দেশনায়ক – ৪৯

অস্থায়ী আজাদ হিন্দ সরকারের সার্বভৌম ক্ষমতা ভারতীয় ভূখণ্ডের কোনও একটি অংশে প্রতিষ্ঠিত হোক এটি নেতাজির ঐকান্তিক ইচ্ছা ছিল। প্রথমে অনিচ্ছুক হলেও শেষপর্যন্ত জাপান সরকার আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জকে অস্থায়ী আজাদ হিন্দ সরকারের শাসনাধীন করতে সম্মত হয়। নেতাজি সুভাষ এই দ্বীপ দু’টির শাসনভার গ্রহণের জন্যে পোর্ট ব্লেয়ারে যান (২৯ ডিসেম্বর, ১৯৪৩) ও এক বিরাট জনসমাবেশে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। ওই দ্বীপ দু’টির প্রশাসনের জন্যে তিনি একজন চীফ কমিশনার নিযুক্ত করেন। আন্দামান-নিকোবরের মুক্তিকে তিনি ফরাসী বিপ্লবের সূচনায় ব্যাস্টিল দুর্গের পতনের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। তিনি বলেন যে, আন্দামানের মুক্তির এক “প্রতীকী তাৎপর্য আছে, কারণ ব্রিটিশরা আন্দামানকে সর্বদা রাজনৈতিক বন্দীদের জন্যে কারাগার হিসেবে ব্যবহার করেছে…ধীরে ধীরে আরো ভারতীয় ভূখণ্ড মুক্ত করা হবে, কিন্তু সর্বদাই প্রথম মুক্ত ভূখণ্ডের তাৎপর্য হয় সর্বাধিক।” শহীদদের স্মরণে তিনি আন্দামানের নতুন নামকরণ করেন ‘শহীদ’। নিকোবরের নামকরণ হয় ‘স্বরাজ’।

আন্দামান সফরের পর নেতাজি বর্মায় পৌঁছন (৭ জানুয়ারি, ১৯৪৪)। কয়েকদিন পরে অস্থায়ী আজাদ হিন্দ সরকারের এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়কের দপ্তর বর্মায় স্থানান্তরিত করা হয় (২১ জানুয়ারি)। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় সীমান্তের দিকে আজাদ হিন্দ ফৌজের অভিযানের প্রস্তুতি এবং পদক্ষেপ। নেতাজির ‘চলো দিল্লী’ বাস্তবে রূপায়িত হওয়ার ঐতিহাসিক মুহূর্ত উপস্থিত হল। জাপানী সাদার্ন কম্যান্ডের ‘ফিফটিনথ্ আর্মি’র অভিযানের পরিকল্পনার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আজাদ হিন্দ বাহিনীর অভিযানের ছক প্রস্তুত করা হয়। ১৯৪৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি আজাদ হিন্দ ফৌজের মুক্তি অভিযান আরাকান ফ্রন্টে শুরু হল। আরাকান-ইম্ফল ফ্রন্টে INA-র তিনটি ডিভিশন অংশ নেয়। একটি ডিভিশন আরাকান ফ্রন্টে, একটি রেঙ্গুনে এবং আর একটি সিঙ্গাপুরে। আজাদ হিন্দ বাহিনী ভারত-বর্মা সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের মূল ভূখণ্ডে প্রবেশ করে (১৮ মার্চ)। নেহরু রেজিমেন্ট ভারতের মাটিতে ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকা উত্তোলন করে। চার দিন পরে ওই বাহিনী মণিপুর ঘিরে ফেলতে অগ্রসর হয়। ইম্ফল-কোহিমা রোড় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ৫ এপ্রিল কোহিমার পতন হয়ে ইম্ফলের চারিদিকে প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়। ইম্ফল অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। কিন্তু শেষপর্যন্ত প্রচণ্ড সংগ্রাম ও চার মাস দীর্ঘ অবরোধের পর আজাদ হিন্দ ফৌজ অবরোধ তুলে নিয়ে (৫ জুলাই) পিছু হটতে বাধ্য হয়। আরাকানে চট্টগ্রাম অভিযানের পথে নেতাজির বাহিনী অপূর্ব সাহস ও শৌর্য দেখিয়েছিল। ব্রিটিশ গোয়েন্দা বিভাগের গোপন রিপোর্টেও তা স্বীকৃত হয়েছিল। জাপানী সামরিক কর্তৃপক্ষের INA-র সৈন্যদের যোগ্যতা সম্পর্কে যে সন্দেহ ছিল তা দূর হয়েছিল। বহু জাপানী সামরিক অফিসার ও সৈন্যদের মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ। জাপানের শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে তারা এতই মোহান্ধ ছিল যে, INA-র সৈন্যদের সঙ্গে সমান মর্যাদার কথা তারা চিন্তাও করতে পারত না। কিন্তু নেতাজি সুভাষ ও তাঁর বাহিনীর বীরত্ব ওই সঙ্কীর্ণমনা জাপানীদের বিস্মিত করে তাদের আস্থা অর্জন করেছিল।

আজাদ হিন্দ বাহিনী যে শেষপর্যন্ত সফল হতে পারেনি তার মুখ্য কারণগুলি ছিল জাপানী সামরিক কর্তৃপক্ষের অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ করার ব্যর্থতা, যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া এবং বর্ষার প্রকোপ। জাপানী বিমান বাহিনী আজাদ হিন্দ-এর স্থল বাহিনী ও যোগাযোগ ব্যবস্থাকে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছিল। অন্যান্য রণক্ষেত্রেও জাপান এবং অক্ষশক্তির পশ্চাদপসরণ শুরু হয়েছিল। অন্য একটি কারণও ছিল। আজাদ হিন্দ বাহিনীর পক্ষে ভারতবর্ষের মূল ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে অভিযান করার মতো পরিস্থিতি আর ছিল না। নেতাজির প্রত্যাশা ছিল যে, একবার সশস্ত্রবাহিনী নিয়ে ভারতবর্ষের মাটিতে পৌঁছতে পারলে সারা দেশে এক গণ-অভ্যুত্থান ঘটবে। আজাদ হিন্দ বাহিনীর শক্তি এবং অভ্যন্তরীণ অভ্যুত্থানের দুর্জয়শক্তি এক হলে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদ সুনিশ্চিত হবে। আজাদ হিন্দ বাহিনী মায়ু নদী অতিক্রম করে ইম্ফলের বিষেণপুরে প্রবেশ করেছিল। নেতাজির আহ্বান ‘চলো দিল্লী’ তাঁর বাহিনীকে উদ্দীপ্ত করেছিল। কিন্তু তাঁর মূল প্রত্যাশা পূর্ণ হয়নি। ১৯৪২-এর ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন প্রকৃষ্ট সময়ের পূর্বেই শুরু হয়ে গিয়ে কার্যত ব্যর্থ হয়েছিল। আর একটি গণ-অভ্যুত্থান তখনি সম্ভব ছিল না। উত্তর-পূর্ব ভারতের দূর প্রত্যন্ত সীমান্তে আজাদ হিন্দ বাহিনীর প্রবেশের সংবাদ দেশের মানুষের কাছে পৌঁছয়নি।

ইম্ফল অভিযানের ব্যর্থতা আজাদ হিন্দ ফৌজের শক্তিকে দুর্বল ও চূড়ান্ত সাফল্যের সম্ভাবনাকে সুদূরপরাহত করেছিল। এই অভিযানের সামরিক যৌক্তিকতা ও পরিকল্পনা নিয়ে সমর-বিশারদরা অনেক প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু নেতাজি সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে তাঁর মুক্তি বাহিনী যে স্বদেশপ্রেম, মাতৃভূমির মুক্তির জন্যে সাহস ও আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন তা অতুলনীয়। প্রত্যক্ষ ফলাফলের বিচারে ওই ঐতিহাসিক অভিযান ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু নেতাজির অবিস্মরণীয় সংগ্রামের আদর্শ ও আবেদনের সুদূরপ্রসারী প্রভাব ছিল অপরিসীম। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা যে আসন্ন, কোনও শক্তিই যে, ভারতের মুক্তি সংগ্রামের দূর্বার গতি রোধ করতে পারবে না, তা প্রমাণিত হয়েছিল অনতিকাল পরেই। সুভাষচন্দ্র নিজে যে এতটুকু মনোবল হারাননি, ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তি যে সুনিশ্চিত, তাঁর এই বিশ্বাস যে অবিচল ছিল তা তাঁর প্রতিটি ভাষণে ব্যক্ত হয়েছিল। একটি স্বরাজ যুব শিক্ষা-শিবিরে তরুণ শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ করে তিনি বলেছিলেন (২৫ এপ্রিল, ১৯৪৪), “কীভাবে বিপ্লব জয়যুক্ত হয় এ কথা বুঝতে শিখলে পথের বাধা দেখে কোনোদিন হতাশ হয়ে পড়বে না। মানুষ তখনই হতাশ হয়ে পড়ে যখন সে এমন কিছুর সম্মুখীন হয় তা তার কাছে অপ্রত্যাশিত। যদি বিপ্লব এবং তার সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলি সম্পর্কে তোমাদের মনে একটা সুস্পষ্ট ছবি আঁকা থাকে তবে বিপ্লবের পথে চলতে গিয়ে কোনো দিনও হতোদ্যম হয়ে পড়বে না।”

একটি প্রচলিত বিশ্বাস হল যে, ইম্ফল রণাঙ্গণে বিপর্যয়ের পর বর্মায় নিযুক্ত একজন জাপানী নৌ-অফিসার নেতাজিকে জাপানীদের বর্জন করে মধ্য এশিয়ার সমরখন্দে সোভিয়েতের সহযোগে তাঁর মুক্তিযুদ্ধের পরিকল্পনা কার্যকর করার উদ্যোগ নিতে পরামর্শ দেন। কিন্তু টোকিওর সর্বোচ্চ সামরিক কর্তৃপক্ষ এই পরিকল্পনা নাকচ করে দেয়। জাপান যদি সম্মত হত তাহলেও ওই প্রস্তাব অবাস্তব ছিল। বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতি যা ছিল এবং রাশিয়ার সঙ্গে আমেরিকা ও ব্রিটেনের সম্পর্ক এবং বোঝাপড়া যে স্তরে পৌঁছেছিল সেই পটভূমিতে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্যে স্ট্যালিন ব্রিটেন ও আমেরিকার সঙ্গে সোভিয়েত রাশিয়ার সম্পর্কে সঙ্কটজনক করে তুলতেন এটা অচিন্তনীয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য হল যে, নেতাজি টোকিওস্থ সোভিয়েত দূতকে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। ওই চিঠিটি না-খোলা অবস্থায় ফেরত এসেছিল।

আর্থিক ব্যাপারেও সুভাষচন্দ্র জাপানীদের ওপর নির্ভরতা পছন্দ করতেন না। জাপান সরকারের আপত্তি সত্ত্বেও তিনি রেঙ্গুনে আজাদ হিন্দ ব্যাঙ্ক স্থাপন করেন (৫ এপ্রিল, ১৯৪৪)। জাপানের কাছ থেকে যে ঋণ তিনি নিয়েছিলেন তা পুরোপুরি শোধ দেওয়া হবে বলে স্থির হয়েছিল। আজাদ হিন্দ ফৌজ এবং তাঁর পরিকল্পনার রূপায়ণের জন্যে সুভাষচন্দ্র পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভারতীয়দের কাছে টাকাকড়ি, গহনা ইত্যাদি দান রূপে সংগ্রহ করেছিলেন। বার্লিনে ফ্রি ইন্ডিয়া সেন্টারের জন্যে যে ঋণ তিনি নিয়েছিলেন তা ওই সংগ্রহ থেকে নেতাজি জার্মান সরকারকে শোধ দিয়েছিলেন। বৈদেশিক ঋণ ও অর্থনৈতিক স্ব-নির্ভরতা সম্পর্কে তাঁর মনোভাব এর থেকে ফুটে উঠেছিল।

পরবর্তী কয়েক মাসের দুঃখ-বেদনাদায়ক বিপর্যয়ের মধ্যেও তাঁর অসীম সাহস, বীরত্ব, হিমালয়-সদৃশ দৃঢ়তা ও ব্রিটিশ-শাসনমুক্ত স্বাধীন ভারতবর্ষের জন্ম সম্বন্ধে সুনিশ্চিত বিশ্বাস নেতাজি সুভাষচন্দ্রকে ইতিহাসের এক মহানায়কের মর্যাদা দিয়েছে। ১৯৪৪ সালের অক্টোবর মাসে জাপানে সরকার পরিবর্তন হওয়ার পর পরামর্শের জন্যে নেতাজি টোকিওতে আমন্ত্রিত হন। কর্নেল এ. সি. চ্যাটার্জি, কর্নেল এম. কিয়ানী, লেঃ কর্নেল হবিবুর রহমান প্রমুখকে নিয়ে নেতাজি টোকিও যাত্রা করেন (১ নভেম্বর, ১৯৪৪)। বিদেশের এক অতি বিশিষ্ট সম্মানিত ব্যক্তি রূপে জাপান সরকার তাঁকে সর্বোচ্চ সম্মান প্রদানের প্রস্তাব করলে নেতাজি তা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন যে, ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ না করা পর্যন্ত কোনও সম্মান আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করা অনুচিত হবে। INA-র সঙ্গে মৈত্রী ও সহযোগিতা প্রসঙ্গে এক জাপানী রিপোর্টে মন্তব্য করা হয়েছিল যে, ইম্ফল অভিযানে বসুর পরিচালনায় যেভাবে ওই বাহিনী চরম বিপর্যয়ের মধ্যেও লড়াই করেছিল তারপরে তাঁকে ও তাঁর বাহিনীকে হৃদয় থেকে না ভালবেসে পারা যায় না। সুভাষচন্দ্র তখনও নতুন জাপান সরকারের কাছে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্যে অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য সাহায্য এবং সহযোগিতার অনুরোধ জানান। কিন্তু জাপানের পক্ষে তা আর সম্ভব ছিল না। জাপানের সামরিক ও মানসিক শক্তি উভয়েই তখন দূর্বল হয়ে পড়েছিল।

টোকিওতে সুভাষচন্দ্র গুরুতর অসুস্থ রাসবিহারী বসু, বরখাস্ত জাপ প্রধানমন্ত্রী তোজো এবং নতুন প্রধানমন্ত্রী জেনারেল কৈজোর (General Koiso) সঙ্গে দেখা করেন। ১৯৪৪ সালের শেষে তিনি রেঙ্গুনে প্রত্যাবর্তন করেন। এরপর তিনি উত্তর মালয় পরিদর্শন করেন। কুয়ালালামপুরে এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন (২২ ডিসেম্বর, ১৯৪৪)। ১৯৪৫ সালের ২১ জানুয়ারি রাসবিহারী বসুর মৃত্যু হয়। ২৩ জানুয়ারি নেতাজির জন্মদিনে রেঙ্গুনে বসবাসকারী ভারতীয়দের এক বিরাট সমাবেশ হয়। ওই সভায় আজাদ হিন্দ ফৌজের সংগ্রামের জন্যে প্রচুর পরিমাণে অর্থ, গয়না ও সোনাদানা সংগৃহীত হয়। তাঁর প্রতি উপস্থিত জনসাধারণের কত গভীর শ্রদ্ধা ও আস্থা ছিল তা আর একবার প্রমাণিত হয়। অল্প ক’দিন পরেই নেতাজি ইরাবতীর যুদ্ধক্ষেত্রে বিপন্ন আজাদ হিন্দ বাহিনীর সৈন্যদের পাশে গিয়ে উপস্থিত হন। সঙ্কটকালে কিছু কিছু INA অফিসার ও সৈন্য যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কাপুরুষের মতো পালিয়ে যেতে থাকলে তিনি আদেশ জারি করেন যে, ওই রকম বিশ্বাসঘাতকতা করলে চরম শাস্তি দেওয়া হবে।

জাপান ও অক্ষশক্তির পক্ষে যুদ্ধ পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটছিল। রেঙ্গুনের পতন আসন্ন হয়ে উঠলে জাপানী সামরিক কর্তৃপক্ষ সুভাষচন্দ্রকে শহর ছেড়ে চলে যাবার অনুরোধ করেন। কিন্তু তিনি স্থির করেন, যতক্ষণ না ঝান্সীর রানী বাহিনীর সমস্ত নারী সৈনিকদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্পূর্ণ হচ্ছে ততক্ষণ তিনি রেঙ্গুন ত্যাগ করবেন না। জাপানীরা তাঁর কথামত সব ব্যবস্থা করতে বাধ্য হয়। রেঙ্গুন থেকে ব্যাঙ্ককের দীর্ঘ বিপদসঙ্কুল পথ ঝড় জল, বন্যা ও অন্যান্য নানা বাধা-বিপত্তির মধ্য দিয়ে ঝান্সী বাহিনী অতিক্রম করে। দুর্গম পথে গাড়িগুলি প্রায়ই খারাপ হয়ে অচল হয়ে পড়ায় সকলকে মাইলের পর মাইল হাঁটতে হয়েছিল। নেতাজি তাঁর বাহিনীর বীরাঙ্গনা ও অন্য সহকর্মীদের সঙ্গে সব সময় পাশে থেকে, সাহস ও অনুপ্রেরণা যুগিয়ে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। রেঙ্গুন থেকে ব্যাঙ্ককে পৌঁছতে এক মাস লেগেছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান আসন্ন এবং মিত্রশক্তির জয় সুনিশ্চিত হওয়ার ফলে ব্রিটিশ সরকার ভারতের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানে পৌঁছনোর জন্যে উদ্যোগ নিতে তৎপর হয়। লর্ড লিনলিথগোর পর লর্ড ওয়াভেল ভাইসরয় নিযুক্ত হন। ১৯৪৫ সালে তিনি লন্ডনে ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার সঙ্গে পরামর্শ করে ভারতে প্রত্যাবর্তনের পর ঘোষণা করেন যে, ব্রিটিশ সরকার ভারতে অচলাবস্থার অবসান এবং স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের প্রস্তাবগুলি কার্যকর করতে উদ্গ্রীব। তিনি কেন্দ্রীয় নিবাহী পরিষদ (Central Executive Council) পুনর্গঠন করে বিভিন্ন ভারতীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি গ্রহণ এবং ভারতীয়দের হাতে অধিকতর ক্ষমতা ও দায়িত্ব অর্পণের প্রস্তাব করেন (১৪ জুন, ১৯৪৫)। ওয়াভেল প্রস্তাব আলোচনার জন্যে সিমলাতে ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিনিধিদের এক সম্মেলন আহূত হয় (২৫ জুন)। গান্ধীজি ওয়াভেল প্রস্তাবের বিরোধী হলেও কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি সিমলা বৈঠকে যোগ দিতে সম্মত হয়। কংগ্রেস প্রতিনিধি দলের মুখপাত্র হন মৌলানা আজাদ। বৈঠকে জিন্না দাবি করেন যে, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সকল মুসলমান সদস্যকে অবশ্যই মুসলিম লীগের সভ্য হতে হবে। এই দাবি কংগ্রেস অগ্রাহ্য করে। ফলে সিমলা আলোচনা ব্যর্থ হয়।

সুভাষচন্দ্র ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, ব্রিটিশ সরকারের উদ্দেশ্য এবং কংগ্রেস ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলির নীতি ও রাজনৈতিক ভূমিকার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রেখেছিলেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, ব্রিটিশ সরকার যুদ্ধে জার্মানীর পরাজয়, পূর্ব এশিয়ায় জাপানের বিপর্যয় ও আমেরিকার সঙ্গে মিত্রতার সুযোগ গ্রহণ করে যুদ্ধের অবসানের পরেও ভারতে ব্রিটিশ শাসন অব্যাহত রাখতে সচেষ্ট হবে। অধিকতর ক্ষমতা দানের নামে শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের মাধ্যমে ভারতবর্ষের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিকে অগ্রাহ্য করবে। এর ফলে দীর্ঘকাল ধরে দেশের ভিতরে ও দেশের বাইরে সংগ্রামের পর স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে এসে ভারতবর্ষ বঞ্চিত হবে। ভারতীয় জনগণের স্বাধীনতার আশা, আকাঙ্ক্ষা, এত ত্যাগ, সংগ্রাম ও আত্মোৎসর্গ বিফল হয়ে স্বাধীনতা সুদূরপরাহত হবে। সিঙ্গাপুর থেকে ভারত তথা বিশ্ব রাজনীতির পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে কংগ্রেস নেতাদের তথা তাঁর দেশবাসীর উদ্দেশে নেতাজি যে বেতার ভাষণগুলি দিতেন তার গুরুত্ব ছিল অসাধারণ।

সুভাষচন্দ্রের গভীর আশঙ্কা ছিল কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আপস করে পূর্ণ স্বাধীনতার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হতে পারে। ব্রিটিশ কূটনীতি ও ভেদনীতিই জয়ী হয়ে দেশের মানুষের স্বাধীনতার আশা-আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নকে ভঙ্গ করবে। এরই প্রতিবাদ ও বিরোধিতা করার ফলে তিনি প্রথমে কংগ্রেস ত্যাগ এবং শেষপর্যন্ত দেশত্যাগ করে বিদেশে সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করেছিলেন। মুসলিম লীগের পাকিস্তান দাবি ও সাম্প্রদায়িক মনোভাব তাঁকে আরও উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল। ১৯৪৪ সালে গান্ধী-জিন্না সাক্ষাৎকারের সংবাদে তাঁর আশঙ্কা হয়েছিল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে একটা বোঝাপড়া হয়ে উভয় দলই ব্রিটেনের সঙ্গে আপস করতে পারে। ভারত বিভাগের যে কোনও প্রচেষ্টাকে রোধ করার জন্যে বর্মার রণাঞ্চল থেকে তিনি বেতার ভাষণে ভারতীয়দের প্রতি আবেদন করেছিলেন (১২ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৪)। তিনি বলেন যে, পাকিস্তান প্রস্তাব মেনে নিলেও সমস্যার কোনও সমাধান হবে না। মুসলিম লীগ কখনও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবে না। লীগের একমাত্র কাজ হল ভারতকে হিন্দু ও মুসলমান রাষ্ট্রে ভাগ করা। আর, ব্রিটিশদের লক্ষ্য হল নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করা। প্রয়োজনে তারা কংগ্রেস-লীগ চুক্তিও অবজ্ঞা করবে।

ওয়াভেল প্রস্তাব সুভাষচন্দ্রকে খুবই উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল। তাঁর আশঙ্কা ছিল যে, কংগ্রেস ওই প্রস্তাব গ্রহণ করে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার প্রশ্নে আপস করতে পারে। ওয়াভেল প্রস্তাব সামান্য পরিবর্তিত আকারে ক্রিপস প্রস্তাব ছাড়া আর কিছুই নয়। ওয়াভেল প্রস্তাবে কংগ্রেসকে ভারতবর্ষের বহু দলের মধ্যে একটি দলের স্বীকৃতি মাত্র দিয়েছে। এই অসম্মান ও উপেক্ষা কোনও জাতীয়তাবাদী ভারতীয়দের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। গান্ধীজি যে ওয়াভেলের প্রস্তাবে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির উল্লেখ পর্যন্ত নেই তা লক্ষ্য কবেছেন। তার জন্যে তিনি গান্ধীজির প্রশংসা করেন। যে কংগ্রেস মাত্র তিন বছর পূর্বে ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনে ‘করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে’ শপথ নিয়েছিল এবং যে নীতি এখনও কংগ্রেস ত্যাগ করেনি, সেই কংগ্রেস কী করে স্বাধীনতার বিকল্প কিছু গ্রহণ করতে পারে? ওয়াভেল প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় সুভাষচন্দ্র ও তাঁর সহযোদ্ধারা খুবই আনন্দিত হয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে কোনও পরিস্থিতিতে ভারতীয় বিপ্লবীদের তাঁদের সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে। তিনি বলেন, “বড়লাটরা আসতে পারেন ও বড়লাটরা যেতেও পারেন, কিন্তু ভারত বেঁচে থাকবে এবং স্বাধীনতার জন্যে ভারতের সংগ্রাম শেষপর্যন্ত সফল হবে।” সুভাষচন্দ্রের প্রতি শ্রদ্ধা ও আনুগত্য জানাতে ৪ থেকে ১১ জুলাই ‘নেতাজি সপ্তাহ’ পালিত হয়েছিল।

ইউরোপে জার্মানীর পরাজয়ের পর পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জাপানের পরাজয় দ্রুত আসন্ন হয়ে পড়ছিল। কিন্তু তবুও হতোদ্যম না হয়ে নেতাজি সুভাষ সিঙ্গাপুরে এসে আজাদ হিন্দ ফৌজকে পুনর্বিন্যাস করার চেষ্টা করেন। ২৭ জুন এক বেতারভাষণে তিনি বলেন যে ‘বিপ্লবী’ হলেন এমন একজন ব্যক্তি যিনি নিজের দেশের পূর্ণ স্বাধীনতার জন্যে দাঁড়ান। যিনি স্বাধীনতার প্রশ্নে কোনও আপস মানেন না। “একজন বিপ্লবী বিশ্বাস করেন যে, তিনি যে আদর্শের জন্যে সংগ্রাম করছেন তা ন্যায়সঙ্গত এবং সেই জন্যে সে আদর্শ শেষপর্যন্ত জয়যুক্ত হতে বাধ্য। বিপ্লবী কখনও কোনও ব্যর্থতা বা বিপর্যয়ে হতাশ বা বিষণ্ণ হতে পারেন না, কারণ তাঁর মন্ত্র হল ‘সবোত্তমের জন্যে আশা করা কিন্তু সর্বনাশের জন্যে প্রস্তুত থাকা’।” নেতাজি যে আদর্শ বিপ্লবীর কথা বলেছিলেন সেই বিপ্লবীর শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি স্বয়ং।

নেতাজির অক্লান্ত প্রচেষ্টা ও প্রচার সত্ত্বেও আজাদ হিন্দ ফৌজকে পুনর্গঠিত ও সুসংহত করে তুলে সামরিক অভিযান পুনরায় শুরু করা আর সম্ভব ছিল না। ৬ আগস্ট হিরোসিমা ও ৯ আগস্ট নাগাসাকিতে প্রমাণবিক বোমা বর্ষণের পর জাপান আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেয়। একমাত্র শর্ত ছিল জাপানের সম্রাটের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে। ১০ আগস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন মিত্রশক্তির পক্ষে প্রশান্ত মহাসাগরীয় যুদ্ধে যোগ দিয়ে জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। মাঞ্চুরিয়া ও উত্তর জাপানের দ্বীপগুলি রাশিয়া আক্রমণ করে। এরপর আর কোনও পথ খোলা ছিল না। ১৪ আগস্ট জাপান মিত্রপক্ষের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে।

জাপান আত্মসমর্পণ করলেও নেতাজি সুভাষ তখনও পরাজয় মেনে না নিয়ে অন্য পথের কথা চিন্তা করছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল তিনি এক স্বাধীন স্বতন্ত্র সরকারের প্রধান। জাপানের আত্মসমর্পণ তাঁর সরকারের আত্মসমর্পণের সমার্থ নয়। ১৬ আগস্ট তিনি জাপান সরকারকে একটি বার্তায় জানান যে, তিনি ও তাঁর মন্ত্রিসভার কয়েকজন বিশ্বস্ত সদস্য সোভিয়েত রাশিয়ায় যেতে ইচ্ছুক। প্রয়োজনে তিনি একাই রাশিয়ায় প্রবেশ করবেন। সে ক্ষেত্রে তাঁর অনুরোধ তাঁর মন্ত্রিসভার অন্য কোনও সদস্য যেন অস্থায়ী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। জাপান সরকার সুভাষচন্দ্রের এই প্রস্তাবে খুশি হয়নি কেননা সোভিয়েত রাশিয়া ইতিমধ্যেই জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছিল। তবুও জাপানীরা সুভাষচন্দ্রকে মাঞ্চুরিয়াতে যাওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করতে সম্মত হয়। সেখান থেকে তিনি ইচ্ছামত সোভিয়েত অগ্রগামী বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করতে পারেন। ওই যাত্রা শুরুর পূর্বে তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করেন যাতে ঝান্সির রানী বাহিনীর প্রত্যেকে নিজ নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন করে। প্রায় এক মাস পূর্বে (৮ জুলাই) সিঙ্গাপুরে মুক্তিযুদ্ধে আজাদ হিন্দ বাহিনীর শহীদদের স্মৃতিফলক স্থাপন করে নেতাজি পূর্ব এশিয়ার রণাঙ্গনে এক মহান জাতীয় কর্তব্য পালন করেছিলেন। স্মৃতিফলকে উৎকীর্ণ ছিল যে, ভবিষ্যতের স্বাধীন ভারতের নতুন প্রজন্ম গর্বের সঙ্গে স্মরণ করবে যে বর্মা আসাম ও মণিপুরের রণাঙ্গনে এই শহীদরা বীরের মতো যুদ্ধ করে সাময়িকভাবে ব্যর্থ হলেও, চূড়ান্ত সাফল্য ও গৌরব সুনিশ্চিত করে গেছেন।

১৬ আগস্ট নেতাজি বিমানে ব্যাঙ্কক যাত্রা করেন ও পরের দিন সাইগন পৌঁছন। এখানে হবিবুর রহমান, প্রীতম সিং, গুলজারা সিং, আবিদ হাসান, দেবনাথ দাস, এস. এ. আয়ার প্রমুখ তাঁর কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা সহকর্মীর সঙ্গে তাঁর কথাবার্তা হয়। নেতাজির দীর্ঘ সময়ের জাপানী অনুবাদক নেগিশি-ও (Negishi) উপস্থিত ছিলেন। মেজর জেনারেল এ. সি. চ্যাটার্জি ও অন্য কয়েকজনেরও আসার কথা ছিল। কিন্তু সায়গনে পৌঁছবার পর পূর্ব-নিধারিত পরিকল্পনার পরিবর্তন করতে হয়। সুভাষচন্দ্র জানতে পারেন যে, তাঁর ও তাঁর সহযাত্রীদের জন্যে আলাদা বিশেষ বিমানের ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে না। রুশ বিশেষজ্ঞ লেঃ জেনারেল সিদেই (Shidei) মাঞ্চুরিয়ার দাইরেন-এ একটি বিমানে করে যাচ্ছেন। বিমানটি ওই দিনই (১৭ আগস্ট) তাইপে (Taipei) হয়ে দাইরেন যাবে। বিমানটিতে শেষপর্যন্ত নেতাজি ও তাঁর একজন সঙ্গীর আসনের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়। অগত্যা নেতাজি স্থির করেন যে সঙ্গী হিসেবে তিনি কর্নেল হবিবুর রহমানকে নেবেন। অন্যরা যত শীঘ্র সম্ভব পরে যাবেন। নেতাজি নেগিশিকে নাকি বলেছিলেন যে, তিনি রুশদের হাতে বন্দী হতে চান, কেননা রুশরাই একমাত্র ব্রিটিশদের বাধা দেবে। নেতাজির সহকর্মীরা সবাই এই ব্যবস্থায় অসন্তুষ্ট হলেও তা মেনে না নিয়ে উপায় ছিল না।

১৭ আগস্ট ভোরবেলা বিমানটি যাত্রা করে উত্তর ভিয়েতনামের টুরেন-এ অবতরণ করে। টুরেন-এ রাত কাটিয়ে ভোরবেলা বিমানটি আবার যাত্রা শুরু করে। এর পরের ঘটনা রহস্যাবৃত। ১৯৪৫ সালের ২৩ আগস্ট টোকিও রেডিওতে ঘোষণা করা হয় যে, তাইহোকু বিমান বন্দর থেকে ওঠবার সময় ওই বিমানটি ভেঙ্গে পড়েছিল। বিমান দুর্ঘটনায় জেনারেল সিদেই, বিমানের পাইলট ও আরও কয়েকজন যাত্রী নিহত হয়েছেন। নেতাজির সঙ্গী হবিবুর রহমান সামান্য আঘাত পেয়েছিলেন। ভীষণভাবে অগ্নিদগ্ধ নেতাজিকে তাইহোকুর একটি সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার অল্প সময়ের মধ্যে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃতদেহ নাকি টোকিও বা সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। শেষপর্যন্ত তাঁর নশ্বর দেহ তাইহোকুতেই দাহ করা হয়। পরে সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি তাঁর ভস্মাবশেষ টোকিওর শহরতলির রেণকোজি মন্দিরে রাখা হয়।

বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির এই মৃত্যুর কাহিনী বহু মানুষ বিশ্বাস করেননি। প্রচারিত কাহিনীর মধ্যে প্রচুর অসঙ্গতি, স্ব-বিরোধ ও নির্ভরযোগ্য তথ্যের অভাব নেতাজির অন্তর্ধান রহস্যকে ঘনীভূত করে। দু’টি তদন্ত কমিশন ভারত সরকার পরবর্তীকালে গঠন করলেও উভয় কমিশনের রিপোর্টই মানুষকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। বহু লেখক ও গবেষক নেতাজির অন্তর্ধান সম্বন্ধে লিখেছেন, নানান প্রশ্ন তুলেছেন ও অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তদন্ত কমিশনের সিদ্ধান্ত বিচার-বিশ্লেষণ করে কেন নেতাজির বিমানদুর্ঘটনায় মৃত্যুর কাহিনী গ্রহণযোগ্য নয় তা দেখাবার চেষ্টা করেছেন। বিতর্ক ও সন্দেহের আজও অবসান হয়নি।

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর দেহ অবিনশ্বর নয়, প্রাণী জগতে মৃত্যু অনিবার্য। কিন্তু মানুষের কীর্তি তাকে অমর করে রাখে ইতিহাসের পাতায়, মানুষের মনে। প্রকৃত অর্থে সুভাষচন্দ্র বসু অমর ও মৃত্যুঞ্জয়ী। তাঁর ক্ষেত্রে এটি এক বহুল ব্যবহৃত বিশেষণ মাত্র নয়, আক্ষরিক অর্থে সত্য।

১৭ আগস্ট নেতাজি আজাদ হিন্দ ফৌজের অফিসার ও সেনাবাহিনীর উদ্দেশে এবং পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বসবাসকারী ভারতীয়দের উদ্দেশে দু’টি পৃথক বার্তা প্রচার করেন। সৈন্যবাহিনীর প্রতি তাঁর আবেদন ছিল, ‘ভারতের প্রতি বিশ্বস্ত থাকুন’। তিনি বলেন যে, বর্তমান অভাবনীয় সঙ্কট সাময়িক। পরাজয়ের মুখে “অপরাজেয় আশাবাদ ও অনড় সঙ্কল্পের পরিচয় ও প্রয়োগ প্রয়োজন। আজাদ হিন্দের অমর গৌরবোজ্জ্বল আত্মত্যাগ কখনও বৃথা যেতে পারে না। দিল্লী যাওয়ার পথ অনেক এবং আমাদের গন্তব্য দিল্লীই রয়েছে…ভারত স্বাধীন হবেই এবং অনতিবিলম্বে।” পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বসবাসকারী ভারতীয়দের অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, “ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অকাতরে লোকবল, অর্থ, রসদ ঢেলে দিয়ে আপনারা দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, আমার ‘সর্বাত্মক সমাবেশ’-এর আহ্বানে যেভাবে আপনারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এবং সস্নেহে সাড়া দিয়েছেন তা আমি কখনও ভুলব না।” ভারতবর্ষের মুক্তি সুনিশ্চিত। সারা বিশ্বের ভারতীয়দের মনে এই সংগ্রাম মৃত্যুহীন উদ্দীপনা সৃষ্টি করবে। সাময়িক পরাজয়ের মধ্যে নৈরাশ্যের কারণ নেই। “চিত্ত প্রফুল্ল ও মন সজীব রাখবেন…বিশ্বে এমন কোনো শক্তি নেই যা ভারতকে দাসত্বশৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখতে পারে।”

চরম বিপর্যয় ও অন্তহীন শূন্য গহ্বরের সামনে দাঁড়িয়েও নেতাজির ওই মাভৈঃ বাণী এবং ভারতবর্ষের স্বাধীনতার সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা হয়নি। মাত্র দু’বছরের মধ্যে ব্রিটিশ শাসন-মুক্ত স্বাধীন ভারত রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল। তার পিছনে ছিল নেতাজি সুভাষচন্দ্র ও আজাদ হিন্দ বাহিনীর অনন্য অবদান।

সকল অধ্যায়

১. দেশনায়ক – ১
২. দেশনায়ক – ২
৩. দেশনায়ক – ৩
৪. দেশনায়ক – ৪
৫. দেশনায়ক – ৫
৬. দেশনায়ক – ৬
৭. দেশনায়ক – ৭
৮. দেশনায়ক – ৮
৯. দেশনায়ক – ৯
১০. দেশনায়ক – ১০
১১. দেশনায়ক – ১১
১২. দেশনায়ক – ১২
১৩. দেশনায়ক – ১৩
১৪. দেশনায়ক – ১৪
১৫. দেশনায়ক – ১৫
১৬. দেশনায়ক – ১৬
১৭. দেশনায়ক – ১৭
১৮. দেশনায়ক – ১৮
১৯. দেশনায়ক – ১৯
২০. দেশনায়ক – ২০
২১. দেশনায়ক – ২১
২২. দেশনায়ক – ২২
২৩. দেশনায়ক – ২৩
২৪. দেশনায়ক – ২৪
২৫. দেশনায়ক – ২৫
২৬. দেশনায়ক – ২৬
২৭. দেশনায়ক – ২৭
২৮. দেশনায়ক – ২৮
২৯. দেশনায়ক – ২৯
৩০. দেশনায়ক – ৩০
৩১. দেশনায়ক – ৩১
৩২. দেশনায়ক – ৩২
৩৩. দেশনায়ক – ৩৩
৩৪. দেশনায়ক – ৩৪
৩৫. দেশনায়ক – ৩৫
৩৬. দেশনায়ক – ৩৬
৩৭. দেশনায়ক – ৩৭
৩৮. দেশনায়ক – ৩৮
৩৯. দেশনায়ক – ৩৯
৪০. দেশনায়ক – ৪০
৪১. দেশনায়ক – ৪১
৪২. দেশনায়ক – ৪২
৪৩. দেশনায়ক – ৪৩
৪৪. দেশনায়ক – ৪৪
৪৫. দেশনায়ক – ৪৫
৪৬. দেশনায়ক – ৪৬
৪৭. দেশনায়ক – ৪৭
৪৮. দেশনায়ক – ৪৮
৪৯. দেশনায়ক – ৪৯
৫০. দেশনায়ক – ৫০

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন