সম্পূর্ণ বিরোধী (India is completely opposed to the idea of the triuinph of Nazism.)।” কংগ্রেস পূর্ব-ঘোষিত পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি সংশোধন করে প্রস্তাব করে যে, যদি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ভারতে একটি অস্থায়ী জাতীয় সরকার (Provisional National Government) গঠন করতে সম্মত হয় তাহলে কংগ্রেস ব্রিটেনের সঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। কিন্তু ভাইসরয় লর্ড লিনলিথগো একটি বিবৃতিতে (৮ আগস্ট, ১৯৪০) ওই প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি খোলাখুলি জানান যে, এখন ভারতবর্ষে ক্ষমতা হস্তান্তর সম্ভব নয়। তিনি এইটুকু শুধু আশ্বাস দেন যে, যুদ্ধ শেষ হবার পর ভারতবর্ষের এক নতুন সংবিধান রচনার জন্যে প্রতিনিধিস্থানীয় ব্যক্তিদের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হবে। এই প্রস্তাব (August Offer রূপে পরিচিত) ছিল অন্তঃসারশূন্য ও অর্থহীন। গান্ধীজি ও জওহরলাল ভাইসরয়ের প্রস্তাবে হতাশ হন। নেহরু মন্তব্য করেন ওই প্রস্তাব সাম্রাজ্যবাদের পুরানো ভাষায় (Old language of imperialism) লেখা মাত্র। বক্তব্যও একই। তবুও কোনও সর্বভারতীয় সত্যাগ্রহ আন্দোলনের কথা গান্ধীজি চিন্তা করতে পারেননি। সাংগঠনিক ও মানসিক প্রস্তুতি জনগণের আছে বলে তিনি মনে করেননি। অনেক ভাবনা-চিন্তার পর অক্টোবর মাসে কংগ্রেস ‘ব্যক্তিগত আইন অমান্য আন্দোলন’ (Individual Civil Disobedience) শুরু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সত্যাগ্রহের জন্যে গান্ধীজি যাঁদের নির্বাচিত করেন তাঁদের অন্যতম ছিলেন জওহরলাল ও আচার্য বিনোবা ভাবে। আদর্শগতভাবে এই প্রকার ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহ প্রশংসনীয় হলেও এর কোনও রাজনৈতিক প্রভাব ছিল বা। তবুও ওই প্রতীকী সত্যাগ্রহ অন্তত আংশিকভাবে সুভাষচন্দ্রের নৈতিক জয় ছিল। কেননা, আন্দোলন করা ছাড়া ভারতবর্ষের মুক্তি লাভের অন্য কোনও পথ নেই তা স্বীকৃত হয়েছিল। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ যে কংগ্রেসের মতো এক জাতীয় প্রতিষ্ঠানকে তার প্রাপ্য গুরুত্ব ও মর্যাদাটুকু দিতেও আগ্রহী ছিল না তা পরিষ্কার বোঝা গিয়েছিল। পরবর্তী ঘটনা পরম্পরা ও ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার বিশিষ্ট সদস্য স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস-এর ভারত আগমন ও তাঁর প্রস্তাব ও প্রচেষ্টার ব্যার্থতার (মার্চ, ১৯৪২) ফলে এই উপলব্ধি হয়েছিল। রাজনৈতিক পরিস্থিতির চাপে শেষপর্যন্ত গান্ধীজিকে ১৯৪২-এর ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন শুরু করতে বাধ্য করেছিল।
রামগড়ে আপস-বিরোধী সম্মেলনের পর এপ্রিল মাসে (৬-১৩ এপ্রিল) সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে ফরওয়ার্ড ব্লক দেশব্যাপী আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করে। বহু রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী গ্রেপ্তার হন। জুন মাসে নাগপুরে সর্বভারতীয় ফরওয়ার্ড ব্লকের অধিবেশনে অবিলম্বে এক অস্থায়ী জাতীয় সরকার গঠনের দাবি করা হয়। জুলাই মাসের সূচনায় কলকাতায় অন্য একটি আন্দোলনের সিদ্ধান্ত সুভাষচন্দ্র নিয়েছিলেন। সেটি হল ডালহৌসি স্কোয়ারে (বর্তমানে বিনয়-বাদল-দিনেশ বাগ) তথাকথিত “অন্ধকূপ হত্যা”র হলওয়েল স্মৃতিস্তম্ভটির অপসারণ। এই আন্দোলনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি ও ঐক্য গড়ে তোলা। আন্দোলন শুরু করার নির্দিষ্ট দিনের পূর্বে সুভাষচন্দ্রকে ভারত রক্ষা আইনে গ্রেপ্তার করে (২ জুলাই, ১৯৪০) অনির্দিষ্ট কালের জন্যে বন্দী করা হয়।
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, বিশ্বযুদ্ধের সুযোগ গ্রহণ করে ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদের জন্যে, কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত হবার পরেও, সুভাষচন্দ্র ব্যক্তিগতভাবে দেখা ও আলাপ আলোচনা করে, চিঠিপত্র ও বার্তা পাঠিয়ে বারবার গান্ধীজিকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করেছিলেন, আবেদন জানিয়েছিলেন আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে। গান্ধীজি সম্মত হননি। তাঁর সম্মতি-অসম্মতির ওপর কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত ছিল পুরোপুরি নির্ভরশীল। ১৯৪০-এর শেষ দিকে গান্ধীজি ব্যক্তিগত আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করলে সুভাষচন্দ্র গান্ধীজিকে আবার অনুরোধ জানান কংগ্রেস ও ফরওয়ার্ড ব্লক একযোগে আইন অমান্য আন্দোলন করুক। উত্তরে গান্ধীজি লেখেন (২৯ ডিসেম্বর, ১৯৪০), “অসুস্থই থাকো আর সুস্থই থাকো তুমি অপ্রতিরোধ্য। তীব্র সংগ্রাম আরম্ভ করবার পূর্বে সুস্থ হয়ে ওঠো।” আইন অমান্য আন্দোলনে কংগ্রেস ও ফরওয়ার্ড ব্লকের সহযোগিতার প্রস্তাব সম্পর্কে তিনি বলেন, “তোমার ব্লকের আইন অমান্যে যোগদান প্রসঙ্গে আমার মনে হয় যে তোমার আমার মধ্যে মৌলিক মতভেদ থাকায় তা সম্ভব নয়। আমাদের মধ্যে একজন অন্যজনের মত গ্রহণ না করা পর্যন্ত আমাদের ভিন্ন ভিন্ন নৌকাতেই চলতে হবে। যদিও নৌকা দু’টির লক্ষ্য এক বলে মনে হয়, কিন্তু শুধু মনেই হয়। ইত্যবসরে এসো আমরা একই পরিবারের সদস্যরূপে পরস্পরের সঙ্গে প্রীতির সম্পর্কে আবদ্ধ থাকি।” গান্ধীজির চিঠির আন্তরিকতার সুরে সুভাষচন্দ্র আনন্দিত হয়েছিলেন। এ চিঠি পরিবারের ‘আদুরে ছেলে’কে গৃহকর্তার চিঠি ছিল না। অবাধ্য পুত্রকে শাস্তি দিয়ে সুশৃঙ্খল করার মনোভাবও ছিল না। সুভাষচন্দ্র সম্বন্ধে গান্ধীজির মনে যে নতুন ভাবনা-চিন্তার সূচনা হচ্ছিল এই চিঠিতে তারই ইঙ্গিত ছিল। কিন্তু নিজের মত ও বিশ্বাসে গান্ধীজি অনড় ছিলেন। সুভাষচন্দ্র প্রত্যুত্তরে (১০ জানুয়ারি, ১৯৪১) গান্ধীজিকে তাঁর সিদ্ধান্ত পুনর্বিচার করার জন্যে অনুরোধ জানান। তিনি গান্ধীজিকে বলেন যে দু’জনের লক্ষ্য ভিন্ন, এই কথাটির বক্তব্য তাঁর বোধগম্য হয়নি। তা কী করে হয়? সুভাষচন্দ্রের প্রশ্ন ছিল, দু’টি নৌকা ভিন্ন হতে পারে (অর্থাৎ মত ও পথ) কিন্তু গন্তব্য স্থল তো অভিন্ন— ব্রিটিশ শাসনের অবলুপ্তি ও ভারতবর্ষের স্বাধীনতা। এই চিঠির উত্তর আর আসেনি। ছ’ দিন পরেই (১৬ জানুয়ারি) সুভাষচন্দ্রের মহানিষ্ক্রমণ ঘটে।
একটি প্রশ্ন মনে জাগে যার উত্তর নিশ্চিতভাবে দেওয়া অসম্ভব। ১৯৪০ সালেও যদি গান্ধীজি সুভাষচন্দ্রের প্রস্তাবে সম্মত হয়ে দেশব্যাপী সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করতেন এবং নেতৃত্ব গ্রহণ করতেন, তাহলে কি সুভাষচন্দ্র তাঁর দেশত্যাগের পরিকল্পনা পুনর্বিচার করে ওই আন্দোলনে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তেন? যে ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন ১৯৪২-এ শুরু হয়েছিল তা যদি দু’ বছর পূর্বে শুরু হত তাহলে কি সুভাষচন্দ্রের জীবন ও সংগ্রাম অন্য রূপ নিত? গান্ধীজি ওই আন্দোলন শুরু করলে তার পূর্বে বা পরে, সুভাষচন্দ্র কারারুদ্ধ হতেনই। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রধান ও বিপজ্জনক শত্রুকে কোনওমতেই কারাগারের বাইরে রাখতে সাহস করতো না। কারাগারের অন্তরাল থেকে সুভাষচন্দ্র কি স্বাধীনতা লাভের সুবর্ণ সুযোগ বৃথা যাওয়া লক্ষ্য করা মেনে নিতেন? তিনি নিজেই লিখেছেন যে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, “যখন অন্যত্র ইতিহাস সৃষ্টি হচ্ছে তখন জেলে নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকা একটি মারাত্মক রাজনৈতিক ভুল হবে।”
অনির্দিষ্টকালের জন্যে সুভাষচন্দ্রকে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে রাখা হয়। বন্দী হওয়ার পূর্ব থেকেই তিনি জার্মানী, জাপান ও সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু এখন সে পথ রুদ্ধ হল। বহু চিন্তা-ভাবনার পর তাঁর দৃঢ় প্রত্যয় জন্মাল: যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে যাবে; বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েও ব্রিটেন ভারতবাসীদের ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না এবং স্বাধীনতা অর্জনের জন্যে ভারতকে সংগ্রাম করতে হবে; ভারত যদি যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ-বিরোধী ভূমিকা নেয় এবং ব্রিটেনের শত্রুপক্ষের (Axis Powers) সঙ্গে সহযোগিতা করে তাহলে ভারত স্বাধীন হবে। সুভাষচন্দ্রের এই সিদ্ধান্তের পিছনে ছিল বহুল প্রচলিত একটি রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিশ্বাস। প্রত্যেক দেশের বৈদেশিক নীতি জাতীয় স্বার্থের (national self-interest) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ও বিরোধের ক্ষেত্রে নীতি নির্ধারণের মূল সূত্র হল ‘শত্রুর শত্রু আমার মিত্র’ (Enemy’s enemy is my friend) এবং ‘রাজনীতিতে স্থায়ী শত্রু বা স্থায়ী মিত্র বলে কেউ নেই’ (In politics there is no permanent friend or permanent enemy.)। সুভাষচন্দ্রের কাছে ভারতবর্ষের স্বার্থসিদ্ধিই ছিল একমাত্র বিবেচ্য। অন্য কোনও ফেনময়, শূন্যগর্ভ, দার্শনিকসুলভ মনোভাব ও বাগাড়ম্বর ভারতবর্ষের মতো পরাধীন দেশের পক্ষে অর্থহীন। জওহরলালের আন্তর্জাতিক সমস্যা ও সম্পর্ক সম্বন্ধে মনোভাবের এটিই ছিল সুভাষচন্দ্রের প্রধান সমালোচনা।
জেল থেকে মুক্ত হতে বদ্ধপরিকর সুভাষচন্দ্র তাঁকে বিনাবিচারে অন্যায়ভাবে জেলে রাখার প্রতিবাদে আমরণ অনশনের সিদ্ধান্ত নেন। প্রেসিডেন্সি জেলের সুপারকে তিনি লেখেন (৩০ অক্টোবর, ১৯৪০) যে, দীর্ঘ চিন্তার পর তাঁর প্রত্যয় হয়েছে “…বর্তমান অবস্থায় (তাঁর) বেঁচে থাকা অর্থহীন। এই মরজগতে নীতি ছাড়া আর সবকিছুই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এই নীতিগুলি একমাত্র তখনি বাঁচতে পারে যখন ব্যক্তিমানুষ সেগুলির জন্য প্রাণ দিতে কুণ্ঠিত হয় না।” নভেম্বর মাসে কালী পুজোর দিন তিনি আমৃত্যু অনশন শুরু করেন। সরকারকে সতর্ক করে দেন তাঁকে যেন বলপ্রয়োগ করে খাওয়াবার চেষ্টা না করা হয়। যদি তা করা হয় তাহলে তিনি জীবন বর্জন করতে পারেন। তার পরিণাম হবে ভয়াবহ। সুভাষচন্দ্রের চিঠিতে বাংলার সরকার ভীত হয়ে পড়ে এবং স্থির করে যে এখন তাঁকে মুক্তি দেওয়াই সমীচীন হবে। তাঁর স্বাস্থ্যের উন্নতি হলে কিছুদিন পরে তাঁকে আবার গ্রেপ্তার করা হবে। ৫ ডিসেম্বর সুভাষচন্দ্র মুক্ত হন। ভারত সরকার বাংলা সরকারের এই সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট হয়েছিল।
মুক্তির পর প্রায় চল্লিশ দিন বাড়িতে নিজের ঘরেই সুভাষচন্দ্র নিজেকে আবদ্ধ রেখেছিলেন। গভীর ভাবে গোপনে দেশের বাইরে থাকার সব রকম সম্ভাব্য উপায় তিনি বিচার-বিবেচনা করতে থাকেন। শেষপর্যন্ত মনস্থির করেন যে নিঃসঙ্গভাবে বিদেশের পথে পাড়ি দেওয়াই সবচেয়ে ভাল হবে। ১৯৪১ সালের ১৬ জানুয়ারি রাত দেড়টায় সুভাষচন্দ্র এলগিন রোডের বাড়ি ছেড়ে তাঁর যাত্রা শুরু করেন। তাঁকে গাড়ি করে, সদাসতর্ক পুলিশ বাহিনী ও গুপ্তচরদের দৃষ্টি এড়িয়ে প্রথমে শরৎচন্দ্র বসুর জ্যেষ্ঠপুত্র অশোকের আসানসোলের কাছে বারারির বাংলোতে ও কিছু পরে সস্ত্রীক অশোককে গাড়িতে তুলে নিয়ে গোমো রেল স্টেশনে পৌঁছে দিয়েছিলেন শরৎচন্দ্রের আর এক পুত্র শিশিরকুমার বসু। গোমমা থেকে তিনি পেশোয়ারের পথে যাত্রা করেন। ভ্রাতুষ্পুত্র শিশিরকুমার ও পেশোয়ারের ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা ও তাঁর বিশ্বস্ত সহযোগী মিঞা আকবর শাহ সুভাষচন্দ্রের নিষ্ক্রমণের পরিকল্পনা কার্যকর করার ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা নিয়েছিলেন। তাঁর দেশত্যাগের সিদ্ধান্তের কথা অন্য যে দু’জন জানতেন তাঁরা হলেন শরৎচন্দ্র বসু ও সত্যরঞ্জন বক্সী।
সুভাষচন্দ্রের মহানিষ্ক্রমণ ও তার রোমাঞ্চকর ইতিহাস সুপরিচিত। শিশিরকুমার বসু, অনেক সহযোগী, সহকর্মী ও আংশিক প্রত্যক্ষদর্শী এই কাহিনী লিখেছেন। কী রকম বাধা-বিপত্তি ও বিপজ্জনক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সুভাষচন্দ্র পেশোয়ার, কাবুল হয়ে মস্কোতে পৌঁছন এবং তারপর বিমানে করে ৩ এপ্রিল বার্লিনে পৌঁছন তার কাহিনী অবিশ্বাস্য মনে হবে। পরে জার্মানী থেকে যেভাবে তিনি সাবমেরিনে করে দীর্ঘ বিপদসঙ্কুল সমুদ্রপথ পেরিয়ে জাপানে পৌঁছেছিলেন তা রূপকথার কাহিনীকেও হার মানায়। যাত্রাপথে সুভাষচন্দ্র প্রথমে ‘মহম্মদ জিয়াউদ্দীন’ ছদ্মনাম নেন। পেশোয়ার পৌঁছে এক “বোবা ও কালা পাঠান’ সাজেন। কাবুলে ইতালীয় দূতাবাসের মন্ত্রী আলবের্তো কোয়ারোনির (Alberto Quaroni) সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁর সহায়তায় ইতালীয় দূতাবাসের এক কর্মচারীর বে-নামে ওরল্যান্ডো মাৎসোটা (Orlando Mazzotta) নামে ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্ট পান। এই পাসপোর্ট নিয়েই তিনি ২৮ মার্চ মস্কো থেকে রওনা হয়ে বার্লিন পৌঁছন। সোভিয়েত কর্তৃপক্ষের অনুমতি পেতে তাঁকে একমাস অপেক্ষা কতে হয়েছিল। শেষপর্যন্ত রুশ, ইতালীয় ও জার্মান— তিন সরকারই তাঁকে বার্লিনে পৌঁছতে সহায়তা করেছিল। এই সহায়তা পাওয়া খুব সহজ হয়নি।
জার্মানীতে পৌঁছবার কয়েকদিনের মধ্যে সুভাষচন্দ্র ভারতবর্ষ, ভারতের মুক্তি সংগ্রাম ও যুদ্ধের সময় ভারত-জার্মানীর মধ্যে সহযোগিতার এক পরিকল্পনা সম্পর্কে একটি স্মারকলিপি জার্মান সরকারকে দেন। তাঁর প্রস্তাব ছিল: ইউরোপে এক স্বাধীন ভারত সরকার গঠন; যুদ্ধে জয়লাভের পর ভারতকে স্বাধীনতা দানের প্রতিশ্রুতি সহ জার্মানী, ইতালী ও স্বাধীন ভারত সরকারের মধ্যে একটি চুক্তি; বিদেশী রাষ্ট্রগুলি থেকে প্রয়োজনীয় ঋণ নিয়ে ভারত যুদ্ধের পর তা শোধ করবে এই মর্মে বোঝাপড়া। সুভাষচন্দ্র একটি সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলার প্রস্তাবও দেন। এই বাহিনী ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির মধ্যে বিদ্রোহ ও দেশের মধ্যে গণ-অভ্যুত্থানে সাহায্য করবে। দেশের মধ্যে বেতার-প্রচারের সুযোগ-সুবিধাও তিনি চেয়েছিলেন। কিছু দিন পরে তিনি ভারতবর্ষের স্বাধীনতার প্রশ্নে জার্মান সরকারের সুস্পষ্ট নীতি জানাবার জন্যে পুনরায় অনুরোধ করেন। কিন্তু তিনি জার্মান বিদেশ দপ্তরের কাছে কোনও সাড়া পাননি। সুভাষচন্দ্র জার্মানীতে ও ইউরোপের অন্যান্য দেশে বসবাসকারী নিবাসিত ভারতীয়দের এবং ভারতীয় ছাত্রদের নিয়ে একটি গোষ্ঠী গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। এই উদ্দেশ্যে তিনি ফ্রান্স, ইতালী ও অষ্ট্রিয়া সফর করেন।
সুভাষচন্দ্রের প্রচেষ্টার ফলে ১৯৪১ সালের শেষ দিকে (২ নভেম্বর) Free India Centre স্থাপিত হয়। এই উদ্যোগে তিনি সহযোগী রূপে যাঁদের পান তাঁদের মধ্যে ছিলেন এ. সি. এন নাম্বিয়ার, আবিদ হাসান, এন. জি. স্বামী, এম. আর. ব্যাস, গিরিজা মুখার্জী, এন, জি. গণপুলে প্রমুখ। গণপুলের Netaji in Germany (A Little-known Chapter) বইটি একটি তথ্যপূর্ণ মূল্যবান গ্রন্থ।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন